Friday, July 3, 2009

উদ্ভাবনী সাহিত্য

লেখক-পাঠকের উন্নত মনোসংযোগের যে শিল্পিত প্রকাশ সেই সাহিত্যই উদ্ভাবনী সাহিত্য। যে কারণে উদ্ভাবনী সাহিত্যের প্রসংগ আসে। একঘেয়ে সাহিত্য বিমুখ করে দেয় রিডারশ্রেণিকে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় হচ্ছে উদ্ভাবনী সাহিত্যে মনোযোগী হওয়া লেখক-কবিদের। উদ্ভাবনী সাহিত্য আসলে কী? এটি সাহিত্যের একটি চলমান প্রক্রিয়া, একটা সময়ের ভাষা থেকে আরেকটা সময়ের ভাষার যোগাযোগ। লেখক-কবিদের রচনার প্রভাব থেকে যা পাঠকের অন্তরে উৎসারণের জন্ম দেয়। অর্থাত পাঠক রচনায় মনোযোগী হলে তার মধ্যেও যে চিন্তার ধারা প্রভাবিত হয় এবং পাঠকের চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতিতে যে চমক সাহিত্যের জন্ম হচ্ছে সেটাই মূলত উদ্ভাবনী সাহিত্যে রূপ নেয় লেখক-কবিদের হাতেই। এই উদ্ভাবনী একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে চলতেই রূপ নিচ্ছে অন্য আরেকটি উদ্ভাবনীতে, জীবনাচারে। সঞ্চারিত হবার পরই রূপারোপ বোঝা যায় রূপের রূপান্তর, কিন্তু রূপান্তরের এই উদ্ভাবনী সাহিত্য সজ্ঞান গতিময়তার সাথে পঠিত হয়? প্রশ্নের উদ্রেক করে। নিথর, নিস্তেজ সাহিত্য উদ্ভাবনের গতিময়তাকে শ্লথ করে দেয়। সময়ের উদ্ভাবনীতে যতো সাহিত্য আমাদের মননের মধ্যে এসেছে তার সমগ্র সাহিত্যই কিছু না কিছু পঠিত হয়েছে রাস্ট্রভেদে, ভাষার বৈচিত্রে; অজস্র পাঠকের মধ্যে। এই পঠনের মধ্যে, পাঠক ক্লান্ত হয়েই কেবল অনুভব করেন নতুন সাহিত্যিক প্রজ্ঞা ও তার প্রয়োজনীয়তা। ক্রমবৈচিত্রে উদ্ভাসিত করতে চান নিজের আলোকিত ভুবন।
জ্ঞানের অসীম সম্ভাবনা। পঠনপাঠন জরুরি। সাহিত্যের বিশুদ্ধ পাঠক আছে একথা হলপ করে বলা দুরূহ ব্যাপার, বিশুদ্ধ পাঠক হয়ও না সাধারণত। ভাসা ভাসা পাঠে মনযোগী থাকেন অধিকাংশ পাঠক। আর গল্প, উপন্যাস, নাটকমতো রচনার তরল পাঠক তো সাহিত্যের ধারে-কাছেই আসে না, আসতে পারে না দুর্বল সাহিত্য মানসিকতার কারণেই। হালকা রোমান্সের আবেগে মগ্ন থাকতে দেখি অধিকাংশ রিডারকে। পাঠেরও যে প্রতিবেশ রাস্ট্রায়তনিক জনঘনত্বের সাথে সাথে বহুকাল পূর্বেই তা বিলুপের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। লেখকের পাঠের পরিবেশ, যাপনপ্রণালী বিঘ্নিত হয়েছে। এখানে পাঠকের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসংগও আসে। সাহিত্য এবং সাহিত্যের ভিতরে সংবাদবস্তুর প্রভাবে মিশ্র একটি ভাষার আবির্ভাব আমরা লক্ষ করেছি। উন্নত জাতিতাত্ত্বিক প্রণোদনায় বিষয়টি যেমন রচনার মধ্যেই আরোপিত হতে পারে তেমনই পাঠককেও সচেতন থাকতে হয় এর ফলাফল আবিস্কার ও পরিণতিতে সচেষ্ট হতে। বাংলা গদ্যের প্রসার এই বঙ্গে হয়নি। সকল গল্প, উপন্যাস, নাটকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি বা ভৌগলিকদর্শন আসছে না। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ নিরীক্ষণমাত্রায় আসার কথা নয়। আবার শুধুমাত্র বিনোদননির্ভর রচনাকেই আমরা সিরিয়াস সাহিত্য বলে আমলে নিচ্ছি না। বিস্তৃত সাহিত্যের উপযোগিতা থেকে এমন বিবৃতিও বের করা সম্ভব যে, মূল রচনার পঙতি ধরে ধরেও অর্থদ্যোতনার যোগসূত্রতা লেখকের চিন্তায় পাওয়া যায় না। যে কারণে সমালোচনা সাহিত্যের পরিপূর্ণতা পায়নি। পাঠক প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। নানা মত-বিতর্কেরও জন্ম হয়েছে, বিশেষ ফল হলে তারও শ্রুতিমাধুর্য এরমধ্যেই আমাদের উদ্ভাবনসীমায় উদ্ভাসিত থেকে যেত স্বনিয়মেই। উদ্ভাবনী সাহিত্যের একটা ধন্দ আছে। লেখকের উদ্ভাবনীতে এর দুটি রূপ পায়। একটি স্বয়ং লেখকের বলবার ভাষায় বর্তমান অন্যটি হচ্ছে তার লেখনির ভাষায় ভবিষ্যত সৃজনশীলতা। কখনো কখনো খুব তাত্ত্বিক মেধাবি লেখকের পক্ষেও তার বলবার ভাষা থেকে লেখার ভাষায় খেই হারানোর ঘটনাটি বুঝতে পারা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বুঝতে পারার সময় উবে যায়। তারই সৃষ্ট সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অবচেতনে তাকেও প্রতারিত করে। স্বয়ংনির্ভর অধিশ্বর। এরকম অবচেতনের জায়গা থেকেই লেখকের স্বাধিনতা ক্ষুণ্ন হয়। চিন্তাশক্তির অবক্ষয় হয়! এই পরিস্থিতিতে তার শ্রমসাধ্য লেখনিটিও পাঠকের শ্রুতিতে সার্বজনিন হয়ে আসে না। একটা বেতাল গতিতে পতিত হয় সমাজ মনস্কতায়। যে কারণে ধরে নিতে হচ্ছে নতুন চিন্তাস্রোত বা বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যে পাঠকের উদাসীনতা রয়েছে। পাঠকভেদে, জাতিভেদে সাহিত্যের উদ্ভাবনটা হয় অবচেতনেই। এর ফলশ্রুতিটি পেশাগত লেখক-কবিদের হাত দিয়েই রচিত হলো নাকি পাঠকই শেষমেশ লেখকসত্তায় উন্নীত হলেন সেটি বড় কথা নয়। যে অবস্থান থেকে উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত কিংবা লিখিত হলো সেখান থেকেই সৃজনশীল সাহিত্য এবং তার সাথে নতুন সাহিত্য কীর্তিমানের সূচনা আমরা ধরে নিতে পারি। ধরে নিতে পারি, সূচিত ওই কীর্তিমানের বিবৃতি থেকেই সভ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে উদ্ভাবনের উন্নীতমাত্রায় উদ্ভাসিত হবার রূপ।
লাখো গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বসাহিত্য আমাদের অপঠিত থাকে। ফলে জ্ঞানের উন্নীত স্পর্ধায় উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত হয় না আমাদের কাছে। বাঙালির চিরায়ত সুফি-সন্ন্যাস বাউলদর্শনের মধ্যে ব্যাপক উদ্ভাবন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সমাধান আছে। মানবিক দীক্ষা কিংবা বিশ্ববীক্ষা ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অভিজ্ঞান পাওয়া যায়। রিলিজিয়ন ফ্রম রিয়েলিটি। স্বভাববৈশিষ্ট্যে বাস্তবভিত্তিক যে জ্ঞানের সমাহার, যুগান্তরের মানবিক দীক্ষা, ওরকম পরিস্থিতি থেকেই সম্ভব। কিন্তু জাতিগত আইডোলিটি থেকে এরাই আবার পতিত হয়েছে। পতিত হবার শিক্ষা অর্জন করেছে। এই যে জীবনাচারের স্ফূরিত সঞ্চালকশক্তি, এটিই আবার উদ্দিপিত করেছে আধুনিক অক্ষরজ্ঞানে শিক্ষিতশ্রেণীকে। গৌতম বুদ্ধ পিতার সিংহাসন ছেড়ে অরণ্যে সন্ন্যাসসাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করলেন আত্মকৃত ভাবাদর্শে। রাস্ট্রবেস্টন তাকে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। কার্ল মার্কসের পুঁজিতন্ত্রের আধিপত্যে বিশ্ববাসী সাম্রাজ্যবাদে দীক্ষিত হলেন। বাঙালির জীবনাচারের ভাষাতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের ভুল ব্যাখ্যা এবং জাতিগত প্রলুব্ধির ক্ষেত্রটিতেও এমনই অবস্থা হয়েছে যে, এদের কথা বলবার ভাষাটিই পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টের ভাষা, বিজ্ঞাপনের ভাষায়। আপনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেনো আপনি পুঁজির সম্পদ। পুঁজি পুঁজির স্থানেই রয়ে গেছে। একক ব্যক্তির পুঁজি এবং সাম্রাজ্য প্রবৃত্তির বিষয়টি এদের সংজ্ঞা থেকে উঠে গেছে।
দশক, শতক পরিবর্তনের সাথে সাথে মৌলিক সাহিত্যব্যতীত অবচেতন উদ্ভাবনী আমাদের সংজ্ঞায় আসে একটা সময়ে। তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক পাঠকশ্রেণির কাছেই কেবল বিষয়টি ধরা পড়ে। আবার মানুষমাত্রই রাস্ট্রবেস্টনের একঘেয়ে জীবনাচারের মধ্যে থেকে নতুন চিন্তার সংগে নিজেকে যুক্ত করেন। রাজনৈতিক চিন্তাস্রোতের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন। এই চিন্তাস্রোতেরই যে ফলশ্রুতি আমরা লেখক-কবিদের মধ্য থেকে পাই তাই আসলে উদ্ভাবনী সাহিত্য। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি পড়ে যদি কোনো পাঠক এরকম মনে করেন যে, ‘যেন মহিমামণ্ডিত হয় এই উঁকি দেয়া, রোদের আগেই / যেই আভা এসে লাগে ধানগাছে, খঞ্জনা পাখির কণ্ঠে / উঠে যেন আসে ওই গান, মানুষের ঠোঁটে’ আবার ফরিদ কবিরের কবিতাপঙতি ‘অঙ্কুরের স্বপ্ন ফল ফলের স্বপ্ন কী? একথা জানি না, এটা জানে আমাদের গৌতম চৌধুরী’। লালে লাল। এরকম পঙতি পড়ে যদি কোনো সংগীত রচয়িতার মধ্যে কোনো প্রভাব পড়ে এবং তিনি যদি একটি সংগীতের, ‘জল ছুঁয়ে যায় জলের বাড়ি মন ছুঁয়ে যায় মনে’ এরকম কোনো পঙতি লিখে ফেলেন তাহলেই কেবল বোঝা সম্ভব উদ্ভাবনীটি আসলে কী ঘটিয়ে দিলো পাঠকের অন্তরে। আসলে বিষয় স্বাভাবিক। যাই হোক, সাহিত্যের উদ্ভাবনীটি তৈরি হয় ভাষার যোগসূত্রে। আদিতে মানুষের যে ভাষা তার সাথে বর্তমানের সমন্বয়ে যে ভাষার জন্ম এবং ভাষাজন্মের যে সাহিত্য। বিজ্ঞাননির্ভর তত্ত্ব দিয়ে আমরা ভাবতে পারি, তাতে সাহিত্য থাকে না। বিজ্ঞানচেতনা সাহিত্যে থাকতে পারে কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুকৃতি পাল্টে দেয় সাহিত্যের ধরন, প্রতিবেশ। ভৌগলিক পরিসর বাঙালিকে কাব্যিক মননশীলতায় ব্যাপ্তি দিয়েছে আর ভারতবর্ষে পড়েছে সাংস্কৃতিক প্রসারণ। তুরস্ক, ইরান, মিসর, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার জীবনাচার আমাদের মাঝে রূপকথারই জন্ম দিয়েছে কিন্তু ভারতবর্ষ সাংস্কৃতিক প্রণোদনার জায়গায় উন্নীত মাত্রাকেও অতিক্রম করেছে। নিসন্দেহে শুধুমাত্র জাতি এবং ভাষাই নয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও পড়েছে ব্যাপকভাবে। জাতিগত সাংস্কৃতিক প্রাণচাঞ্চল্যের বৈশিষ্ট্যে ভারত আজ আর পিছিয়ে নেই। কবিতা, গদ্যসাহিত্য, চলচিত্র, রাজনৈতিক অভিজ্ঞানেও ব্যাপক পরিসরের প্রসংগে পাঠকশ্রোতার বিমুখ হবার অবকাশ নাই। এখানে বাঙালির সুফিতত্ত্বের ধারণাটি একটি চমক সৃষ্টি করবে। অধ্যাত্ম মরমীচর্চায়, আদিভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় হয়ত অতীশ দীপঙ্করের ভাষাকেই কমুনিকেট করা যায়। তাতে কাব্যিক মননশীলতাও পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভৌগলিক বীক্ষায় সংস্কৃতিকচর্চা করতে গেলে বাস্তবতায় ফিরে আসতেই হয়। সজ্ঞানে, বাজারদরে কোনো পাঠকও এখানে প্রতারিত হবার সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হবেন না।
ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মান সাহিত্যের সংগে আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য। দুর্বলতার একটা ক্ষেত্রে অবস্থানে আমরা সংজ্ঞাত হয়েছি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানদের সাহিত্যই আধুনিক সাহিত্য। আরো বিভাজন করে দেখলে স্পেন, ফ্রান্স, কানাডা, সুইডেন, জাপান, জার্মান সাহিত্যই কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত। কিন্তু ভাষার অজ্ঞতা থেকেই যায়। জাতিগতভাবে আত্মনির্ভরতা হারালেই কেবল এইরূপ চিন্তন প্রক্রিয়ার অভ্যুদয় হয়। বিশ শতকের একেবারে শেষ দু-দশকে আমরা দেখেছি পেঙ্গুইন বুকস, রাশান প্রগতি, সংঘ প্রকাশনের বাংলা প্রকাশনার সমৃদ্ধি এমনকি ভারতিয় আনন্দবাজার, দেশ প্রকাশনার সহস্র প্রকাশনায় বৈদেশিক সাহিত্যের ছড়াছড়ি যেভাবে হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশি সাহিত্য কিংবা প্রকাশনার বিশেষ কোন ব্যাপ্তিই ওইসব প্রকাশনায় ছিল না। ফলে বাংলাভাষায় সাবলিল বুদ্ধিবৃত্তিক মনোনিবেশের বিকাশ ঘটার প্রতিবেশ পায়নি। উল্লেখিত কমুনিকেটিভ লিটারেচারেও আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তিতে প্রসারলাভ বিলম্বিত হয়েছে। অধুনান্তিক গ্লোবালাইজেশন প্রক্রিয়াটি দূরকল্পন। প্রতি পনের কিলোমিটার অন্তরেই মানুষের ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার লৈঙ্গিক রাজনীতিতেও ভাষা দুর্বলতার শিকার হয়। দুর্বল ভাষার প্রভাবে হীনসংস্কৃতির উদ্ভব। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই পেশাগত অবস্থানকে বিগড়ে দিচ্ছে। একদিকে করুণ আর্তির নগ্নতায় রচিত হয় হীনমন্যতা অন্যদিকেই বিনোদনের মাত্রাতিরিক্ত সভ্যতার ভোগবাদ। ফলে ভোগবাদের সাহিত্য হীনমন্য সামাজিকতাকেই উন্নীত করেছে বিশ্ব চরাচরে। এর ফলশ্রুতি ইউরোপ, আমেরিকায় পড়েনি। যা শ্রেষ্ঠ তা আসলে শ্রেষ্ঠই, শ্রেষ্ঠজ্ঞানে উদ্ধৃতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে ভাষায় আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য এবং দখলদারিত্ব নেই এরকম বিষয়ই নির্বাচিত করি আমরা উদ্ভাবন বিবেচনায়।
উদ্ভাবনী সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আছে। উদ্ভাবন থেকেই উদ্দিপিত হওয়া। মানুষের জীবনাচারে সাহিত্য না থাকলে সংস্কৃতির জন্ম হয় না, সংস্কৃতি না থাকলে রাস্ট্রের উপস্থাপনশৈলী বিশ্বের কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ রাস্ট্রের কাছে যেমন দায়বদ্ধ তেমনই মহাকালের সময়ে, সৌরজগতের ব্যাপৃতিতেও তার দায় যথাবহাল থাকে। মহাকালের চেতনায় আপনার রাস্ট্র ভেদ করে বিশ্বে এবং বিশ্ব থেকে সৌরশক্তিতে প্রবেশ করার (যুদ্ধপ্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আধিপত্যের চেয়ে সৌন্দর্যবীক্ষায় সাম্রাজ্যহরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যম) নব নব চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতিই সময়ের উদ্ভাবনী সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিচেতনার অবিসংবাদিত সেই মননশীল কীর্তিমান যার মননশীলতায় জাতিগতভাবেই উন্নীত হওয়া আজো সময়ের ব্যাপার। এই অবিসংবাদিত মহান কীর্তিমানের সাহিত্যিক পদমর্যাদা মর্মবস্তুতে উন্নীত না করেই দুই বাংলার সাহিত্যিক প্রতিবেশ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সাহিত্যিক প্রবণতা ও প্রতিবেশের মানবীয় গুণাগুণ। ভবিষ্যত সাহিত্যে আমরা হয়ত ভাষার দুর্বল সেই অবস্থানের দিকেই যাচ্ছি যেখানে অবিভক্ত বাংলাভাষার উৎসচর্চায় মূল কেন্দ্রবিন্দুটি আর শনাক্ত করা যাবে না। কিছুটা ভাষার উৎস আমরা পাবো পল্লিকবি জসীমউদ্দীনেই। পূর্ববঙ্গে তিনিই একমাত্র আধুনিক, যার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো শিক্ষিতশ্রেণির বোধকে জাগ্রত করে দেয়া চিরন্তন বাঙালির চর্চিত মূল্যবোধের ভাষায়, মানবিক জীবনবৈশিষ্ট্যে।
আধুনিক গদ্যসাহিত্যের প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েনি। মননশীলতার প্রভাবই-বা সৃজিত হয় কোত্থেকে। অমিয় চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গদ্যছাড়া আধুনিক গদ্যসাহিত্য কিংবা সমালোচনা সাহিত্যের সমৃদ্ধি আসেনি। রাস্ট্রচিন্তায় সমালোচনা সাহিত্যের যেটুকু প্রবৃত্তি অর্জন হয়েছে এর বাইরে এই সময় একমাত্র সলিমুল্লাহ খানেরই বুদ্ধিবৃত্তিক রচনার সমৃদ্ধি এসেছে। ঔপনিবেশিক, উপমহাদেশিয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং গ্লোবালচিন্তন প্রক্রিয়ার প্রভাব উন্মুক্ত করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চা, সমাজ-রাজনীতি, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান আছে। ড. প্রথমা রায়মণ্ডল লিখেন, প্রবন্ধের বিকাশ যে অনুকূল পরিবেশকে আশ্রয় করেই সম্ভব হয় এবং অধোগতিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে প্রতিকূল পরিবেশের যন্ত্রণায়- বাঙলাদেশের রাজনীতিতে তথা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের সেই চেহারাটিই লক্ষ করা যায়।
সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূলতায় চিন্তাবিদদের চিন্তাশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তেমনি অনুকূল প্রতিবেশ পেলে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক ও শিল্পীর অধিকার তথা স্বাধিন সৃষ্টিশীল দিগন্ত হয় প্রসারিত। পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতির বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটেছে, তবে তা নিছকই কৌশলগত। মূল কাঠামো না বদলালে তার উপরি-কাঠামো বদলায় না।
(বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, প্রতীক বুকস, কলকাতা-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২৩)
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে রোমান্টিক রচনাধারায় ভিন্নমাত্রিক সংযোজন নাসরীন জাহানের ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’। জৈবনিক বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট এটি একটি প্রভাব আধিপত্যের উপন্যাস। ঔপনিবেশিকতা ছাড়া মানবীয় চরিত্রই যেখানে প্রধান উপজীব্য হয়েছে। যদিও উপন্যাসটিতে লৈঙ্গিক শ্রেণিবিন্যাসে শুধুমাত্র নারীবাদী রচনা বলে খারিজ করে দিতে পারেন যেকোন পাঠক। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গদ্যের দুর্বলতা, মৌলবাদী হীনমন্যতা বর্জন করা গেলে উপন্যাসটিতে বিবাহযোগ্যা একজন যুবতী কন্যার রাস্ট্রিক সামাজিক প্রপীড়ন, লজ্জা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ট্র্যাজিক চিত্রটিই নিবেদিত হয় পাঠকের দরবারে, যে ধরনের রচনার পক্ষে সম্ভব মুহূর্তেই পাঠককে উদ্দিপিত করে ফেলা সাহিত্যিক সঞ্চারণে।
মানুষের মধ্যেই যেহেতু সাহিত্যের বিস্তার কাজেই মানবজন্মের সংগে এর সম্পৃক্ততা নিবিড়, আরাধ্য। সৌরমণ্ডলে মানব অস্তিত্ব বিলুপ হবার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যের উৎসারণ আমরা পাবো এবং কালে কালে এর উদ্ভাবনও দেখবো এটা ঠিক। আবার প্রযুক্তিও ব্যাপক উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। সময়ে যা মানুষের কাছে পরিবর্তিত হলো, পরিবর্তনের প্রকাশ হলো সেটাই উদ্ভাবন আমাদের। উনিশ শতকের প্রযুক্তি এবং পরিবর্তনের পর আজকের বিশ শতকে লেখক-পাঠক যারা তারাই এই উদ্ভাবনের ধন্দে পড়লেন। হস্তলিখিত সাহিত্যের মুদ্রণভঙ্গিমা পাল্টে যুক্ত হলো প্রযুক্তি মাধ্যমের ওয়েব সংস্করণ / প্রকাশন। লেখক-কবিমাত্রই কাগজে-কলমে চিন্তাশক্তির ব্যাপক প্রয়োগে লিখন প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। প্রযুক্তির আধিপত্য। আপনার চিন্তার পরের ফলশ্রুতিটিও পেতে পারেন খুব সহজেই। রিডার নোটবুক পিসি, প্রযুক্তির একটি পাঠক ধরে নিয়েও সম্ভব উদ্ভাবনী সাহিত্য তথা সাহিত্যিক প্রসারণ ক্ষমতা আবিষ্কার করা। এই উদ্ভাবন বা ধন্দটাকেই আমি একটা চাটখিলা অবস্থা বলে চালিয়ে নিতে চাই। অর্থাত ক্রমউদ্ভাবনের মধ্যে থেকেও আপনার মনে হলো যে আপনি সাহিত্যের উদ্ভাবনীতে নেই। সাহিত্য পঠিত হলে যেমন উদ্ভাবন বহাল থাকে আবার অপঠিত থাকলে তারও উদ্ভাবন থাকে লেখক-কবি বা পাঠকের মননের মধ্যেই। যা উদ্ভাবন তা আসলে উদ্ভাবন-ই। এর কোনো বিকল্প নাই।
চর্যাপদের ভাষা এবং জীবনাচার একরকম ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যধরন আরেকপ্রকার। বঙ্কিম-রবীন্দ্র বা বিশ শতকের সামগ্রিক সাহিত্যের মননশীলতায় একরূপ আর এই সময়ের সাহিত্যের সৃজনকাতরতার ভিন্ন আরেকটি রূপ। রাস্ট্রবেস্টনের মধ্যে, জীবনাচারে পিছিয়ে পড়া লেখক-কবিমাত্রই বলবার কিংবা প্রকাশ ভঙ্গিমায় সাহিত্যকে অস্বীকার করেন আবার নিজেই নিজের ভেতরে লালন করেন আত্মার অসীম মুক্তি, মুক্তির আকুলতা তারই সৃষ্ট রচনার গুণাগুণে। এই যে আমাদের চেনাজানা সাহিত্যের পরিবর্তন, লেখক-কবিরাই ভৌগলিক বীক্ষায় লেখনির জায়গাটিতে ক্রমান্বয়ে দাসে পরিণত হলেন। এর একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তরেই আমরা দেখেছি সাহিত্যের উদ্ভাবন সময়ের লেখক-কবিদের।

