কোন একটি লোক দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তার শেষে এসে যদি অন্য কোন একজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমি যাচ্ছি কোথায়?’ তবে তার মালকোচা দিয়ে দৌড়ানোর কোন ফল হল না কারণ সে তার লক্ষ সম্পর্কে জানে না, জানে না কি তার অস্তিত্ব, কি তার দৌড়ানোর হেতু? শিল্পের ল্য আছে নিশ্চিত! যিনি এপথে লক্ষহীন দৌড়ানোর কথা বলেন তার শিল্প মূলতই ল্যহীন। অযথাই দৌড়ে দৌড়ে তিনি রাস্তায় ধুলো ওড়ালে শিল্পের পথ ধুলোয় মলিন হয়ে ঝাপসা হবে বৈকি! কবিতাও তাই, সে কবিতা পাঠকের নয়, সে কবিতা শিল্পের নয়, সে কবিতা সংস্কৃতির নয়। এভাবে যদি কেউ শিল্পের পথে কবিতার মনোজাগতিক পরম্পরায় চলে আসেন তবে তার পরবর্তী কোন পথিক- আইডল নির্মাণে কবিতা কবিতা বলে রাস্তায় আসলে শুধুই অন্ধকার দেখবেন। অমরত্ব সন্ধানে তারও পথ হারানোর সম্ভাবনাই বেশি। কালাকাল হিসেব করলে দেখা যায় আসলে হচ্ছেও তাই, শিল্পপথিক সবসময় তাঁর অগ্রজদের সূত্র ধরেই পথিকের সারিতে দাঁড়ান। যখন একটি রোডম্যাপ বা প্লাটফর্ম নখদর্পণে, সেখানে তাঁর প্রাপ্য বিষয়ই হচ্ছে সুগম্য সঞ্চারণের মূল ল্যবিন্দু। তৃতীয়বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়েছে। জাপানে হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ভয়াবহ নৃশংস ঘটানার ক্ষত পৃথিবীবাসির মন থেকে মুছে যায়নি, সাম্প্রতিক সময়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার ঘটনা, আত্মকলহে প্রবৃত্ত হয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ ‘ইরাক’ বিগত ২০ বছরে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, আমাদের দেশেও ওয়ান ইলাভেনসহ আরো কিছু ঘটনা প্রতিবেশ উত্তপ্ত করে দিয়েছে। মনুষ্যসৃষ্টির বাইরেও রয়েছে বৃহৎ বৃহৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এরকম বর্বরতা থেকে মানুষ চিরকাল মুক্তি পেতে চেয়েছে আর বরাবরই তাঁর শিল্পিত আশ্রয়ের জায়গা কবিতাতেই। আমরা জানি, কবিতা মানবিক অন্তরাত্মার সৌন্দর্য বিষয়ক নিবেদন, বিচরণ। শব্দের ইন্দ্রজালিক মহিমাটি ঘুরেফিরে দেখছে, আপনার চিন্তাজগতের প্রতিটি ইউনিট কোমল অধ্যাসে সমাপিত কিনা! কবিতার সার্বজনীন আবেদন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার দিকে দৃষ্টি ফেরালেই গোচরিভূত হবে এলায়িত অলস বাঙালির কাব্যিক মৌলিক কোনো উপস্থাপনা নেই। কোমল রৌদ্ররাগে উদিত সূর্যসকালের মতো সুন্দর প্রণোদনাই নেই আমাদের সমগ্র জাতিসত্ত্বায়। কবিতায়ই সম্ভব ছিলো আমাদের নিত্যদিনের এ আচারবিধি যোজন দূরের মানবীয় অবস্থান থেকে একেবারে অন্তরায় বেজে ওঠা। প্রশ্ন আসতে পারে, কবিতা কি শুধু বিনোদনের খোরাক হলেই কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা পাবে? আমি বলি কি, কবিতা যতক্ষণ পর্যন্ত শিল্পের মর্যাদা নিতে অম বা সংস্কৃতিতে পরিণত না হচ্ছে ততণ পর্যন্ত কবিতা, আসলে কবিতাই হয়ে ওঠবে না (শুধু নামেমাত্র ‘কবিতা’ ধারণ করে আবহমান বাতাসে দোল খেতে খেতে হয়ত একদিন এ সভ্যতাতেই বিলীন হয়ে যাবে)। পরবর্তী কোনো সভ্যতার সূচনাতে দেখা যাবে তাতে কবিতার কোনো চিহ্নমাত্রই থাকলো না। খুবই স্বাভাবিক। কবিতার সংজ্ঞা বা কাঠামো নির্মাণের বিষয়টি যেমন লেখকব্যতীত আর কারও স্বচ্ছ করা সম্ভব নয় তেমনই তিনিই নির্দেশনা দিচ্ছেন, শাব্দিক ইন্দ্রজালই আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছে মহাকাব্যিক এষণায়। শ্রুতিমধুর শব্দদ্যোতনা আজিবন সঞ্চারণমাত্রায় উজ্জ্বল, যার আবেদন চিরকালিন। সেদিক থেকে ভারতিয় উপমহাদেশে আমাদের এপিকস্গুলো বা শুধু ভারতিয় উপমহাদেশেই নয় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আরো যেসব এপিকস্ আমরা গ্রহণ করেছি, যথার্থ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে। হ্যাঁ। আমাদের চর্যাগীতির বয়স হাজার বছরেরও বেশি, আজ সে সংস্কৃতির মর্যাদা ঠিকই নিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন মানসিকতার বাইরেও এর আবেদন এখন কোথাও কোথাও চিরঅম্লান। মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল, ইলিয়ড, ওডিসি, কোরআন আজ বিশাল জনগোষ্ঠির মহাসংস্কৃতির মর্যাদা গ্রহণ করেছে (ঘরে ঘরে যা এখন ধার্মিক মূল্যবোধে নিত্যদিনের প্রার্থনার বিষয়)। সাম্প্রতিক সময়ে রবীন্দ্র রচনাবলী, জীবনানন্দ রচনাবলী তারই এক ভিন্ন সংস্করণ হয়ে উঠেছে। একজন শিল্পপ্রাণের দিবস শুরুর প্রার্থনার মতো সম্ভাষিত এ দুইয়ের সামগ্রিক উপস্থাপনা। সংস্কৃতিবিচারে এই দুই এপিকস্ কোন অংশে পিছিয়ে নয়। তদ্রুপ গূঢ়ার্থে কবিতা বলতে তাকেই বুঝবো, যা শিল্পের মর্যাদায় সংস্কৃতির আসনে উদ্ভাসিত হতে সম প্রযোজনা। অবশ্য কবিতার পাঠকমাত্রই তাঁর বিচারে চূড়ান্ত রায় দিতে পারেন, যদি সেক্ষেত্রে জরুরি কোন প্রয়োজন পড়ে কারণ কবিতা তো বিচারবিধির কোন বিষয় নয়। আর উত্তরসূরি, যার নিবেদন থেকেই তার ফলাফল আপনার প্রার্থিত দুয়ারে।
The blood is red / or the red is blood
The sea is asking me / where is the blood’s flood
where is the red flood / but the flood’s color is looking like
my shed / it’s my life / my life is a life
And i will mix up my life with red.