অনুচ্চকণ্ঠ, দূরবর্তী চেতনার কবিতা

বাংলা কবিতার দীর্ঘ ধারাবাহিকতার পর ত্রিশের দশকে এসে কাব্য-ব্যবচ্ছেদে এক নতুন পথ তৈরি হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত হাঁটছেন অনেকেই। অবশ্য পঞ্চাশের দশকের পর গভীরতর বিস্তৃত পথ একটু শীথিল হয়ে যায়। তারপরও এর ভেতরেই কিছু কিছু কবি রয়েছেন যাঁরা একটু ব্যতিক্রম পথে হেঁটে চলেছেন। ষাঁট, সত্তুর দশকেও সেরকম দু,চারজন কবির সন্ধান পাওয়া যাবে। আশির দশক থেকে পুনরায় বাংলা কবিতা ভিন্নভাবে সজাগ হতে চলেছে। আর তারই বাঁক সম্ভাবনা কাঁধে নিয়ে নব্বইয়ের এবং বর্তমান শূন্য দশকের কবিদের পদচারণা শুরু হয়েছে। ধারণা করা যায় একবিংশের কবিদের হাতে কবিতার আর এক বাঁক বা ভাষার গূঢ়পট পরিবর্তনের উত্থান হবে এবং তার কাজ ভেতরে ভেতরে চালিয়ে যাচ্ছেন এই সময়ের কবিরা। কামরুল হাসান এই সম্মিলিত আশি-নব্বই এবং শূন্য দশকের ঊর্ধ্বতন অন্যতম প্রজ্ঞাকবি একজন। যিনি একাধারে কাব্যপুরুষ, পঠিত, প্রমাণিত এবং ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতায়ও যাঁর অমিত সম্ভাবনা থাকবে ধারণা করা যায়।
শফিক রেহমানের ‘রিপু কাহিনী’ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে মধ্যবিত্ত বাংলা ছোটগল্প সঞ্চারণের কাছে আমাদের ব্যাপক পাঠক পৌঁছাতে পারেনি। বরং তথাকথিত সাহিত্য সমালোচকের বদৌলতে পাঠককুল মৌলিকত্ব হারিয়েছে। অন্যদিকে নির্মলেন্দু গুণের ‘আপন দলের মানুষ’ পড়তে গিয়ে অভিভূত হয়েছি, কবির লেখা গল্প অসাধারণ সঞ্চারিত করেছে আমাকে। দুটি গল্প বইয়ের উদ্বৃতি দিলাম এই জন্যে যে, কবি কামরুল হাসানের কবিতায় এই গল্পময়তা গুণটিই অধিক সঞ্চারিত করেছে আমাকে। অগ্রে বলে রাখি ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণকারী এই কবির ‘পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে’সহ এযাবৎ মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ওপার বাংলার লিটল ম্যাগাজিনসহ একবিংশ, নিসর্গ এবং সমকালিন বাংলা ছোটকাগজ ‘হাওড়’-এর অন্যতম প্রধান কবি-লেখক তিনি। কামরুল হাসান স্মিতবাক, অনুচ্চকণ্ঠ, দূরবর্তী চেতনার কবি। জীবনস্পৃষ্ঠ দর্শন-চিন্তা কবিতার অন্তরীক্ষে কুয়াশার পাতলা আবরণের মতো কখনো স্বচ্চ, কখনো ম্রিয়মাণ। তবে দর্শনের গুরুভার তাঁর কবিতার মুখ্য উপাদান নয়। নয় বনেদী বাংলা কবিতার প্রথাছন্দ প্রয়োগের কবি। তাঁর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি আপনা থেকেই তাঁর কবিতার ছন্দ দোলায়িত করে পাঠক-কে। ফলে তাঁর কাব্যিক অবস্থান গিয়ে পৌঁছায় শাশ্বতকালের বাংলা শব্দতাঁতির অন্য এক গৌড়চন্দ্রিকায়। কেউ কেউ মনে করেন ছন্দ ছাড়া টিকে না কবিতা আবার কেউ কেউ মনে করেন কবিতা তার আপন ছন্দেই উপস্থাপিত হয়। তাঁর কবিতার ছন্দের উদারতার সূত্র ধরে লিখতে চাই যারা অনুবাদ কবিতার পাঠক তারা লক্ষ করবেন যখন অন্যভাষার একটি কবিতার অনুবাদ আমরা পাঠ করি তখন কিন্তু কবিতাটিতে আর মূলছন্দ থাকে না। একই অবস্থা হয় যখন বাংলাভাষার একটি কবিতা ইংরেজি কিংবা অন্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। কখনো কখনো এমন হয় যে মূল কবিতাটির ভাবান্তরও ঘটে যায়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে এই কাব্যিক গল্পময়তা এবং প্রথাছন্দহীন একটি ছন্দ কবিতার উদ্বৃতি দিচ্ছি।
নদীর উপরে জানি জানি, উত্তাল ঢেউ চড়েছিল, হেঁটে যাচ্ছিলাম
হাঁটতে হাঁটতে সেই সাধু হয়ে গেলাম যে মাঝনদীতে ডুবে গিয়েছিল
ঐ নদীর তলদেশে বহু রক্তাক্ত লাশ আর বিধ্বস্তরাজ্য স্তুপ হয়ে ছিল
রক্তাক্তরাজ্য আর বিধ্বস্তলাশের আগে
কিসের রাজ্য কিসের ত্রিতাল
রিপুর কাছেই জগত মাতাল
ভেঙে পড়ছে সময়ের ত্রাশ
সকল রাজা হলেন তো লাশ
দ্রাবিড়যাত্রা ও খড়ম প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৯
কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক যেন সেই গ্রামীণ লোকপুরাণের চিত্রটি ঠিক চোখের সামনে দেখতে পান। নদীর উপর দিয়ে কোনো সাধু-সন্ন্যাসী জায়নামাজ বিছিয়ে কিংবা খড়ম পায়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছেন। শুধু লোকশ্রুতির এই খড়ম-সন্ন্যাসীর কথাই নয় গ্রন্থভুক্ত তাঁর আরেকটি অসাধারণ কবিতা ‘সুনামগঞ্জ’। কবিতাটিতে আমাদের আঞ্চলিক লোকাচারের বিশেষ ছাপ, অন্তর্দাহের প্রজ্ঞাপিত আবেগময় স্মৃতিচারণা আছে। বরাবরই কবিতার ক্ষেত্রে একটি বাক্য খুব জোড়ালো হয়ে ওঠে উপেতি, অবহেলিত, দুর্বোধ্য। এই পাঠক দারিদ্র্যতার কথাটি আমরা নিজেই ভাবি না। আশ্চর্য! ল্য করুন, কবির সজ্ঞায় কিভাবে আমাদের লোক-সংস্কৃতির পরিবর্তন উঠে এসেছে। অবচেতনেই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে কপটতা, ভাণ-ভণ্ডামির। শুধুমাত্র কাব্যিক প্রতিবেশেই নয় চিরকাল যা আমরা বর্জন করতে চেয়েছি মানবিক মূল্যবোধের তাগিদেই।
খুব সকালে যাচ্ছিলাম আর্ট স্কুলের দিকটায়,
দেখি বন্ধ জানালার পাশে এক সুলনা দাঁড়িয়ে,
‘এই যে শুনুন’
ভাবলাম ভাগ্য প্রসন্ন, দেবী ডাকছেন,
বল্লেন, ‘ঘুমন্ত গৌতমকে একটু ডেকে দিন তো
হাত ধরে পালাবো’।
যেদিকে পালাতে চান সেদিকে স্থানুর মূর্তি ধরে আছে রামকিংকর বেইজ।
শান্তিনিকেতন, পৃষ্ঠা-১১
বোধের, আবেগের, ভাবের শিল্পিত বহিঃপ্রকাশই কবিতা। ধীরলয়। অনেকটা জীবনানন্দের ধীরলয়ের কাব্য-ঘরাণার চমৎকার একটা ফর্ম বেছে নিয়েছেন কামরুল হাসান, তাঁর কবিতায়। ধীরলয়ের এই মহিমাগুণেই তিনি পাঠককে প্রভাবিত করেন দূরশ্র“ত শব্দ-দ্যোতনায়। ফলে তিনি যে কোথাও কোথাও বাংলা কবিতার প্রভাব-প্রপাগাণ্ডার মধ্যে পড়েননি তা নয়। তাঁর কোনো কোনো কবিতাতে উৎপল কুমার বসু থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর অনুজ কবি ব্রাত্য রাইসুর কবিতার প্রভাবও লক্ষ করা যায়। গ্রন্থভুক্ত ‘কবরকাব্য’ কবিতাটি পাঠ করলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পজিটিভ অর্থেই লিখছি, বাংলাভাষার সবচেয়ে সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবিদের তালিকা করলে দেখা যাবে জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, উৎপল কুমার বসু, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর প্রমুখ কবিকুলই সর্বাধিক সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবি। অনায়াসে কামরুল হাসান নিজেও এই গোত্রের একজন।
আমরা জানি, কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়। আর সঞ্চারণ থেকেই যেহেতু প্রভাব-প্রবণতা তৈরি হয় কাজেই কবিতায় যদি কারো প্রভাব থাকে সেটি দোষের নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন আছে ‘প্রভাব কবিতা বর্জন করা’। এতে একটা মুশকিল হয়, মুহুর্মহু কবিতার নিউ টেক্সট কবিতার বৈচিত্রের বদলে কবিতার ভারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারেন পাঠক। আমার মতে, এই ‘প্রভাব কবিতা বর্জন’ ধারণাটির এখনি পরিবর্তন হওয়া জরুরি। ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট থেকে কবিতা বিষয়ক কবির নিজস্ব ভাবনাও এখানে উপস্থাপন করছি। ‘অতিদুর্বোধ্য, মাথামুণ্ডুহীন লেখারও বিপক্ষে আমি। আমাদের কবিতায় একদিকে অতিতরল কবিতার বল্গাহীন দৌড়, অন্যদিকে অতিদুর্বোধ্য লেখার অর্থহীন ভীড়। আমার কবিতা এ দু’ধরনের অকাব্যিক প্রবণতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে এবং মাঝামাঝি কোথাও নিজের পথটি খুঁজে পায়। কবিতায় ছন্দ থাকা প্রয়োজন তবে সে ছন্দ নিক্তি মেপে বসানো প্রাণহীন মাত্রা আর পর্বের হিসাব নয়, বরং কবির কানের কাছে শ্রুতিমধুর পদাবলী’।
কামরুল হাসান স্বভাব কবি। তাঁর কাব্যস্বভাবের একটি বৃহৎ অংশে বিস্তৃত রয়েছে রোমান্টিকতা। বাঙালির প্রধান স্বভাব-বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রেম, গূঢ়অর্থেই তিনি আমাদের জীবনাচারের সঠিক জায়গাটিতেই ক্লিক করেছেন। একটা সময় ছিল যখন ব্যাপকহারে কবিরা প্রেমের কবিতা লিখতেন। বাজারে অডিও মিডিয়ার কল্যাণে ট্রেডমার্কধারী কিছু প্রেমের কবিতা লিখিয়েও ছিলেন, যাঁরা শুধু প্রেমের কবিতাই লিখতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষপ্রান্তে এসে অডিও মিডিয়ায় আবৃত্তি শিল্পের ভাটা পড়ার সাথে সাথে এই রোমান্টিকতার বিলুপ্তি হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ এবং যুক্তিসঙ্গত প্রেমের কবিতার কথাই লিখছি। পাঠক লক্ষ করবেন, বিষয়টি কামরুল হাসানের কবিতায় কত গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
কী কাতরতায় মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে মানুষ একাকী
মাইল মাইল কুয়াশা পাড়ি দেয়, অন্ধকারে হাঁটে?
কে কবে বুঝেছে কাকে, তবু কেউ একজন চলে যায় / অযুত যোজন দূরে-
এইপাড় হতে কে একজন ক্ষীণস্বরে তাকে ডেকে আনে / অবোধরে...
কে অবোধ? কার কষ্ট ভারী হলো মাঠের হৃদয়ে?
প্রান্তরের কান্নাসজল মানুষেরা, পৃষ্ঠা-৪৪
‘সময় সবুজ ডাইনী’ রণজিৎ দাশের এই কাব্যমনীষার যথার্থ যৌক্তিকতা আছে। সমকাল কবি-লেখকদের কাছ থেকে উবে যায়। কামরুল হাসানের ক্ষেত্রেও এর বাত্যয় ঘটেনি। তাঁর কাব্যপ্রবণতা দিনে দিনে কতটা গভীর হয়েছে তা আমাদের ব্যাপক পাঠকের সংজ্ঞায় আসেনি। অথচ প্রেমের কবিতা লেখার ট্রেডমার্ক পোয়েট মহাদেব সাহা কী করে বালখিল্যতা করে একটি প্রেমের চিঠিকে ছন্দের প্রয়োজনে ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেন ‘করুণা করেও হলে চিঠি দিও’। অদ্যাবধি কবিতাটি মহাদেব সাহার একটি শীর্ষ প্রেমের কবিতা হিসেবে স্বীকৃত! প্রণম্য পাঠক, খুবই আশ্চর্যের বিষয় তাই না!
বাংলাভাষায় নরেশ গুহ নামে একজন কবি ছিলেন। যিনি মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থের অধিকর্তা ছিলেন। কবি বিনয় মজুমদার, তাঁর একটি প্রবন্ধে পাঠকের উদ্দেশ্যে আর্জি রেখেছিলেন তাঁকে যথার্থ কবি হিসেবে বিবেচনা করার। বাংলা ভাষাভাষিদের একজন বড়মাপের কবি কামরুল হাসানের কাব্যপ্রতিভাকে খাটো করা অর্থে নয় বরং ব্যাপক দৃষ্টিনন্দন উদ্দেশ্যেই লিখছি, কাব্যস্বভাবে কামরুল হাসান অনেক বিস্তৃত এবং পাড়ি দিয়েছেন যোজন অভিজ্ঞতায়। ফলে পাঠকের দরবারে তিনি যতটা প্রজ্ঞাসহ এগিয়ে এসেছেন, পাঠকের উচিত হবে ততোধিক সাদরেই তাঁকে গ্রহণ করা, বাংলা কবিতায়।
পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে \ কামরুল হাসান, প্রকাশক \ নিসর্গ, ফেব্রুয়ারি-২০০৭, প্রচ্ছদ \ অশেষ সাহা, পৃষ্ঠা-৬৪, মূল্য-৫০ টাকা।

কবিতার ভবিষ্যৎ

মানুষের মধ্যে সাহিত্যধারণা কিছুটা সচল থাকলেও সাহিত্যের কবিতা বিষয়ে, ধারণা অতটা স্বচ্ছ নয়। যে কারণে বিষয়টি ভালো পঠিত-চর্চিত হওয়ার চেয়ে বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। কাজেই এর ভবিষ্যত বিষয়ে কিছু বলতে গিয়ে সর্বাগ্রেই নানাবিধ বিরূপ দুরূহতায় আটকে থাকতে হয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত একাডেমিক একটি ধারণা আমাদের তৈরি হয়েছে। এটি আসলে সমস্যা জর্জরিত সাময়িক শিক্ষাব্রতী মানসিকতায় পরিচালিত ক্ষণভঙ্গুর একটি ধারণা। শ্রেণিশিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মানসিকতা ছাড়া ওখানে আসলে পাঠমনস্কতা তৈরি হয় না। বিষয়টি ক্রমান্বয়ে কবিতার ভবিষ্যত গন্তব্য নির্ধারণের চেয়ে রাস্ট্রিয় পলিসি মেকিং-এ গাণিতিক ব্যাখ্যাটিই নিশ্চিত করে কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হয় না। কবিতা যখন রাস্ট্র থেকে উত্তীর্ণ মানসিকতায় অবস্থান করে তখনই শিকার হয় ধর্মীয় মূল্যবোধের। ফলে ভবিষ্যত কবিতার একদিকে গন্তব্য নিশ্চিত হলেও অন্য আরেকটি সাহিত্য মানসিকতা অবহেলায় অবদমিত হয় পাঠকের অন্তরেই। এখানে রুটস্ এবং সাহিত্য মানসিকতা এ দুয়ের সমন্বিত একটি রূপই কবিতার ভবিষ্যতরূপ হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করতে পারি। যে বিষয়টি আসলে ক্রম চলমান সুদূর সীমানায় অবস্থিত মূল লক্ষবিন্দু নির্দেশ করে।
সাহিত্যের সৃষ্টি কখন হয়েছিলো যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে এর কোনো সুষ্পষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবে ধারণা করা হয় মানুষ যখন নিজেকে মানুষ বলে জানতে শিখলো তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে সাহিত্যের ধারণার সৃষ্টি হতে শুরু করে এবং তা কালে কালে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। মানুষ একসময় সাহিত্য করতো মুখে মুখে বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে (যখন ভাষা বা শব্দ ছিল না, ইতিহাস খুঁড়ে-ছেনে তুলে আনবার প্রয়োজনে যার কিছু কিছু রূপ এখনো আমাদের সংস্কৃতিতে উপস্থাপিত হয়)। আমরা জানি নৃত্য সৃষ্টির প্রথম কলা, কথাটি সম্পূর্ণ নয় এই জন্য যে, প্রাগৈতিহাসিক শব্দটি নিশ্চয়ই কোন পাঠক সাহিত্যের আভিধানিক ব্যাখ্যা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না, এর কোন ইতিহাসও আমরা কেউ জানি না। মানুষ ক্রমান্বয়ে রেখাচিত্র বা অঙ্কনের মাধ্যমেও সাহিত্যে অনুপ্রবেশ করে। যখন উপস্থাপন শৈলী বা নিবেদন মানসিকতার প্রশ্নের উদ্রেক হলো, সে সময়টাকেই আমরা সাহিত্যের শুরুর কাল হিসেবে ধরতে পারি। আবহমান সাহিত্যের সেই টোটালিটি থেকে তারই এক উত্তরসংস্কৃতি কবিতা। প্রথমদিকে কবিতা মুখে মুখেই করা হতো। মুখের ভাষার সেই তিনি, উৎকৃষ্ট কবি তার আবেগ, অনুভূতি, জ্ঞান, দর্শন সবমিলিয়েই যখন একটি কবিতা রচনা করতেন তখন তার রচনার মাধ্যম ছিল তারই ব্যাপৃত মন। ধারণা করা যায়, উৎকৃষ্ট মনের সেই ব্যক্তিটি এভাবেই মুখে মুখে বলে বেড়াতেন তার কবিতা জগতময়, যাকে আমরা একযুগ আগেও জানতাম এরকম ব্যক্তিটি আসলে সন্ন্যাসী। কিন্তু সন্ন্যাসের ভাষাই কী প্রকৃত কবিতার অনুবাদ? নাকি ভাষার প্রকৃত অনুবাদই হচ্ছে কবিতা; তা কে বলবে? পাঠক নাকি ভাষার অনুবাদক। কালে কালে লোকধর্ম বা সন্ন্যাসব্রতীদের ভাষার অবমূল্যায়ন হয়েছে আমাদের মাঝে। বিষয়টি চর্চিত হওয়া জরুরি।
সময়ের ব্যবধানে কোনো ব্যাখ্যাই স্থিত থাকছে না। ক্রমবৈচিত্রে পাল্টে যাচ্ছে ব্যাপৃত মানবসংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক মাধ্যম। ফলে বিচ্ছিন্ন না হয়েই সাহিত্য থেকে পাল্টে যাচ্ছে করিতার নিবেদন ভঙ্গিমাও। আমাদের মুদ্রণ যন্ত্রের ইতিহাস খুব বেশি দীর্ঘ নয়। ধরা যায় মুদ্রণ যন্ত্র আসার পর থেকেই সমগ্র সাহিত্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে থাকে। আর এই সময়ের সাহিত্যপ্রকাশও হয়ে ওঠছে ডিজিটাল এবং অদূর ভবিষ্যতের সন্নিকট চিত্রটিও প্রায় এরকম যে আগেকার কোনো প্রিন্টধরনেরও প্রয়োজন পড়বে না। তো মুখে মুখে যখন সাহিত্যচর্চা করা হতো সে সময়ের কোন কবিতার কথা আমরা কি জানি? তার উত্তর হলো অবশ্যই জানি কারণ আমরা শুধু লেখার প্রমাণ হিসেবে দলিল-দস্তাবেজকেই বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি মুখের কথাকেও এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ মনের ভাষাও স্বীকার করি। পাঠক-শ্রোতার আস্থা তো ধারণার বাইরে, কখনো কখনো দুটোতেই বিশ্বাস অবিচল থাকতে হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে সেরকম অজস্র কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীময় যা আমরা বিশ্বাস করি। লালন শাহ, হাসন রাজা এর উলেøখযোগ্য সাধক। এই দুই সাধকের কবিতা যা আমরা ধারণ করতে পেরেছি লেখায় তার চেয়ে বহুগুন রয়েছে লেখার বাহিরে। একসময় মানুষ উলঙ্গ ছিল কারণ তখন বস্ত্র ছিল না বা মানুষ বস্ত্রের কথা ভাবেনি। তখন ওটাকেই সভ্য বলে ধরে নেয়া হতো। এখনকার সময়ে বস্ত্র পরাটাকেই সভ্য বলে গণ্য করা হয়। এই সাময়িক রকমফের মানুষের সাহিত্যচর্চার ভিন্ন চেহারা মাত্র। এটা আমার আলোচ্য বিষয় নয় আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কবিতার ভবিষ্যত। তার আগে একটু কবিতা ব্যবচ্ছেদ জরুরি মনে করি। ভাষার উন্নত প্রকাশই হচ্ছে কবিতা। পাঠক যা তার অধ্যয়ন মানিসকতায় নিজের মধ্যে ক্রমাগত বিষয়টি রিনিউ করে। সেটা কোনো আকার নির্দিষ্ট করে নয়। সময়ের শূন্যতার ধ্বনিচিত্রও হতে পারে। ফলে কবিতার জন্য ভাষা যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ভাষার পাঠকও। পাঠকই কবিতার ভবিষ্যত। ভাষা এবং পাঠক কবিতার ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই সমান্তরাল প্রবাহমান। ভবিষ্যত পাঠকের পঠিত কবিতাই ভবিষ্যতের কবিতা। যদিও বিষয়টির স্পেসিফিক চরিত্র আবিস্কার করা কঠিন। রাস্ট্র অবহেলিত হলে ভাষা বিকৃত হয়ে যায়, ভাষার বিকৃতিতে ধর্মীয় অবক্ষয়; ধর্মের অবক্ষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কবিতার সম্ভাবনা, কবিতার ভবিষ্যত। কিন্তু কথা হচ্ছে নির্দিষ্ট কবিতার ভবিষ্যত বলতে তাহলে আমরা কী বুঝবো! বর্তমানের কোনো কবিতা যুগ যুগ জিয়ে ভবিষ্যতেও পঠিত হলে ওই পাঠমনস্কতাই কবিতার ভবিষ্যত এবং পঠিত কবিতাটিই ভবিষ্যতের কবিতা? নাকি শুধুমাত্র উচ্চারণনির্ভর নিরাকার, মানুষের চর্চিত ভাষাটির ভবিষ্যতই কবিতা? ভাষা তো অমর, ভবিষ্যতের ঊর্ধ্বে।
কবিতা নামক শব্দটিকে আমরা জেনেছি অনিবার্য ভাবেই তার সর্বময় উপস্থিতির কারণে। যিনি এ প্রশ্নটি করবেন যে, কবিতার ভবিষ্যত কী? তিনি আসলে সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ হবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি আমাদের সমগ্র সংস্কৃতির অনিবার্য সঞ্চারণশীল একটি ভাবাবেগ হলো কবিতা। যার মৌলিক কোনো ব্যাখা নেই আবার বিষয়টি আমূল ব্যাখ্যাত নয়। আবেগতাড়িত মানুষমাত্রই তার ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যামটিই বেছে নেয়। সেটি আঙ্গিক বিবেচনা করে কবিতা না বলে সবিতা বললেও অর্থের রকমফের প্রায় একই থাকে। চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। তবে শব্দ, আবেগ আর সময় সম্পর্কিত আরো যত আছে এইসব শব্দাবলি এর ব্যাখ্যায় কিছুটা যোগমাত্রা তৈরি করতে পারে। যোগমাত্রা তৈরি করবে একে ভেঙে ফেলার পর বেরিয়ে আসা কোটি কোটি অনুশব্দও; যার কানাকড়িও আমার জানা নেই। হয়তবা প্রতিটি পাঠকের ভেতর থেকে একটি একটি করে এর ভিন্ন শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকের মতে বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকে চিহ্নিত করা হয়। সে অর্থে চর্যাপদের সাহিত্য মর্যাদা বনেদী মেহমানখানার বনেদী অতিথির মতো। তার আরো পরে হিসেব করে দেখলে কবিতার দেহ, ভাষা, শব্দ আর আঙ্গিক গঠন ভাঙাগড়ার বিবেচনায় কবিতার বর্তমান হাল। কিন্তু এরও উৎস কোথায় ছিল? এবার গ্রাফচিত্রের ব্যাখ্যায় দেখি, একথা সত্য যে চর্যাপদে আমরা যে লোকাচারের জীবনচিত্র লক্ষ করেছি আজও তা সেই যুগ যুগ চিত্রধরনের অনুরণন মাত্র। বলা হয় চর্যাপদ দুর্বোধ্য কঠিন। অন্তত এখনকার সময়ে ভাষার তরজমা করলে আমরা তাই দেখবো। সেক্ষেত্রে পাঠক-শ্রোতাকে এর চিত্রধরনের সঞ্চারণে আস্থা রাখতে হয়। এখানে পাঠকের আস্থাই যদি না থাকে তাহলে কবিতা তো পঠনে-শ্রুতিতে আসবার কথা নয়। আর পঠন-শ্রুতিতে না থাকা মানেই কবিতা ভবিষ্যতহীন। কালিদাসের মেঘদূত, লালন শাহ, হাসন রাজার সাহিত্য জীবন, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গুরুসন্ধানী কাব্য গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, ময়মনসিংহ গীতিকা, সাম্প্রতিক জসীমউদ্দীনের ট্র্যাজিক আখ্যান-কাব্য নকশিকাঁথার মাঠ অন্যদিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করেছে মহাকাব্যিক যেসব গ্রন্থাবলি এগুলোও তার উদ্ধৃতিই হতে পারে মাত্র কিন্তু কবিতা নামে স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো বিষয় নয় কিংবা পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতি এগুলো ভবিষ্যত কাব্যেরও কোনো নিদর্শন নয়।
কবিতার কোনো বয়স নেই, কবিতা প্রৌড়ও নয়, কবিতা চির যৌবন। যতদূর তার যৌবনের হাওয়া গিয়ে শিহরণ জাগিয়ে আসতে পেরেছে সেখানেও কবিতার জন্ম হয়েছে। বাংলা কবিতার দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র কবিতাতে ফিরে আসি তবে তার অস্তিত্ব বের করা সম্ভব নয়। ওই যে লিখলাম পৃথিবীতে যখন শব্দ-ভাষার উদ্ভব হলো তারই আবেগের সঞ্চারণ কবিতা। তখনকার সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, সুখ, দুঃখ, জীবনবোধের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতাকে যিনি প্রথম প্রাণের গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন তার ধ্যানমগ্নতা, সন্ন্যাস পৃথিবীর সর্বময় পাঠিয়েছেন; নিশ্চয় সঞ্চারণ-মোহই শুধু নয় তাতে সংবেদনমাত্রাও যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার সে নিঃশ্বাস-বিশ্বাস ক্রমশ প্রসারিত হয়ে আসছে। আজ সে শুধুমাত্র একটি গ্রহ নয় একাধিক গ্রহে প্রসারিত হতে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে প্রথম সংগীত পরিবেশন করতে যাচ্ছেন সংগীততারকা ম্যাডোনা। একদিন কবিতাও পঠিত-যন্ত্রিত হতে পারে! এভাবে শুধুমাত্র স্যাটেলাইট গ্রহ-উপগ্রহই নয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রহ-উপগ্রহেও প্রাণের অস্তিত্বমাত্রই সেখানে ভাবাবেগ বিস্তারিত হতে পারে। আর ভাবাবেগের সরব উপস্থিতি মানেই ধরে নিচ্ছি প্রকৃত কবিতার সঞ্চারণ হলো এবং হতে থাকলো।
এভাবেই কি পাঠক-শ্রোতাকে কবিতা / কবিতার ভবিষ্যত বোঝাতে চাওয়ার পাণ্ডিত্য অর্জন সম্ভব! কবিতা কথার ঝুড়ি, শব্দের নবাগত পেলভতার আতিথ্যবরণই শুধু নয়। কবিতার জন্য দরকার হৃদয়ের উপলব্ধি। যেকথা আমি বোঝাতে চাই সেকথা হয়ত কবিতা হৃদয়ের কোনো অংশই স্পর্শ করলো না। সেজন্য একজন পাঠকের প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা আর প্রকৃত কবিতা উদ্ঘাটন। পাঠকের এই উদ্ঘাটন-উদ্ভাবনের মধ্যেই কবিতার ভবিষ্যত পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু মুশকিল আছে, কবিতার ভবিষ্যত নির্ধারণ করা তার পক্ষেও সম্ভব হবে না এই জন্যে যে, আজ যে কবিতা লিখিত হয়নি সে কবিতা ভবিষ্যতের কোনো কবি লিখে ফেলতে পারে। তখন কবিতার ভবিষ্যত নামের কাক্ঙ্ক্ষিত সাফল্যটি অর্জিত হয়ে যেতে পারে। অন্যঅর্থে ‘ভবিষ্যত’ ব্যাপারটি তাহলে কী দাঁড়ায়? সেটা কী সভ্যতার পর সভ্যতাধরে কবিতাকাল অতিক্রান্ত হওয়ার সময় হবে? নাকি যেকোন ব্যাপার-বিষয়ের নির্ভরতার মতোই কোনো ঘটনা! তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কবিতার ভবিষ্যত আছে। আজ থেকে পাঁচহাজার বছর পূর্বের কবি ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র কথা ভাবা যেতে পারে। মেয়েদের হাত ধরে পুরুষদের সাংস্কৃতিকচর্চার ভব্যতা থেকে যার সমস্ত সৃষ্টিকর্মই প্রায় বিলীন ছিলো, দীর্ঘবছর অপঠিত এবং অনাবিস্কৃত থাকার পর এই সময় তার কবিতা আবিষ্কৃত হওয়ার কথা নয়। স্বল্পদীর্ঘ সময়ের যেসব সভ্যতা আমাদের থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সেখানেও কী কোনো কবি ছিল না? প্রায় ১০ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মিসরীয় ফাঁরাও সভ্যতা কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো কোনো স্যভতাতেও। বিষয়টি তাও নয়। এযাবত লিখিত সব কবির কবিতা থেকে যদি কোনো কবির কবিতা যদি কাঙ্ক্ষিত সেই সময় অতিক্রম করে তাহলে এই কবিতাকে ভবিষ্যতের কবিতা বলার ব্যক্তিটিই বা কে হবেন? নিশ্চয়ই আজকের কোনো প্রশ্নকর্তার সে ভবিষ্যত দেখা সম্ভব নয়। ব্যক্তিমাত্রই ইতিহাস থেকে অতীত-ভবিষ্যত যতটুকু জানতে পারে সেটি কোনো সভ্যতাকে অতিক্রম করে না। আবার জাতি অর্থেও এই সময় রেড ইন্ডিয়ানদের আমরা আর পাবো না। কিন্তু এখানেও তো ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হয়ত রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই ভবিষ্যতের সেই নির্বাচিত কবি ও তার কবিতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাপানের হিরোশিমার কথাও ভাবি আমরা, ভবিষ্যতের কবিতা কি ওখানেই ছিলো? যদি তাই হয় তাহলে ভবিষ্যতের কবিতা নিশ্চয়ই ওখানে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য, যা আমরা আর ফিরে পাবো না।
কাহ্নপাদানাম, কৃত্তিবাস, জ্ঞান দাস, কালিদাস, দৌলত উজীর বাহারাম খান, আলাওল, দ্বিজ কানাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর, নাহিদ হাসান এরকম অনেক কবি-লেখক রয়েছেন যারা লেখকের দৃষ্টিগোচরে রয়েছেন। বাংলা কবিতার এইসব কবিদের মধ্যে কোনো কোনো কবির নাম ওঠে আসে শতাব্দি শতাব্দি কাল ধরে, যদিও এরমধ্যে কারো কারো কবিতা রচনাকাল দশকমাত্রই অতিক্রম হয়নি। এঁদেরও কেউ কেউ শতবর্ষ অতিক্রম করে সহস্রাব্দ, লক্ষাধিক বছর পঠিত-চর্চিত থাকতে পারেন কিন্তু মহাকালের বিবেচনায় সেটি হয় ভগ্নাংশকাল। এই ভগ্নাংশকালই অতিক্রম করার যে লক্ষবিন্দু ধরে নিই সেটিই আসলে কবিতার ভবিষ্যত। ভাবাবেগ থাকলেও সেই ভবিষ্যত কী মানুষের আকার থেকেই প্রকাশিত হবে, কেউ হয়তো জানবে না।
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই এই প্রশ্ন তোলবেন যে কবিতার ভবিষ্যত কী? তার পক্ষে কবিতার বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাকে অযথাই এই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতার ভবিষ্যত। একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন তার কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুন বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জনক। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকেই আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার, আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবন বোধ এইসব অসংখ্য কাজ এক নয়। কবিতাও তাই অজস্র বছর চলতে চলতে ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি। হয়তবা ভবিষ্যতে আমরা এর আরো আরো অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পক্ষে অসম্ভব যতক্ষণ না তিনি কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত অধ্যাপক, সমালোচকদের। একাডেমিক ধারণার ক্ষেত্রে আমি বলবো অধ্যাপকগণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হলেও সমালোচকমাত্রই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হন না তবু আমরা এ দুয়ের উপর ভরসা করতে পারি। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেওয়া’। সেদিক থেকে মূলত রিডার্স অর্থে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শুরুতেই ছাত্রদের কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে তা উপলব্ধি করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না যখন দেখি আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে পাঠপর্ব শেষ। এই হীন অবস্থার দায় নিশ্চয়ই ওই অধ্যাপক / সমালোচকদের। কবিতার ভবিষ্যত প্রশ্নটি করার আগে ওইসব অধ্যাপক / সমালোচকদের কানে কাঠি ঠেলে কবিতাপাঠ ধারণাটি প্রবেশ করানো জরুরি। কেননা এই কবিতাপাঠ ধারাবাহিকতাই একসময় কবিতার ভবিষ্যত গন্তব্যে কবিতাকে নিয়ে যেতে পারে। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তাহলে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। তবে মর্মে উপলব্ধি করার ব্যাপরটি বাদ দিতে পারি কারণ জ্ঞান মহাশয়ও যে জ্ঞান চুরির ঘটনায় দোষি সাব্যস্ত হবেন না ভবিষ্যতে, তাইবা হলপ করে কে বলতে পারে?
লিখছি কবিতার ভবিষ্যত অর্থাৎ কবিতার চলমান সময় পেরিয়ে ভবিতব্য আগামীর কথা প্রসঙ্গত কয়েকটি কথা এসে হাজির হলো। যেকোন প্রাণী জন্মমাত্র তার মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে আসে। আসন্ন মৃত্যুকে সামনে রেখেও সে আরো বাঁচতে চায়। যতটা জীবন পেরুয় ভাবে কিছুটা ভুল রয়ে গেল আর ভাবে আগামীতে সে ভুল শুদ্ধ করে নেবে। এমন আশায় আশায় সে আরো আরো বেশি সময় বাঁচতে চায়। এ ভাবনা তার মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বহাল থাকে। কবিতাও তেমন, সব কবিতা পাঠকের নয় কোনো কোনো কবিতা পাঠকের। কাজেই যে কবিতা পাঠকের নয় সে কবিতার জন্মমাত্রই মৃত্যু হলো। এরকম সব কবিতাই যদি পাঠকের হাতে মৃত্যুর মুখে পড়ে তাহলে তো নির্দিষ্ট কবিতার জন্য অন্তত ভবিষ্যত বলেও কিছু থাকছে না।
একথা সত্য যে পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্ব, প্রাণের ভাষা, প্রাণের ভাবাবেগ যতদিন থাকবে ততদিন কবিতাও পরম্পরায় বেঁচে থাকবে। একটি দিন পেরিয়ে মানুষ যেমন তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরবর্তী দিন তা আবার শুধরে নিয়ে সচল পথে হাঁটে। ঠিক তেমনই কবিতাও তার ভুলগুলি অতীত করে শুদ্ধতার দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। কেননা তিনিই স্বচ্ছ কবি যিনি তার ভুলগুলি লিখেছেন, শুদ্ধগুলিও লিখেছেন এবং ভবিষ্যতেও লিখবেন। সেদিক বিবেচনা করলে পৃথিবী যত সমাধানের দিকে এগুচ্ছে আমরা মনে করি কবিতাও সে পথেই এগুচ্ছে ক্রমশ, একটি সুনির্দিষ্ট সমাধানের জন্য। কবিতা বারবার পাঠে যা মনে হয়, আমাদের শব্দভাণ্ডার কম নয়। আবহমানকালে যা আমরা পাঠ হিসেবে পেয়েছি তা এর বিন্দুমাত্র। ফলে আগামীতে কবিতার পথ আরো আরো অনেক প্রসারিত হবার সম্ভাবনায়... যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তিভাবনা, নানা টেকনিক, ফিকশন-ডিকশন, কবিতা হয়ে ওঠছে আরো সাবধানি... জীবন ঘনিষ্ট... তত্ত¡বহুল... আরো যুক্তি নির্ভর... এ আমরা বিশ্বাস করি।

চিরায়ত লোকমানসের কথাসাহিত্যিক, সংগঠক খালেকদাদ চৌধুরী

কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত লেখক খালেকদাদ চৌধুরী। তাঁর একটি গল্প পাঠের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ২০০২ সালে। গল্পটির নাম ‘আবর্ত্ত’। সম্পাদকীয় লেখা থেকে জানা যায় এটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ রচনা। গল্পটি একজন প্রৌড়ার জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত। জনৈকা প্রৌড়ার পারিবারিক অস্তিত্ব, দাপট, ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে বিরোধিপক্ষের আঘাতে একে একে সাতটি সন্তানের মৃত্যু হয়। অথবা বলা যায় একমাত্র মাতৃপ্রীতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে সাতটি ছেলের আত্মাহুতির ঘটনা। গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা, আমার এ মতের কারণ নিশ্চয়ই জানবেন যে, গল্পটিতে পরিষ্কার কোনো বিষয়বস্তু (থিম) পাঠকের দরবারে তুলে দেওয়া হয়নি। বাস্তব কিংবা কল্পিত আখ্যান এটি; এরকম বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। যাহোক, গল্পটি আমার মধ্যে কৌতূহলী পাঠকসত্ত্বার উন্মোচন ব্যাতীত বিশেষ রেখাপাত করেনি তখন। তবু জন্মগতভাবে নেত্রকোণার একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম নিশ্চয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা লেখা বাহুল্য মনে করি, তাঁর ‘আবর্ত্ত’ গল্পটি না পড়লে জানতাম না যে, তিনি নেত্রকোণায় জন্মেছিলেন। সম্ভবত ভুল তথ্যেই আমি জানতাম খালেদা এদিব চৌধুরী নামে একজন নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণকারী লেখক। এই ‘আবর্ত্ত’ গল্পটি থেকেই মূলত খালেকদাদ চৌধুরীর সমগ্র সাহিত্যকীর্তিতে আমার অনুপ্রবেশের সূত্রমুখ ও সৃষ্ট অন্বেষী অভিপ্রায়। কালের বিচারে খালেকদাদ চৌধুরী ছিলেন বিগত শতকের ত্রিশের দশকের কথাসাহিত্যিক। এখানে উলেøখ রাখা ভালো যে, তাঁর ক্ষেত্রে এই ত্রিশের দশকের লেখক বিবেচনা কখনো কখনো সাহিত্যিক বিতর্কের কারণ হয়ে ওঠতে পারে। ছাত্রজীবনে ১৯২৩ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বিকাশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ এবং পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক কবি বন্দে আলী মিয়া তাৎক্ষণিক আরো লেখা চেয়ে চিঠি লিখলে যথারীতি ছোটগল্পসহ বেশ কয়েকটি লেখা প্রেরণ ও মুদ্রণের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রাথমিক সাহিত্যের অবতাড়না হলেও তিনি প্রকৃত সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ১৯৩০ সালের পরে, কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতাকালীন প্রধান শিক্ষক কবি আবদুল কাদিরের অন্যতম সাহচর্যে। ফলে তাঁকে লেখককাল বিবেচনায় চল্লিশের লেখক বলে যদি কেউ প্রজ্ঞা করেন তাতেও খুব বেশি ভ্রম হবাব অবকাশ নাই। আমি তাঁকে জন্মকাল ধরেই সাহিত্যিক বিবেচনায় এনেছি। কাজেই এ বিষয়ে অন্তত দ্বিমতপোষণ বা সংঘশক্তি প্রয়োগে চূড়ান্ত দশক নির্ধারণ প্রবৃত্তির প্রয়োজন পড়বে না।
তাঁর সমকালে তিনি খুব জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন আজকের বিশ্লেষণী সাহিত্য বিবেচনায় সেটি হলপ করে বলা মুশকিল। বরং তাঁর সময়ে উচ্চ সাহিত্যমার্গ বিবেচনায় তিনি কিছুটা পিছিয়েই ছিলেন, বোধ করি প্রতিবেশ এবং পেশাগত সাহিত্যিক, সামাজিক অবস্থানই এর প্রধান কারণ। কথাবস্তুতে খালেকদাদ যে বিষয় এবং ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা ছিলো বৃহত্তর ময়মনসিংহের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক কোনো কোনো প্রেক্ষাপট। বলা যায় চিরায়ত বাংলার সুবর্ণ-সবুজ অধ্যায় তথা লোকমানসই তাঁর সাহিত্যের মূলভিত্তি। কবিতায় পল্লিকবি জসীম উদ্দীন, কথাসাহিত্যে এ সময়ের শওকত আলী (প্রদোষে প্রাকৃতজন-এ) যে বিষয়ভিত্তিক অবস্থানে সফল ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই মূলত খালেকদাদ চৌধুরীর মূল কথাভাষ্যটি নির্মিত হয়। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ তিনি যে কোথাও কোথাও জনপ্রিয় ছিলেন সেই দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের পত্রতাগিদে।
ব্যক্তি জীবনের অবদমন প্রথা কখনো কখনো লেখকের সাহিত্যকীর্তিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শুধু লেখক বলে নয়, সামাজিক এই দুর্ধর্ষ অবদম অনাকাক্ঙ্ক্ষিতভাবে যে কারোরই মধ্যে জারিত হতে পারে। বোধ করি খালেকদাদ তাঁর সাহিতত্যিক জীবনে এই অবদমনের শিকার। ফলে সাহিত্যিক অবস্থানসহ তাঁর পশ্চাদপদতা ব্যাতীত কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারভূঁঞা আমলের অন্যতম বংশাতিবংশ তাঁরা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমলে কোম্পানি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁদের পূর্ব-পুরুষ ঢাকার গাজীপুর অঞ্চলে আশ্রয় নেন। পরবর্তিতে তাদেরই অধস্তন পুরুষ গাজী লস্কর ও গাজী আসকর নামে দুই ভাই আলপসিং পরগনায় চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। ছোটভাই গাজী আসকর নেত্রকোণা অঞ্চলের আটপাড়া থানায় সোনাজোড় গ্রামে স্থায়িভাবে বসতি গড়ে তোলেন। খালেকদাদ চৌধুরী এই গাজী আসকরেরই অধঃস্থন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন। ধারণা করা যায়, তাঁর পরিবার ঐতিহাসিক এতবড় একটি পরাজয়ের যে গ্লানি বহন করে চলেছিল এর বৃহত্তর প্রভাবও খালেকদাদের সাহিত্যিক প্রবণতাকে কোথাও কোথাও অবদমিত করে রেখেছিল অবচেতনে। মহাত্মা আহমদ ছফার যুক্তি (থিয়োরি) এখানে যোগ করতে চাই। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ লিখতে গিয়ে তিনি এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলেন যে, সামাজিক জীবনে আমরা চলায়, ফেরায়, বলায় তথা কর্মে এরকম একটি উপাসক প্রতিমূর্তি (আইডল) নির্মাণ করি, যেটি আমাদেরই ঈশ্বরের প্রতিরূপ পূজনিয়। নির্মাণের কারিগর ব্যাক্তি (আমাদের) কথা বাদ দিলে অন্তত উক্ত উপাসক বা প্রোফেট চরিত্রটির নিজস্ব ভাবাবেগ, স্বকিয়তা বা পার্সোনালিটি থাকে না। মোতাহার হোসেন চৌধুরীর যুক্তি অবশ্য এর বিপরীতে। ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে তিনি এই ঈশ্বরের প্রতিরূপ ব্যক্তিস্বত্তাটি নিজের মধ্যেই স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আমার আজকের অবস্থান সেখানে নয়। খালেকদাদ তাঁর সাহিত্যকীর্তিতে এইরূপ অনাকাক্ঙ্ক্ষিত প্রভাব, প্রবণতা দ্বারা কোথাও তাড়িত হননি সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হওয়া যায় না। এতদস্বত্ত্বেও উপন্যাসে তাঁরই সৃষ্টি সেইরূপ কোনো কোনো চরিত্র যেন আমাদের (পাঠকের) দরবারে আর্তি জানিয়েছে বারবার। ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে দিয়ারিশ, ‘চাঁদবেগেড় গড়’এ ডাকাত চাঁদবেগ, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ গায়বী বাবা তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
এ যাবৎ আমার খালেকদাদ রচিত উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’, ‘চাঁদবেগেড় গড়’, আত্মজীবনী ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’, অনুবাদ-ভ্রমণ ‘মরু সাহারায়’, ইতিহাস গ্রন্থ ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ছোটগল্প পাঠব্যাতীত আর কোনো গ্রন্থপাঠের সৌভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি কেননা তাঁর সকল গ্রন্থই এখন অনেকাংশে পাওয়া দুর্লভ। খালেকদাদ চৌধুরী রচিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব মিলিয়ে ১৫টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে উল্লেখিত গ্রন্থগুলো ব্যাতীত উপন্যাস ‘এ মাটি রক্তে রাঙা’, ‘অভিশপ্ত মসনদ’, ‘শেষ রণাঙ্গন’, ‘বেদুঈনের মেয়ে’, ‘আলবকর দ্বীপ’ দুটি অনুবাদ গ্রন্থসহ বেশকটি অনুবাদ গ্রন্থও তাঁর রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এইসব গ্রন্থসমুচয়ের প্রকাশকগণ গ্রন্থগুলোর প্রকাশনা, পুনমুদ্রণ বিষয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ আজো নিচ্ছেন না। খালেকদাদ চৌধুরীর ভাতিজা, নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের অন্যতম সংগঠক, সম্পাদক কামরুজ্জামান চৌধুরীর বরাতে জানা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ ইতিহাস অনুবাদ গ্রন্থটি চারখণ্ড একত্রে সম্প্রতি দিব্য প্রকাশের সত্ত্বাধিকারি মঈনুল আহসান সাবের প্রকাশ করেছেন। ০২ ফেব্রæয়ারি ২০০৭ তাঁর জন্মের ১০০ বছর এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ২৪ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি বাংলাদেশে, বাংলাভাষার বাঘা এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি খালেকদাদ চৌধুরী রচনাবলি প্রকাশের কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রকাশনা সংক্রান্ত কোনো খোঁজ-খবরও নেয়নি। উল্লেখ্য তাঁর সময়ে মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, দিলরুবা, যুগবাণী, সচিত্র সন্ধানী, পাকিস্থান খবর, প্রতিধ্বনি এইসব বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকায় বিভিন্ন সময়-সংখ্যায় লেখা ছোটগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রবন্ধ, (প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়ে) লেখাগুলোর সন্ধান, সংরক্ষণ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ কথাটি সর্বাগ্রে সত্য না হলেও কখনো কখনো তা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে সমাজের সঠিক দর্পণই বলা যেতে পারে। আর উপন্যাস, গল্পের ক্ষেত্রে যেখানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কাহিনী, নাটকীয়তা, চরিত্র তথা আখ্যান বিবৃডিতটিই হয়ে ওঠে সমাজের দর্পণ সেখানে কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর রচনায় এই গুণাগুণ অনেকাংশেই বিস্তৃত। তাছাড়া এই বৈশিষ্টটিতাঁর স্বভাবজাত, যাপিত জীবনের মধ্যেই ছিল। কখনো উপমাগুণে, কখনো রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে কল্পনায় আবার কখনো তিনি ঐতিহাসিক সত্যেই নির্মিত করেছিলেন গ্রমীণ জীবনের বিশুদ্ধ আখ্যান বা তাঁর দুর্লভ কথাভাণ্ডার। এমনই একটি বিশুদ্ধ আর্তিতে ওঠে আসে তাঁর উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’। প্রধান চরিত্র দিয়ারিশ। আমরা দেখি, তৎকালিন পাষণ্ড সমাজ ব্যবস্থায় কূটচক্রের শিকারে কী করে নির্দোষ দিয়ারিশের জীবন বিপণ্ন হতে হতে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। প্রথমে গ্রামবাসির কূটচক্রের শিকার। সুন্দরী স্ত্রীসহ রাতে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র এক জমিদারের আশ্রিত। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে বিশ্বস্ততা অর্জন। সেখানেও স্বস্তিতে থাকে না দিয়ারিশ। জমিদার-বধূ কর্তৃক পুনরায় কূটচক্রের শিকারে দীর্ঘ জেলযাপন। অবশ্য এ স্থানে এসে ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে ঔপন্যাসিক খালেকদাদের প্রবল নাটকীয়তা উপলব্ধি করা যায়। দিয়ারিশের সুন্দরী কন্যার প্রেমেমুগ্ধ জমিদারের দুইপুত্র। একে-অপরের দ্বন্দ এবং এক ভাইয়ের হাতে অন্য ভাই খুন হওয়ার ঘটনাটিই মূলত ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’ উপন্যাসকে এবং ঔপন্যাসিক খালেকদাদ চৌধুরীকে যথার্থ ঔপন্যাসিক মর্যাদায় উন্নীত করে। আর করুণ আর্তির দিয়ারিশ চরিত্রটি হয়ে ওঠে তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক নায়ক।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ খালেকদাদ চৌধুরীর কথাসাহিত্যিক প্রবণতা আরো ঝরঝরে, উজ্জ্বল। গল্পচরিত্র গায়বী বাবার মধ্য দিয়েই তিনি বিবৃত করেছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফকির বিদ্রোহের কাহিনী। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ সত্যিকার নায়েবে নাজেম মজনু শাহ (নবাব নূর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জঙ্গ বাহাদুর) এর কাহিনী। কিছুটা কল্পনাশ্রয় ব্যাতীত উপন্যাসটি ঐতিহাসিক সত্যেই রচিত। গায়বী বাবা চরিত্রটি যে খালেকদাদের স্বয়ং সে বিষয়ে ঘাগু পাঠকমাত্রই সহজে অনুমেয়। উপন্যাসটি তাঁর পূর্বপুরুষাশ্রয়ী, সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, কোম্পানি যুদ্ধ, মীর জাফর, মীর কাসিম, রাজা রাজবল্লব, জগৎ শেঠ, ফকির নেতা মজনু শাহ, টিপু পাগলা, জেনারেল কীড, এইমলি এইসব চরিত্র তথা ঘটনা বর্ণনাই তা প্রমাণ করে। উপন্যাসটি রচনায় খালেকদাদ কেন যে সম্পূর্ণ ইতিহাসাশ্রয়ী হননি সেটি অবশ্য প্রশ্নই থেকে যায়। এ বিষয়ে তার নিজের ভাষ্য...
‘দিলিøর মোঘল সম্রাট আকবর, ঈশা খাঁ-কে যে বাইশটি পরগণা দান করেছিলেন, শেরপুর দক্ষবাড়িয়া তার অন্যতম। ঈশা খাঁ-র শেষ জীবনে তার দৌর্বল্যের সুযোগে তাঁর সেনাপতি আফগান গাজীরা শেরপুর দক্ষবাড়িয়া, ভাওয়াল পরগণা এবং মজলিশরা, খালিয়াজুড়ি ও নাসিরুজিয়াল পরগণা কেড়ে নিয়ে নিজেদের সেখানকার স্বাধীন ভূ-স্বামী শের আলী গাজীর নামানুসারে সে পরগণার নাম হয় শেরপুর। শের আলী গাজীকে এক হীনষড়যন্ত্রজালে জড়িত করে শেরপুর জায়গীরদারী থেকে বঞ্চিত করা হয়। কথিত আছে যে, দর্শার কানুন গো সেরেস্তাদার কর্মচারী বৈদ্যরাজবল্লব মজুমদারের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর প্রতি শের আলী গাজী আকৃষ্ট হন। তিনি নাকি তাকে লাভ করার জন্য গোপনে রামবল্লবকে হত্যা করান। রামবল্লবের স্ত্রী পালিয়ে তার পিত্রালয় মুর্শিদাবাদে চলে যায় এবং নওয়াব দরবারে শের আলীর বিরুদ্ধে নালিশ করে। শের আলী গাজীকে পদচ্যুত করে তার জায়গীরদারী রামবল্লবের বিধবাকে দান করেন।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’-এর পটভূমিকা এ পর্যন্তই। বাকিটুকু নিছক উপন্যাস এবং কল্পনাপ্রসূত। উপন্যাসের সার্থকতা পাঠকের বিচারের উপর নির্ভরশীল, সে ভার সহৃদয় পাঠকের / পাঠকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
স্বাধিনতা দিবস ১৯৬৬, নেত্রকোণা খালেকদাদ চৌধুরী
আমাদের অতীত মানে সুবর্ণঅতীত। আমরা অনেক কিছুই স্মৃতিতে রাখি না। এটা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যজনক! এ স্থানে এসে আবিস্কৃত হয় যে খালেকদাদ চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ উপন্যাসের মূল ভিত ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলের ফকির অভিযান থেকে শুরু করে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত শেরপুর নছরত শাহী পরগণা, টিপু পাগলের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধিন হওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আজকের সময় পর্যন্ত এসে যদি গড় বিবেচনায় স্থিত হই যে এই উপন্যাস খুঁড়ে-ছেনে বাঙালি জাতির অন্তত ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের সূত্রমুখ তথা সত্যাসত্য ঘটনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে। তাতেও পাঠকের অত্যুক্তি হওয়ার অবকাশ থাকবে না। স্থানিক, ভাষিক উপস্থাপন-এষণা এবং সে বিষয়ে যৌক্তিক অবতাড়না আজ আর নয়। তাঁর সময়ের অনেক লেখককেই তো আরো বিস্তৃত ব্যাপক প্রকাশনায় পেয়েছি, জেনেছি। এমনকি পাঠ্যসূচিতেও। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রসংগ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। খালেকদাদ চৌধুরীর সাংবাদিক জীবনে যিনি ছিলেন দৈনিক নবযুগ প্রধান সম্পাদক এবং সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব বা সাংবাদিকতা সংসর্গই নয় কবি নজরুলের সাহিত্যিক সংসর্গেও যে খালেকদাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন সে সম্পর্কে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দিন খালেকদাদ লোকান্তরিত হওয়ার পর এক নিবন্ধে লিখেন...
সেকালের তরুণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য তারকা জ্বলছিল, যার যতটুকু ক্ষমতা সেইমতো আলো বিকিরণ করছিল। একে একে সবাই বিদায় নিচ্ছেন। খালেকদাদ চৌধুরীর পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ তারকাটি খসে পড়লো।’
কবি নজরুলের কিংবদন্তি সাহিত্যের তুলনা না করলেও খালেকদাদ চৌধুরীর সমকালিন সাহিত্যিক কবি জসিম উদ্দিন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবু জাফর শামসুদ্দিন, শওকত ওসমান প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরীসহ অনেকের লেখা আমরা ব্যাপক প্রকাশিত ও পাঠ্য হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু খালেকদাদ অপঠিত থেকে গেছেন। এটা সত্য এবং লজ্জাকর।
কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, তিনি বিবৃতিপ্রধান লেখক ছিলেন। উপন্যাস, গল্পের প্রধান চরিত্রটির মধ্য দিয়ে গল্প তৈরির অভিনব কৌশুলীয় ছিলেন বটে। এই কৌশলের মাধ্যমেই তিনি তাঁর উপন্যাস, গল্পের মূল বিষয়টির ইংগিত প্রদান করতেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই গল্পময়তা বিষয়টি কথাসাহিত্যের আদিতেই ছিল। স্থান, কাল, পাত্র এবং ব্যাপ্তীগুণেই কথাসাহিত্যের পাঠক / শ্রোতাগণ উপন্যাসের সঠিক অবস্থানটি শনাক্তকরণ বা অভিযোজনের কাজটি সমাপ্ত করতে পারতেন। ‘চাঁদবেগের গড়’এ এসে প্রবলভাবে উপলব্ধি হয় যে, তাঁর এ উপন্যাসটি শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের দুঃখ, দুর্দশা তথা দৈন্যপীড়িত মানুষের প্রপীড়ণের চিত্রই নয় বরং এর ভিতরেই লুকিয়ে ছিল জাতিগত প্রপীড়ণমালার অন্য এক ইতিহাস। অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া, নীলকর, বৃটিশদের অত্যাচারের বিপরীতে ডাকাত চাঁদবেগের ভূমিকাটি যে প্রতিবাদী সত্ত্বাই ছিল সে বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ উন্মোচন করেন নাই। সে সময় কথাসাহিত্যের মননের চর্চায় তার প্রয়োজন হতো না নিশ্চয়ই। ডাকাত চাঁদবেগের সেই অপ্রকাশিত মহিমা বস্তুটিই ছিল পাঠকশিক্ষার জায়গা।
কথাসাহিত্যে খালেকদাদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি রোমান্টিকতা বর্জিত লেখক ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালুতে যেমন রোমান্টিকতার প্রয়োজন ছিল না। ঠিক তথাকথিত অর্থেও নয় তাঁর লেখক বৈশিষ্ট্যটেও বোধহয় বিষয়টি ছিল না। অনেকানেক যুক্তি হলো, ইতিহাস বিবৃতিই এর প্রধান কারণ ছিল। তাই বলে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’কে যদি কেউ রোমান্টিকতা বর্জিত আধুনিক উপন্যাস ভাবেন সেটা ভুল হবে। বরং বিষয় বিবেচনায় এ দুটি উপন্যাস অধিক সঞ্চারিত করে আমাকে। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর সময়ে অপঠিত ছিলেন বিষয়টি সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্যজনক কিংবা লজ্জাকর না ভেবে এরকম বিষয় ভাবা যেতে পারে। সমস্যা এখানেও আছে, কোনো রোমান্টিকতার ছাঁচে ফেলে তাঁর প্রবণতাকে খারিজ করা অসম্ভব। সিরিয়াস কথাসাহিত্য পাঠকের কাছে অন্তত এই যুক্তি অবান্তর ঠেকতে পারে। কথাসরিৎসাগরের টোটালিটি ধারণ করে যদি কোনো পাঠক বিষয়টি রোমান্টিক বলে আমলে আনেন তবে সেখানে যুক্তি প্রযোগের চেষ্টাও বৃথা যেতে পারে। পাঠক ক্যাটাগরিই মুখ্য। আজকের বিবেচনায় খালেকদাদ অবশ্য অন্য এক অনন্য সাহিত্যমাত্রিক সামগ্রিক।
খালেকদাদ চৌধুরী নামটি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিক পরিচয়েই নয় প্রত্যক্ষ একজন সমাজ সংগঠকের ভূমিকাও যথার্থ উজ্জ্বল। ষাট-সত্তুর-আশির দশকে খালেকদাদ চৌধুরী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ এবং ‘সৃজনী’ নামক ছোটকাগজটি ঘিরে নিভৃতপ্রায় একটি মফস্বল শহরের তথা সারাদেশের অগ্রজ-অনুজ লেখকদের মধ্যে যে চঞ্চলতার ধারা প্রবাহিত হয়েছিল, সেই কৃতিত্বও খালেকদাদ চৌধুরীর নিজের মহিমাগুণে। এই ‘উত্তর আকাশ’ থেকেই আমরা পেয়েছি নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘নূতন কাণ্ডারী’ (যিনি আজকের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ)। এছাড়াও রওশন ইজদানী, জালাল উদ্দিন খাঁ, রফিক আজাদ, নূরুল হক, আসাদ চৌধুরী, হুমায়ূন আজাদ, আশরাফ সিদ্দিকী, বশির আল হেলাল, আহমদ রফিক, শামসুল ইসলাম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, হেলাল হাফিজ, শামসুল আরেফিন, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ লেখকদের বিভিন্ন রচনা আমরা পাঠ করেছি ‘উত্তর আকাশ’ ও ‘সৃজনী’ থেকেই। নির্মলেন্দু গুণের নিজের লেখা থেকে এ কথার সত্যতা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে...
‘আমি এক কথায় বলতে পারি, তিনি, খালেকদাদ চৌধুরী আমাদের নেত্রকোণার দর্পণ। তাঁর উদার নেত্রের কোণায় ছায়া ফেলেছিল এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ। তিনি সেইসব মানুষের সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন সাফল্যের সঙ্গে তাঁর উপন্যাসে, গল্পে। সেকথা আমরা তাঁর রচনা থেকে জানি। কিন্তু নেত্রকোণার মতো আর্য-অগম্য একটি মফস্বল গ্রামে জন্মগ্রহণ করে, তিনি কিভাবে বিভাগপূর্ব কলকাতার রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক কল্লোলে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, সেখানে তাঁর ভূমিকা কী ছিল তা আমাদের সকলের জানা ছিল না। আমাদের জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি এঁকেছেন ওই সময়ের রেখাচিত্র। ফলে, নবজাগরণ প্রত্যাশী মুসলমান সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা, কবি নজরুল, মাওলানা আকরাম খাঁ, ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, কবি আবদুল কাদির, বন্দে আলী মিয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি মহীউদ্দীন-এঁরা সবাই খালেকদাদ চৌধুরীর নেত্রকোণায় কিছুটা ভিন্নভাবে ধরা পড়েছেন।’
নেত্রকোণা জেলার প্রথম গ্রাজুয়েট ও নেত্রকোণা পৌরসভার প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান, আঞ্জুমান হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আইনজীবী মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান নেত্রকোণার আপামর মানুষকে নির্দেশনা দিতে যে সুন্দর শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, বলা যায়, খালেকদাদ চৌধুরী তারই বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে। নেত্রকোণা সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতার সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না। গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রবীণ কর্মকর্তা মোর্শেদ আলী খানের দেয়া তথ্যমতে, প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলী ওসমান সিদ্দিকী। খালেকদাদ চৌধুরী দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকাকালিন গ্রন্থাগারটি বকুলতলায় একটি বড় পরিসরে স্থানান্তর এবং দ্বিতল ভবন নির্মাণে তাঁর বিশেষ অবদানই প্রধান ভূমিকা ছিল। নেত্রকোণার আজকের গণমানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্যে অগ্রণী ভূমিকায় নিয়ে আসতে মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান ও কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর ভূমিকা অমলিন, অনসীকার্য। সৈয়দ শামসুল হকের একটি উদ্বৃতি দিয়ে প্রবন্ধের প্রাথমিক অবতাড়না সমাপ্ত রাখছি...
‘এই শহর (নেত্রকোণা) ও অঞ্চল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পেলাম এখান থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র সৃজনীতে। শুধু ইতিহাস নয়। এখানকার লেখকদের সৃষ্টিশীল লেখারও ভালো সাক্ষাতও পাওয়া গেল এর পাতায়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করি যে, ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত বলেই পত্রিকাটি সাহিত্য সংস্কৃতির মূলধারা থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন নয়। খুবই উন্নতমানের এই সাহিত্য পত্রিকাটি আমি যে আগে কখনো দেখিনি, একটু লজ্জিত বোধ করলাম; সর্বাধুনিক সংখ্যাটি দেখতে চাইলাম। জানতে পারলাম এর সম্পাদক খালেকদাদ চৌধুরী লোকান্তরিত হবার পর এখন পর্যন্ত এমন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সম্পাদনার দায়িত্ব বহন করতে পারেন। কাজেই পত্রিকাটি বের হয় না। এটিও আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো।’
তথ্যসূত্র:
১. ছোটগল্পের কথা: রথীন্দ্রনাথ রায়, সুপ্রকাশ প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-১৯৫৯
২. বাঙালি মুসলমানের মন: আহমদ ছফা, বাংলা একাডেমি-১৯৮১
৩. শতাব্দীর দুই দিগন্ত: খালেকদাদ চৌধুরী, সুনেত্র-১৯৯৫
৪. জীবনী গ্রন্থমালা, খালেকদাদ চৌধুরী: ইমামুর রশীদ, বাংলা একাডেমি-১৯৯৭
৫. উত্তর আকাশ (পাক্ষিক)
৬. সৃজনী (সাহিত্য পত্রিকা): ১৩তম সংখ্যা, বৈশাখ-১৩৯১, এপ্রিল-১৯৮৪
৭. স্টাইলের দড়ি-খুঁটি, একটি বাস্তবের সামিয়ানা: সাধন চট্টোপাধ্যায়, নিসর্গ: সম্পাদক-সরকার আশরাফ
৮. সওগাত: বৈশাখ-১৩৪০ সংখ্যা
৯. মাহে নও: মার্চ ১৯৫৬, চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যা
১০. মাসিক মোহাম্মদী: ১০ম বর্ষ, ৭তম-৮ম-৯বম সংখ্যা