(Red: Mugdha Chondrika)
সারাদিন পাখিগুলো কোন আকাশ থেকে কোন আকাশে থাকে।
শহর কলকাতার শহর যেন পাখিহীন হয়ে থাকে;
পাখিদের আমি সবচেয়ে ক্যাপিটাল মনে করি।
(এইসব পাখি: জীবনানন্দ দাশ)
কখন যে চাঁদ ওঠে আড়াআড়ি পাহাড়ের ফাঁকে:
যেন কার পাথুরে স্তনের কাছে ঝুলে আছে শাদা
চাঁদির লকেট। দূরে, অতিকায় পাহাড়চূড়োয়
অপার্থিব আলো জ্বলে শিবের মন্দিরে। আর ভাবি
আমার মতন বুঝি জেগে আছে সেখানেও কেউ
অসংসারী, শঙ্কাহীন, মিথ্যে কোনো মায়াবী আশায়।
(অরণ্যে কান্তির দিন: আল মাহমুদ)
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
সে চারিদিকে তাকায় না। শূন্য শস্যতে।
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
একে একে ছায়াগুলো ভেঙে শিথিল হয়ে যায়
আর বসন্তের আকাশ-গহ্বরে ঢুকে পড়ে।
(ভ্রমণের সূত্র: টোমাস ট্রান্সটোমার)
বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ‘পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বলে কিছু নেই, যা আছে তা সাময়িক উত্তেজনামাত্র।’ কথাটি যথাযথ হৃদয়গ্রাহী মনে করি আর তাঁকে মেনে নিয়েই... কোন কবিতাকেই আসলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে লেখা হয়ে ওঠে না, হওয়া উচিতও নয়। একক স্বকীয়সত্ত্বায় মনেপ্রাণে শেষ্ঠত্ব ধারণ করে আমরা স্থিতধিত বিচরিত। নতুন শ্রেষ্ঠটিও যেকোন ফেলনামূল্যে আমাদের কাছে অবিবেচিত হচ্ছে। এতটাই গভীরতার ভুল আলেখ্য আমাদের গ্রাস করেছে, যেখানে কার্পণ্যতা বসবাস করছে ব্যাখ্যাহীন সীমাহীন! কবিতার ক্ষেত্রেও বরাবরই তাই হয়ে আসছে। অনেকটা হযবরল হয়ে ওঠেছে আমাদের নিত্যদিনের বৈষয়িক যাপিতজীবন। কেননা কালে কালে নতুন কবিতা লেখা হতে পারে, হতে পারে সময়ের শ্রেষ্ঠ এমন সঠিক সন্ধানীও হতে পারিনি আমরা তাছাড়া আমাদের পাঠকের অধ্যয়নের পৃথিবীটা দিনদিন যেন আরও ছোট হয়ে আসছে। ছোট হয়ে আসছে টেক্সটও, কর্পোরেট লাইফ আমাদের সেই অবস্থানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, জাপানের হাইকু যারা পাঠ করেছেন তারা হয়ত দেখেছেন স্পিড অব ন্যাশনালিটি সেখানে কবিতার আঙ্গিক কাঠামো কত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এবং এটাকেই তারা সূতর জাতীয় মৌলিক কবিতাবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করতে সম হয়েছেন। হাইকুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হাজার বছর পূর্বের সকল কবিতাই কি ধারণ করতে পেরেছি আমরা? এককালে তা কখনোই সম্ভব নয়, হাজারও কবিতা হয়তোবা সময়ের চাপে কবেই তার নিজস্ব ভূমিতে হারিয়ে গেছে। যা হয়তোবা আমরা পুনরায় খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনছি, দ্যোতিত করে তুলছি সাময়িক বোধ বিবেচনায়, আলোকবর্ষের সুনৃতে। সমকালিন কবিতা বলে আসলে কোন কিছুকেই দাবি করা যায় না। কারণ ওই কবিতার জন্ম বা প্রসব উত্তর যন্ত্রণা বেশ অনেক পূর্বেই শুরু হয় বা যার আবহটাই গোলকায়িত যন্ত্রণায় কবিকে অস্থির করে তোলে। একজন কবি তার যে কবিতা একটু আগেই প্রসব করলেন সেই আবহ বা চিন্তা হয়তোবা দীর্ঘসময় ধরে দোলা খেতে খেতে বাতাসের সাথে ঝুলছিল। হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে টুপ করে জলে পড়লো কেবল! আর হঠাৎ করেই কেবল আপনি আবিস্কার করলেন, অরের জালে মৎস্যসন্তরণের ন্যায় বৃত্ত থেকে ব্যাপৃত হচ্ছে আপনার সুলেখাসমগ্র, ঠিক যেমনটি আপনি চেয়েছিলেন। যে পাঠক কবিতায় ঢুকতে চাচ্ছেন না আমি তাকে জোর করে কবিতায় ঢুকাতে পারবো না, সেটা আমার কাজও নয়। কারণ এইশ্রেণিটা বরাবরই ধূসর-বিমুখ তার আপন বিবরেই। আর যাই হোক তার কাছে চিরকালই দস্যি কবিতার প্রযোজনা অর্থাৎ বিষয়টি তার মধ্যে কখনোই সঞ্চারণ সৃষ্টিতে সম নয়। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার একবার তাঁর নিজের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘খোলা জানালা’য় কবিতা বিষয়ক এক গদ্যে কবিতা লেখার বিষয়ে বেশ কতগুলো কলা-কানুন দেখালেন এবং তিনি দাবি করলেন উক্ত নিয়ম বহির্ভূত কোন লেখা কবিতা হয়ে ওঠবে না। আমি ঠিক জানি না কাহ্নুপা, বিহারীলাল চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বিশাল মহীরুহের মতো এইসব কবিকুল তাঁর উক্ত নিয়ম মেনেই সেসময় কবিতা লিখতেন কিনা? আজকের তরুণ কবিই বা সে নিয়ম কতটুকু ভাবার অবকাশ পান তাঁর সুদূরপ্রসারী জীবন ভাবনার মাঝে? একজন কবি-লেখক যে সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হন তারও একটা সুবিশাল ভূমিকা থাকে। অবশ্য তিনি এরকম মনে করেন যে, একজন কবির যেখানে ব্যর্থতা রয়েছে মূল কাব্যিক কার্যসিদ্ধিতে অন্য আরেকজন কবি বা পাঠকের উচিৎ সেখান থেকেই শুরু করা। তাহলেই কেবল এর সমাধান সম্ভব।
উজানে ভেসেছি গংগা গা ভরতি মাদুলি কবজ কড়ি হাত-পা জড়িয়ে আছে শরীর জড়িয়ে আছে শীতল শরীর আহা মন আমার উথালপাথাল কত খালবিল নদীনদ পেরিয়ে এলাম তোকে বোঝাবো কেমনে গংগা কী যে সুখে ভেসে যাই ডানে বাঁয়ে হা-পিত্যেস ছড়ানো সংসারে কত ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন দেয় উলুধ্বনি না'য়ে না'য়ে আবাল্য সখীরা ডাকে না যাও রে ভরা গাঙে ডিঙা ডুবে ডিঙা ভাসে দেবর ননদ জা সতীন শাশুড়ি চলে পাশে ভেসে জলটানে চলেছি
(মনসা: ব্রাত্য রাইসু)
ইতিহাস খুলে পড়ছো তোমার পূর্ব পুরুষদের
প্রথম উড়াল আর শেয়ালতত্ত্বের কথা।
একদিন পৃথিবী ছিল যাদের মগজের দাস
সিংহ আর মাংসের সমন্বয়কারী
সেইসব প্রজাতি লুপ্ত আজ।
(শেয়াল বিলুপ্তির পর: মিজান মল্লিক)
পৃথিবীর ঘাস, মাটি, মানুষ, পশু ও পাখি সবার জীবনী লেখা হলে
আমার একার আর আলাদা জীবনী লেখা না হলেও চলে যেত বেশ।
আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেত।
তার মানে মানুষের, বস্তুদের, প্রাণিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক
অসংখ্য জীবন নয়, সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন মোটে; ফলে
আমি যে আলেখ্য আঁকি তা বিশ্বের সকলের যৌথ দৃষ্টি এইসব ছবি।
(এ জীবন: বিনয় মজুমদার)
কবিতা পড়া জরুরি বা জরুরি নয় কিনা তারচেয়েও জরুরি, কবিতা পাঠকমাত্রই শিক্ষিত, ঋদ্ধ, মার্জিত পাঠক সর্বাগ্রে এ ধারণাটিও যে ঠিক নয় এটি অন্তত পরিস্কার জেনে ফেলা। অনেকের কাছেই এর গভীরতা পরিস্কার নয়, পরিস্কার হয়েও ওঠে না। গুলিবিদ্ধ একজন মানুষের চেয়ে কবিতাবিদ্ধ একজন মানুষের যন্ত্রণা বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে যথার্থ কবিতাতেই বিদ্ধ হলো কিনা সেটি ভাববার বিষয়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিবৃতি সাজিয়ে সে পাঠককে কোনটা কবিতা কোনটা অকবিতা তা বুঝাতে গিয়ে তাঁকে খাটো করতে চাই না। বরং একজন শিতি পাঠক তাঁর কবিতা ঠিকই হাজার কবিতার ভেতর থেকে আবিষ্কার করে নেয় বলে জানি। এটা আসলে এক ধরনের কবিতার সংবেদও বলা যায়। কবিতায় উদ্ভাসিত এই সংবেদ মূলত আকুল করে তোলে কবিকে, যিনি পাঠক তার উপর সংবেদন জারিত হয়, প্রিয় কবিতাটি পড়ামাত্রই পাঠক সঞ্চারিত হচ্ছেন অনেকটা ঐশ্বরিক মহিমায়। একেবারে সন্নিকটে না হলেও যোজন দূরে কোথাও তার প্রভাব পড়ে থাকে। আর যতসব নিয়ম-নির্মিতি তা শুধু নিজের ভালো লাগা বা না লাগার ব্যাপারমাত্র। তাছাড়া যে পাঠক সাহিত্যের টোটালিটি থেকে একটিমাত্র কবিতাকেই বেছে নিলেন, সে পাঠকমাত্রই বোকা এ জ্ঞান সম্পূর্ণ শুদ্ধ শব্দচর্চার দাবি রাখে না, অন্তত আমি তা যথার্থ অর্থেই মনে করি। কেননা ওই একটি কবিতাই তো মহিমান্বিত করে তুলছে তার অমিয় ভুবন। কবিতা পড়ার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, অন্তর্লোকে প্রবেশের পূর্বে নির্দেশিকাটি দেখুন। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন পাঠেরও নির্দেশিকা আছে ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’। এর একটা সফল কার্যকরিতা আছে, যথার্থ নিবেদনে মধুর আবেগে পাঠে মনযোগি হওয়ার গুরুত্ব তৈরি হয়। ফলে স্বয়ং পাঠকই নয় সঞ্চারিত হতে থাকেন তার পরের শ্রোতাও। কবিতা আখ্যানের কোনো কোনো অধ্যায়ে এরকম পূণ্যার্থী ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। যদিও সামগ্রিক কবিতাক্ষেত্রে এরকম পূণ্যার্থীর কোনো ভূমিকা পাওয়া যাবে, সহজ অর্থে আমি তা প্রথমেই বিশ্বাস করি না। বরং আজকের এই কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগে একজন পাঠক তাঁর প্রিয় লেখাগুলো বেছে নেয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে হাতের কাছে পাচ্ছেন খুব সহজেই। সে পাঠককে কবিতা বোঝাতে যাওয়া তো আরও বোকামি। আমার সাত্ত্বিক অবস্থান হলো এই সত্ত্ত্বাটির মৌলিক ইন্দ্রিয়টি বাজিয়ে দেয়া, যে বৃত্ত থেকে বা কেন্দ্রবিন্দু থেকেই উদ্ভাসিত হয়ে তার আগমন হোক না কেন। মার্জিত একটি লক্ষেই তো প্রযোজিত হচ্ছেন তিনি কিংবা প্রযোজনার জন্য সঞ্চারিত হচ্ছেন। যেমন ধরুন, দিবস শুরুতে আপনার মন উতলা হয়েছে, ফরিদ কবিরের ‘সুরসন্ধানী’ কবিতাটি পাঠ করলেন যার কোনো কোনো পঙক্তি এরকম ‘সঙ্গীত এতটা পারে, শুষে নেয় গমের যন্ত্রণা / যে-কারণে ঘন হয় গাছের নিঃশ্বাস / রাতের পাতায় জমে ঘাম / সুরের সন্ধানে তবু লোকে করে / নদীর বন্দনা / আমি কিংবা মিতা হক উপলমাত্র’। সেইসাথে আপনার দিবসটিই সঙ্গীতময় হয়ে গেলো, আপনি যতই বিচরিত হলেন আপনার সমগ্র সত্ত্বায় সঙ্গীতই সেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এরকম সঙ্গীতময়তার কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন পড়ে না নিশ্চয়ই। আসলে ওইদিন আপনার সঞ্চারণ পৃথিবীর এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে কি!
বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু আর মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন / সদলবলে গাইবে দুর্ভিরে স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস
ফিরে তুমি যাবে বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও, / কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?
(মেঘদূত: সমর সেন)
আমাদের হাওয়া গিয়ে তোমাদের জামপাতা মৃদুভাবে নাড়ে,
ফলে কি জামের বন আত্মীয়প্রবণ হয়ে ওঠে!
আমরা কোকিল ছাড়ি তোমাদের কাকের গৃহে ডিম পেড়ে আসে,
তোমাদের পীছানাগুলি এপাড়ের ডালে বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করে।
সীমান্তরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পিঁপিলিকা শ্রেণী / খাদ্য বহন করে নিয়ে আসে এপাড়ের থানায় থানায়
একই জলে স্নান করে দুই ভূগোলের দুটি লোক,
বিদেশ এতটা নিকটে থাকে। এতখানি শিলাময়!
(সীমান্ত: কামরুজ্জামান কামু)
সে বাড়ি ফেরে। কথা বলে না কোন।
নিশ্চিত খারাপ কিছু ঘটেছে। / সে জামাজুতো নিয়েই শুয়ে পড়ে।
মাথা গুঁজে দেয় কম্বলের নিচে।
পা’দুটো কুঁকড়ে নেয়। / বয়স তার চল্লিশ, যদিও এ মুহূর্তে নয়।
এখন তার অবস্থান মাতৃজরায়ুর
সপ্তম আবরণের এলাকার সুরতি অন্ধকারে।
কাল সে মহাকাশ নিয়ে বক্তৃতা দেবে।
(প্রত্যাবর্তন: ভিস্লাভা শিম্বোর্স্কা)
কবিতার পথ বহুদূর নয় বটে তবে এতটা পথ যে, আর পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি আপনার মৌলিক অবস্থান থেকে অনেক দূর চলে এসেছেন কবিতার দিকে। লক্ষ করে দেখুন, কবিতা যতদূর এগিয়েছে ততটুকুতেই সে সংস্কৃতি দাবি করে বা আমরা যতটুকুই সংস্কৃতির আসনে বসিয়েছি। অথবা ধরতে পারেন কবিতা একটি আলাদা সংস্কৃতি বলেই তাকে আপনি সবিতা বলে জানেননি। কোথাও কোথাও জেগে ওঠছে ধর্মীয় মূল্যবোধও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হতো, কাজী নজরুল ইসলামের হামদ্-নাথ্ এখনো মুসলিম ইজমের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় পবিত্রতা বা শুভ ভাবনায় পাঠ হয়ে থাকে, বলা হয়ে থাকে বাইবেলে অজস্র কবিতার উপাদান ছড়ানো-ছিটানো কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এসবই জাগিয়ে তুলেছে শৃংখলিত এক সূতর ধর্মীয় মূল্যবোধ। আর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ তো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক মহাকাব্যিক ইস্যু। গ্রামাঞ্চলে বাউলদের পালাগানও অনেকটা এরকমই সেখানে ভেদজ্ঞান, তাত্ত্বিকতা তো থাকেই যা হাজার দর্শক দলবেধে গভীর মনযোগে অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকে। এ সবই আসলে একটি সত্ত্বার উপর মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, কবিতা মাধ্যমেও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। একসময় হয়ত সে একত্ববাদ থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেক কবিতাই তাঁর নিজস্ব ভূ-মণ্ডলে এক ভিন্ন ভিন্ন ইমেজের জন্ম দেবে। সেটা খুবই স্বাভাবিক, তাছাড়া মানব সভ্যতার ভাবের জায়গাটি অন্তর্লোকেই আর সেখান থেকেই তো কবিতা বেজে ওঠছে খুব শক্তিশালী হয়ে। হাজার বছরের কবিতার ভাঙা-গড়ায় আমাদের যে চৈতন্য ঘটে তা তিরিশের জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে। আমি বলবো এঁরা ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছেন বাংলা কবিতায়, একেবারে কবিতা মাধ্যমটিকে উজ্জ্বল করেই। অন্তত ১০০ বছরের বাংলা কবিতার কথাই ধরুন, আধুনিক কবিতার সাথে বাঙালি জাতির পরিচয়টা যেভাবে হয়েছে। কবিতায় এসেছে সমকালিনতা, রাজনীতি, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের ধারণা, ঔপনিবেশিক সমন্বয়। উবঢ়ঃয ঙভ খরঃবৎধঃঁৎব মননবৃত্তেই আপনি দুমড়ে-মুচড়ে নতুন করে নির্মিত হয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন প্রায় এক শতাব্দীর কাব্যিক ফের। তার পরবর্তী আজকেরও যে কবিতা, তাতো ভিন্ন প্যাটার্নের অবশ্যই। একেবারে সন্নিকট চিত্রটিও প্রত্য করে দেখুন, মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যেই আমরা তার ফলাফল গ্রহণ করতে যাচ্ছি; এক দশক সময় শুধুমাত্র আপনার নির্ণায়ক বিচার বিশ্লেষণের সময়। কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়, একবার পাঠ করে রেখে দিলেই চোখের সামনে স্পষ্টভাবে কবিতার উজ্জ্বল চিত্রটি প্রত্য করা সম্ভব নয়। বারবার পাঠে কবিতা স্বচ্ছ থেকে আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। চর্চার এ জায়গাটিতে আমরা বরাবরই অলস, আপন বিবরের উপস্থাপনা থেকে এর উত্তরণ অধিক জরুরি আর তখনই কবিতার ফলাফল একজন পাঠকের নেয়া সম্ভব। কেননা আজকের কোন কোন কবিতার বিষয় তার শব্দ প্রয়োগ বিন্যাস অবশ্যই দীর্ঘদিনের উপকথার ফসল। সৃষ্টি শুরুর পর থেকে যখন মানব সভ্যতার প্রসার হলো বোধ করি কবিতা নামক সঞ্চারণটি সেই তখন থেকেই আপন বিবরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে ভাগ হয়ে সমর্পিত হয়ে আসছিলো। মাটি, পাহাড়, বাতাস, আলো, রোদ্দুর, নদী, দূরের নত্র, সভ্যতার যত যত এলিমেন্ট, অচেনা জগত এগুলো যত চর্বিতচর্বণ হয়েই থাকুক না কেন আজকে তা আকাক্সার, আজকে তা পাঠকের... এই গূঢ় সত্য বিষয়টি যতণ না কোন পাঠক গভীর মহিমায় উপলব্ধি করতে পারছেন ততদিন আমাদের অপো করতে হবে খেয়াঘাটের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া মাথায় নিয়েই।
দাঁড়াও রুপালি নদী, রজত জ্যোৎস্নার শিহরণ
আমি সংগে যাবো!
সামান্য হাতের কাজ বাকি আছে, সেরে নিয়ে দ্রুত
দরোজা দু’হাট খুলে মাঠে গিয়ে নিশ্চয় দাঁড়াবো
নিরুদ্দেশ পথের বাতাসে...
রাত্রিভর হেঁটে যাবো বালুচরে। শ্মশানে নিঃশব্দ কাশবন,
ঘুমন্ত গ্রামের ছায়া রেখে যাবো পাশে...