মৃদু বিনয় কম্পন

জীবদ্দশাতেই কবিতার শহীদ বলে খ্যাত কবি বিনয় মজুমদার। কাহ্নুপা থেকে বিহারীলাল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ এবং তৎপরবর্তী জীবনানন্দ, শক্তি, সৈয়দ হক, কাদরী, উৎপল পেরিয়ে বাংলা কবিতার আরো একজন উজ্জ্বলতম কবিতাকুহক। বিনয়ের কাব্য পাঠান্তে যেকোনো পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন যে, তাঁর কাব্যভাষাটি মূলত সারল্যের ভাষা, অরবৃত্ত গদ্য-ছন্দের গাঁথুনিতে কখনো টলে পড়ে না। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও যে ঘটেনি তা নয়। এর কারণ, বিনয়ের খোঁজ-খবর যারা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে থাকেন তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, বিনয় তাঁর চিন্তা-চেতনায় অধিক সময় অবচেতনে বিচরণ করেছেন। এই ‘অবচেতনে’ শব্দটি কেবল বিনয়ের ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। কেননা আমরা যে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়-কে মানসিক অসুস্থতার বিবেচনা করে থাকি মূলত সেটিই বিনয়ের কাব্যভাষা। লক্ষ করার বিষয়, বিনয়কে আমাদের এই অপ্রকৃতিস্থ বোধ-বিবেচনার কবি হিসেবে জানবার ফলে বিনয়ের কোনো কোনো কবিতায় ব্যঙ্গ-রসাত্মক উপমাটি আমাদের কাছে অন্য মানে তৈরি করে। জৈবনিক দীক্ষায় তিনি কী অন্যমনে শেষমেষ কবিতাকেই ধীকৃত করেছিলেন সমর্পণের দায়ে? বিনয়ের এইরূপ ভাষা-প্রক্রিয়ায় খেলা করার বিষয়টি বাংলা কবিতার সমঝদার পাঠকশ্রেণিকে নিশ্চয়ই আন্দোলিত করে। বিষয়-বৈচিত্রতায় বিনয়ের কাব্যভাষায় যথেচ্ছ চমক আছে, বিনয় সেই অবতাপ্রাপ্ত হয়েই জন্মেছিলেন। কিন্তু সমকালের বিক্রিত বিবেচনাই তাঁর সে অবস্থান ক্ষুণ্ন করেছে। বৈচিত্রের বদলে হয়ে ওঠেছেন মরুবৃক্ষের ন্যায় বিপণ্ন, বৈভবহীন ছিন্ন মনীষা। ভুল আলোচনার শিকার হয়ে পীড়িত হয়েছেন তিনি। কবিতা আর গণিতের সূত্রবদ্ধ সংজ্ঞায় নির্বাচিত যে বিনয়-কে দিব্যজগতে আমরা পেয়েছি সে বিনয় আজ আর নেই। বাংলা কবিতার এক সরলরৈখিক প্রবণতার সমাপ্তিরেখা অঙ্কন করে ১১ ডিসেম্বর ২০০৬ তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন মহিমান্বিত অনন্ত কবিতার প্রজ্ঞায়। তাঁর কাব্যভাষা মহাকালের খণ্ডিত কম্পনরূপে স্বারিত হয়ে থাকলো আমাদের কাছে। এই ফাঁকে, স্বতো-অবসরে তাঁর কবিতার দুটি মহার্ঘ পঙক্তি পাঠ করে নিই।
কিলবার্ণ কোম্পানির অফিস দেখেই আমি লাফ মেরে উঠি,
তাড়াতাড়ি চলে আসি এই গ্রামে শিমুলপুরেই।
কিলবার্ণ কোম্পানির / আমাকেও মনে রেখো, পৃষ্ঠা-৪৪
সময়ের নাগরিক ব্যস্ততা-জটিলতাকে প্রত্যভাবে পাশ কাটিয়ে বিনয়ের কাব্যসহবাস নির্ঝঞ্ঝাট, ঝুঁকিহীন, সরস-স্বাভাবিক প্রকৃতির। শুধুমাত্র প্রান্তিক জনজীবন থেকে শিল্পভাবের স্বচ্ছ উদ্ভাবনী স্বাত্তিক স্বত্তা দিয়ে নয়, নির্জলা কাব্যিকদ্যোতনাই একদিন তাঁকে শিমুলপুরে সন্ন্যাসযাপনে আন্দোলিত করেছে। যেমন আন্দোলিত করেছিল নিবিড় আরাধ্য আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, জয়নাল আবেদীন-কে। ভাবকে ভাষায় ফুটিয়ে তোলার বহু কৌশল আছে, প্রকৃত কথাটিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অন্যভাষায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বিনয় মজুমদার-কে আমার মনে হয় সেখানেই সিদ্ধহস্ত তিনি, শিশুর সারল্যবোধই তাঁকে সে স্থানে উন্নীত করেছে। ‘অকপটে সবকথা বলতে পারাই শিশুর সারল্যের নিদর্শন’ বিনয়ের যা স্বভাবজাত। গাণিতিক সূক্ষাতিসূক্ষ অন্তর্লোকই যাঁর স্বভাবকে নির্দেশ করেছে শিশুর সারল্যে। কাব্যিক ভেদাভেদে শিমুলপুরের বিনয় মজুমদার আর কলকাতার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দুজনেই শক্তিমান নিঃসন্দেহে। মুশকিল হলো, শক্তি সঞ্চারণের পরে বিনয় অবতা’র উল্টো হয়ে গৃহপ্রবেশের দৃষ্টিনন্দিত উপস্থাপনাটি সহজে কারো চোখে পড়ে না। ফলে দূরশ্রুত এক শব্দশিল্পীর মনো-সঞ্চারণ আবিস্কারের এই ট্রাজিক মাত্রাটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হওয়ার চেয়ে বরং চৈতনিক বিনয়ের অন্তর্বৃত্তেই ঘূর্ণমান নিজস্ব আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।
বস্ত্র পরিহিত এই পর্জন্যসমূহ কথা বলে / শাশ্বত গম্ভীর মন্ত্রে, তাদের বাণীনিঃসৃত আলো / উদ্ভাসিত করে তোলে জীবনের কিয়দংশ, ফলে / অন্তরে আনন্দ আসে, তমিশ্রায় পথ দেখা যায়।
বস্ত্র পরিহিত এই / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৯২ (দে’জ)‘
মুগ্ধতার কোনো বিশ্লেষণ হয় না। অন্তত আমি সে অসম্ভব ব্যাখ্যায় অম। বিনয় মজুমদার-কে আমি দেখেছি, তার সংগে কথা বলেছি, তিনি সস্নেহে আমার মতো অনধিকারীর সামনেও কবিতা ও গণিতের রামধনু সেতুটির ইশারা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন- এ সবই পূণ্যার্জন বলে আমি মনে করি। শুধু, আমি একা নই, আমরা শ্বাস নিচ্ছি সেই পৃথিবীতে, যখন একই মাতৃভাষায় শ্বাস নিচ্ছেন বিনয় মজুমদার, এ আমি সব সময়ের বাঙালির গর্ব মনে করি। সে গর্ব ঘুমন্ত ও সঙ্গোপন। এবং ভবিষ্যৎগামী। আমি এমনও আশা করি, আজ থেকে বহুবছর পরে কবিতা-গণিত সূত্রের নানা উন্মোচনে, আমাদের কারো কারো এই পূণ্যার্জন, অন্তত পারিবারিকভাবেও শুভ ও মঙ্গলের কারণ হয়ে উঠবে।’নাস্তিকের পূণ্যার্জন / মৃদুল দাশগুপ্ত, লোক * বিনয় মজুমদার সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৭৭
এ যাবৎ বিনয়ের এবং বিনয় সম্পর্কিত গোটাদশেক গ্রন্থ / ছোটকাগজ আমি পাঠ করেছি তাতে লক্ষ করেছি বিনয় তাঁর কাব্যে অবস্থান করেন উত্তমপুরুষে। এই উত্তমপুরুষটি এককেন্দ্রিক, অন্যঅর্থে বহুধাবিভক্তও বটে। কবিতার অন্তর্গত সেই উত্তমপ্রকৃতিটিরই প্রকাশনা ঘটিয়েছেন নির্দ্বিধ, কোথাও ফাঁকি দেননি তিনি। অথচ অশ্লিলতার ভাষ্য বলে কোথাও কোথাও অবহেলার শিকার হয়েছেন। এটি তাঁর একটি সেনসেশনাল ফের। অবশ্য আমার মনে হয় তাতে বিনয়ের কোনো খেদ নেই। কেননা বিনয় সে দিকে ফিরেও তাকায় না বা তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। তাঁর ‘বাল্মিকীর কবিতা’ যাকে বলা হচ্ছে, যৌনতার ভাষ্য নির্মাণ সেই কবিতাগুলোকেই আমার বহুল অর্থে লিখিত বলে মনে হয়। অন্তত আমি তা পাঠক-কে পড়ে দেখতে বলি। প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, কবিতাগুলো পাঠের শুরুতেই পাঠক যৌন বিষয়ক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন বেশি। এক্ষেত্রে যৌনতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতায় উপমা প্রয়োগ ও বিবৃতির গাণিতিক ব্যাখ্যাটিকেই তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন হয়ত। কিন্তু এর ভিতরেই কবিতার অন্য উপমিতি ছিল না তা নয়। কবিতাগুলো মূল্যায়ণ বিষয়ে অধিকাংশের নিম্নরুচির উপমাবিচার বাদ দিলে কবিতাগুলো সর্বাধিক কাব্যশৃঙ্গারে উত্তীর্ণ কবিতা। ভারতীয় উপমহাদেশে কাম-শৃঙ্গারের বিশ্লেষিত উপস্থাপনার যেরূপ চিত্র সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত ‘চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়– চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, মধ্যযুগের বাংলাগীতি কবিতা, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ কিংবা কামশাস্ত্র অধ্যয়নে আরো যেসব উদ্ধৃতি রয়েছে, কবিতাগুলো মোটেও তার থেকে পিছিয়ে থাকে না।আমার ভুট্টায় তেল মাখতে মাখতে চাঁদ বলল ‘তোমার / ভুট্টাটি ভীষণ মোটা’ আমি তার জবাব না দিয়ে / অন্য কথা বললাম- ‘ভুট্টার মাথায় একটু তেল মাখ’ তবে / চাঁদ কিন্তু ভুট্টাটিকে ফুটিয়েও ভুট্টার মাথায় / তেল মাখল না শুধু চারপাশে গায়ে মাখে, তেল মাখা হলে / চাঁদ মেঝে থেকে হেঁটে বিছানায় এসে শোয়, বিছানা মেঝেই পাতা থাকে।আমার ভুট্টায় তেল / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৮০, (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় আরো কিছু কবিতায় রূপকার্থে ব্যবহৃত এমন সব শব্দ পাওয়া যায়, যাকে, বহুপাঠক / প্রাবন্ধিক / আলোচক এ যাবৎ কবিতাগুলোকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে অপব্যাখ্যা দিয়ে কবিতার মূল টার্ম ভেঙে বিনয়-কে কাণ্ডজ্ঞানহীন দোষী সাব্বস্ত করেছেন। যা একজন উচ্চমার্গিয় কবি-লেখকের ক্ষেত্রে কোনোকালেই প্রাপ্য ছিল না। কবিতাগুলো পাঠশেষে, সর্বাগ্রে আমি এটাই মনে করি বিনয় মজুমদার এ কাব্যগুলোতেই ভাষার গূঢ়তাত্ত্বিক কারিগরি করেছেন। এইসব শব্দের স্থলে পাঠক তার পছন্দমতো আবিস্কৃত একটি প্রয়োজনীয় শব্দ বসিয়েও এখান থেকে নাব্যিক ভব্যতার শিল্পরস বের করে নিতে পারেন। তাছাড়া, বিনয় একটি ভুট্টার গায়ে তেল মেখে আগুনের আঁচে সেদ্ধ করে ভুট্টা খাওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি নিয়ে তাঁর কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে মিলিত হতেই পারেন। সেটা খুবই স্বতোঃসিদ্ধ, মজার বিষয় হলো উপমিত ‘মোটা ভুট্টা’ শব্দটি প্রয়োগে অনুমিত হওয়া যায় ভূগোলের একা একজন মানুষ কীরূপ শিশুবোধে কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে ক্রিড়ামগ্ন থেকেছেন। পাঠক সজাগ হলে লক্ষ করবেন যে বিনয় আরো লিখেছেন ‘লম্বা ডালাদের তক্তা বড় থাকে’। বাক্যটির মূলশব্দ ‘ডালা’র জীবন্ত চরিত্র নির্মাণ করে এর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিবৃতি দিচ্ছেন বিনয় মজুমদার। এবং পাঠকও সেদিকে ঝুঁকে পড়েছেন বেশি। বাক্যটিতে ডালা বিষয়ে অর্থাৎ একটি জড়বস্তুর ক্রিয়ার অর্থগত কোনো মানে তৈরি হয় না। নিষিদ্ধ ব্যঞ্জনেও কেউ কেউ জিভে জলসহযোগে রসনার তৃপ্তি পেতে পারেন কখনো, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আসলে অর্থহীন শব্দের দ্যোতনা এটি, এতদ্বসত্ত্বেও পাঠক উপমিত ডালার যৌনক্রীড়ায় আন্দোলিত হয়েছেন মুহুর্মুহু। কখনো কখনো এটাই বিনয়ের সরল বৈষয়িক কাব্যরীতি, বিনয়ের সঞ্চারণ মাত্রাই যেন পাঠক কে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। যারা তাঁর ছোটগল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী বা অন্যান্য পার্শ্ব রচনা পাঠ করেছেন তারা হয়ত অবগত আছেন যে তিনি সেখানেও একই গাণিতিক অন্তর্জাল ব্যাপ্ত করেছেন। আর ছন্দবীক্ষায় তো যেসব বর্ণের মাত্রা নেই সেসব বর্ণকে মাত্রার মর্যাদাই দেননি। আমি বলতে চাই এই হলো কবি বিনয় মজুমদার, আপাদমস্তক গাণিতিক-কাব্যিক অবিকারগ্রস্থ বিশ্বায়নের এক অন্যমানব।
বিপন্ন মড়াল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে, / যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে / রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ; / স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে; / সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু / এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি... তুমি...
একটি উজ্জ্বল মাছ / কালের খেয়া, সংখ্যা-৭৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬
কবিতার রয়েছে কোনো শিল্পিত লক্ষ কিংবা নেই। অতটা খুঁজিনি, বিনয়কে পেয়েছি, জেনেছি, কবিতা কবিতাই, ভব্যতার নিগূঢ় কোনো এক সূক্ষতাত্ত্বিক এলিমেন্ট। বিনয়ের কবিতা বিনয়ের মতোই সহজ-স্বাভাবিক, জটিলতাবিহীন অবিকারগ্রস্থ ভাষা। যারা তাঁর কাব্যভাষা-কে কখনো কখনো বিকারগ্রস্থ ভেবেছেন-দেখেছেন তারাই নিজেদের ফাঁকি দিয়েছেন। তারা বিনয় মজুমদারের কাব্যলোকে প্রবেশের সূত্রমুখও আবিষ্কার করতে পারেননি। আবার কখনো কখনো তাঁর কবিতা বিষয়ে অহেতুক তর্ক-বিতর্কের ফাঁদ তৈরি করে কবিতা সঞ্চারণের মাত্রাকে অন্য আরেক অর্থে জাগিয়ে তোলার সুপ্তবীজও লুকায়িত ছিল বিদগ্ধশ্রেণিতে, এমন ধারণা করলে অস্বাভাবিক হবে না। আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলেও এরকম উন্নাসিকতার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যাবে। সোজাঅর্থে এটি কবিতার গরল। গায়ত্রী চক্রবর্তী’র সাথে বিনয়ের প্রণয় সম্পর্কটি যারা জানেন তারা ‘ফিরে এসো চাকা’ গ্রন্থটি পাঠ করলে বুঝতে পারবেন বিনয়ের সংবেদনশীলতার গভীরতা। কাব্যিক মহাকালের ক্রান্তিকাল এখন, বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে তর্কে-বিতর্কে জড়ানোর চেয়ে তাঁর কাব্য ব্যবচ্ছেদ সঙ্গত কারণেই অধিক জরুরি। পরিশেষে, এ সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধার্হ কবি শামসুর রাহমানের বিনয়াভিব্যক্তিটি তুলে ধরতে চাই পাঠকের দরবারে...
“আমরা একটি বিবৃতি পড়ছি। কিন্তু কোনো কোনো বিবৃতিও কবিতা হতে পারে, যেমন বিনয়ের এই পঙক্তিমালায় কবিতার স্বাদ রয়ে গেছে। ‘আমিই গণিতের শূন্য’ পুস্তকে কবি কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বিবৃতি বলে রচনাগুলিকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। সম্ভবত এই বইয়ের কবিতাবলিকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কিংবা ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র সমপর্যায়ে রাখা যাবে না, কিন্তু উড়িয়ে দেয়াও অসমীচীন।”
লোক, পৃষ্ঠা-১৬৬, বিনয় মজুমদার সংখ্যা, সম্পাদক: অনিকেত শামীম।
ভুট্টা সিরিজের কবিতাধারার আরো কিছু কবিতা লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে একই বিষয় রূপকার্থে ব্যবহৃত শব্দগুলো পাল্টিয়ে বরং নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগে তিনি পরবর্তী কবিতাগুলোর সমৃদ্ধ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এটি জনশ্রুতি না ভেবে যারা অভিযোগ করেন যে, বিনয় মূল নির্ণয় বাক্যে অবস্থান না করে শব্দের প্রকারান্তরে নিজেকে ব্যাপ্ত করেছেন বেশি তাদের বলতে পারি এ কাজটি কেবল ভাষা-বোধ-উপমা সচেতন কবির পক্ষেই সম্ভব। বিনয়ও তাই করেছেন, সেইসব সমালোচক-বিশ্লেষকদের বোকা বানিয়ে তিনি চলে গেছেন তাঁর অভিপ্সীত লক্ষে, যা থেকে তিনি শিতি করেছেন পাশবিক বিবেচনাকারীর। যেকোন বিষয়মাত্রই টেক্সট এরকম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির কবিতা থেকে দূরে থাকাই ভালো। মূলত এই শ্রেণির অজ্ঞতা থেকেই শিল্পের অবমূল্যায়ণটা তৈরি হয়ে আসতে থাকে। জানা দরকার কবিতা কোনো ফেলনা যৌগিক বিষয় নয়, পাষণ্ডদের হাতেই কেবল কবিতার বিষয়বস্তু বিচারে মৌলিকত্ব ছিল না চিরকাল। তারা একটি গড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন ‘উই আর অলওয়েজ মেইক থিঙ্কিং রাইট উইথ রিয়েলিটি’। বাট থিঙ্কিং জাস্ট এন ডেভিল সোসাইটি’ এ বিষয়টি সহজে তাদের মাথায় ঢুকেনি। এই হলো বৈষয়িক সোর্স আমাদের! অথচ বিনয় মজুমদার মনে করতেন যে কবিতার জন্য চাই ভালো কোনো বিষয়বস্তু সেই সাথে দার্শনিক প্রজ্ঞা যা পাঠকের ভাবাবেগ-কে আন্দোলিত করতে পারে। আমার কাছে মনে হয় ভুট্টা সিরিজ কিংবা ‘বাল্মিকীর কবিতা’গুলো তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
প্রৌঢ় বয়সেও আমি প্রায়শ দাঁড়াই দৃঢ় হয়েতার কিছুণ পরে আবার নেতিয়ে পড়ি আমি। বৃষ্টির দেবতা আমি এ জীবনে যত বৃষ্টিপাতকরেছি সে সব কথা মনে পড়ে, ফলে বেঁচে আছি। বৃষ্টি পতনের কথা কোনোদিন মনে থাকে না।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৪ (দে’জ)
সম্মত জলের কাছে বসে বসে তারপর চলে গেল একটি কবিতা। সেইহেতু লতা বাড়ে পুষ্পে পল্লবে স্নিগ্ধ, কবিতার পদাঙ্ক আকারলতাটির পাতাগুলি; বলি তাও ফেটে যায় আরো ছোট বালিকণা হয়েসাগর সৈকতে, আহা, জলের নিকটে থেকে। ফলে অসদ্ভাব হয় জলে ও বালুতে।
ধুয়ে দিই / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৭ (দে’জ)
এ বছর মাঘ মাসে আমের মুকুল দেখা দিয়েছে বাগানে।
সারাটা জীবন আমি বৃদেবতার ডালে মুকুল দেখেছি।
অনুজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডালের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ধীরে
এ ফর্সা মুকুল আসে বের হয়ে, বসন্তের বাতাসে সে দোলে।
এ বছর মাঘ মাসে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১১ (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় লেখার যে মূলভাব, বিষয়বস্তু, ঈঙ্গিতময়তা- তা মূলত জৈবিক-প্রাকৃতিক খেলার নামান্তর মাত্র। লক্ষ করেছি, চিরকাল মানুষ যা আড়াল রাখতে চেয়েছে মনোবৈকল্যে বা অপরাধবোধে তাড়িত হয়ে, তিনি সেই দুর্লভ বস্তুটিকে উন্মোচিত করেছেন। জীবনাচারে আমরা যার নাম দিয়েছি যৌনতা। মহাকালের বিকৃত চর্বিতচর্বণে মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ আজ অবয় হতে হতে মৌলিকত্ব হারিয়েছে। যেখানে কামের ক্ল্যাসিকাল রূপটি বিবেচিত স্বর্গীয় এষণায় সেখানে কামকে টেনে-হিঁচড়ে রূপ নিয়েছে উলঙ্গ যৌনতায়। বিনয় মজুমদার প্রতীকি উপমায় সেই মহাকালিক গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই জানাচ্ছেন সৃষ্টিতত্ত্বের সূত্রপাত। প্রকৃতির সকল উপাদানের মধ্যেই অপারবিষ্ময়ে তিনি খুঁজেছেন সে রহস্যময় খেলা। পেয়েছেন। শুধু বিশ্বজগতেই নয় সমগ্র সৌরমণ্ডলেও কবির দৃষ্টিন্দ্রিয় দেখেছে এই দুর্লভ খেলা। আর এ খেলাটি সমগ্র প্রাণিজগতের সম্মুখে ঘটে থাকে। তবে সকলেই দেখে না বিনয়ের মতো কেউ কেউ দেখে। ফলে অদেখা জগতে অসদ্ভাব তৈরি হওয়াটাও স্বাভাবিক কিন্তু কাব্যমাত্রিক বিনয় মজুমদার-কে অসদ্ভাবে ঠাউরে যদি কেউ অবিবেচনা করেন তবে তা কবিতার পরিপন্থিই হবে।
সূর্য গ্রহণের কালে কিছু লেখা ভালো- এই ভেবে
আমি লিখি। আজ হলো তেসরা ফাল্গুন শনিবার
তেরোশ ছিয়াশি সাল। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে চাঁদের ছায়া। এই
লিখে ফের উঠলাম, গ্রহণ আবার দেখে আসি।
গ্রহণ দেখতে গিয়ে দেখলাম মেঘের আড়ালে
সূর্য চলে গেছে, আমি দুইখানি আলোকচিত্রের
ফিল্ম একসঙ্গে নিয়ে তার মাঝ দিয়েই দেখেছি
সূর্যের গ্রহণ প্রায় দশবার, তবে বর্তমানে
সূর্যকে ঢেকেছে মেঘে। যাই ফের দেখে আসি মেঘ
সরে যায় কিনা। ফিরে এসে আবার লিখছি বর্তমানে
আমার ঘড়িতে বাজে তিনটে আটচল্লিশ; মেঘে
সূর্য পুরোপুরি ঢাকা। ফের আমি উঠে গিয়ে দেখে
এলাম আকাশ, মেঘে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা তবে আকাশে
রযে অংশ মেঘে না ঢাকা সে আকাশ মনোযোগ দিয়ে
দেখেছি কোথাও কোনো তারকা উঠেনি আজ গ্রহণের কালে।
ঘড়িতে চারটে দশ বাজে, ফের আমি দেখে এলাম আকাশ
পুরোটাই মেঘে ঢাকা বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে।
চারটে বত্রিশ বাজে, বৃষ্টি অবিরাম পড়ে, তবে
রোদ্দুর উঠেছে ফলে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢাকা চাঁদের ছায়ায়, পুনরায়
দেখে আসি, রোদ আছে। পুনরায় দেখেছি সূর্যের
উপরের সিঁকিভাগে চাঁদের ছায়ায় ঢাকা আছে
চারটে উনচলিøশ মিনিটে। গ্রহণ শুরু হয়েছে যখন
সূর্যের নিচের দিক দেখেছে তখন, আর এই
গ্রহণের শেষ দিকে সূর্যের উপরের দিক ঢাকা,
অর্থাৎ চাঁদের ছায়া নিচ দিক থেকে ক্রমে উপরের দিকে
গিয়েছে বিকেলবেলা, পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন রয়েছে।
বৃষ্টি থেকে গেছে আমি ফের দেখে এসেছি সূর্যকে
চারটে উনপঞ্চাশ মিনিটে, সূর্যের উপরের
দিক ঢাকা মোটামুটি এক পঞ্চমাংশ, দেখলাম।
আবার বাইরে গিয়ে দেখলাম সূর্য মেঘে ঢাকা
চারটে পঞ্চান্ন বাজে সে সময়ে আমার ঘড়িতে
এই আমি করলাম আজ সূর্য গ্রহণের কালে
আমার শিমুলপুর গ্রামে বসে বিকেলবেলায়।
সূর্য গ্রহণের কালে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১৬
এ প্রসঙ্গে কবি-শ্রদ্ধার্হ উৎপল কুমার বসু’র একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘আমরা বিষ্ময়ের সংগে লক্ষ করি আলোচ্য কবি অবলীলায় নির্ণয়বাক্য থেকে আরেক প্রকারে চলে যায়। কখনও ফিরে আসেন মূল সূত্রে। কখনও স্থির হন এক মাঝামাঝি অবস্থায়। আমি সেদিন বসে বসে একটি তালিকা তৈরি করছিলুম কী-জাতিয় নির্ণয়বাক্য বিনয় মজুমদারের প্রিয় প্রকরণ। এই তালিকা দিচ্ছি:স্বয়ংনির্ভর (পধঃবমড়ৎরপধষ) যদি-তাহলে (যুঢ়ড়ঃযবঃরপধষ) বিকল্পাত্মক (ফরংলঁহপঃরাব) অস্তিত্ববাচক (ধঃযবৎসধঃর) নিষেধাত্মক (হবমধঃরাব) সাকুল্যব্যাপক (ঁহরাবৎংধষ) পুননিশ্চয় (হবপবংংধৎু) সম্ভাবনাবাচক (ঢ়ৎড়নষবসধঃরব) এবংবস্তুবিষয়ক (ৎবধষ) আমি শুধু প্রস্তাবাকারে হদিশ দিলুম। তালিকাটিও সম্পূর্ণ নয়। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ বৈশিষ্ট্যের জন্য বিনয় মজুমদারের কবিতা তার অনেক অলংকার বর্জন করেছে। ছন্দোগুণ, উপমা, ধ্বনিসৌকর্য, অন্তমিল এবং আরো বহুবিধ চরিত্র লক্ষণ অর্থাৎ শাঁখা-সিঁদুর থেকে পান-আলতা- যা দিয়ে আমরা কবিতাকে চিনে থাকি- তা সবই প্রায় কবিতায় অনুপস্থিত। তাঁর কবিতার এই নিরাভরণ রূপটি বড় মনোলোভা। কমলকুমার মজুমদারের প্রভাবে বলা যায় বিনয়ের কাছে ‘রূপের কখনো রূপান্তর হয় না’।’

কবিতার সঞ্চারণ-ধারা

কোন একটি লোক দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তার শেষে এসে যদি অন্য কোন একজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমি যাচ্ছি কোথায়?’ তবে তার মালকোচা দিয়ে দৌড়ানোর কোন ফল হল না কারণ সে তার লক্ষ সম্পর্কে জানে না, জানে না কি তার অস্তিত্ব, কি তার দৌড়ানোর হেতু? শিল্পের ল্য আছে নিশ্চিত! যিনি এপথে লক্ষহীন দৌড়ানোর কথা বলেন তার শিল্প মূলতই ল্যহীন। অযথাই দৌড়ে দৌড়ে তিনি রাস্তায় ধুলো ওড়ালে শিল্পের পথ ধুলোয় মলিন হয়ে ঝাপসা হবে বৈকি! কবিতাও তাই, সে কবিতা পাঠকের নয়, সে কবিতা শিল্পের নয়, সে কবিতা সংস্কৃতির নয়। এভাবে যদি কেউ শিল্পের পথে কবিতার মনোজাগতিক পরম্পরায় চলে আসেন তবে তার পরবর্তী কোন পথিক- আইডল নির্মাণে কবিতা কবিতা বলে রাস্তায় আসলে শুধুই অন্ধকার দেখবেন। অমরত্ব সন্ধানে তারও পথ হারানোর সম্ভাবনাই বেশি। কালাকাল হিসেব করলে দেখা যায় আসলে হচ্ছেও তাই, শিল্পপথিক সবসময় তাঁর অগ্রজদের সূত্র ধরেই পথিকের সারিতে দাঁড়ান। যখন একটি রোডম্যাপ বা প্লাটফর্ম নখদর্পণে, সেখানে তাঁর প্রাপ্য বিষয়ই হচ্ছে সুগম্য সঞ্চারণের মূল ল্যবিন্দু। তৃতীয়বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়েছে। জাপানে হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ভয়াবহ নৃশংস ঘটানার ক্ষত পৃথিবীবাসির মন থেকে মুছে যায়নি, সাম্প্রতিক সময়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার ঘটনা, আত্মকলহে প্রবৃত্ত হয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ ‘ইরাক’ বিগত ২০ বছরে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, আমাদের দেশেও ওয়ান ইলাভেনসহ আরো কিছু ঘটনা প্রতিবেশ উত্তপ্ত করে দিয়েছে। মনুষ্যসৃষ্টির বাইরেও রয়েছে বৃহৎ বৃহৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এরকম বর্বরতা থেকে মানুষ চিরকাল মুক্তি পেতে চেয়েছে আর বরাবরই তাঁর শিল্পিত আশ্রয়ের জায়গা কবিতাতেই। আমরা জানি, কবিতা মানবিক অন্তরাত্মার সৌন্দর্য বিষয়ক নিবেদন, বিচরণ। শব্দের ইন্দ্রজালিক মহিমাটি ঘুরেফিরে দেখছে, আপনার চিন্তাজগতের প্রতিটি ইউনিট কোমল অধ্যাসে সমাপিত কিনা! কবিতার সার্বজনীন আবেদন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার দিকে দৃষ্টি ফেরালেই গোচরিভূত হবে এলায়িত অলস বাঙালির কাব্যিক মৌলিক কোনো উপস্থাপনা নেই। কোমল রৌদ্ররাগে উদিত সূর্যসকালের মতো সুন্দর প্রণোদনাই নেই আমাদের সমগ্র জাতিসত্ত্বায়। কবিতায়ই সম্ভব ছিলো আমাদের নিত্যদিনের এ আচারবিধি যোজন দূরের মানবীয় অবস্থান থেকে একেবারে অন্তরায় বেজে ওঠা। প্রশ্ন আসতে পারে, কবিতা কি শুধু বিনোদনের খোরাক হলেই কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা পাবে? আমি বলি কি, কবিতা যতক্ষণ পর্যন্ত শিল্পের মর্যাদা নিতে অম বা সংস্কৃতিতে পরিণত না হচ্ছে ততণ পর্যন্ত কবিতা, আসলে কবিতাই হয়ে ওঠবে না (শুধু নামেমাত্র ‘কবিতা’ ধারণ করে আবহমান বাতাসে দোল খেতে খেতে হয়ত একদিন এ সভ্যতাতেই বিলীন হয়ে যাবে)। পরবর্তী কোনো সভ্যতার সূচনাতে দেখা যাবে তাতে কবিতার কোনো চিহ্নমাত্রই থাকলো না। খুবই স্বাভাবিক। কবিতার সংজ্ঞা বা কাঠামো নির্মাণের বিষয়টি যেমন লেখকব্যতীত আর কারও স্বচ্ছ করা সম্ভব নয় তেমনই তিনিই নির্দেশনা দিচ্ছেন, শাব্দিক ইন্দ্রজালই আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছে মহাকাব্যিক এষণায়। শ্রুতিমধুর শব্দদ্যোতনা আজিবন সঞ্চারণমাত্রায় উজ্জ্বল, যার আবেদন চিরকালিন। সেদিক থেকে ভারতিয় উপমহাদেশে আমাদের এপিকস্গুলো বা শুধু ভারতিয় উপমহাদেশেই নয় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আরো যেসব এপিকস্ আমরা গ্রহণ করেছি, যথার্থ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে। হ্যাঁ। আমাদের চর্যাগীতির বয়স হাজার বছরেরও বেশি, আজ সে সংস্কৃতির মর্যাদা ঠিকই নিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন মানসিকতার বাইরেও এর আবেদন এখন কোথাও কোথাও চিরঅম্লান। মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল, ইলিয়ড, ওডিসি, কোরআন আজ বিশাল জনগোষ্ঠির মহাসংস্কৃতির মর্যাদা গ্রহণ করেছে (ঘরে ঘরে যা এখন ধার্মিক মূল্যবোধে নিত্যদিনের প্রার্থনার বিষয়)। সাম্প্রতিক সময়ে রবীন্দ্র রচনাবলী, জীবনানন্দ রচনাবলী তারই এক ভিন্ন সংস্করণ হয়ে উঠেছে। একজন শিল্পপ্রাণের দিবস শুরুর প্রার্থনার মতো সম্ভাষিত এ দুইয়ের সামগ্রিক উপস্থাপনা। সংস্কৃতিবিচারে এই দুই এপিকস্ কোন অংশে পিছিয়ে নয়। তদ্রুপ গূঢ়ার্থে কবিতা বলতে তাকেই বুঝবো, যা শিল্পের মর্যাদায় সংস্কৃতির আসনে উদ্ভাসিত হতে সম প্রযোজনা। অবশ্য কবিতার পাঠকমাত্রই তাঁর বিচারে চূড়ান্ত রায় দিতে পারেন, যদি সেক্ষেত্রে জরুরি কোন প্রয়োজন পড়ে কারণ কবিতা তো বিচারবিধির কোন বিষয় নয়। আর উত্তরসূরি, যার নিবেদন থেকেই তার ফলাফল আপনার প্রার্থিত দুয়ারে।

The blood is red / or the red is blood

The sea is asking me / where is the blood’s flood

where is the red flood / but the flood’s color is looking like

my shed / it’s my life / my life is a life

And i will mix up my life with red.

(Red: Mugdha Chondrika)