(যাবো: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
নদীর জলে ওড়ে ভষ্ম, ওড়ে মৎস্য, কোথায় যাবি তুই
বাইসনেরা ধুলোয় লুটায় / পক্ষিরা সব পক্ষ গুটায়
দিসনে ঠোকর, পুড়বে কেবল পুড়বে রে চঞ্চুই।
(সার্কারামা: মাসুদ খান)
তাকালেই ভোর হয়, তাকালেই সন্ধ্যা
যেনবা আঙুলব্যাপী সন্তরণশীল ভোর, সন্ধ্যা
আমার ইঙ্গিতমতো পাল্টায় পোশাক
পোশাকেই সমস্ত রহস্য / ধর্মগ্রন্থে এসবের উল্লেখ ছিল না।
পাতায় পাতায় আমি এই কথা প্রচার করেছি
নগ্ন-নারী নয়, আনারসে আছে প্রকৃত রহস্য
খোসা ছাড়ালেই আনারসমাত্র খাদ্য হয়ে ওঠে
মেঘাচ্ছন্ন রমণীরা সেই খাদ্য পরিবেশন করে।
(রহস্য: ফরিদ কবির)
নদী যেরকম যায় সেরকম পাখি যেরকম যায় সেরকম
চলে যেতে সমূহ ইচ্ছুক আমি সে রকমই চলে যেতে চাই,
হাতের পালকগুলো খসে গেলে ক্ষতি নেই,
চোখ একটা অবাস্তব জলাশয় কিছু যায় বা আসে না,
এবং শরীর একটা অন্ধকার মৃত্যুর কবর হলে ক্ষতি নেই।
মানুষের কাছ থেকে মানুষের মতো আমি চলে যেতে চাই।
(প্রস্থান প্রসঙ্গ: আবুল হাসান)
কবিতায় আসছে নতুন টেক্সট, থীম, ধারণা, প্রচার, প্রয়াস। আসছেন নতুন কবি, বদলাচ্ছে কবিতার মানে, উপমিতি, অনুষঙ্গ আপনার সমস্ত ধারণা যা কিছু আছে, আমূল সব পাল্টে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠছে নব নব কবিতার প্রস্তরায়ণ। এই এক দশক পূর্বেও আমরা কবিতাকে যেভাবে বুঝতে শিখেছি আজ আর তা ভাববার সুযোগ নেই। তৈরি হয়েছে যোজন ব্যবধান, চিন্তার আর অর্থগত মানে কবিতার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যিনি শুধু একবেলা খাবারের কথা ভাবেন তার সাথে কবিতার কিছুটা তফাত তো রয়েছেই কেননা কবিতা খাবারের বা খেয়ে জীবনধারণের কথাই শুধু চিন্তা করে না করে আত্মসংযমেরও। ফলে কবিতার ঞড়ঃধষ টহরঃ-এর একটি হচ্ছে সংযম অর্থাৎ স্বীয় সত্ত্বাটিকে অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে অবদমিত করা। এক্ষেত্রে সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন আর একজন কবির স্বীয় অবদমন ক্রিয়াটির বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আইডল নির্মাণের বিষয় নিহিত থাকে আর কবির আত্ম-অবদমনের মধ্যে থাকে কবিতার সুন্দর নির্মিতি বা শুধুমাত্র কাব্যিক আইডল। ফলে সাধক কবির এই কাজটি যে খুব সহজ নয় এইটা খুব দ্রুত জেনে ফেলাই হলো একজন বুদ্ধিমান পাঠকের কাজ। কবি কল্পলোকে তাঁর জীবনকে উপো করেন চিন্তার প্রখরতায়। এখানে কবির সাধক সত্ত্বাটিও আপনার কাছে সুবিবেচ্চ না হলে আপনার সকল কৌতূহল বৃথা গেল। একটি কবিতাই যখন সকল মসৃণতা নিয়ে উপস্থিত হয় আপনার নিকট ইন্দ্রিয়ে বা সংসার ত্যাগী হয়েও যখন তাঁর আবেগ দিয়ে সংসার ভাবনা পাঠককে বুঝাতে চান এইরূপ তাঁর ভালোবাসা কিংবা সহজ অর্থে প্রণয়েরর হেতু। তখন তাকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পে সম্ভব নয়। কেননা তাঁর ভাবনা আমাকেও মোহগ্রস্থ করে গূঢ় এক ব্যাপৃত ইন্দ্রজালে। একটা সময়কে কেন্দ্র করেই একদল কবির সম্মিলিত ভাষাটি স্পষ্ট হয়। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এটা স্পষ্ট বুঝে ফেলা খুবই সহজ। এ সময়ের কবি-পাঠকরা সেটা খুব সহজেই আয়ত্ত করছেন। আমাদের পূর্বে যারা ছিলেন তাদেরকেও চিহ্নিত করা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। আমাদের দেশে আশির কবি-লেখকদের মধ্য থেকে সেটি খুব জোরালো হয়ে উঠেছে। একদল কবি বিশেষ করে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, মাতিয়ার রাফায়েল, জহির হাসান, সাখাওয়াত টিপু, বদরে মুনীর এঁরা চর্যাপদ থেকে শুরু করে কালিদাস, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, মাইকেল, বিহারীলালকেও আদ্যন্ত নখরে গেঁথেছেন। কারো কারো কবিতায় এসেছে ভিন্নমাত্রিক ভাষার দ্যোতনাও। এঁদের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষার উজ্জ্বল কবি ফরিদ কবির। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর অরবৃত্ত মুক্তকের দৃঢ় ছন্দোবদ্ধতায় অনেকটা চিহ্নিত করেছেন, বাংলা কবিতা যে-রকমটা পাঠকের কবিতা হয়ে উঠতে পারে। সঞ্চারণ থেকে পাঠক ফিরে যেতে পারেন অযাচিত কোনো কবিতায় এমনটি হবার নয়। অনেকটা পড়ে যাওয়া পাঠককে তুলে এনে কবিতার মূল স্থানাঙ্কবিন্দুতে স্থিত করা। শব্দের সমীক্ষা, আভিজাত্য, বিদগ্ধতা আর অর্থদ্যোতকের নির্দেশনায় পাঠকের শব্দজট খুলে যাচ্ছে মুহূর্তেই। প্রচল কবিতার ভাবাদর্শ বর্জন করে সেটা তিনি ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে সম হয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটি দাঁড়ায় অন্য জায়গায়, যিনি সুহৃদচিত্তেই কবিতার দিকে ধাবিত হলেন তাকে অব্যাখ্যাত বিবৃতির ছাঁচে ফেলে দ্বিধাদ্বৈতের চর্চা করা আমাদের জনাধিক্যের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা। একজনের সংস্কৃতি মনস্কতা অন্যজনের বঞ্চিত অধিকার। অথচ এরকম জীবনবিমুখ কর্মকাণ্ড চিরকালই শিল্পের বিপরীতে অবস্থান নেয়। শিল্পপ্রাণ ব্যক্তিমাত্রই এই বিষয়টির প্রতি সচেতন হওয়া জরুরি যার অধিক অভাব আমাদের সাহিত্য পাঠক শ্রেণির মধ্যে। ফলে কবিতা ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে অব্যাখ্যাত প্রমাণ বঞ্চনায় এরকম ট্রাজেডি থেকে আমাদের এখনি বেরিয়ে পড়া জরুরি।
আমার মায়ের নাম গ্রাম। / পিতা নাকি দূরের শহর!
নদী ও হাওড় দুটি বোন, / এই বিল জলা সহোদর।
আমি ভালোবাসি সমুদ্র দুহিতারে
দিগন্তের হাওয়া এসে শোনায় সুদূরতা, / মেঘের ঠিকানা, ঝড়ের বার্তাদি।
পিতা ভুলে গেছে আমাদের, / চুপিচুপি কাঁদে মা আমার।
আমি তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জেলে / ফেঁসে গেছি জলচক্রে, জালে।
ফেঁসে তো গেছি কংকালে, মাংস থেকে মাংসে।
(কংকালে মাংসে: মাহবুব কবির)
ঘরে প্রজাবর্গের মতো বাবা। উঠানে মটরশুঁটির মতো মা।
তৃণ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাঙের শরগুলো ভয়ঙ্কর ধারালো।
বাবা একটা হারেমের ভিতরে থাকে। আমার অনেকগুলো মা।
আমার মা ভিজে পাখির যন্ত্রণার মতো। আমার মা কলাপাতার মতো দুঃখি।
(আমার ডাকনাম: রিফাত চৌধুরী)
সামান্য কিশোরী তুমি! ঘুরে ঘুরে / দাদী’মা হয়েছ!
কি তবে গ্রহণীয় আজ / গৃহে গৃহে?
অসীমায় সীমাবদ্ধ যাহা... ম্যাজিক্যাল
ও ভাই স্পাইরাল / তবে কী না
আমার দাদী’মা কখনো কিশোরী ছিল না
যেন আমি কোনওদিন কোথাও যাইনি...
(সংশয়: টোকন ঠাকুর)
বসন্ত বেড়াতে যায়...