সারাদিন পাখিগুলো কোন আকাশ থেকে কোন আকাশে থাকে।
শহর কলকাতার শহর যেন পাখিহীন হয়ে থাকে;
পাখিদের আমি সবচেয়ে ক্যাপিটাল মনে করি।
(এইসব পাখি: জীবনানন্দ দাশ)
কখন যে চাঁদ ওঠে আড়াআড়ি পাহাড়ের ফাঁকে:
যেন কার পাথুরে স্তনের কাছে ঝুলে আছে শাদা
চাঁদির লকেট। দূরে, অতিকায় পাহাড়চূড়োয়
অপার্থিব আলো জ্বলে শিবের মন্দিরে। আর ভাবি
আমার মতন বুঝি জেগে আছে সেখানেও কেউ
অসংসারী, শঙ্কাহীন, মিথ্যে কোনো মায়াবী আশায়।
(অরণ্যে কান্তির দিন: আল মাহমুদ)
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
সে চারিদিকে তাকায় না। শূন্য শস্যতে।
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
একে একে ছায়াগুলো ভেঙে শিথিল হয়ে যায়
আর বসন্তের আকাশ-গহ্বরে ঢুকে পড়ে।
(ভ্রমণের সূত্র: টোমাস ট্রান্সটোমার)
বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ‘পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বলে কিছু নেই, যা আছে তা সাময়িক উত্তেজনামাত্র।’ কথাটি যথাযথ হৃদয়গ্রাহী মনে করি আর তাঁকে মেনে নিয়েই... কোন কবিতাকেই আসলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে লেখা হয়ে ওঠে না, হওয়া উচিতও নয়। একক স্বকীয়সত্ত্বায় মনেপ্রাণে শেষ্ঠত্ব ধারণ করে আমরা স্থিতধিত বিচরিত। নতুন শ্রেষ্ঠটিও যেকোন ফেলনামূল্যে আমাদের কাছে অবিবেচিত হচ্ছে। এতটাই গভীরতার ভুল আলেখ্য আমাদের গ্রাস করেছে, যেখানে কার্পণ্যতা বসবাস করছে ব্যাখ্যাহীন সীমাহীন! কবিতার ক্ষেত্রেও বরাবরই তাই হয়ে আসছে। অনেকটা হযবরল হয়ে ওঠেছে আমাদের নিত্যদিনের বৈষয়িক যাপিতজীবন। কেননা কালে কালে নতুন কবিতা লেখা হতে পারে, হতে পারে সময়ের শ্রেষ্ঠ এমন সঠিক সন্ধানীও হতে পারিনি আমরা তাছাড়া আমাদের পাঠকের অধ্যয়নের পৃথিবীটা দিনদিন যেন আরও ছোট হয়ে আসছে। ছোট হয়ে আসছে টেক্সটও, কর্পোরেট লাইফ আমাদের সেই অবস্থানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, জাপানের হাইকু যারা পাঠ করেছেন তারা হয়ত দেখেছেন স্পিড অব ন্যাশনালিটি সেখানে কবিতার আঙ্গিক কাঠামো কত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এবং এটাকেই তারা সূতর জাতীয় মৌলিক কবিতাবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করতে সম হয়েছেন। হাইকুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হাজার বছর পূর্বের সকল কবিতাই কি ধারণ করতে পেরেছি আমরা? এককালে তা কখনোই সম্ভব নয়, হাজারও কবিতা হয়তোবা সময়ের চাপে কবেই তার নিজস্ব ভূমিতে হারিয়ে গেছে। যা হয়তোবা আমরা পুনরায় খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনছি, দ্যোতিত করে তুলছি সাময়িক বোধ বিবেচনায়, আলোকবর্ষের সুনৃতে। সমকালিন কবিতা বলে আসলে কোন কিছুকেই দাবি করা যায় না। কারণ ওই কবিতার জন্ম বা প্রসব উত্তর যন্ত্রণা বেশ অনেক পূর্বেই শুরু হয় বা যার আবহটাই গোলকায়িত যন্ত্রণায় কবিকে অস্থির করে তোলে। একজন কবি তার যে কবিতা একটু আগেই প্রসব করলেন সেই আবহ বা চিন্তা হয়তোবা দীর্ঘসময় ধরে দোলা খেতে খেতে বাতাসের সাথে ঝুলছিল। হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে টুপ করে জলে পড়লো কেবল! আর হঠাৎ করেই কেবল আপনি আবিস্কার করলেন, অরের জালে মৎস্যসন্তরণের ন্যায় বৃত্ত থেকে ব্যাপৃত হচ্ছে আপনার সুলেখাসমগ্র, ঠিক যেমনটি আপনি চেয়েছিলেন। যে পাঠক কবিতায় ঢুকতে চাচ্ছেন না আমি তাকে জোর করে কবিতায় ঢুকাতে পারবো না, সেটা আমার কাজও নয়। কারণ এইশ্রেণিটা বরাবরই ধূসর-বিমুখ তার আপন বিবরেই। আর যাই হোক তার কাছে চিরকালই দস্যি কবিতার প্রযোজনা অর্থাৎ বিষয়টি তার মধ্যে কখনোই সঞ্চারণ সৃষ্টিতে সম নয়। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার একবার তাঁর নিজের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘খোলা জানালা’য় কবিতা বিষয়ক এক গদ্যে কবিতা লেখার বিষয়ে বেশ কতগুলো কলা-কানুন দেখালেন এবং তিনি দাবি করলেন উক্ত নিয়ম বহির্ভূত কোন লেখা কবিতা হয়ে ওঠবে না। আমি ঠিক জানি না কাহ্নুপা, বিহারীলাল চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বিশাল মহীরুহের মতো এইসব কবিকুল তাঁর উক্ত নিয়ম মেনেই সেসময় কবিতা লিখতেন কিনা? আজকের তরুণ কবিই বা সে নিয়ম কতটুকু ভাবার অবকাশ পান তাঁর সুদূরপ্রসারী জীবন ভাবনার মাঝে? একজন কবি-লেখক যে সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হন তারও একটা সুবিশাল ভূমিকা থাকে। অবশ্য তিনি এরকম মনে করেন যে, একজন কবির যেখানে ব্যর্থতা রয়েছে মূল কাব্যিক কার্যসিদ্ধিতে অন্য আরেকজন কবি বা পাঠকের উচিৎ সেখান থেকেই শুরু করা। তাহলেই কেবল এর সমাধান সম্ভব।
উজানে ভেসেছি গংগা গা ভরতি মাদুলি কবজ কড়ি হাত-পা জড়িয়ে আছে শরীর জড়িয়ে আছে শীতল শরীর আহা মন আমার উথালপাথাল কত খালবিল নদীনদ পেরিয়ে এলাম তোকে বোঝাবো কেমনে গংগা কী যে সুখে ভেসে যাই ডানে বাঁয়ে হা-পিত্যেস ছড়ানো সংসারে কত ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন দেয় উলুধ্বনি না'য়ে না'য়ে আবাল্য সখীরা ডাকে না যাও রে ভরা গাঙে ডিঙা ডুবে ডিঙা ভাসে দেবর ননদ জা সতীন শাশুড়ি চলে পাশে ভেসে জলটানে চলেছি
(মনসা: ব্রাত্য রাইসু)
ইতিহাস খুলে পড়ছো তোমার পূর্ব পুরুষদের
প্রথম উড়াল আর শেয়ালতত্ত্বের কথা।
একদিন পৃথিবী ছিল যাদের মগজের দাস
সিংহ আর মাংসের সমন্বয়কারী
সেইসব প্রজাতি লুপ্ত আজ।
(শেয়াল বিলুপ্তির পর: মিজান মল্লিক)
পৃথিবীর ঘাস, মাটি, মানুষ, পশু ও পাখি সবার জীবনী লেখা হলে
আমার একার আর আলাদা জীবনী লেখা না হলেও চলে যেত বেশ।
আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেত।
তার মানে মানুষের, বস্তুদের, প্রাণিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক
অসংখ্য জীবন নয়, সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন মোটে; ফলে
আমি যে আলেখ্য আঁকি তা বিশ্বের সকলের যৌথ দৃষ্টি এইসব ছবি।
(এ জীবন: বিনয় মজুমদার)
কবিতা পড়া জরুরি বা জরুরি নয় কিনা তারচেয়েও জরুরি, কবিতা পাঠকমাত্রই শিক্ষিত, ঋদ্ধ, মার্জিত পাঠক সর্বাগ্রে এ ধারণাটিও যে ঠিক নয় এটি অন্তত পরিস্কার জেনে ফেলা। অনেকের কাছেই এর গভীরতা পরিস্কার নয়, পরিস্কার হয়েও ওঠে না। গুলিবিদ্ধ একজন মানুষের চেয়ে কবিতাবিদ্ধ একজন মানুষের যন্ত্রণা বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে যথার্থ কবিতাতেই বিদ্ধ হলো কিনা সেটি ভাববার বিষয়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিবৃতি সাজিয়ে সে পাঠককে কোনটা কবিতা কোনটা অকবিতা তা বুঝাতে গিয়ে তাঁকে খাটো করতে চাই না। বরং একজন শিতি পাঠক তাঁর কবিতা ঠিকই হাজার কবিতার ভেতর থেকে আবিষ্কার করে নেয় বলে জানি। এটা আসলে এক ধরনের কবিতার সংবেদও বলা যায়। কবিতায় উদ্ভাসিত এই সংবেদ মূলত আকুল করে তোলে কবিকে, যিনি পাঠক তার উপর সংবেদন জারিত হয়, প্রিয় কবিতাটি পড়ামাত্রই পাঠক সঞ্চারিত হচ্ছেন অনেকটা ঐশ্বরিক মহিমায়। একেবারে সন্নিকটে না হলেও যোজন দূরে কোথাও তার প্রভাব পড়ে থাকে। আর যতসব নিয়ম-নির্মিতি তা শুধু নিজের ভালো লাগা বা না লাগার ব্যাপারমাত্র। তাছাড়া যে পাঠক সাহিত্যের টোটালিটি থেকে একটিমাত্র কবিতাকেই বেছে নিলেন, সে পাঠকমাত্রই বোকা এ জ্ঞান সম্পূর্ণ শুদ্ধ শব্দচর্চার দাবি রাখে না, অন্তত আমি তা যথার্থ অর্থেই মনে করি। কেননা ওই একটি কবিতাই তো মহিমান্বিত করে তুলছে তার অমিয় ভুবন। কবিতা পড়ার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, অন্তর্লোকে প্রবেশের পূর্বে নির্দেশিকাটি দেখুন। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন পাঠেরও নির্দেশিকা আছে ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’। এর একটা সফল কার্যকরিতা আছে, যথার্থ নিবেদনে মধুর আবেগে পাঠে মনযোগি হওয়ার গুরুত্ব তৈরি হয়। ফলে স্বয়ং পাঠকই নয় সঞ্চারিত হতে থাকেন তার পরের শ্রোতাও। কবিতা আখ্যানের কোনো কোনো অধ্যায়ে এরকম পূণ্যার্থী ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। যদিও সামগ্রিক কবিতাক্ষেত্রে এরকম পূণ্যার্থীর কোনো ভূমিকা পাওয়া যাবে, সহজ অর্থে আমি তা প্রথমেই বিশ্বাস করি না। বরং আজকের এই কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগে একজন পাঠক তাঁর প্রিয় লেখাগুলো বেছে নেয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে হাতের কাছে পাচ্ছেন খুব সহজেই। সে পাঠককে কবিতা বোঝাতে যাওয়া তো আরও বোকামি। আমার সাত্ত্বিক অবস্থান হলো এই সত্ত্ত্বাটির মৌলিক ইন্দ্রিয়টি বাজিয়ে দেয়া, যে বৃত্ত থেকে বা কেন্দ্রবিন্দু থেকেই উদ্ভাসিত হয়ে তার আগমন হোক না কেন। মার্জিত একটি লক্ষেই তো প্রযোজিত হচ্ছেন তিনি কিংবা প্রযোজনার জন্য সঞ্চারিত হচ্ছেন। যেমন ধরুন, দিবস শুরুতে আপনার মন উতলা হয়েছে, ফরিদ কবিরের ‘সুরসন্ধানী’ কবিতাটি পাঠ করলেন যার কোনো কোনো পঙক্তি এরকম ‘সঙ্গীত এতটা পারে, শুষে নেয় গমের যন্ত্রণা / যে-কারণে ঘন হয় গাছের নিঃশ্বাস / রাতের পাতায় জমে ঘাম / সুরের সন্ধানে তবু লোকে করে / নদীর বন্দনা / আমি কিংবা মিতা হক উপলমাত্র’। সেইসাথে আপনার দিবসটিই সঙ্গীতময় হয়ে গেলো, আপনি যতই বিচরিত হলেন আপনার সমগ্র সত্ত্বায় সঙ্গীতই সেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এরকম সঙ্গীতময়তার কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন পড়ে না নিশ্চয়ই। আসলে ওইদিন আপনার সঞ্চারণ পৃথিবীর এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে কি!
বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু আর মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন / সদলবলে গাইবে দুর্ভিরে স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস
ফিরে তুমি যাবে বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও, / কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?
(মেঘদূত: সমর সেন)
আমাদের হাওয়া গিয়ে তোমাদের জামপাতা মৃদুভাবে নাড়ে,
ফলে কি জামের বন আত্মীয়প্রবণ হয়ে ওঠে!
আমরা কোকিল ছাড়ি তোমাদের কাকের গৃহে ডিম পেড়ে আসে,
তোমাদের পীছানাগুলি এপাড়ের ডালে বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করে।
সীমান্তরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পিঁপিলিকা শ্রেণী / খাদ্য বহন করে নিয়ে আসে এপাড়ের থানায় থানায়
একই জলে স্নান করে দুই ভূগোলের দুটি লোক,
বিদেশ এতটা নিকটে থাকে। এতখানি শিলাময়!
(সীমান্ত: কামরুজ্জামান কামু)
সে বাড়ি ফেরে। কথা বলে না কোন।
নিশ্চিত খারাপ কিছু ঘটেছে। / সে জামাজুতো নিয়েই শুয়ে পড়ে।
মাথা গুঁজে দেয় কম্বলের নিচে।
পা’দুটো কুঁকড়ে নেয়। / বয়স তার চল্লিশ, যদিও এ মুহূর্তে নয়।
এখন তার অবস্থান মাতৃজরায়ুর
সপ্তম আবরণের এলাকার সুরতি অন্ধকারে।
কাল সে মহাকাশ নিয়ে বক্তৃতা দেবে।
(প্রত্যাবর্তন: ভিস্লাভা শিম্বোর্স্কা)
কবিতার পথ বহুদূর নয় বটে তবে এতটা পথ যে, আর পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি আপনার মৌলিক অবস্থান থেকে অনেক দূর চলে এসেছেন কবিতার দিকে। লক্ষ করে দেখুন, কবিতা যতদূর এগিয়েছে ততটুকুতেই সে সংস্কৃতি দাবি করে বা আমরা যতটুকুই সংস্কৃতির আসনে বসিয়েছি। অথবা ধরতে পারেন কবিতা একটি আলাদা সংস্কৃতি বলেই তাকে আপনি সবিতা বলে জানেননি। কোথাও কোথাও জেগে ওঠছে ধর্মীয় মূল্যবোধও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হতো, কাজী নজরুল ইসলামের হামদ্-নাথ্ এখনো মুসলিম ইজমের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় পবিত্রতা বা শুভ ভাবনায় পাঠ হয়ে থাকে, বলা হয়ে থাকে বাইবেলে অজস্র কবিতার উপাদান ছড়ানো-ছিটানো কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এসবই জাগিয়ে তুলেছে শৃংখলিত এক সূতর ধর্মীয় মূল্যবোধ। আর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ তো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক মহাকাব্যিক ইস্যু। গ্রামাঞ্চলে বাউলদের পালাগানও অনেকটা এরকমই সেখানে ভেদজ্ঞান, তাত্ত্বিকতা তো থাকেই যা হাজার দর্শক দলবেধে গভীর মনযোগে অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকে। এ সবই আসলে একটি সত্ত্বার উপর মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, কবিতা মাধ্যমেও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। একসময় হয়ত সে একত্ববাদ থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেক কবিতাই তাঁর নিজস্ব ভূ-মণ্ডলে এক ভিন্ন ভিন্ন ইমেজের জন্ম দেবে। সেটা খুবই স্বাভাবিক, তাছাড়া মানব সভ্যতার ভাবের জায়গাটি অন্তর্লোকেই আর সেখান থেকেই তো কবিতা বেজে ওঠছে খুব শক্তিশালী হয়ে। হাজার বছরের কবিতার ভাঙা-গড়ায় আমাদের যে চৈতন্য ঘটে তা তিরিশের জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে। আমি বলবো এঁরা ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছেন বাংলা কবিতায়, একেবারে কবিতা মাধ্যমটিকে উজ্জ্বল করেই। অন্তত ১০০ বছরের বাংলা কবিতার কথাই ধরুন, আধুনিক কবিতার সাথে বাঙালি জাতির পরিচয়টা যেভাবে হয়েছে। কবিতায় এসেছে সমকালিনতা, রাজনীতি, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের ধারণা, ঔপনিবেশিক সমন্বয়। উবঢ়ঃয ঙভ খরঃবৎধঃঁৎব মননবৃত্তেই আপনি দুমড়ে-মুচড়ে নতুন করে নির্মিত হয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন প্রায় এক শতাব্দীর কাব্যিক ফের। তার পরবর্তী আজকেরও যে কবিতা, তাতো ভিন্ন প্যাটার্নের অবশ্যই। একেবারে সন্নিকট চিত্রটিও প্রত্য করে দেখুন, মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যেই আমরা তার ফলাফল গ্রহণ করতে যাচ্ছি; এক দশক সময় শুধুমাত্র আপনার নির্ণায়ক বিচার বিশ্লেষণের সময়। কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়, একবার পাঠ করে রেখে দিলেই চোখের সামনে স্পষ্টভাবে কবিতার উজ্জ্বল চিত্রটি প্রত্য করা সম্ভব নয়। বারবার পাঠে কবিতা স্বচ্ছ থেকে আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। চর্চার এ জায়গাটিতে আমরা বরাবরই অলস, আপন বিবরের উপস্থাপনা থেকে এর উত্তরণ অধিক জরুরি আর তখনই কবিতার ফলাফল একজন পাঠকের নেয়া সম্ভব। কেননা আজকের কোন কোন কবিতার বিষয় তার শব্দ প্রয়োগ বিন্যাস অবশ্যই দীর্ঘদিনের উপকথার ফসল। সৃষ্টি শুরুর পর থেকে যখন মানব সভ্যতার প্রসার হলো বোধ করি কবিতা নামক সঞ্চারণটি সেই তখন থেকেই আপন বিবরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে ভাগ হয়ে সমর্পিত হয়ে আসছিলো। মাটি, পাহাড়, বাতাস, আলো, রোদ্দুর, নদী, দূরের নত্র, সভ্যতার যত যত এলিমেন্ট, অচেনা জগত এগুলো যত চর্বিতচর্বণ হয়েই থাকুক না কেন আজকে তা আকাক্সার, আজকে তা পাঠকের... এই গূঢ় সত্য বিষয়টি যতণ না কোন পাঠক গভীর মহিমায় উপলব্ধি করতে পারছেন ততদিন আমাদের অপো করতে হবে খেয়াঘাটের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া মাথায় নিয়েই।
দাঁড়াও রুপালি নদী, রজত জ্যোৎস্নার শিহরণ
আমি সংগে যাবো!
সামান্য হাতের কাজ বাকি আছে, সেরে নিয়ে দ্রুত
দরোজা দু’হাট খুলে মাঠে গিয়ে নিশ্চয় দাঁড়াবো
নিরুদ্দেশ পথের বাতাসে...
রাত্রিভর হেঁটে যাবো বালুচরে। শ্মশানে নিঃশব্দ কাশবন,
ঘুমন্ত গ্রামের ছায়া রেখে যাবো পাশে...
(যাবো: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
নদীর জলে ওড়ে ভষ্ম, ওড়ে মৎস্য, কোথায় যাবি তুই
বাইসনেরা ধুলোয় লুটায় / পক্ষিরা সব পক্ষ গুটায়
দিসনে ঠোকর, পুড়বে কেবল পুড়বে রে চঞ্চুই।
(সার্কারামা: মাসুদ খান)
তাকালেই ভোর হয়, তাকালেই সন্ধ্যা
যেনবা আঙুলব্যাপী সন্তরণশীল ভোর, সন্ধ্যা
আমার ইঙ্গিতমতো পাল্টায় পোশাক
পোশাকেই সমস্ত রহস্য / ধর্মগ্রন্থে এসবের উল্লেখ ছিল না।
পাতায় পাতায় আমি এই কথা প্রচার করেছি
নগ্ন-নারী নয়, আনারসে আছে প্রকৃত রহস্য
খোসা ছাড়ালেই আনারসমাত্র খাদ্য হয়ে ওঠে
মেঘাচ্ছন্ন রমণীরা সেই খাদ্য পরিবেশন করে।
(রহস্য: ফরিদ কবির)
নদী যেরকম যায় সেরকম পাখি যেরকম যায় সেরকম
চলে যেতে সমূহ ইচ্ছুক আমি সে রকমই চলে যেতে চাই,
হাতের পালকগুলো খসে গেলে ক্ষতি নেই,
চোখ একটা অবাস্তব জলাশয় কিছু যায় বা আসে না,
এবং শরীর একটা অন্ধকার মৃত্যুর কবর হলে ক্ষতি নেই।
মানুষের কাছ থেকে মানুষের মতো আমি চলে যেতে চাই।
(প্রস্থান প্রসঙ্গ: আবুল হাসান)
কবিতায় আসছে নতুন টেক্সট, থীম, ধারণা, প্রচার, প্রয়াস। আসছেন নতুন কবি, বদলাচ্ছে কবিতার মানে, উপমিতি, অনুষঙ্গ আপনার সমস্ত ধারণা যা কিছু আছে, আমূল সব পাল্টে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠছে নব নব কবিতার প্রস্তরায়ণ। এই এক দশক পূর্বেও আমরা কবিতাকে যেভাবে বুঝতে শিখেছি আজ আর তা ভাববার সুযোগ নেই। তৈরি হয়েছে যোজন ব্যবধান, চিন্তার আর অর্থগত মানে কবিতার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যিনি শুধু একবেলা খাবারের কথা ভাবেন তার সাথে কবিতার কিছুটা তফাত তো রয়েছেই কেননা কবিতা খাবারের বা খেয়ে জীবনধারণের কথাই শুধু চিন্তা করে না করে আত্মসংযমেরও। ফলে কবিতার ঞড়ঃধষ টহরঃ-এর একটি হচ্ছে সংযম অর্থাৎ স্বীয় সত্ত্বাটিকে অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে অবদমিত করা। এক্ষেত্রে সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন আর একজন কবির স্বীয় অবদমন ক্রিয়াটির বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আইডল নির্মাণের বিষয় নিহিত থাকে আর কবির আত্ম-অবদমনের মধ্যে থাকে কবিতার সুন্দর নির্মিতি বা শুধুমাত্র কাব্যিক আইডল। ফলে সাধক কবির এই কাজটি যে খুব সহজ নয় এইটা খুব দ্রুত জেনে ফেলাই হলো একজন বুদ্ধিমান পাঠকের কাজ। কবি কল্পলোকে তাঁর জীবনকে উপো করেন চিন্তার প্রখরতায়। এখানে কবির সাধক সত্ত্বাটিও আপনার কাছে সুবিবেচ্চ না হলে আপনার সকল কৌতূহল বৃথা গেল। একটি কবিতাই যখন সকল মসৃণতা নিয়ে উপস্থিত হয় আপনার নিকট ইন্দ্রিয়ে বা সংসার ত্যাগী হয়েও যখন তাঁর আবেগ দিয়ে সংসার ভাবনা পাঠককে বুঝাতে চান এইরূপ তাঁর ভালোবাসা কিংবা সহজ অর্থে প্রণয়েরর হেতু। তখন তাকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পে সম্ভব নয়। কেননা তাঁর ভাবনা আমাকেও মোহগ্রস্থ করে গূঢ় এক ব্যাপৃত ইন্দ্রজালে। একটা সময়কে কেন্দ্র করেই একদল কবির সম্মিলিত ভাষাটি স্পষ্ট হয়। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এটা স্পষ্ট বুঝে ফেলা খুবই সহজ। এ সময়ের কবি-পাঠকরা সেটা খুব সহজেই আয়ত্ত করছেন। আমাদের পূর্বে যারা ছিলেন তাদেরকেও চিহ্নিত করা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। আমাদের দেশে আশির কবি-লেখকদের মধ্য থেকে সেটি খুব জোরালো হয়ে উঠেছে। একদল কবি বিশেষ করে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, মাতিয়ার রাফায়েল, জহির হাসান, সাখাওয়াত টিপু, বদরে মুনীর এঁরা চর্যাপদ থেকে শুরু করে কালিদাস, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, মাইকেল, বিহারীলালকেও আদ্যন্ত নখরে গেঁথেছেন। কারো কারো কবিতায় এসেছে ভিন্নমাত্রিক ভাষার দ্যোতনাও। এঁদের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষার উজ্জ্বল কবি ফরিদ কবির। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর অরবৃত্ত মুক্তকের দৃঢ় ছন্দোবদ্ধতায় অনেকটা চিহ্নিত করেছেন, বাংলা কবিতা যে-রকমটা পাঠকের কবিতা হয়ে উঠতে পারে। সঞ্চারণ থেকে পাঠক ফিরে যেতে পারেন অযাচিত কোনো কবিতায় এমনটি হবার নয়। অনেকটা পড়ে যাওয়া পাঠককে তুলে এনে কবিতার মূল স্থানাঙ্কবিন্দুতে স্থিত করা। শব্দের সমীক্ষা, আভিজাত্য, বিদগ্ধতা আর অর্থদ্যোতকের নির্দেশনায় পাঠকের শব্দজট খুলে যাচ্ছে মুহূর্তেই। প্রচল কবিতার ভাবাদর্শ বর্জন করে সেটা তিনি ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে সম হয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটি দাঁড়ায় অন্য জায়গায়, যিনি সুহৃদচিত্তেই কবিতার দিকে ধাবিত হলেন তাকে অব্যাখ্যাত বিবৃতির ছাঁচে ফেলে দ্বিধাদ্বৈতের চর্চা করা আমাদের জনাধিক্যের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা। একজনের সংস্কৃতি মনস্কতা অন্যজনের বঞ্চিত অধিকার। অথচ এরকম জীবনবিমুখ কর্মকাণ্ড চিরকালই শিল্পের বিপরীতে অবস্থান নেয়। শিল্পপ্রাণ ব্যক্তিমাত্রই এই বিষয়টির প্রতি সচেতন হওয়া জরুরি যার অধিক অভাব আমাদের সাহিত্য পাঠক শ্রেণির মধ্যে। ফলে কবিতা ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে অব্যাখ্যাত প্রমাণ বঞ্চনায় এরকম ট্রাজেডি থেকে আমাদের এখনি বেরিয়ে পড়া জরুরি।
আমার মায়ের নাম গ্রাম। / পিতা নাকি দূরের শহর!
নদী ও হাওড় দুটি বোন, / এই বিল জলা সহোদর।
আমি ভালোবাসি সমুদ্র দুহিতারে
দিগন্তের হাওয়া এসে শোনায় সুদূরতা, / মেঘের ঠিকানা, ঝড়ের বার্তাদি।
পিতা ভুলে গেছে আমাদের, / চুপিচুপি কাঁদে মা আমার।
আমি তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জেলে / ফেঁসে গেছি জলচক্রে, জালে।
ফেঁসে তো গেছি কংকালে, মাংস থেকে মাংসে।
(কংকালে মাংসে: মাহবুব কবির)
ঘরে প্রজাবর্গের মতো বাবা। উঠানে মটরশুঁটির মতো মা।
তৃণ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাঙের শরগুলো ভয়ঙ্কর ধারালো।
বাবা একটা হারেমের ভিতরে থাকে। আমার অনেকগুলো মা।
আমার মা ভিজে পাখির যন্ত্রণার মতো। আমার মা কলাপাতার মতো দুঃখি।
(আমার ডাকনাম: রিফাত চৌধুরী)
সামান্য কিশোরী তুমি! ঘুরে ঘুরে / দাদী’মা হয়েছ!
কি তবে গ্রহণীয় আজ / গৃহে গৃহে?
অসীমায় সীমাবদ্ধ যাহা... ম্যাজিক্যাল
ও ভাই স্পাইরাল / তবে কী না
আমার দাদী’মা কখনো কিশোরী ছিল না
যেন আমি কোনওদিন কোথাও যাইনি...
(সংশয়: টোকন ঠাকুর)
বসন্ত বেড়াতে যায়...
কি এক নিঃসঙ্গ কুয়াশায় ভরে যায় দেহ,
সূর্য আমি তাকাতে পারি না।
আমার ডানায় পিঁপড়েরা ঘুমিয়ে আছে,
চারপাশে জল, মালিরা ফিরেছে ঘরে
শুধু এক সর্বনাশা খেয়েছে ফসল।
(বাগান: সরোজ মোস্তফা)
কবিতার পথ বড় দহনের। দহনে দহনে কবিতা যেন আরও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। যিনি এ পথে আসেন, আসলে প্রথমে তিনি বুঝতে পারেন না এটা আসলেই একটা দহন প্রক্রিয়া। ব্যক্তি কবিটির কথা উহ্য রেখে দিলেও দহন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত কবিতাটিই যেন কারো কারো কাছে কোটরাগত প্রাণ, যা তিনি বের করে নিয়ে নেন। কবিঅর্থে চিহ্নিত সত্ত্বাটি আসলে মোটেও পশ্চাতপ্রবণ নয় বরং জ্বলতে জ্বলতে তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কে বা আপন বিবরে অবকাশ যাপনে গিয়ে খানিক জিরিয়ে নেন। ওইখানে কবি আসলে সমূহ উজ্জ্বল এক প্রাণ, আসলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কিভাবে তিনি জ্বালানোর প্রক্রিয়াটা শুরু করবেন। মূল কথাটা হচ্ছে কবি জ্বলতে আসেন, জ্বালাতে আসেন; দিনে দিনে জ্বালানোটাই যেন সংসার পেতে বসে কারও মনে। বোধকরি এইরূপ প্রণোদনাও সকল কাব্যিক নিবেদন নয়। তবে কি, কী কবিতা আর কী কবিতা নয় এরূপ বোধ বিবেচনায় আমরা কিছু উদাহরণকেও বেছে নিতে পারি নিজেকে শানিয়ে নেয়ার জন্যে। জানি সেদিনই তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ‘কবিরা শিশু। কবির মনটাই সরল; বুদ্ধিটা ঋষির। কবি তপস্যা করেন, সৃজন করেন, কৃষকের মতো কর্ষণ করেন; ভাষা দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন রূপের ফসল।’ তো ফসলের এই ফলেল শুভাচার আমরা কিভাবে বুঝবো? নিশ্চয়ই বুদ্ধির ব্যবহারটা এখানে সাবলীল হওয়া চাই। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব প্রয়োজন পড়েছিলো আর আমাদের দেশে শিল্পবিপ্লব অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে গেছে সেটা জাতির মননের ভেতর দিয়েই। শিল্প বিষয়টি আমাদের দেশের মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছেন। যেকোন কালচারাল ইভেন্টগুলির উপর নজর দিয়ে দেখতে পারেন। উন্নত জাতির প্রশ্নে, তারা এখন বুঝতে শিখেছেন শিল্পিত উপস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। যে জাতির উপস্থাপনা যত বেশি শিল্পিত সে জাতিই সারাবিশ্বে পুচ্চটি তার উচ্চে তুলে ধরেছে। বরাবরই কবিতা এখানে সেরা মাধ্যম, তীক্ষ্ন এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবিতার পাঠক খুব সহজেই এ বিষয়টি বুঝে ফেলতে পারেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একবাক্যে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন ‘কবিতা পাঠককে শিক্ষিত হতে হয়, কবি ভাষাটি জানতে হয়।’
কবিতাকে কোন সংজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। স্বয়ংসম্পন্ন শব্দের দ্যোতনায় আইডেন্টিফাইড কবিতা আত্মারই খোরাক অবশেষে। দিবসের সকল কান্তি-শ্রান্তির পর এলানো দোলানো আপনার মন খুব সুন্দর একটি দৃশ্য প্রযোজনায় রত। আপনিও কল্পনা করে দেখুন না জনাধিক্য নির্বাসন দিয়ে একটি শিশু সুদূর নির্জনে পাহাড়ের চূড়ায় বসে তপস্যারত। সুন্দরের এই উপাসক সত্ত্বাটিই আসলে অধিশ্বর, কবিতার। স্থানাঙ্কবিন্দু নির্দেশনায় ধরে নিতে পারেন সেখান থেকেই উদ্ভাসিত হচ্ছে কবিতাবিবর। শিশুর কান্নায় আপনি আন্দোলিত হচ্ছেন, উদ্বেলিত হচ্ছেন কিন্তু উপাসক শিশুর ভূমিকায় আপনি কি ভেঙে পড়েছেন? সে হয়ত আগেই উপলব্ধি করেছিলো বেথেলহেম ঠিকই একদিন ব্রোথেলে পরিণত হয়ে যাবে। কবিতাটি আসলে এখানেই, প্রতিটি মানুষ যা দেখে, যা শেখে, যা লেখে বা তাঁর অতীতের কয়েকটি দিনের ভাবনাও কবিতা। বলতে চাচ্ছি কবিতা প্রতিটি মানুষের দর্শন, বিশ্বাস। লিখতে গেলে পরিমাপের দিক থেকে যার ওজন হবে অজস্র ভাগের একবিন্দু মাত্র। ওই একবিন্দুতেই আমার স্বনির্ভর পক্ষপাত কেননা ওখানেই কবিতা রয়েছে আর যেখানে কবিতা রয়েছে সেখানে আমার বিচরণের সায় ব্যাক্ত করি।
এই যে কবিতার হাঁটাহাঁটি মানতে পারি কি সব শিল্পের বিপরীতে, আর ভাবি শিল্পটা কী, সে কি বলো জটিল গণিত কোনো, প্রাইভেট স্যার রেখে শিখে-টিখে নেবো, পথেদের কোন বাঁকে বহাবো তবে এই শব্দমিছিল, যেই দিকে মনোবল ভারী করে তোলে, জনতাই ঠিক যদি তবে আর কবিতার খোঁজে ফিরে লাভ নেই, এইমতো ভাবি আমি, এইমতো ভেবে ভেবে লিখে ফেলি যতোসব অপকবিতারে।
(বাতিঘর: মুজিব মেহদী)
প্রতিটি সূর্যাস্ত কেশবতী হলে ভালো লাগে।
প্রতিটি দুপুর শস্যমাতা হলে ভালো লাগে।
উঠোনের ধানে নূপুরের কল্লোল নেমে এলে,