কি এক নিঃসঙ্গ কুয়াশায় ভরে যায় দেহ,
সূর্য আমি তাকাতে পারি না।
আমার ডানায় পিঁপড়েরা ঘুমিয়ে আছে,
চারপাশে জল, মালিরা ফিরেছে ঘরে
শুধু এক সর্বনাশা খেয়েছে ফসল।
(বাগান: সরোজ মোস্তফা)
কবিতার পথ বড় দহনের। দহনে দহনে কবিতা যেন আরও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। যিনি এ পথে আসেন, আসলে প্রথমে তিনি বুঝতে পারেন না এটা আসলেই একটা দহন প্রক্রিয়া। ব্যক্তি কবিটির কথা উহ্য রেখে দিলেও দহন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত কবিতাটিই যেন কারো কারো কাছে কোটরাগত প্রাণ, যা তিনি বের করে নিয়ে নেন। কবিঅর্থে চিহ্নিত সত্ত্বাটি আসলে মোটেও পশ্চাতপ্রবণ নয় বরং জ্বলতে জ্বলতে তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কে বা আপন বিবরে অবকাশ যাপনে গিয়ে খানিক জিরিয়ে নেন। ওইখানে কবি আসলে সমূহ উজ্জ্বল এক প্রাণ, আসলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কিভাবে তিনি জ্বালানোর প্রক্রিয়াটা শুরু করবেন। মূল কথাটা হচ্ছে কবি জ্বলতে আসেন, জ্বালাতে আসেন; দিনে দিনে জ্বালানোটাই যেন সংসার পেতে বসে কারও মনে। বোধকরি এইরূপ প্রণোদনাও সকল কাব্যিক নিবেদন নয়। তবে কি, কী কবিতা আর কী কবিতা নয় এরূপ বোধ বিবেচনায় আমরা কিছু উদাহরণকেও বেছে নিতে পারি নিজেকে শানিয়ে নেয়ার জন্যে। জানি সেদিনই তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ‘কবিরা শিশু। কবির মনটাই সরল; বুদ্ধিটা ঋষির। কবি তপস্যা করেন, সৃজন করেন, কৃষকের মতো কর্ষণ করেন; ভাষা দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন রূপের ফসল।’ তো ফসলের এই ফলেল শুভাচার আমরা কিভাবে বুঝবো? নিশ্চয়ই বুদ্ধির ব্যবহারটা এখানে সাবলীল হওয়া চাই। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব প্রয়োজন পড়েছিলো আর আমাদের দেশে শিল্পবিপ্লব অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে গেছে সেটা জাতির মননের ভেতর দিয়েই। শিল্প বিষয়টি আমাদের দেশের মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছেন। যেকোন কালচারাল ইভেন্টগুলির উপর নজর দিয়ে দেখতে পারেন। উন্নত জাতির প্রশ্নে, তারা এখন বুঝতে শিখেছেন শিল্পিত উপস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। যে জাতির উপস্থাপনা যত বেশি শিল্পিত সে জাতিই সারাবিশ্বে পুচ্চটি তার উচ্চে তুলে ধরেছে। বরাবরই কবিতা এখানে সেরা মাধ্যম, তীক্ষ্ন এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবিতার পাঠক খুব সহজেই এ বিষয়টি বুঝে ফেলতে পারেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একবাক্যে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন ‘কবিতা পাঠককে শিক্ষিত হতে হয়, কবি ভাষাটি জানতে হয়।’
কবিতাকে কোন সংজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। স্বয়ংসম্পন্ন শব্দের দ্যোতনায় আইডেন্টিফাইড কবিতা আত্মারই খোরাক অবশেষে। দিবসের সকল কান্তি-শ্রান্তির পর এলানো দোলানো আপনার মন খুব সুন্দর একটি দৃশ্য প্রযোজনায় রত। আপনিও কল্পনা করে দেখুন না জনাধিক্য নির্বাসন দিয়ে একটি শিশু সুদূর নির্জনে পাহাড়ের চূড়ায় বসে তপস্যারত। সুন্দরের এই উপাসক সত্ত্বাটিই আসলে অধিশ্বর, কবিতার। স্থানাঙ্কবিন্দু নির্দেশনায় ধরে নিতে পারেন সেখান থেকেই উদ্ভাসিত হচ্ছে কবিতাবিবর। শিশুর কান্নায় আপনি আন্দোলিত হচ্ছেন, উদ্বেলিত হচ্ছেন কিন্তু উপাসক শিশুর ভূমিকায় আপনি কি ভেঙে পড়েছেন? সে হয়ত আগেই উপলব্ধি করেছিলো বেথেলহেম ঠিকই একদিন ব্রোথেলে পরিণত হয়ে যাবে। কবিতাটি আসলে এখানেই, প্রতিটি মানুষ যা দেখে, যা শেখে, যা লেখে বা তাঁর অতীতের কয়েকটি দিনের ভাবনাও কবিতা। বলতে চাচ্ছি কবিতা প্রতিটি মানুষের দর্শন, বিশ্বাস। লিখতে গেলে পরিমাপের দিক থেকে যার ওজন হবে অজস্র ভাগের একবিন্দু মাত্র। ওই একবিন্দুতেই আমার স্বনির্ভর পক্ষপাত কেননা ওখানেই কবিতা রয়েছে আর যেখানে কবিতা রয়েছে সেখানে আমার বিচরণের সায় ব্যাক্ত করি।
এই যে কবিতার হাঁটাহাঁটি মানতে পারি কি সব শিল্পের বিপরীতে, আর ভাবি শিল্পটা কী, সে কি বলো জটিল গণিত কোনো, প্রাইভেট স্যার রেখে শিখে-টিখে নেবো, পথেদের কোন বাঁকে বহাবো তবে এই শব্দমিছিল, যেই দিকে মনোবল ভারী করে তোলে, জনতাই ঠিক যদি তবে আর কবিতার খোঁজে ফিরে লাভ নেই, এইমতো ভাবি আমি, এইমতো ভেবে ভেবে লিখে ফেলি যতোসব অপকবিতারে।
(বাতিঘর: মুজিব মেহদী)
প্রতিটি সূর্যাস্ত কেশবতী হলে ভালো লাগে।
প্রতিটি দুপুর শস্যমাতা হলে ভালো লাগে।
উঠোনের ধানে নূপুরের কল্লোল নেমে এলে,
কোজাগরী মুখে ছড়ায় গাঁয়ের ঝিলিক;
অরূপিত গানে অধিবাস কেটে গেলে
পৃথিবীর মাঠ যেন বহু শিলাময়, আরও রূপময়।
(আহ্নিক: রাজীব আর্জুনি)
পাটাতনে শুয়ে আছে কাঠ
কাঠ চেরাইয়ের শব্দ, তোমাদের বাগানবাড়ি।
আমার স্বপ্নের ভেতর লোহার করাত দাঁত / কাঠের শরীর ফালিফালি।
তুমি ঘরের ভেতর গোসল করো, পাশ ফিরে শোও
আমার ঘুমের ভেতর কাঠের গুঁড়া, স্বপ্নের বিষয়।
(কাঠ চেরাইয়ের শব্দ: শোয়াইব জিবরান)
আমি আমার পাঁচটি আঙুলে
পাঁচ রাজ্যের প্রভুত্ব / রেখেছিলাম
হায় ইশ্বর / এখন ছেঁড়া কামিজ মেরামত করতে
আমার সকাল / সন্ধ্যার দিকে পা বাড়ায়।
(দর্জি: অমর শঙ্কর দত্ত)
কবি ভাবছেন কবিতা তাঁর অন্তর্গত ঘোরের বয়ার। ভাবনাটি ঠিক। জৈবনিক এই মহৎ সন্তরণ ক্রিয়াটি সমন্বিত এক বেষ্টনির ভেতরে থেকে তাঁকে লিখতেই হচ্ছে। যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে নিরেট তাঁর দাহিকাবিবর। যিনি কবিতা লিখেন তিনি শব্দ কুড়াতে কুড়াতে এক সময় কাব্যবন্ধনীর ভেতরে শরীরটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর জগত রচনা করেন। মৃত্যু ও ক্ষীণ বিষক্রিয়ার সেই পোকাটির মতো যে তার সমাধিমহল নিজেই তৈরি করে অনন্তযাত্রাকে স্বীকার করে নেয়। সবুজ কোনো মাঠে ঘাসেদের মাড়িয়ে যখন যেতে থাকেন দিগন্তের দিকে তখনও তিনি সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই, যখন তিনি কোনো জনবহুল রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে রাস্তা পার হন বা যখন তিনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন কিংবা কোনো নির্জন বাগানে একটি প্রজাপতির ডানার শব্দ শুনতে মগ্ন থাকেন তখনও তিনি তাঁর সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই অবস্থান করেন অর্থাৎ যিনি কবিতা লিখেন তাঁর মনে সব সময় দোল খেতে থাকে ‘কবি’ নামক শুদ্ধ, সৎ, অতি নির্ভীক শব্দটি যার শুধুমাত্র ভাবনা হলো কবিতা বা তাঁর এই ঘোরের বয়ার, যার ভাবনা হলো সদ্য গর্ভজাত কবিতাটি কোন্ শব্দের পরিচর্যায় তিনি তাঁর গর্ভে লালন করে আলোর মুখ দেখাবেন। এহেন ভাবনায় জর্জরিত হতে হতে তিনি সুন্দর করেন তাঁর সন্তানকে। তাঁর চোখে দেখা পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরকে তিনি তুলে আনেন কবিতায়। কবিতা তাই বহুগুণের অধিকারী- তার প্রথম গুণই হলো স্বয়ং কাব্যিক অধিশ্বর কবি এবং ক্রমান্বয়ে তারপরের গুণই হলো কবিতা কবিতা। প্রকৃতপে কবি ও কবিতাই হলো পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থনার বিষয় যেখানে কোনো বৈষয়িক ভাবনা নেই। আছে শুধু নিজস্ব ভূ-মণ্ডলকে দেখার বাসনা, জানার বাসনা, জানাবার প্রচণ্ড তাগিদ। এতসব জানার পরও সিরিয়াস পাঠকের কাছে কবিতা পুনরায় দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। আমরা জেনেছি কবিতার প্রথম পঙক্তি স্বর্গ থেকেই কবির উপর সঞ্চারিত হয় বাদবাকি কবির ঘোরেরই অন্তর্বয়ান। কিন্তু আলফ্রেড খোকন তাঁর এক কবিতায় জানাচ্ছেন কোনো এক বিশেষ কারণে তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরকম পঙক্তি উৎসারণের ফলে পাঠক একটু দ্বন্দেই পড়তে পারেন। প্রথমত তিনি কবিতা লিখে সেই লেখার সূত্রাসূত্র নির্দেশনায় আস্থা রাখেননি, দ্বিতীয়ত অধ্মাত্য একটি ইন্দ্রজালে পাঠককে এখানে অযথাই জটিল করে তোলেন তিনি। সমস্ত ঘোরের বয়ার ভেঙে দিয়ে পাঠক এখানে স্থূল কোনো আইডিয়ায় আটকে যেতে পারেন। কবিতা কি তবে স্বয়ং কবির ক্রিয়েটিভিটি ছাড়াই রচিত হবার মতো কোনো বিষয়? তাহলে তাঁর এই দীর্ঘ দীর্ঘ কাব্যিক উপাসনার ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে? স্বয়ং অতীশ দীপঙ্কর কী সহস্র বর্ষের থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে তাঁর জমানো শব্দগুলো কবির ভেতর থেকে বের করে সাজিয়ে, নিবেদনের জন্য নিয়ে গেলেন? মোটেও তা নয়, সেক্রিফাইস যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ওখান থেকেই তো লিখিত হতে পারতো! পাঠকের আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনাটি কিন্তু এখানে ঘটে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আইডিয়া আবিষ্করণে পাঠকের বিশেষ ব্যবচ্ছেদ-জ্ঞান জরুরি। সাধক পাঠকের অধিক নিমগ্নতার কোনো বিকল্প থাকছে না এখানে। সমকালিন প্রেক্ষাপটে বলতে পারি এরকম পাঠমনস্কতার অভাব দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। এরূপ পরিস্থিতি পরবর্তী সময়কে ব্যাপক দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেভাবেই হোক এই অবস্থাটি আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
তুমি কালো নদী থেকে উঠে এসে জাপটে ধরো আমাকে
সূর্য বেরিয়ে পড়ে মেঘ থেকে, কতোকাল সে আমার / বন্ধু ছিল না
ধুলোর ভেতর দিয়ে জুতোহীন হেঁটে গেছি পাতার-বাকলে / গুপ্তাঙ্গ ঢেকে
দুপুর, সকাল থেকে; সন্ধ্যা, বিকেল থেকে; / রাত্রি বসেছে বেঁকে ভোরে
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
(ভারতবর্ষ: চঞ্চল আশরাফ)
কোন না কোন সমুদ্রের জন্য
আমাদের নারীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে / ভূতপূর্ব দস্যুর সত্তায়।
হাওয়ার ধারালো হ্রেষার চেয়ে তীক্ষ্ন
লবণাক্ত ফেনার প্রসার এসে যার
রক্তকে ফেনিয়ে তোলে, ঢেকে দেয়
প্রজ্ঞাপ্রণালীর হিমায়িত সিন্ধুর কিনারা। / তবুও সমুদ্র দেখিনি আমরা।
(জলদস্যু: শান্তনু চৌধুরী)
কায় ভাসিলো পথের ধুলোয়
আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন
কে গো ভাসালে বলো / উড়ো মন্তরের ছায়া ঘোরের বয়ার
রহস্য বিভঙ্গ আরও পরে থাকে মেঘের কাপড়
আমি গৃহ বাঁধি তার বাড়ি / ধুলোর জলে অনেক রকম কেলি
(ধুলোপাঠ: মোস্তাক আহমাদ দীন)
ছন্দময়তা কবির কর্ণইন্দ্রিয়টিকে সজাগ করে দেয় ফলে একজন লেখক-কবির মধ্যে সহজ মন্তব্যে কর্ণযোগ করার একটি প্রবণতা আপনা থেকেই তৈরি হয়। রচয়িতার স্বাভাবিক সঞ্চারণও কখনো কখনো মুছড়ে পড়ে সেখানে। কবিতার কথা শোনেই যে পাঠক নাক সিটকোবেন যে, কবিতা-টবিতার ওসব বুঝি না কিছু, কি যে লিখে ছাই! এখানে নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটিই আসলে নিগৃহিত হলো দুর্বল পাঠকের মন্তব্যে কিন্তু কবিতার জন্য আসলে এটি কোনো মন্তব্যই নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি আসলে সাহিত্যের কোন শাখায় বোঝেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কবিতা বুঝতে পারা যতটা কঠিন তার চেয়ে সহজ হবে না বোঝা এমন ভাবনা থেকেই হয়ত সহজেই কেউ ওরকম মন্তব্য করে বসতে পারেন। এটাই তার জন্যে সঙ্গত সহজকথা। তাছাড়া তার এই বোধভাবনাটি যে ব্যাপৃত কবিতার চেয়ে কবির মৌলিকসত্ত্বায় গিয়ে পড়েছে তা আমার বুঝতে বাকি থাকে না। এরকম মন্তব্যে যেকোন লেখক-কবিরই মৌলিক ভাবনা ব্যাহত হবার কারণ থাকে। জাতিয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে এই মনোভাবটি বর্জিত হওয়া জরুরি বলেই মনে করি আমি। যে কারণে আমাদের শিতি পাঠকশ্রেণি থাকা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি যদি তিনবেলা পেটপুরে খাবার খেতে পছন্দ করেন, খানিকটা হাঁটতে, গান গাইতে, কোন নারীর যৌন উত্তেজনা পেতে বা মাটিচাষ করে ফসল ফলাতে ভালোবাসেন তবে তিনি যে কবিতায়ই ঘুরেফিরে আসছেন তা তাকে বুঝতে হবে। একটি পাখির হৃদস্পন্দন ও পিঁপড়ের নিরব হাঁটাহাঁটিও আমার কাছে একটি প্রকৃত কবিতার গর্ভপঙতি। পৃথিবীর এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে কবিতার কোষ নেই। কবিতা অসীম শূন্যতার মতোই সর্বময় বিভাজিত আর তা থেকে কবিতা ব্যাপৃতই হচ্ছে কেবল। আসলে তাঁর ভেতরটা কবি বাহিরটা শ্যাঁওলায় তেলতেলে, পা রাখলেই পিছলে যায়। আবার অন্যঅর্থে এরও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, খুব কমসংখ্যক কাব্য রচয়িতার ক্ষেত্রেই এরকমটি হতে পারে। অনেক ভালো সৃজন প্রয়াসও তাঁর কাছে ব্যর্থ হতে পারে অধিক শৈল্পিক প্রকরণগত ভাবনার কারণে। কবি-ছড়াকার রইস মনরম লেখালেখির প্রসঙ্গ ধরে খুব সূক্ষ একটি প্রশ্ন রাখলেন আমার কাছে। যেকোন লেখকমাত্রই কি তাঁর লেখনি হতেই হবে ভেবে লিখতে হবে? মুশকিল হলো, তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন লেখকের কাছে বিষয়টি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাঁর লিখনপ্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয় তখনই যখন সে বুঝে ফেলে তাঁর লেখা হতেই হচ্ছে না। এরকম বোধ, প্রজ্ঞার কারণে তাঁর কাছ থেকে সবকিছু ফসকে যেতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন চূড়াস্পর্শী তাঁর লেখনিটি হয়তো আর ভূচরণে সমাপিত হবার নয়। ফলে এই হতেই না হওয়া লেখাটি নিয়ে ক্রমশ হতাশায় পড়ে তিনি কবিতা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে যেতে থাকেন। আর এভাবে লেখকটির কাছ থেকে ইনফরমেশনও এমনভাবে কমতে থাকে যে, একসময় লেখকটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়েন। এবং তাঁর শব্দ-সম্ভারের ক্রিয়েটিভ সার্কেলটি হয়ে পড়ে প্রায় মনোবাঞ্ছাহীন এক ব্যর্থ মনীষা। এরকম পরিস্থিতিতে আটকে থাকা কোন সৃজনশীল লেখকের জন্যই কাম্য নয়। এটা একটা জাতির জন্য দুষ্প্রাপ্য মৌলিক কোনো প্রাপ্তির আরাধ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। সমকালিন প্রোপট যাই হোক না কেন বরং সামগ্রিক কবিতাকল্যাণে এর থেকে কাব্যিক সত্ত্বাটির উত্তরণই জরুরি।
পাতার আড়ালে গিয়ে চুপচাপ থাকবো ঘুমিয়ে
একটি মৃত্যুর পরে জমে হিম করুণ বরফ
অসীম অমর তুমি শূন্যতায় সারাটি দুপুর
পৃথিবীতে কেঁদে কেঁদে জলে জলে জাগাবে জীবন
নদী কি ঝরনার মতো গলে গলে
পর্বতের স্তন বেয়ে চিরে-চিরে জন্মের নাভিতে / আমি।
(পুনর্জন্ম: শোয়েব শাদাব)
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে পোড়ে পথ, গ্রাম / ছেঁউরিয়া জপে শুধু রাধা রাধা নাম
আকাশে প্রবল মেঘ গ্রামবাসী ঘুমে অচেতন
এখনই নামবে ঝড় কলঘরে জলের পতন
কালঘুমে পার হয় জন্মের স্বাদ / বৃষ্টির জল আনে নতুন আবাদ
কর্ষণে বীজ পেলে একে একে দিন চলে যায়
রাধাও শাশুড়ি হয় কোনো এক ঘন বরিষায়।
(নতুন আবাদ: অলকা নন্দিতা)
মানুষকে তার দুঃখ কি পুড়ে? / মানুষ পোড়ে সুখে।
রহস্যময়ী সুখ মানুষকে কেবলই এক
নিকষ অন্ধকারে উবু করে রাখে।
আর সুখের এই হেন অনুধ্যানে / মানুষ তার দিনরাত্রি খুয়ে
নিঃস্ব হতে ঢাকে বিবর্ণ মুখ / এভাবেই সুখ
মানুষ পুড়ে পুড়ে খণ্ডন করে / একদিন পৃথিবীর সমিল করে তোলে।