কোজাগরী মুখে ছড়ায় গাঁয়ের ঝিলিক;
অরূপিত গানে অধিবাস কেটে গেলে
পৃথিবীর মাঠ যেন বহু শিলাময়, আরও রূপময়।
(আহ্নিক: রাজীব আর্জুনি)
পাটাতনে শুয়ে আছে কাঠ
কাঠ চেরাইয়ের শব্দ, তোমাদের বাগানবাড়ি।
আমার স্বপ্নের ভেতর লোহার করাত দাঁত / কাঠের শরীর ফালিফালি।
তুমি ঘরের ভেতর গোসল করো, পাশ ফিরে শোও
আমার ঘুমের ভেতর কাঠের গুঁড়া, স্বপ্নের বিষয়।
(কাঠ চেরাইয়ের শব্দ: শোয়াইব জিবরান)
আমি আমার পাঁচটি আঙুলে
পাঁচ রাজ্যের প্রভুত্ব / রেখেছিলাম
হায় ইশ্বর / এখন ছেঁড়া কামিজ মেরামত করতে
আমার সকাল / সন্ধ্যার দিকে পা বাড়ায়।
(দর্জি: অমর শঙ্কর দত্ত)
কবি ভাবছেন কবিতা তাঁর অন্তর্গত ঘোরের বয়ার। ভাবনাটি ঠিক। জৈবনিক এই মহৎ সন্তরণ ক্রিয়াটি সমন্বিত এক বেষ্টনির ভেতরে থেকে তাঁকে লিখতেই হচ্ছে। যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে নিরেট তাঁর দাহিকাবিবর। যিনি কবিতা লিখেন তিনি শব্দ কুড়াতে কুড়াতে এক সময় কাব্যবন্ধনীর ভেতরে শরীরটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর জগত রচনা করেন। মৃত্যু ও ক্ষীণ বিষক্রিয়ার সেই পোকাটির মতো যে তার সমাধিমহল নিজেই তৈরি করে অনন্তযাত্রাকে স্বীকার করে নেয়। সবুজ কোনো মাঠে ঘাসেদের মাড়িয়ে যখন যেতে থাকেন দিগন্তের দিকে তখনও তিনি সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই, যখন তিনি কোনো জনবহুল রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে রাস্তা পার হন বা যখন তিনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন কিংবা কোনো নির্জন বাগানে একটি প্রজাপতির ডানার শব্দ শুনতে মগ্ন থাকেন তখনও তিনি তাঁর সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই অবস্থান করেন অর্থাৎ যিনি কবিতা লিখেন তাঁর মনে সব সময় দোল খেতে থাকে ‘কবি’ নামক শুদ্ধ, সৎ, অতি নির্ভীক শব্দটি যার শুধুমাত্র ভাবনা হলো কবিতা বা তাঁর এই ঘোরের বয়ার, যার ভাবনা হলো সদ্য গর্ভজাত কবিতাটি কোন্ শব্দের পরিচর্যায় তিনি তাঁর গর্ভে লালন করে আলোর মুখ দেখাবেন। এহেন ভাবনায় জর্জরিত হতে হতে তিনি সুন্দর করেন তাঁর সন্তানকে। তাঁর চোখে দেখা পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরকে তিনি তুলে আনেন কবিতায়। কবিতা তাই বহুগুণের অধিকারী- তার প্রথম গুণই হলো স্বয়ং কাব্যিক অধিশ্বর কবি এবং ক্রমান্বয়ে তারপরের গুণই হলো কবিতা কবিতা। প্রকৃতপে কবি ও কবিতাই হলো পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থনার বিষয় যেখানে কোনো বৈষয়িক ভাবনা নেই। আছে শুধু নিজস্ব ভূ-মণ্ডলকে দেখার বাসনা, জানার বাসনা, জানাবার প্রচণ্ড তাগিদ। এতসব জানার পরও সিরিয়াস পাঠকের কাছে কবিতা পুনরায় দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। আমরা জেনেছি কবিতার প্রথম পঙক্তি স্বর্গ থেকেই কবির উপর সঞ্চারিত হয় বাদবাকি কবির ঘোরেরই অন্তর্বয়ান। কিন্তু আলফ্রেড খোকন তাঁর এক কবিতায় জানাচ্ছেন কোনো এক বিশেষ কারণে তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরকম পঙক্তি উৎসারণের ফলে পাঠক একটু দ্বন্দেই পড়তে পারেন। প্রথমত তিনি কবিতা লিখে সেই লেখার সূত্রাসূত্র নির্দেশনায় আস্থা রাখেননি, দ্বিতীয়ত অধ্মাত্য একটি ইন্দ্রজালে পাঠককে এখানে অযথাই জটিল করে তোলেন তিনি। সমস্ত ঘোরের বয়ার ভেঙে দিয়ে পাঠক এখানে স্থূল কোনো আইডিয়ায় আটকে যেতে পারেন। কবিতা কি তবে স্বয়ং কবির ক্রিয়েটিভিটি ছাড়াই রচিত হবার মতো কোনো বিষয়? তাহলে তাঁর এই দীর্ঘ দীর্ঘ কাব্যিক উপাসনার ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে? স্বয়ং অতীশ দীপঙ্কর কী সহস্র বর্ষের থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে তাঁর জমানো শব্দগুলো কবির ভেতর থেকে বের করে সাজিয়ে, নিবেদনের জন্য নিয়ে গেলেন? মোটেও তা নয়, সেক্রিফাইস যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ওখান থেকেই তো লিখিত হতে পারতো! পাঠকের আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনাটি কিন্তু এখানে ঘটে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আইডিয়া আবিষ্করণে পাঠকের বিশেষ ব্যবচ্ছেদ-জ্ঞান জরুরি। সাধক পাঠকের অধিক নিমগ্নতার কোনো বিকল্প থাকছে না এখানে। সমকালিন প্রেক্ষাপটে বলতে পারি এরকম পাঠমনস্কতার অভাব দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। এরূপ পরিস্থিতি পরবর্তী সময়কে ব্যাপক দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেভাবেই হোক এই অবস্থাটি আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
তুমি কালো নদী থেকে উঠে এসে জাপটে ধরো আমাকে
সূর্য বেরিয়ে পড়ে মেঘ থেকে, কতোকাল সে আমার / বন্ধু ছিল না
ধুলোর ভেতর দিয়ে জুতোহীন হেঁটে গেছি পাতার-বাকলে / গুপ্তাঙ্গ ঢেকে
দুপুর, সকাল থেকে; সন্ধ্যা, বিকেল থেকে; / রাত্রি বসেছে বেঁকে ভোরে
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
(ভারতবর্ষ: চঞ্চল আশরাফ)
কোন না কোন সমুদ্রের জন্য
আমাদের নারীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে / ভূতপূর্ব দস্যুর সত্তায়।
হাওয়ার ধারালো হ্রেষার চেয়ে তীক্ষ্ন
লবণাক্ত ফেনার প্রসার এসে যার
রক্তকে ফেনিয়ে তোলে, ঢেকে দেয়
প্রজ্ঞাপ্রণালীর হিমায়িত সিন্ধুর কিনারা। / তবুও সমুদ্র দেখিনি আমরা।
(জলদস্যু: শান্তনু চৌধুরী)
কায় ভাসিলো পথের ধুলোয়
আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন
কে গো ভাসালে বলো / উড়ো মন্তরের ছায়া ঘোরের বয়ার
রহস্য বিভঙ্গ আরও পরে থাকে মেঘের কাপড়
আমি গৃহ বাঁধি তার বাড়ি / ধুলোর জলে অনেক রকম কেলি
(ধুলোপাঠ: মোস্তাক আহমাদ দীন)
ছন্দময়তা কবির কর্ণইন্দ্রিয়টিকে সজাগ করে দেয় ফলে একজন লেখক-কবির মধ্যে সহজ মন্তব্যে কর্ণযোগ করার একটি প্রবণতা আপনা থেকেই তৈরি হয়। রচয়িতার স্বাভাবিক সঞ্চারণও কখনো কখনো মুছড়ে পড়ে সেখানে। কবিতার কথা শোনেই যে পাঠক নাক সিটকোবেন যে, কবিতা-টবিতার ওসব বুঝি না কিছু, কি যে লিখে ছাই! এখানে নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটিই আসলে নিগৃহিত হলো দুর্বল পাঠকের মন্তব্যে কিন্তু কবিতার জন্য আসলে এটি কোনো মন্তব্যই নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি আসলে সাহিত্যের কোন শাখায় বোঝেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কবিতা বুঝতে পারা যতটা কঠিন তার চেয়ে সহজ হবে না বোঝা এমন ভাবনা থেকেই হয়ত সহজেই কেউ ওরকম মন্তব্য করে বসতে পারেন। এটাই তার জন্যে সঙ্গত সহজকথা। তাছাড়া তার এই বোধভাবনাটি যে ব্যাপৃত কবিতার চেয়ে কবির মৌলিকসত্ত্বায় গিয়ে পড়েছে তা আমার বুঝতে বাকি থাকে না। এরকম মন্তব্যে যেকোন লেখক-কবিরই মৌলিক ভাবনা ব্যাহত হবার কারণ থাকে। জাতিয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে এই মনোভাবটি বর্জিত হওয়া জরুরি বলেই মনে করি আমি। যে কারণে আমাদের শিতি পাঠকশ্রেণি থাকা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি যদি তিনবেলা পেটপুরে খাবার খেতে পছন্দ করেন, খানিকটা হাঁটতে, গান গাইতে, কোন নারীর যৌন উত্তেজনা পেতে বা মাটিচাষ করে ফসল ফলাতে ভালোবাসেন তবে তিনি যে কবিতায়ই ঘুরেফিরে আসছেন তা তাকে বুঝতে হবে। একটি পাখির হৃদস্পন্দন ও পিঁপড়ের নিরব হাঁটাহাঁটিও আমার কাছে একটি প্রকৃত কবিতার গর্ভপঙতি। পৃথিবীর এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে কবিতার কোষ নেই। কবিতা অসীম শূন্যতার মতোই সর্বময় বিভাজিত আর তা থেকে কবিতা ব্যাপৃতই হচ্ছে কেবল। আসলে তাঁর ভেতরটা কবি বাহিরটা শ্যাঁওলায় তেলতেলে, পা রাখলেই পিছলে যায়। আবার অন্যঅর্থে এরও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, খুব কমসংখ্যক কাব্য রচয়িতার ক্ষেত্রেই এরকমটি হতে পারে। অনেক ভালো সৃজন প্রয়াসও তাঁর কাছে ব্যর্থ হতে পারে অধিক শৈল্পিক প্রকরণগত ভাবনার কারণে। কবি-ছড়াকার রইস মনরম লেখালেখির প্রসঙ্গ ধরে খুব সূক্ষ একটি প্রশ্ন রাখলেন আমার কাছে। যেকোন লেখকমাত্রই কি তাঁর লেখনি হতেই হবে ভেবে লিখতে হবে? মুশকিল হলো, তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন লেখকের কাছে বিষয়টি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাঁর লিখনপ্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয় তখনই যখন সে বুঝে ফেলে তাঁর লেখা হতেই হচ্ছে না। এরকম বোধ, প্রজ্ঞার কারণে তাঁর কাছ থেকে সবকিছু ফসকে যেতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন চূড়াস্পর্শী তাঁর লেখনিটি হয়তো আর ভূচরণে সমাপিত হবার নয়। ফলে এই হতেই না হওয়া লেখাটি নিয়ে ক্রমশ হতাশায় পড়ে তিনি কবিতা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে যেতে থাকেন। আর এভাবে লেখকটির কাছ থেকে ইনফরমেশনও এমনভাবে কমতে থাকে যে, একসময় লেখকটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়েন। এবং তাঁর শব্দ-সম্ভারের ক্রিয়েটিভ সার্কেলটি হয়ে পড়ে প্রায় মনোবাঞ্ছাহীন এক ব্যর্থ মনীষা। এরকম পরিস্থিতিতে আটকে থাকা কোন সৃজনশীল লেখকের জন্যই কাম্য নয়। এটা একটা জাতির জন্য দুষ্প্রাপ্য মৌলিক কোনো প্রাপ্তির আরাধ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। সমকালিন প্রোপট যাই হোক না কেন বরং সামগ্রিক কবিতাকল্যাণে এর থেকে কাব্যিক সত্ত্বাটির উত্তরণই জরুরি।
পাতার আড়ালে গিয়ে চুপচাপ থাকবো ঘুমিয়ে
একটি মৃত্যুর পরে জমে হিম করুণ বরফ
অসীম অমর তুমি শূন্যতায় সারাটি দুপুর
পৃথিবীতে কেঁদে কেঁদে জলে জলে জাগাবে জীবন
নদী কি ঝরনার মতো গলে গলে
পর্বতের স্তন বেয়ে চিরে-চিরে জন্মের নাভিতে / আমি।
(পুনর্জন্ম: শোয়েব শাদাব)
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে পোড়ে পথ, গ্রাম / ছেঁউরিয়া জপে শুধু রাধা রাধা নাম
আকাশে প্রবল মেঘ গ্রামবাসী ঘুমে অচেতন
এখনই নামবে ঝড় কলঘরে জলের পতন
কালঘুমে পার হয় জন্মের স্বাদ / বৃষ্টির জল আনে নতুন আবাদ
কর্ষণে বীজ পেলে একে একে দিন চলে যায়
রাধাও শাশুড়ি হয় কোনো এক ঘন বরিষায়।
(নতুন আবাদ: অলকা নন্দিতা)
মানুষকে তার দুঃখ কি পুড়ে? / মানুষ পোড়ে সুখে।
রহস্যময়ী সুখ মানুষকে কেবলই এক
নিকষ অন্ধকারে উবু করে রাখে।
আর সুখের এই হেন অনুধ্যানে / মানুষ তার দিনরাত্রি খুয়ে
নিঃস্ব হতে ঢাকে বিবর্ণ মুখ / এভাবেই সুখ
মানুষ পুড়ে পুড়ে খণ্ডন করে / একদিন পৃথিবীর সমিল করে তোলে।
মানুষকে তার দুঃখ তো পুড়ে না / মানুষ পোড়ে সুখে।
(মানুষ পোড়ে সুখে: সৈয়দ নাজমুল করিম)
কবিতা আপনার কেন ভালো লাগবে আর কেন ভালো লাগবে না তা আমার জানা নেই। কী করলে ভালো লাগবে তাও জানা নেই। তবে আমার কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে বারবার পড়তে, যতবার পড়ি ততবার সে আমার কাছে চির নতুন, প্রথম সঙ্গমের মতো আরামদায়ক। অক্সিজেনহীন কোনো ঘরে একজন মানুষ বাতাস পেলে যেমন প্রাণ ফিরে পায় আমার কাছে কবিতা সেরকম স্বস্তিদায়ক। শৈশবে আমি ঘোড়ায় চড়তাম, গর্ভবতী ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াতাম, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বহুদূরের গ্রাম দেখতাম, সবুজ মাঠ; পিঁপড়ের মতো মানুষজন দেখতাম, মনে হতো যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। আজ সেই স্বপ্নগুলো আমার অতীত, আকাশে ভেসে বেড়ানো হয় না ঘুমের মধ্যে ছাড়া। ঘুড়ির লেজের মতো ছিঁড়ে গেছে উড়াল পাখির দিন। পেছনের লেজটাও হারিয়েছি কবে। অরণ্য থেকে বেরিয়ে মুছে ফেলেছি পিতামহের নাম, মসৃণ সুতোয় ঢেকে ফেলেছি সুন্দর সৌন্দর্যটুকু। মনে নাই আমার নামও ছিলো ক্যালকানা ফলুয়াকি চ্যাঙ। মন্দ কি! কবিতা হলেই যদি সে স্বপ্নটাকে পুনরায় উপভোগ করি তার শব্দের গূঢ়তায় তবে তা যথার্থ যশাসই। শব্দের শক্তি ও আরও অনেক সম্ভাবনার কথা সকলেই জানি। শব্দের পর শব্দ সমন্বয় করেই একজন কবি আপনাকে দোলায়িত করছেন কবিতায়। কোমল ভাবনাটি জাগিয়ে তুলছেন, নরম করে তুলছেন আপনার সূক্ষ ইন্দ্রিয়কে যেন আপনি স্বাপ্নিক ঘুমে চিৎকৃত হচ্ছেন। শব্দের এই দোলায়িত হওয়ার বিষয়টিই আসে ছান্দিক কবির সুনির্দিষ্ট ছন্দের প্রয়োগ থেকেই। আমি প্রায়শই বলে থাকি, যে কবির কবিতায় ছন্দের সুন্দর বিন্যাস থাকে ওই কবির কবিতা দীর্ঘব্যঞ্জণায় পাঠকের মনে অনেক অনেক দিন সঞ্চারিত হতে থাকে। যেমন ধরুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিপখান তিনদাড় / তিনজন মাল্লা / চৌপর দিনভর / দেয় দূর পাল্লা’ আবার আমার ‘অসমাপ্ত রৌদ্রদিন’ কবিতার কয়েকটি চরণ এরকম ‘মেঘশরীরে শীতল ছিলো, শীতল ছিলো পানি / তোমার বাড়ি দেখিনি আরও চোখের রেখাখানি / চোখের কোণে সাঝের ছবি চোখেই সর্বনাশ / তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আমার গলায় ফাঁস’ স্বরবৃত্ত ছেড়ে অন্য আরেকটি ছন্দে সুমন রহমানের ‘মেঘশিশু’ কবিতাটি দেখুন ‘আকাশে তখন জোর প্রস্তুতি, তুমুল গমগম / সমতটে শ্রাবণ আজ শুরু, মেয়েটিকে প্রথম কদম / উপহার কে দেবে, বাঁশি একাই রাধা রাধা বলে / হায় চঞ্চল হাওয়া! ওকে ডাক, ও যে মেঘশিশু / ডেকে আন মাতৃমেঘে, কচুক্ষেতে করতে দিও না হিশু’। এখন পাঠক ভেবে দেখুন উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর সঞ্চারণ আর প্রথাছন্দহীন কোনো কবিতার সঞ্চারণ একইরকম কিনা? যে কারণে একজন কবির ছন্দ সচেতন হয়ে কবিতা লেখা জরুরি, পাশাপাশি পাঠকেরও ছন্দজ্ঞান ব্যতীত কবিতা আস্বাদন কবিতাকে কখনো কখনো অর্থহীনতায় ফেলে দেয়। আবার কবিতার নিজস্ব একটা ছন্দ আছে যা থেকে পাঠক দারুণ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। টি,এস এলিয়ট মনে করতেন যে ‘কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়’, অর্থাৎ সঞ্চারণ বস্তুটি এমনই সূতর যে বোধগম্য হওয়ার চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত পাঠককে পৌঁছাতে হচ্ছে না, এরও অনেক পূর্বে কবিতার পজিটিভ দিকটি তার মধ্যে লোডেড হয়ে যাচ্ছে। কোনো পঙক্তি উচ্চারণের সাথে সাথে মুহূর্তেই আপনি এর ভাবাবেগে আন্দোলিত হতে থাকলেন। এর বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলবো ওখানেই কবিতা নিহিত আছে। যিনি পড়বেন আপন ভুলে, ধ্যানে মগ্ন হয়ে। আর যিনি লিখবেন একপশলা রোদ এসে কীভাবে একটি সকাল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। টেক্সটের ভিন্নতা সত্বেও এখানে উভয়ের চেনাপথ, দর্শন, চলাফেরা, যন্ত্রণা একই। আসলে এঁরা দুজনেই কবি। একজন পড়েন অন্যজন লিখেন। কবিতার একই ঘরে সহোদর তারা মিলেমিশে পাঠক আর কবি। একজন আসেন সৃজন করতে অন্যজন গড়তে। এ দুয়ের ভূমিকাও সমান কাব্যিক ব্যঞ্জণায় উদ্ভাসিত।
কাকের কথা আমি আগেও বলেছি- তারা শান্তিপ্রিয়, এখনো আমার প্রতিবেশী হিসেবে তাদের পাই সকালের আয়োজনে রাতের অপস্রিয়মাণতায়। পৃথিবীর সমস্ত পতঙ্গ তাকে ভুল বুঝেছে ভুল চিনেছে- কাকের অনন্য সাধারণ কর্কশ কণ্ঠের বিরল সুস্পষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে কাক বিষয়ে আমাদের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
(পুনশ্চ, কাক বিষয়ে: জাফর আহমদ রাশেদ)
দ্রুততম চলে যাচ্ছে সময় তার অদ্ভুত-অদৃশ্য বাহনে চড়ে
আমাদের নেই একটুও ঠাঁই তার কামড়ায় একসঙ্গে উঠার;
কেনো মিছে ভাই হেঁয়ালি তবে আর / উজান-তরঙ্গে কিসের ভাটিয়ালি!
যখন য়ে গিয়ে বিনষ্ট আমাদের না’-এর গলুই-তক্তা-মাথাকাঠ,
ফেরার আগেই সঙ্গীদের হারিয়েছি চিরপুরী বাতাসে-
আর কত ভাসান দেব, হৃদয়-আকাশেরও তো / কূল-কিনার নেই;
(সময়বোধ: আশরাফ রোকন)
সবসময় তোমাকে অবশ্যই মাতাল হতে হবে।
সময়ের বিভৎস বোঝা যাতে অনুভব করতে না হয়, যা-
তোমার কাঁধ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, নুইয়ে দিচ্ছে মাটির...
দিকে, তোমাকে মাতাল হতেই হবে, একটুও থামলে চলবে না।
কিসে মাতাল হবে, সূরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা-
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
(শিরোনামহীন: শার্ল বোদলেয়ার)
কবিতার এই আবহমান প্রক্রিয়ায় আমরা পার করে এসেছি বিগত শতাব্দী। অসংখ্য কবিতার বোঝা আমাদের মাথায়। গত শতাব্দীতে আমরা কবিতাকে কতটুকু ভালোবেসেছিলাম, কতটুকু লালন করেছিলাম, কতটুকু ব্যাপৃত প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা সঠিক জেনে নিয়েই আজকের নতুন কবিকে লিখে যেতে হবে তাঁর অভিপ্রায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজের সময়টা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। সমকাল তাকে এত বেশি মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, অন্ধমোহে জড়িয়ে থাকা ছাড়া তার কোন গত্যন্তর থাকে না। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে যে, সে তাঁর অতীতের দিনগুলোকে প্রত্য করেনি; প্রত্যক্ষ করেনি কোন কবিতার গূঢ়তায় তার আজকের লেখার তাগিদ আর দেখেনি সে নিকট কোনো ভবিষ্যত। যে নবীন কবি আজকের এই দীনতাকে মাথায় তোলে বয়ে বেড়াবেন তাঁর সময়কে, আগামীর শ্রদ্ধা তো তাঁরই। তাছাড়া এই বিষয়টি প্রত্য উপলব্ধি করার সুযোগ নবীনদের ক্ষেত্রেই বেশি থাকে। সেই আসন্ন নবীন কবি-পাঠকটিই জরুরি এখন বাংলা কবিতায়। বিগত শতাব্দিতে আমরা কবিতার কাছে যতটা দায় ফেলে এসেছি সে দায় থেকে মুক্তি পেতে যে অগ্রজ একজন নতুন কবিকে পর্দার আড়ালে টেনে নিয়ে ধোঁয়া সেধে অজ্ঞান করে রাখতে চাইছেন সে দায়টুকুও একজন নবীনকেই মাথায় নিয়ে তাকে শিল্পের পথ পরিস্কার করতে হবে। একজন কবির যদি তাঁর লেখার সময় থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত জানার প্রচণ্ড তাগিদ না থাকে আর কবিতাকে নাকসিটকোতে শিখেন তবে প্রকৃতই কবিতার আসন্ন মৃত্যু হবে বৈকি! (অবশ্য সে মৃত্যু ওই নির্দিষ্ট সময়ের পাঠকের কাছে, প্রকৃতই কবিতার মৃত্যু নেই। প্রায় চার / পাঁচ হাজার বছর পর আবিষ্কৃত সাফো’র দুর্লভ কবিতাগুলো আজ আমরা ঠিকই পড়তে পারছি)।
এ আমাদের দীনতাই বলতে হবে যে, বাংলা একাডেমির মতো এত বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের থাকা সত্বেও তরুণদের জন্য বৃহৎ কোনো উদ্যোগে তাদের চৈতন্য নেই। প্রতিবছরই এই প্রতিষ্ঠান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অজস্র প্রকাশনা করে থাকলেও কবিতার ক্ষেত্রে আহামরি কোনো অবদান রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। (করে থাকলেও আমার মতো অনেক পাঠকের যোগাযোগের বাইরে)। প্রায়শই দেখা যায় যে অগ্রজ-অনুজের মধ্যে চিন্তার একটা তফাত তৈরি হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও এরকমই ঘটে আসছে। অগ্রজ একজন কবি সাধারণত অনুজ কোন কবির লেখা পড়েন না কিছুই হচ্ছে না বা হয়ে ওঠবে না কিংবা হয়ে উঠলেও তাঁর কাক্সিত ল্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না এরকম একটা ধারণা নিয়ে। বিপরীত একটা মুশকিল এখানে থাকছে। অনুজ কবির সৃষ্টিশীলতা তাঁর অজ্ঞাতেই থেকে যাচ্ছে এবং তার ব্যর্থতার জায়গাটিও তিনি আবিষ্কার করতে পারলেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে চিন্তার যোজন ফারাক আর বৈষম্যতাও। অগ্রজ-অনুজ এই দুই বৈষম্যকে সমন্বয় করতে তারাই পারেন এ’দুয়ের ফলপ্রসূ প্রকাশনার মাধ্যমে। অথচ সেদিকটাতেও তাদের হুঁশ রয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে এতটা কার্পণ্য নেই বোধ হয়। সারাবিশ্বের যেকোন দেশের কোনো না কোনো কবিকে আমাদের দেশের পাঠক জেনে গেছেন মূলত সে দেশের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও যোগাযোগের কারণে। আমার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সেরকম ফলপ্রসূ কোন ভূমিকা আজও রাখতে পারেনি। কবিতার ভূমি আমার গর্বের দেশ অথচ কি বিচিত্র এই বঙ্গদেশ! দেশের মানুষজন! প্রতিষ্ঠান! সেলুকাস... আজও তারা কবিতাকে ধারণ করতে পারলো না প্রাণের গভীরে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করবো আমাদের বৃহৎ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেজন্যই ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র লিটলম্যাগের আবির্ভাব ঘটেছে এইটুকু একটা দেশে আর সেগুলোর হঠাৎই মৃত্যু হয়। কোন কোনটির ক্ষেত্রে আর্থিক অসংগতি, বিজ্ঞাপনের অভাব, লেখার অভাব, লেখায় শিল্পময়তার অভাব এখানেও ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠছে অগ্রজ-অনুজ বৈষম্য। এহেন কলুষিত অধ্যায় আমরা সাহিত্য থেকে মুছে ফেলতে না পারলে বা পাঠকের কানে সে সুর বাজার আগেই কবিতার পথ পরিস্কার না করলে ধ্বংসের কিনারে একা একা বসে থাকতে হবে আগামীর কবিদের। আমি মনে করি শুভস্য শীঘ্রম আপনার কাব্যিক প্রণোদনা।
বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যায় সমস্ত শরীর / ভায়ওলিনের সুর দোলে
দুলে ওঠে মানিপ্লান্টের লতা / একচালা ছোট ছোট ঘরগুলি
পুকুর ঘাটে নতুন বউ, কদম গাছে ছোটপাখি
ধানের ক্ষেতে শাপলা একপায়ে তালগাছ
পর্দা সরে যায় বড়কর্তার ঘরের জানালার
মেঘের শব্দে মিশে যায় নারীর আর্তনাদ
স্বর্ণচাপার তলায় সাপের খেলা / নেড়ি কুকুর অবিরাম ডেকে চলে, ডাকছে কাক
খিচুরির চাল ফুটছে চুলোয় / ঘরে প্রতিক্ষায় কেউ
(স্বীয় সঙ্গোপনে-১৩: মাহফুজা হিলালী)
ভালো ভাষা, তুমি কি বহন কর বিশ্বাসযোগ্যতা?
সৌন্দর্যবিচার থেকে কিছু শব্দ খসে গেছে, পড়ে আছে
নর্দমার ধারে, তাকে তুলে এনে কোথায় রেখেছো?
ঘষা কাঁচ, পুরনো পয়সার দুঃখ নিঃস্বের ঝুলিতে
প্রাত্যহিকতার সাথে মিশে তাও আজ কিশে।
(ভালো ভাষা, কোথায় চলেছ?: বিশ্বজিৎ চৌধুরী)
জল বোবা হলে / সাগর হয়ে ওঠে
দেশে দেশে পালকের বোবা কাহিনী / গেয়ে থাকে পাখিরা
বোবাদের চারপাশে বেড়ে ওঠে / গান, ফুল ও রোদ
আমার ঘর যেন / পালক ও কাশফুলের পৃথিবী
(বোবা কাহিনী: যুবা রহমান)
‘কাব্য সাহিত্যে নাটক হচ্ছে সর্বোত্তম’ উক্তিটি কার? এ মুহূর্তে মনে আসছে না। তবে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি এই জন্যে যে, তাঁর বোধের স্বচ্ছ জগত থেকে তিনি তাঁর বোধের ভাষাটা রেখেছিলেন কাব্য পাঠকের জন্য। নাটকের প্রধান সঞ্চারণের বিষয় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার মধ্যেই দর্শকশ্রেণি আন্দোলিত হচ্ছেন ঠিক অন্য একটি ঘটনায়, তাঁর কল্পলোকে। আর সেই কল্পনা থেকেই জেগে উঠছে আপনার প্রকৃত ইমোশান বা ভাবাবেগ যা শিল্পের জন্য প্রধান একটি বিষয়। জগতের সকল বিষয়েই আমরা যেরূপ নাটকিয়তা প্রত্যক্ষ করি আমাদের জৈবনিক সকল ক্রিয়ায় অনেকটা বন্ধনযাতনায়! ফলে প্রিয় থেকে প্রিয়তম এই বিষয়টির শিল্পময়তা বিষয়ে আমার দ্বিধাদ্বৈততা নেই। আর সাধারণ শ্রেণির আন্দোলিত হওয়ার পেছনেও আমার যথাযথ সায় ব্যাক্ত করি, পাশাপাশি সংগীতের আবেদনকেও এর সাথে যোগ করি আমি।
কিন্তু একজন কবি যথার্থ অর্থেই নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকার, প্রবন্ধকার যাই হোন না কেন তাঁর ভেতরে যখন কাব্য খেলা করে তখন তিনি কোথায় উত্তম, সর্বোত্তম, অধতম তা তাঁর নিজেরই জানা থাকে না। আপাত দৃষ্টিতে তাঁর কবিন্দ্রিয়টি খোলা রাখলে বা খোলা থাকে তবে তাঁর সৃষ্টি সর্বোত্তম, সে নাটকই হোক, কবিতাই হোক, প্রবন্ধই হোক আর ছোটগল্পই হোক। কবির জন্য এটি অত্যন্ত সুখের যে, তাঁর কবিন্দ্রিয়টি যদি খোলা থাকে বা যদি হয় সঞ্চারণম তবে একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদার্পণ করা কিন্তু একজন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, ভ্রমণ কাহিনী এইসব লিখিয়ে এমনই এক সূক্ষ বৃত্ত বা ব্যাসার্ধ থেকে পরিচালিত হন যে, তাঁর পে কখনোই সম্ভব নয় কাব্যিক অন্তরায় সঞ্চারিত হওয়া, ওই অবস্থান থেকে কখনোই সম্ভব নয় সাহিত্যের সকল শাখায় প্রভাব বিস্তার করা। এক্ষেত্রে কবি ও কবিতাই সিদ্ধ স্মরণেষু কেননা একজন কবি তাঁর কবিতায় ধারণ করেন সমস্ত কিছুর প্লট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সৈয়দ শামসুল হকের লেখা যাঁরা গভীরভাবে পাঠ করেছেন তাঁরা এর সত্যাসত্য আবিষ্কার করেছেন নিশ্চয়ই। একমাত্র কবিরই সকল বোধ খোলা থাকে কিন্তু যাঁরা সরাসরি ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার তাঁদের বেলায় এরকমটা হয় না সাধারণত। কবি অর্থে চিহ্নিত কারা? তা প্রমাণ করা কারো পে সম্ভব নয়, একমাত্র তিনিই এর যথার্থ উত্তর মেলাতে পারেন যিনি পড়েন আর পড়েন এবং পাঠশেষে নির্দ্বিধ বলে দিতে পারেন সর্বোচ্চ সঞ্চারিত কবির নাম। কিন্তু যুক্তিনিষ্ট সত্যভাষণ প্রদান করতে পারেন এরকম পাঠক আমাদের নেই। তারপরও স্বাভাবিক অর্থেই আমরা জেনে যাই কে কবি আর কে অকবি। পাঠকই তা নির্ধারণ করেন। অবশ্য এখানে একটা সমস্যা তৈরি হয়, পাঠকই আসলে প্রকৃত অর্থে কবি; তা না হলে কবি যে কবিই মূলত সে বিষয়টি কে আবিষ্কার করতো? জীবনানন্দ দাশ কবি চিহ্নিত করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ শেষপর্যন্ত তারও সিদ্ধান্ত ছিলো পাঠকের উপর কেননা সকলেই কবি না হলেও পরবর্তীতে আর কোনো কবি আসবে না একথা তিনিও বলে দিতে পারেননি আর তাছাড়া নিজেকে যদি কেউ সঠিকতা নির্ণায়ক হিসেবে দাবি করেন তবে তা ভুলই হবে। সময়ই বলে দিতে পারে কে কবি আর কে অকবি। একশো বছর পর যদি ওই সময়ের পাঠক জীবনানন্দ দাশের পরে কবি হিসেবে মহাদেব সাহা, রবীন্দ্র গোপ, আসলাম সানী-কে আবিষ্কার করেন এবং সে যুক্তি যদি যথার্থ অর্থে সাময়িক হয় তবে কারোরই কিছু করার থাকবে না। যেহেতু এ সময় আমরা এঁদের সেঅর্থে কবি হিসেবে মনে করি না। কিছুটা মহাদেব সাহা ব্যতীত বাকি দুজনই কবিঅর্থে প্রায় নিষ্ক্রিয় বলা চলে।
তাহলে সোজা কথাটা দাঁড়াচ্ছে এরকম যে, সামগ্রিক অর্থে কাউকে কবি বা অকবি বলবার মতা আমাদের নেই বরং আমরা আমাদের পছন্দের কবি চিহ্নিত করতে পারি শুধু।
আমাকে দাওনি তুমি কম্পাসের খল নির্ভরতা
ছিলে না পরার্থপর মৃত্তিকার দিগন্ত নির্দেশে / বস্তু হতে অবাস্তব ভূতের আশ্লেষে
ক্রমশ লুপ্ত হয়ে অতগুলি অলৌকিক যন্ত্রের কথা
মনে কি পড়ে না কারো? আকাশে উড্ডীন
শকুনতাড়িত সূর্য হেলে পড়ে কম্পাসকাঁটায়-
বৈশাখ দুপুরে দূর বিমানের ধাতু আলেয়ায়
বিপুল এয়ারড্রোম পড়ে আছে বৈমানিকহীন।
(বিশাল বাস্তবিক নত্রপদ্ধতি: উৎপল কুমার বসু)
ভোরের উৎফুল্ল ঠোঁট দরোজায় জানালায় চুমু খায় আয়।
এই ছোট্ট ডাক দিয়ে একজন পাশ ফেরে যুগল শয্যায়,
ঘুমের ভেতরে হাসে, সবুজ বৃরে মতো আঙুল বাড়ায়।
আমাকে নির্বোধ যদি মনে করে থাকো- ভুল হবে;
যদি মনে করো আমি স্বভাবত ভুলে যাই সব- ভুল হবে;
যদি মনে করো এখনো জানি না আমি কি ফেলে এসেছি-
ভুল মনে করা হবে।