মানুষকে তার দুঃখ তো পুড়ে না / মানুষ পোড়ে সুখে।
(মানুষ পোড়ে সুখে: সৈয়দ নাজমুল করিম)
কবিতা আপনার কেন ভালো লাগবে আর কেন ভালো লাগবে না তা আমার জানা নেই। কী করলে ভালো লাগবে তাও জানা নেই। তবে আমার কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে বারবার পড়তে, যতবার পড়ি ততবার সে আমার কাছে চির নতুন, প্রথম সঙ্গমের মতো আরামদায়ক। অক্সিজেনহীন কোনো ঘরে একজন মানুষ বাতাস পেলে যেমন প্রাণ ফিরে পায় আমার কাছে কবিতা সেরকম স্বস্তিদায়ক। শৈশবে আমি ঘোড়ায় চড়তাম, গর্ভবতী ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াতাম, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বহুদূরের গ্রাম দেখতাম, সবুজ মাঠ; পিঁপড়ের মতো মানুষজন দেখতাম, মনে হতো যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। আজ সেই স্বপ্নগুলো আমার অতীত, আকাশে ভেসে বেড়ানো হয় না ঘুমের মধ্যে ছাড়া। ঘুড়ির লেজের মতো ছিঁড়ে গেছে উড়াল পাখির দিন। পেছনের লেজটাও হারিয়েছি কবে। অরণ্য থেকে বেরিয়ে মুছে ফেলেছি পিতামহের নাম, মসৃণ সুতোয় ঢেকে ফেলেছি সুন্দর সৌন্দর্যটুকু। মনে নাই আমার নামও ছিলো ক্যালকানা ফলুয়াকি চ্যাঙ। মন্দ কি! কবিতা হলেই যদি সে স্বপ্নটাকে পুনরায় উপভোগ করি তার শব্দের গূঢ়তায় তবে তা যথার্থ যশাসই। শব্দের শক্তি ও আরও অনেক সম্ভাবনার কথা সকলেই জানি। শব্দের পর শব্দ সমন্বয় করেই একজন কবি আপনাকে দোলায়িত করছেন কবিতায়। কোমল ভাবনাটি জাগিয়ে তুলছেন, নরম করে তুলছেন আপনার সূক্ষ ইন্দ্রিয়কে যেন আপনি স্বাপ্নিক ঘুমে চিৎকৃত হচ্ছেন। শব্দের এই দোলায়িত হওয়ার বিষয়টিই আসে ছান্দিক কবির সুনির্দিষ্ট ছন্দের প্রয়োগ থেকেই। আমি প্রায়শই বলে থাকি, যে কবির কবিতায় ছন্দের সুন্দর বিন্যাস থাকে ওই কবির কবিতা দীর্ঘব্যঞ্জণায় পাঠকের মনে অনেক অনেক দিন সঞ্চারিত হতে থাকে। যেমন ধরুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিপখান তিনদাড় / তিনজন মাল্লা / চৌপর দিনভর / দেয় দূর পাল্লা’ আবার আমার ‘অসমাপ্ত রৌদ্রদিন’ কবিতার কয়েকটি চরণ এরকম ‘মেঘশরীরে শীতল ছিলো, শীতল ছিলো পানি / তোমার বাড়ি দেখিনি আরও চোখের রেখাখানি / চোখের কোণে সাঝের ছবি চোখেই সর্বনাশ / তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আমার গলায় ফাঁস’ স্বরবৃত্ত ছেড়ে অন্য আরেকটি ছন্দে সুমন রহমানের ‘মেঘশিশু’ কবিতাটি দেখুন ‘আকাশে তখন জোর প্রস্তুতি, তুমুল গমগম / সমতটে শ্রাবণ আজ শুরু, মেয়েটিকে প্রথম কদম / উপহার কে দেবে, বাঁশি একাই রাধা রাধা বলে / হায় চঞ্চল হাওয়া! ওকে ডাক, ও যে মেঘশিশু / ডেকে আন মাতৃমেঘে, কচুক্ষেতে করতে দিও না হিশু’। এখন পাঠক ভেবে দেখুন উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর সঞ্চারণ আর প্রথাছন্দহীন কোনো কবিতার সঞ্চারণ একইরকম কিনা? যে কারণে একজন কবির ছন্দ সচেতন হয়ে কবিতা লেখা জরুরি, পাশাপাশি পাঠকেরও ছন্দজ্ঞান ব্যতীত কবিতা আস্বাদন কবিতাকে কখনো কখনো অর্থহীনতায় ফেলে দেয়। আবার কবিতার নিজস্ব একটা ছন্দ আছে যা থেকে পাঠক দারুণ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। টি,এস এলিয়ট মনে করতেন যে ‘কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়’, অর্থাৎ সঞ্চারণ বস্তুটি এমনই সূতর যে বোধগম্য হওয়ার চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত পাঠককে পৌঁছাতে হচ্ছে না, এরও অনেক পূর্বে কবিতার পজিটিভ দিকটি তার মধ্যে লোডেড হয়ে যাচ্ছে। কোনো পঙক্তি উচ্চারণের সাথে সাথে মুহূর্তেই আপনি এর ভাবাবেগে আন্দোলিত হতে থাকলেন। এর বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলবো ওখানেই কবিতা নিহিত আছে। যিনি পড়বেন আপন ভুলে, ধ্যানে মগ্ন হয়ে। আর যিনি লিখবেন একপশলা রোদ এসে কীভাবে একটি সকাল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। টেক্সটের ভিন্নতা সত্বেও এখানে উভয়ের চেনাপথ, দর্শন, চলাফেরা, যন্ত্রণা একই। আসলে এঁরা দুজনেই কবি। একজন পড়েন অন্যজন লিখেন। কবিতার একই ঘরে সহোদর তারা মিলেমিশে পাঠক আর কবি। একজন আসেন সৃজন করতে অন্যজন গড়তে। এ দুয়ের ভূমিকাও সমান কাব্যিক ব্যঞ্জণায় উদ্ভাসিত।
কাকের কথা আমি আগেও বলেছি- তারা শান্তিপ্রিয়, এখনো আমার প্রতিবেশী হিসেবে তাদের পাই সকালের আয়োজনে রাতের অপস্রিয়মাণতায়। পৃথিবীর সমস্ত পতঙ্গ তাকে ভুল বুঝেছে ভুল চিনেছে- কাকের অনন্য সাধারণ কর্কশ কণ্ঠের বিরল সুস্পষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে কাক বিষয়ে আমাদের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
(পুনশ্চ, কাক বিষয়ে: জাফর আহমদ রাশেদ)
দ্রুততম চলে যাচ্ছে সময় তার অদ্ভুত-অদৃশ্য বাহনে চড়ে
আমাদের নেই একটুও ঠাঁই তার কামড়ায় একসঙ্গে উঠার;
কেনো মিছে ভাই হেঁয়ালি তবে আর / উজান-তরঙ্গে কিসের ভাটিয়ালি!
যখন য়ে গিয়ে বিনষ্ট আমাদের না’-এর গলুই-তক্তা-মাথাকাঠ,
ফেরার আগেই সঙ্গীদের হারিয়েছি চিরপুরী বাতাসে-
আর কত ভাসান দেব, হৃদয়-আকাশেরও তো / কূল-কিনার নেই;
(সময়বোধ: আশরাফ রোকন)
সবসময় তোমাকে অবশ্যই মাতাল হতে হবে।
সময়ের বিভৎস বোঝা যাতে অনুভব করতে না হয়, যা-
তোমার কাঁধ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, নুইয়ে দিচ্ছে মাটির...
দিকে, তোমাকে মাতাল হতেই হবে, একটুও থামলে চলবে না।
কিসে মাতাল হবে, সূরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা-
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
(শিরোনামহীন: শার্ল বোদলেয়ার)
কবিতার এই আবহমান প্রক্রিয়ায় আমরা পার করে এসেছি বিগত শতাব্দী। অসংখ্য কবিতার বোঝা আমাদের মাথায়। গত শতাব্দীতে আমরা কবিতাকে কতটুকু ভালোবেসেছিলাম, কতটুকু লালন করেছিলাম, কতটুকু ব্যাপৃত প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা সঠিক জেনে নিয়েই আজকের নতুন কবিকে লিখে যেতে হবে তাঁর অভিপ্রায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজের সময়টা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। সমকাল তাকে এত বেশি মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, অন্ধমোহে জড়িয়ে থাকা ছাড়া তার কোন গত্যন্তর থাকে না। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে যে, সে তাঁর অতীতের দিনগুলোকে প্রত্য করেনি; প্রত্যক্ষ করেনি কোন কবিতার গূঢ়তায় তার আজকের লেখার তাগিদ আর দেখেনি সে নিকট কোনো ভবিষ্যত। যে নবীন কবি আজকের এই দীনতাকে মাথায় তোলে বয়ে বেড়াবেন তাঁর সময়কে, আগামীর শ্রদ্ধা তো তাঁরই। তাছাড়া এই বিষয়টি প্রত্য উপলব্ধি করার সুযোগ নবীনদের ক্ষেত্রেই বেশি থাকে। সেই আসন্ন নবীন কবি-পাঠকটিই জরুরি এখন বাংলা কবিতায়। বিগত শতাব্দিতে আমরা কবিতার কাছে যতটা দায় ফেলে এসেছি সে দায় থেকে মুক্তি পেতে যে অগ্রজ একজন নতুন কবিকে পর্দার আড়ালে টেনে নিয়ে ধোঁয়া সেধে অজ্ঞান করে রাখতে চাইছেন সে দায়টুকুও একজন নবীনকেই মাথায় নিয়ে তাকে শিল্পের পথ পরিস্কার করতে হবে। একজন কবির যদি তাঁর লেখার সময় থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত জানার প্রচণ্ড তাগিদ না থাকে আর কবিতাকে নাকসিটকোতে শিখেন তবে প্রকৃতই কবিতার আসন্ন মৃত্যু হবে বৈকি! (অবশ্য সে মৃত্যু ওই নির্দিষ্ট সময়ের পাঠকের কাছে, প্রকৃতই কবিতার মৃত্যু নেই। প্রায় চার / পাঁচ হাজার বছর পর আবিষ্কৃত সাফো’র দুর্লভ কবিতাগুলো আজ আমরা ঠিকই পড়তে পারছি)।