(গাছ পড়ে যায়: সৈয়দ শামসুল হক)
সময়ের মধ্য থেকে কিছুটা সময় বের করে নিতে হয়
যেমন সবার মধ্য থেকে প্রিয়তম বন্ধু এসে ডাক দেয়;
তার সরল কথা শোনার পরে পৃথিবীটা চির আধুনিক
জ্ঞানী কিংবা মূর্খ প্রত্যেকেই চেয়েছিলো এই ডাক দিক;
সময় পেয়েছে যারা, সময়ের থেকে চলে গেছে বহুদূর
সময়ের হাত ধরে লাইনে দাঁড়ালো- ওই যে সুদূর;
(সময়ের মধ্য থেকে: আলফ্রেড খোকন)
ভাবনার, আবেগের, বোধের সন্তরণই কবিতা। কবিকে তাই মগ্ন থাকতে হয় তাঁর চিন্তায়, কবি তাই মগ্নই থাকেন আর এভাবে মগ্ন থেকে থেকে ক্রমান্বয়ে তিনি হারাতে থাকেন পরিবার, সমাজ, দেশ। কবির ভাবনায় সমস্ত ভূখণ্ডই হয়ে যায় তাঁর চলার পথ। কেউ কেউ বলেন কবি আসলে সমাজের বিচ্ছিন্ন একটি প্রাণির নাম, এ কারণে যে একজন কবির মধ্যে সামাজিক কোনো দায়বোধ থাকে না বা সেঅর্থে জন্মও নেয় না। শুধুমাত্র একজন কবির ক্ষেত্রেই নয় যেকোন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিমাত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। এ কথাটা যতটা সত্যি তারচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে কবির কল্পনার বিস্তার সমস্ত মহাশূন্যকে ঘিরে। সুতরাং পরিবার সমাজ, দেশ, জাতি, ধর্ম, এসব কবির কাছে ক্ষুদ্র হয়ে যায়। সঙ্ঘশক্তি বা সমাজভাবনা যেখানে একজন সাধারণের আরাধ্য বিষয় হয়ে থাকে সেখানে একজন কবির ক্ষেত্রে বিপরীত হিতেরও কারণ হয়। ফলে ত্রেবিশেষ শুধু একজন কবি নয় সিরিয়াস পাঠকও এরকম সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। একটি কথা হলো, যার ঘর রা হয় তার বাহির রা হয় না আর যার বাহির রা হয় তার ঘর রা হয় না, মূলত এ দুটোর মাঝখানেই কবির অবস্থান। যার দুকূলই রা হয় বা এ’দুয়ের লিটারেসি মিডিয়ায় অধ্যরে ভূমিকা পালন করেন তিনি একজন পাঠক। একমাত্র পাঠকের দ্বারাই সম্ভব দুটো বিষয়কে সমন্বয় করা। আমাদের পাঠকরাই সমৃদ্ধ নয় এ দোষ বা গুণ কার উপর গিয়ে বর্তাবে তা ভেবে পাই না। সর্বোপরি আমাদের কবিরাও পাঠঋদ্ধ হওয়ার আগেই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন- যা সাধারণ পাঠকের প্রাপ্য নয়। বস্তুজগতের সকল মানুষই কবি এবং সবকিছুই কবিতা। এর মধ্যেও একজন কবি যখন লিখতে শুরু করলেন ধরা যাক সে সময় থেকেই কেবল তাঁর ইন্দ্রিয়টি খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রকাশবিচারে একজন কবির জ্ঞানের জগত যথার্থ প্রগাঢ় হওয়া চাই। এই বিষয়টির যথেষ্ট অভাবস্বত্বেও যখন একজন কবির মধ্যে অহেতুক উতলা হওয়ার অভিনয় দেখি তখন কষ্ট পাওয়াব্যাতীত কোনো গত্যন্তর থাকে না।
বাংলাসাহিত্যে পড়ান এমন এক রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপকের সাথে কথা হয়েছিলো একদিন। তাঁর বক্তব্য ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠের পর অধুনা সাহিত্য পাঠের কি প্রয়োজনিয়তা থাকতে পারে একজন পাঠকের? কি করবো হাসিতে ট্রাজেডিক লুকোচুরি খেলেছিলাম সেদিন। প্রশ্নটির মধ্যে পাঠকের গভীরতা নির্ণয়ের একটি বিষয় ছিলো কিন্তু আমার হাসিটা ছিলো অন্য কারণে। সমকালিন সৃষ্টিশীলতার কি তবে কোন প্রয়োজনিয়তাই থাকছে না? কবিতা তো তাই একবেলা খাবারের পর দ্বিতীয়বার ক্ষুধা পায় যেমন। আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবী স্থবির নয় তারই উদাহরণ কবিতা, এও সত্য যে পুরনো কে ভাঙাই কবিতার কাজ বা পুরানের ভেতর থেকেই নতুনের সৃষ্টি। একজন জীবনানন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং তাঁর কবিতা শতাব্দীর কবিতা হিসেবে যথার্থ গুরুত্বের দাবিতে ভরপুর; জীবনানন্দ দাশ ভেঙেছেন তাঁর পুরনো ধ্যান-ধারণা এবং উৎকৃষ্ট বোধে মূল্যায়িত করেছেন সময়ের সম্ভাষণাকে। তাই বলে যাঁরা এমন সাহিত্য বলয় তৈরি করেছেন তার ভেতরেই বা একজন পাঠক আবদ্ধ থাকবেন কেন? যাকে বলি মায়াজাল, একজন পাঠকের এরকম আবদ্ধতা আসলে কাটিয়ে উঠা উচিত। তাহলেই কেবল প্রকৃত চেতনার স্ফূরণটি তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
একজন পাঠকই আসলে প্রকৃত কবি। যখন তিনি নিমগ্ন হয়ে উপলব্ধি করেন কবিতাকে তখনই জন্ম নেয় তাঁর যথার্থ কবিতাগুলো। ফলে সময়মতো তাঁর কবিতাগুলো তিনিও লুফে নেন তাঁর কবির ভেতর থেকে। একজন যথার্থ পাঠকই হলেন প্রকৃত কবিতার জন্মদাতা।
ধূলিপথে প্রণয় হলে প্রলয় প্রত্যাসন্ন হয়,
অতঃপর পুনরায় ফিরে দেখা দ্বারপ্রান্তের দৃশ্যরেণু;
নগর কাহার নাগর ও ধূলিভাই
শিল্পবন্ধু, অনুনাদহীন নগরের বিস্তার-
আজ ঘরে ঘরে শূন্যতা বর্ণনা করি!
(নগরপর্ব: আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিন
ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুন
মসৃণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীলচিঠি
লন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপসন, শাদা বাক্স ওষুধের
সৌখিন শার্টের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতার
ভবিতব্যহীন নানাস্মৃতি আর রঙবেরঙের দিনগুলি
(বৃষ্টি, বৃষ্টি: শহীদ কাদরী)
জন্মভূমি- কথাটার মধ্যে এক আশ্চর্য মাদুর বিছানো আছে,
তাতেও শুয়ে দেখতে পারো।
জ্বালা যন্ত্রণার কথা মুখ ফুটে না বললেও টের পাই-
মানুষ যেমন ফুল, মানুষ তেমনই কাঁটা!
ঘরের ভেতরকার আসবাবে হোঁচট খেলেও তো তাকে রাখো!
(ফুলঝুরি, তোমার নাম: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কবি দেখেন, পড়েন, ভাবেন, লিখেন অতঃপর তিনি একটা ভূ-মণ্ডল রচনা করেন যা তাঁর একান্ত নিজস্ব একটা বলয়। সেখানে তিনি একা, বলা যায় এটা তাঁর গভীর পাঠ প্রস্তুতির কারণে। একাই দেখেন, ভাবেন, বুঝেন, লিখেন... এখানে তাঁর ভাবনার ব্যতিক্রম তো রয়েছেই, এখানে তিনি সমাজের আর দশজন মানুষের মতো ভাবনা বিস্তারী নন। তাঁর ভাবনা অতলস্পর্শী যা শেকড় ছুঁয়ে যায়, যতটা তিনি দিগন্তপ্লাবী ততটাই তিনি গভীর পাঠক। তিনি যখন একজন পাঠক এবং আরেকজন পাঠককে বিশ্লেষণ করতে যান তখনই ফুটে ওঠে তাঁর ব্যতিক্রম সত্তা ফলে পাঠককে ছুঁতে গিয়ে তাঁকে হয়ে উঠতে হয় অত্যন্ত গভীর বোধ আর মেধার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। কবিতার ভেতরকার টেক্সটই তাঁকে সেরকম ভারী করে তোলে। এইগূঢ় সত্যের বাহিরে যিনি অবস্থান করেন তিনি এক সাধারণ মানুষ, অতি প্রাকৃত, অতি সামাজিক, অতি কোমলপ্রাণ একজন। এরকম মুহূর্তে কবির যাকে দরকার তিনি একজন ঋদ্ধপাঠক, একমাত্র তিনিই ভাঙতে পারেন কবির নিজস্ব বলয়ের আবহটাকে এবং বের করে নিয়ে আসতে পারেন তাঁর নির্বাচিত কবিটাকে। শেষপর্যন্ত কোন পাঠকই যদি তা উদ্ধার করতে সম না হন তবে কবির তাতে বয়েই যায় বরং তাঁর কাব্যসত্ত্বা অপেক্ষা করে পরবর্তী মহাকালের অপেক্ষায়। একটা সত্যি বিষয় হলো, কবির বলয় থেকে তাঁর সত্ত্বাটাকে বুঝবার মতো কোন যোগ্য পাঠকের সৌভাগ্য হয়নি বাঙলা কবিতার। যেটুকু হয়েছে তা অতিসস্তা, নিম্নমানের, সাময়িক মুগদ্ধমানের পাঠক আর তাতেই বাঙলা কবিতা রাজকপালে। আজ যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর... জীবনানন্দ দাশ... জসীম উদ্দীন... সৈয়দ শামসুল হক... ফরিদ কবির... বলে হাই তোলে ঘুম ছাড়ছি কবিতা কবিতা বলে তারাও শেষমেষ পাঠকের দলে নই কারণ এঁদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হতে গিয়ে তারাই বসে আছেন রবীন্দ্র সাহিত্য বলয়ে, সেখান থেকে তাঁদের বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এ থেকে জীবনানন্দের পাঠক অবশ্য ব্যতিক্রম, তাঁরা ক্ষাণিকটা বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছেন আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হয়ে। কিন্তু এতেই বাঙলা কবিতার ব্যাপক প্রসার নিশ্চিত হয়ে পড়েনি, বলা যায় সবেমাত্র পাঠককুলের নাকের আঁওয়া ভাঙতে শুরু করেছে। এদিক থেকে আমরা আশাবাদী যে, বাঙলা কবিতার আরও ব্যাপক প্রসার অবশ্যস্থাবী। টেক্সটের ধারণা এখানে এসে সমস্ত যৌক্তিকতা ভেঙে দেয়। টেক্সটই যদি আপনাকে কবিতার দিকে প্রবাহিত করলো তবে সেখানে পাঠকের দুর্বলতা কিংবা টেক্সটের শক্তিময়তার কথা ভাবার কোন সুযোগ নেই। স্বয়ংনির্ভর টেক্সট কোন সঠিক জায়গায় আবেদিত হয়ে সমাপিত হলো সেটিই প্রধান বিষয়।
এই শীতে গান। এই শীতে গান নেই যদি না বানাই আমি
কেননা শালিক, কাক, চড়ুইয়ের ডাক / গান নয়- যদিও আমার কানে গান-
পাখিরে দেয়নি গান, পাখিরে দিয়েছে শুধু ডাক
আমারে দিয়েছে গান, আমি তাই গানেরেই ডাকি,
ডাকি শীতে, শীতের শত্রুতা সহ্য করে, পাংশু, দিনে, / রক্তশোষা অসহ্য সন্ধ্যায়।
(মৃত্যুর পরে-জন্মের আগে: বুদ্ধদেব বসু)
কবরের পাশে জন্মানো পিপ্পল গাছ,
সারারাত বাতাস আর ঘুঙুরের শব্দ শোনো,
কোথাও বিষাদ আড়াল করে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে রুষ্ঠ প্রেতাত্মারা,
দেখছে কবর প্রাচীর ভেঙে রাত থাকতে চলে গেছে গোরখোদকেরা,
কে তোমার পাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে হৃদয়?
(উপকথার কবর ও একটি গাছ: রায়হান রাইন)
কেমন জাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতোপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিলো, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাওলার ঝোপে / লুকিয়ে বেঁচেছি এতকাল
(ডানা: সাজ্জাদ শরিফ)
কবিতা যেহেতু সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা, কাজেই সুযোগসন্ধ্যানী পাঠক সেদিকেই ধাবিত হবেন। কিন্তু আমাদের সমাজে সৌন্দর্যবীক্ষার এই ধারণারও একটা অবমূল্যায়ন আছে। আদ্যন্ত কবিতাকে জেনে নিয়েই একজন কবির উচিত তাঁর সকল নিবেদনকে প্রজ্ঞাপিত করা। গাল্পিক-সুলেখক রাজীব নূর, রেজা ঘটকের সংগে বিশেষ একটি আড্ডা হয়েছিলো একদিন আমাদের ‘পাঠসূত্র’ অফিসেই। তিনি প্রশ্ন রাখলেন কবিতা লেখা কেন জরুরি? একজন লেখক কেন তাঁর লেখাটি প্রকাশ মাধ্যমে দিতে পারেন? মহাকালের সৌন্দর্যচেতনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ইউনিট হচ্ছে কবিতা। আগেই উল্লেখ করেছি ‘সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা’ কবিতা তাই একজন কবির সৌন্দর্যচেতনা থেকেই লেখা জরুরি। যেখানে পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠতে পারে শৈল্পিক নিবেদন, অহং। ‘সঙ্ঘশক্তি’ ঠিক যে অর্থে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রিয়ার সৃষ্টি করে এর বিপরীত একটি অর্থেই একজন লেখকের প্রকাশিত লেখনি সমধিক ব্যাঞ্জণায় সঞ্চারণ সৃষ্টি করতে সম। ফলে একজন লেখকসত্ত্বার পূর্ণ নিবেদনে অবশ্যই ব্যাপক প্রকাশনা জরুরি। একটা বিষয় আমি স্পষ্ট লত করেছি যে, আমাদের কবিরা নিজেদের কবি হিসেবে ভাবতে সাহসী নয় কেননা তাঁরা এতই মুখচোরা যে, এখন আর কবি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন না। বিষয়টা প্রস্তাবনার ফলে কেউ কেউ হয়ত উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ দাশকে টেনে আনতে ভুল করবেন না কিন্তু আমার চিন্তা খুবই সাধারণ। আজও আমরা কবিতা লিখে গর্ববোধ বা শৈল্পিক অহং-এ তাড়িত হতে পারি না, যেন কবিতা লিখছি এটা একটা গর্হিত অপরাধির কাজ। তবে কিসে আর গর্ববোধ করবো? এমন অনেক পটূ কবিও রয়েছেন যাঁরা কবিতা লিখলেও মূলত তাঁর অহং-এর জায়গাটি হয়ে থাকে অন্য কোনো বৃহৎ পরিচয়ের। যা হয়ে থাকে বড় কোনো কর্মকর্তা, একজন বিদেশ ফেরত অকেজো বা কথার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে ধন্যবোধ করেন (হিজরা ইংরেজ) অথচ সকলেই জানি ওইসব স্থূল পরিচয়ের চেয়েও কবিতা নিশ্চয়ই আরো মহত্তম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের। এসবই প্রমাণ করে আমাদের কবি ও কবিতার অবস্থান এখন কেমন। যাঁরা এ অবস্থানটা তৈরি করেছেন ওইসব হিজরেরা কি জানেন পরবর্তী কবিদের মাথায় এর কতটা বোঝা তুলে দেয়া হলো। কথা আরো থেকে যাচ্ছে, সুন্দর প্রতিবেশ কবিতার একটি প্রধান শর্ত! মুক্তচর্চায় এরকম প্রতিবেশই কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য জরুরি হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহৎ কোনো ব্যক্তিক আইডেন্টিটিসহই কাব্যিক আইডলটি এত বেশি উজ্জ্বল থাকেন যে, আপনার সমস্ত ধারণা আমূল পাল্টে দিয়ে শৈল্পিক অহংটি পরাজিত হয়ে যেতে পারে। যে কারণে শুধু কবিতা নয় সমগ্র সাহিত্যই নখদর্পণে থাকা জরুরি। সাহিত্যে বাঙালির প্রথম নোবেল উইনার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। এরপর বাঙালির আর কোন সাহিত্যে নোবেল নেই। প্রায় একশো বছর পরে আমাদের এ দীনতা ঘুচাতে আজকের তরুণদের আরো বেশি সজাগ হওয়া জরুরি। এখনো আমাদের বাস্তবতা এরকম যে এই বাংলাদেশে শান্তিতে নোবেল পেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস আর আমাদের তরুণরা উদ্বেলিত হয়ে চায়ের আসর, ক্যাফে-ক্যান্টিন টেবিল চাপড়ে গরম করে ফেললো খবরটি শোনার পর। অথচ এরূপ হওয়াই সঙ্গত ছিলো যে, রবীন্দ্রনাথের পর আমাদের দেশে সাহিত্যে নোবেল পেতে যাচ্ছেন ফরিদ কবির। এই খবরটা আগেই জেনে ফেলা, তাহলে সেটি অধিক ফলপ্রসূ হতো। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ কিন্তু আমার ভাবনাটা এর বিপরীতে। আমার কাছে কেউ কেউ কবি নয় সকলেই কবি। কবিতা নামক শব্দটি যিনি জানেন, কবিতা নামক শব্দটি যিনি বুঝেন তিনিই কবি। যদি এমন কোনো পাঠককে খাতা-কলম হাতে বসিয়ে দিই কোথাও তবে তার পক্ষেও লিখে ফেলা সম্ভব কোনো কবিতা। সমস্যাটা এখানেই, কবিতা লিখলেই যে সেখানে কাব্যিক সঞ্চারণ থাকবে বা শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে যাবে বা যিনি লিখিয়ে তিনি যথার্থ অর্থে কবি হয়ে উঠবেন এমনটি নয়। মূলত তাকে চেনার জন্য পাঠকের একটি চোখ খোলা রাখলেই চলবে। যাঁর চলায়, ফেরায়, বলায়, চিন্তায়, মেধায়, মননে, দৃষ্টিতে, চেতনে, অবচেতনে, স্বপ্নে সর্বণ কাব্যচিন্তনের বিস্তার তিনিই কবি। সমাজের, দেশের, বিশ্বের তথা ভৌগলিক সমস্ত সুন্দর যিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর ভাবনায়; যাঁর চিন্তা সুন্দর, যিনি সত্য ভাবেন, সত্য লিখেন, যিনি সর্বণ দগ্ধ হচ্ছেন কবিতায়, তিনিই আমার কবি। ধন্য তাঁকে, নমস্য তাঁর পঙক্তি, আমার সকল নিবেদন, আমি তাঁর পূজা করি।
রক্ত দ্রাঘিমা থেকে পাঠিয়েছ বোবার কাহিনী
তাকে ক্যাসেটে চড়ালে শুধু শব্দহীন / ব্যর্থ ঘুরে মরে
আর যতো রাতের প্রদীপ এসে / হানা দ্যায় নিঃশ্বাসের ঝড়
ফলত সে নিভে যায়! / তথাপি শিখরে তার শিখা জ্বলমান
দৃষ্টি তো নিরেট তাই লোকেরা দ্যাখে না
শীতল ফলের মর্মে আজ রাতে তারকার নত।
(বোবার কাহিনী: জুয়েল মাজহার)
টের পাই / বীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে ফসলের গাছ
টের পাই / জেগে ওঠছে কবিতার নতুন অঙ্কুর
টের পাই / কাগজের শাদা পৃষ্ঠা নিয়ে খেলা করছে অবিরাম ঢেউ
টের পাই / ভোরবেলা জেগে ওঠবে কবিতার চারা
(কবিতার চারা: আবিদ আজাদ)
তোমার হতাশ চোখে
সন্ধ্যায় আগুনছবি নিভে আসে, মেঘ আরো নিচু / এবার হাডুডু মাঠে স্বগতোক্তি মুছে নিয়ে সংলাপের জন্ম হয়, ঝিঁঝিঁ ডাক / জোনাকি আলোয় তৃতীয় পঙতির মতো একটি গরীব মেয়ে হেঁটে যায়, ছেঁড়া ফ্রক / লোকচুক্ষুভীতা ভয়ে তুমি দ্যাখো, / এই অন্ধকার গ্রামে, কুপি জ্বেলে, পাঠকই কবিতা।
(হাডুডু খেলার মাঠ: রণজিৎ দাশ)
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই প্রশ্ন তোলবেন যে, কবিতা কি এবং কেন? কবিতার ভবিষ্যত কি? তারপে কবিতার ‘ক’ আর বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাঁকে অযথাই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতা কি ও কেন এবং কবিতার ভবিষ্যত কি? একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন, তাঁর কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুণ বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জন্মদাতা। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকে আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার-আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবনবোধ, এসব অসংখ্য কাজ এক নয়, কবিতাও তাই। অজস্র বছর চলতে চলতে এর ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি, হয়তোবা ভবিষ্যতেও আমরা এর আরও অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পে অসম্ভব যতণ না তিনি গভীরভাবে কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত সেইসব অধ্যাপক সমালোচকদেরই, যাঁরা কবিতা মাথায় নিয়ে পাঠক / শিক্ষার্থীদের কবিতার ভেদজ্ঞান বোঝাতে নিজেদের অধ্যাপক সাজিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেয়া।’ অর্থাৎ কাব্যিক আইডলটিরই সুনির্মাণ করা। কিন্তু ভাববার বিষয় হচ্ছে যে সেদিক থেকে আমাদের বর্তমান শিা প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠককে কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে, কতটুকু পাঠমনস্ক, কতটুকু পাঠক করে তোলে তার অধ্যাপক সমালোচকের মাধ্যমে। এটা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না আমাদের, যখন দেখি আমাদের পাঠকদের কাচুমাচু অবস্থা। আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে তার পাঠপর্ব শেষ, এই হীনভাবনার দায় নিশ্চয়ই ওই দুর্বল প্রতিষ্ঠান আর অধ্যাপকদের। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠপর্ব শেষ করে সে আর তার মতো করে পাঠের প্লানিং ফর্মটিই তৈরি করতে পারছে না বা সেই দায়বোধও তার মধ্যে জাগছে না। এই প্রশ্নটি করার আগে এইসব অধ্যাপকদের কানে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিস্কার করে কবিতার সঞ্চারণ সৃষ্টি করা জরুরি। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তবে কবিতার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে কেননা তা না হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এমন অনেক প্রশ্নকর্তা বেরিয়ে আসবে সে পরিপূর্ণ জ্ঞানপিপাষু হবার আগেই।
মাটি খুঁড়ি। তামার স্তর ভেদে, ভেঙে এত স্বর্ণ স্তূপ।
ছড়িয়েছি তাতে শরীর ও বিবমিষা, আমার দীর্ঘচুলের জটিল জালে
কালো মাটি আর আগুন ও চুম্বনে অগ্নি-ভষ্ম-বীজে;
অন্ধেরা পায় চূর্ণসূর্য, রঙের সারাতসার; উদগমনের ভারে
বীজের ভিতর ধারণ করেছি তাকে, সর্বগ্রাসে গর্ভধারণ করে
বেঁচে থাকা তাই ধানভানা এক আনন্দময়ী গান! তবু
চাল ও চুলায় চন্দনখড়ি জ্বেলে পাতাল গল্প বলি:
(শিকড়গুচ্ছ: শাহেদ শাফায়েত)
স্বাদগন্ধ নিরুদ্দেশ। আমি তাই স্ত্রীলোকের আমন্ত্রণে গিয়ে
দেখেছি জলের পাত্রে দুধ আর দধির কলস ভরা জল।
আসলে দেখিনি, শুধু নিরাপদ বাক্যালাপে অনুমান করে
বুঝেছি নারীর সংগে প্রকাশ্যেও পুণ্যলাভ হয়।
(কর্মফল: মৃদুল দাশগুপ্ত)
এই সামান্যই, দেখেছি ভেজা চোখে পাহাড়ে আগুন জ্বালে ছেলেরা
আর মেয়েদের থানে থানে তখনো জেগে আছে বাল্বের আলো
ছেলেরা কলার গাছ কেটে আনে। পরদিন ভাসাবে বাউলের ভেলা
শিশিরের ছেলেরা খাবে বলে বসে আছে চায়ের ফোয়ারা
আমাদের গ্রামে ক্যান্টিনও ছিলো। তখনো বেঁচে ছিলো এক টাকা।
নন-সাইবেরিয়ান ঠাণ্ডা পালায় কাপের-পর-কাপে ঘা খেয়ে
(শীতকাল: পলাশ দত্ত)
শিল্প কি? এরকম প্রশ্ন যদি কাউকে করা যায় তবে তিনি কোন জটিলতায় না গিয়ে সরাসরি উত্তর দিতে পারেন ‘সুন্দর’ পৃথিবীর সমগ্র সুন্দরকেই আমরা শিল্প বলতে পারি, তা সে কৃষি কাজই হোক, ব্যবসার কাজই হোক, অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠানই হোক, হাড়ি-পাতিল তৈরি করাই হোক বা অন্যান্য আরও যা কিছু আছে তাই হোক, কাজ যখন সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই তাতে শিল্প ফুটে ওঠে যা আমাদের প্রত্যেকেরই সূক্ষ অনুভূতির জন্ম দেয়। অবশ্য, আজ যা সুন্দর ভবিষ্যতে তা সুন্দর নাও থাকতে পারে কেননা সুন্দরকে কে, কখন, কোথায়, কিভাবে করে তোলবেন তা তার সময়ের মানুষেরাই ভালো বুঝবেন। এই আপেকি বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই, সুন্দরের আখ্যান মানুষেরাই রচনা করবেন মানুষেরাই ভাঙবেন। এইসব ভাঙাগড়ার মধ্যেই কবি সুন্দরকে নিয়ে আসেন তাঁর কবিতায়। ফলে যে কবিতায় সুন্দরের প্রকাশ তা যে কোনো প্রকারের কবিতাই হোক না কেন উহা পাঠকের কবিতা, কেননা কবি যে সুন্দরকে কুড়িয়ে এনে জড়ো করেন কবিতায় তা কোন না কোনভাবে পাঠকেরই জন্যে সমাপিত হয়।
একজন কবির কতজন পাঠক থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করতে পারি? এখানে লেখা বাহুল্য যে, কবিকীর্তিটি স্পষ্ট করার জন্য ওই নির্দিষ্ট কবি ব্যতীত আর একজন পাঠকেরও দরকার নেই আসলে। এই প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হয়ত নিজের ঢোল নিজেই বাজাতে শুরু করবেন- যা একজন কবির কখনোই সংগত নয়। একটি কবিতা যখন কবিআত্মা থেকে মুক্তি পাবে তখন আরেকজন পাঠককে যদি স্পর্শ না করতে পারে তবে তা যথার্থ কবিতা কেন? অবশ্য পৃথিবীতে যত কবিতা লেখা হয়ে থাকে প্রতিটি কবিতাই- পাঠ নিশ্চয়তা নিয়ে আসে- কোন না কোনভাবে তা পঠিত হয়।
কবির নিজস্ব একজন পাঠকের প্রয়োজন আছে কি? না, তারও প্রয়োজন নেই কিন্তু কেউ যদি সাগ্রহে এসে কবির পাঠক হয়ে ওঠেন তবে এটা তাঁর কাব্যিক মহিমাগুণেই। ওই নির্দিষ্ট পাঠকটি অবশ্য তার কবির গুরুত্ব বুঝতে এবং কবিকে যাতে কোনভাবে অবহেলা বা অবিচার করতে না হয় সেজন্যেই তাকেও হয়ে ওঠতে হয় সামগ্রিক কবিতার একজন স্বচ্ছ পাঠক আর সমগ্র কবিতা বোঝার পরই কেবল পাঠক তার নিজস্ব কবিটিকে আলাদা করতে পারেন টোটাল কাব্যিক প্রতিবেশ থেকে। এরকম অভিজ্ঞ পাঠকই জরুরি অধুনান্তিক বাংলা কবিতায় যাঁর কথা ইতোমধ্যে আলোচনা করে এসেছি। শেষপর্যন্ত তার কবি হবে সেই সত্ত্বাটি যার কবিতা সাত্তি¡ক অবস্থান থেকেই শাসন করবে তার অন্তরাত্মা। সেই পাঠকটিই অর্জিত হওয়া কবিকীর্তির স্বার আর সেরকম নিবেদিত পাঠকেই মূলত কবিতার পাঠক বলা যায়। এও সত্য যে একজন কবি তাঁর যথার্থ সঞ্চারণটি পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে উপভোগ করতে চান প্রকৃত সেই উদ্ভাবনা শব্দের, যা তাঁর মধ্যে নিবেদনের ক্রিয়াটি জন্ম দিয়েছিলো, যে বিদগ্ধতায় তিনি অস্থির হয়েছিলেন। ফলে একজন কবির পাঠক তো জরুরিই সেক্ষেত্রে শিক্ষিত পাঠকটিই তাঁর বেশি প্রয়োজন যেখানে তাঁর নিগূঢ় নিবেদন বস্তুটি স্বযত্নে মূল্যায়িত হয়। বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, গীতা যেখানে এই নিবেদন বস্তুটির কথাই উল্লেখিত হয়েছে অজস্রবার। আমাদের জীবনাচারের কাব্যময়তা থেকে যার বিরূপ ক্রিয়াও আমরা উপলব্ধি করেছি এবং সেই প্রার্থিত সুন্দর মহাসময়ের অপেক্ষাও আমরা করছি যার অবমূল্যায়ন থেকে মূল্যায়নই জরুরি হয়ে পড়েছে।
কথা যে স্বয়ম্ভরসভাবে হাসায়, শব্দদের প্রতিভা সে জানে
মহাপ্রকৃতি যে নিয়মে স্নায়ুকে জাগায়, উদ্দীপ্ত করে রাখে
অন্বিষ্ট ব্যাখ্যান থেকে পরাজিত মানুষের বেদনা তুলে নিয়ে
সেও তো মৌলিক হলো, ঐ গান শঙ্খসমুদ্রে যেভাবে বেজেছে
মানবীর তন্তুতারে তার সুর বুঝি পড়োকান্না কালরাতে
যৌগিক সমুদ্রে খুব ঝড় হলো, প্রভাতে তার চিহ্ন মাত্র নেই।
(মানুষ মকর নয়, অন্যপ্রত্নজীব: কামরুল হাসান)
ধান ছড়ানোর বেলা শেষে
উঠানে করো কি বউ? ভাবের বিন্যাস।
ধানের গন্ধের নেশা বাতাস আক্রান্ত করে / অতঃপর চুলে
বেঁধে নিয়ে খোঁপার কৌশলে
একটি ফুলের গাথা কেমন মৌসুমভর / আসর জমায়।
(শস্য নয়, ভাবের পার্বণ: শুভাশিস সিনহা)
ওরে ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া
আসমানে উড়াল দিয়া তোমরা আসেন
মরুভুমিতে যায়া লড়িব আমরা / কার সনে তাহা বাবাই জানেন
ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া / ইসলাম জীন্দা হোতা হায়,
(ভাওয়াইয়া: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
একটা মুশকিল হলো, যতই আমরা সাহিত্য সাহিত্য বলে চরাই-উৎরাই করে ফেলি না কেন আমাদের এই বিচিত্র বঙ্গদেশ মূলত সাহিত্য মূল্যায়নের কোনো স্থান নয়। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে অসংখ্য অরজ্ঞানসম্পন্ন মূর্খের ভিড় আশেপাশে, বিচিত্র জাতের মানুষের হাতে আমাদের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলি জিম্মি হয়ে আছে। এদেশে লেখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া অত্যন্ত মুশকিল। এর চেয়ে বরং ওপার বাংলার সাহিত্য এখন জমজমাট, এদের হাতে রয়েছে প্রচুর পাঠক আর নিজস্ব ঐতিহ্যসম্পন্ন বিশাল বিশাল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যদিও সেগুলোতে কাঁঠালপাতা চিবানোর সংখ্যাই বেশি তারপরও এই প্রকৃতির লোক যত রয়েছে তারচেয়েও বেশি আছে কাঁঠালগাছ। ফলে শিল্প-সাহিত্যে তারাই অনেক এগিয়ে। সাহিত্যের মান খুব একটা আহামরি নয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই তো ঝড়ের গতিতে ছেয়ে যাচ্ছে বিশ্বময় অথচ আমাদের দেশে শিল্পঋদ্ধ প্রকাশনা সম্পন্ন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তাদের নিজেদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজস্ব গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। টোটাল সাহিত্যে খুব বেশি অবদান নেই অথচ আমাদের দেশেই ইসলামিক ফাউন্ডেশান গড়ে তোলছে তার শাখা-প্রশাখা থানায় থানায় আর আমাদের বাংলা একাডেমি বসে বসে আঙুল চুষছেন আর ভাবছেন সেই খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প, বেশ! আশ্চর্যই বটে, এহেন মনীষায় তারা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড!
এদেশে লেখার মূল্যায়ন আজও তৈরি হয়নি, আমাদেরই দীনতা প্রচুর কারণ নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যের লেখাটি আজও মূল্যায়ন করতে শিখেনি আমাদের লেখককুল, যেন সর্বদাই তাঁর ভেতরে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। আর এমন অনেক লেখক বন্ধুও রয়েছে যে, বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থটির পাশাপাশি আরও অনেক ঋদ্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর হাজার কপি গ্রন্থ কেনার জন্য টেলিফোন ব্যতীত পার্শ্ববর্তী গ্রন্থটির প্রশংসাও করতে জানেন না। শিক্ষামন্ত্রণালয়ও কম যান না, তাদের চোখে প্রকৃত মসিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতিগণ। যেখানে একটি পাখির কণ্ঠ বিশ্লেষণ করতে লেখক-কবি আপাদমস্তক নেমে পড়লেন পুটলাপুটলি নিয়ে তাঁর তো রাস্তায় বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা ওইসব প্রকাশক, কর্মকর্তারাই তো উঠে পড়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রীর বই হাজার হাজার কপি কেনার জন্য। এতগুলা দীনতা যে দেশে সে দেশে লেখক থাকার কি প্রয়োজন তা আমার জানা নেই।