এ আমাদের দীনতাই বলতে হবে যে, বাংলা একাডেমির মতো এত বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের থাকা সত্বেও তরুণদের জন্য বৃহৎ কোনো উদ্যোগে তাদের চৈতন্য নেই। প্রতিবছরই এই প্রতিষ্ঠান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অজস্র প্রকাশনা করে থাকলেও কবিতার ক্ষেত্রে আহামরি কোনো অবদান রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। (করে থাকলেও আমার মতো অনেক পাঠকের যোগাযোগের বাইরে)। প্রায়শই দেখা যায় যে অগ্রজ-অনুজের মধ্যে চিন্তার একটা তফাত তৈরি হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও এরকমই ঘটে আসছে। অগ্রজ একজন কবি সাধারণত অনুজ কোন কবির লেখা পড়েন না কিছুই হচ্ছে না বা হয়ে ওঠবে না কিংবা হয়ে উঠলেও তাঁর কাক্সিত ল্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না এরকম একটা ধারণা নিয়ে। বিপরীত একটা মুশকিল এখানে থাকছে। অনুজ কবির সৃষ্টিশীলতা তাঁর অজ্ঞাতেই থেকে যাচ্ছে এবং তার ব্যর্থতার জায়গাটিও তিনি আবিষ্কার করতে পারলেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে চিন্তার যোজন ফারাক আর বৈষম্যতাও। অগ্রজ-অনুজ এই দুই বৈষম্যকে সমন্বয় করতে তারাই পারেন এ’দুয়ের ফলপ্রসূ প্রকাশনার মাধ্যমে। অথচ সেদিকটাতেও তাদের হুঁশ রয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে এতটা কার্পণ্য নেই বোধ হয়। সারাবিশ্বের যেকোন দেশের কোনো না কোনো কবিকে আমাদের দেশের পাঠক জেনে গেছেন মূলত সে দেশের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও যোগাযোগের কারণে। আমার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সেরকম ফলপ্রসূ কোন ভূমিকা আজও রাখতে পারেনি। কবিতার ভূমি আমার গর্বের দেশ অথচ কি বিচিত্র এই বঙ্গদেশ! দেশের মানুষজন! প্রতিষ্ঠান! সেলুকাস... আজও তারা কবিতাকে ধারণ করতে পারলো না প্রাণের গভীরে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করবো আমাদের বৃহৎ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেজন্যই ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র লিটলম্যাগের আবির্ভাব ঘটেছে এইটুকু একটা দেশে আর সেগুলোর হঠাৎই মৃত্যু হয়। কোন কোনটির ক্ষেত্রে আর্থিক অসংগতি, বিজ্ঞাপনের অভাব, লেখার অভাব, লেখায় শিল্পময়তার অভাব এখানেও ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠছে অগ্রজ-অনুজ বৈষম্য। এহেন কলুষিত অধ্যায় আমরা সাহিত্য থেকে মুছে ফেলতে না পারলে বা পাঠকের কানে সে সুর বাজার আগেই কবিতার পথ পরিস্কার না করলে ধ্বংসের কিনারে একা একা বসে থাকতে হবে আগামীর কবিদের। আমি মনে করি শুভস্য শীঘ্রম আপনার কাব্যিক প্রণোদনা।
বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যায় সমস্ত শরীর / ভায়ওলিনের সুর দোলে
দুলে ওঠে মানিপ্লান্টের লতা / একচালা ছোট ছোট ঘরগুলি
পুকুর ঘাটে নতুন বউ, কদম গাছে ছোটপাখি
ধানের ক্ষেতে শাপলা একপায়ে তালগাছ
পর্দা সরে যায় বড়কর্তার ঘরের জানালার
মেঘের শব্দে মিশে যায় নারীর আর্তনাদ
স্বর্ণচাপার তলায় সাপের খেলা / নেড়ি কুকুর অবিরাম ডেকে চলে, ডাকছে কাক
খিচুরির চাল ফুটছে চুলোয় / ঘরে প্রতিক্ষায় কেউ
(স্বীয় সঙ্গোপনে-১৩: মাহফুজা হিলালী)
ভালো ভাষা, তুমি কি বহন কর বিশ্বাসযোগ্যতা?
সৌন্দর্যবিচার থেকে কিছু শব্দ খসে গেছে, পড়ে আছে
নর্দমার ধারে, তাকে তুলে এনে কোথায় রেখেছো?
ঘষা কাঁচ, পুরনো পয়সার দুঃখ নিঃস্বের ঝুলিতে
প্রাত্যহিকতার সাথে মিশে তাও আজ কিশে।
(ভালো ভাষা, কোথায় চলেছ?: বিশ্বজিৎ চৌধুরী)
জল বোবা হলে / সাগর হয়ে ওঠে
দেশে দেশে পালকের বোবা কাহিনী / গেয়ে থাকে পাখিরা
বোবাদের চারপাশে বেড়ে ওঠে / গান, ফুল ও রোদ
আমার ঘর যেন / পালক ও কাশফুলের পৃথিবী
(বোবা কাহিনী: যুবা রহমান)
‘কাব্য সাহিত্যে নাটক হচ্ছে সর্বোত্তম’ উক্তিটি কার? এ মুহূর্তে মনে আসছে না। তবে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি এই জন্যে যে, তাঁর বোধের স্বচ্ছ জগত থেকে তিনি তাঁর বোধের ভাষাটা রেখেছিলেন কাব্য পাঠকের জন্য। নাটকের প্রধান সঞ্চারণের বিষয় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার মধ্যেই দর্শকশ্রেণি আন্দোলিত হচ্ছেন ঠিক অন্য একটি ঘটনায়, তাঁর কল্পলোকে। আর সেই কল্পনা থেকেই জেগে উঠছে আপনার প্রকৃত ইমোশান বা ভাবাবেগ যা শিল্পের জন্য প্রধান একটি বিষয়। জগতের সকল বিষয়েই আমরা যেরূপ নাটকিয়তা প্রত্যক্ষ করি আমাদের জৈবনিক সকল ক্রিয়ায় অনেকটা বন্ধনযাতনায়! ফলে প্রিয় থেকে প্রিয়তম এই বিষয়টির শিল্পময়তা বিষয়ে আমার দ্বিধাদ্বৈততা নেই। আর সাধারণ শ্রেণির আন্দোলিত হওয়ার পেছনেও আমার যথাযথ সায় ব্যাক্ত করি, পাশাপাশি সংগীতের আবেদনকেও এর সাথে যোগ করি আমি।
কিন্তু একজন কবি যথার্থ অর্থেই নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকার, প্রবন্ধকার যাই হোন না কেন তাঁর ভেতরে যখন কাব্য খেলা করে তখন তিনি কোথায় উত্তম, সর্বোত্তম, অধতম তা তাঁর নিজেরই জানা থাকে না। আপাত দৃষ্টিতে তাঁর কবিন্দ্রিয়টি খোলা রাখলে বা খোলা থাকে তবে তাঁর সৃষ্টি সর্বোত্তম, সে নাটকই হোক, কবিতাই হোক, প্রবন্ধই হোক আর ছোটগল্পই হোক। কবির জন্য এটি অত্যন্ত সুখের যে, তাঁর কবিন্দ্রিয়টি যদি খোলা থাকে বা যদি হয় সঞ্চারণম তবে একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদার্পণ করা কিন্তু একজন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, ভ্রমণ কাহিনী এইসব লিখিয়ে এমনই এক সূক্ষ বৃত্ত বা ব্যাসার্ধ থেকে পরিচালিত হন যে, তাঁর পে কখনোই সম্ভব নয় কাব্যিক অন্তরায় সঞ্চারিত হওয়া, ওই অবস্থান থেকে কখনোই সম্ভব নয় সাহিত্যের সকল শাখায় প্রভাব বিস্তার করা। এক্ষেত্রে কবি ও কবিতাই সিদ্ধ স্মরণেষু কেননা একজন কবি তাঁর কবিতায় ধারণ করেন সমস্ত কিছুর প্লট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সৈয়দ শামসুল হকের লেখা যাঁরা গভীরভাবে পাঠ করেছেন তাঁরা এর সত্যাসত্য আবিষ্কার করেছেন নিশ্চয়ই। একমাত্র কবিরই সকল বোধ খোলা থাকে কিন্তু যাঁরা সরাসরি ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার তাঁদের বেলায় এরকমটা হয় না সাধারণত। কবি অর্থে চিহ্নিত কারা? তা প্রমাণ করা কারো পে সম্ভব নয়, একমাত্র তিনিই এর যথার্থ উত্তর মেলাতে পারেন যিনি পড়েন আর পড়েন এবং পাঠশেষে নির্দ্বিধ বলে দিতে পারেন সর্বোচ্চ সঞ্চারিত কবির নাম। কিন্তু যুক্তিনিষ্ট সত্যভাষণ প্রদান করতে পারেন এরকম পাঠক আমাদের নেই। তারপরও স্বাভাবিক অর্থেই আমরা জেনে যাই কে কবি আর কে অকবি। পাঠকই তা নির্ধারণ করেন। অবশ্য এখানে একটা সমস্যা তৈরি হয়, পাঠকই আসলে প্রকৃত অর্থে কবি; তা না হলে কবি যে কবিই মূলত সে বিষয়টি কে আবিষ্কার করতো? জীবনানন্দ দাশ কবি চিহ্নিত করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ শেষপর্যন্ত তারও সিদ্ধান্ত ছিলো পাঠকের উপর কেননা সকলেই কবি না হলেও পরবর্তীতে আর কোনো কবি আসবে না একথা তিনিও বলে দিতে পারেননি আর তাছাড়া নিজেকে যদি কেউ সঠিকতা নির্ণায়ক হিসেবে দাবি করেন তবে তা ভুলই হবে। সময়ই বলে দিতে পারে কে কবি আর কে অকবি। একশো বছর পর যদি ওই সময়ের পাঠক জীবনানন্দ দাশের পরে কবি হিসেবে মহাদেব সাহা, রবীন্দ্র গোপ, আসলাম সানী-কে আবিষ্কার করেন এবং সে যুক্তি যদি যথার্থ অর্থে সাময়িক হয় তবে কারোরই কিছু করার থাকবে না। যেহেতু এ সময় আমরা এঁদের সেঅর্থে কবি হিসেবে মনে করি না। কিছুটা মহাদেব সাহা ব্যতীত বাকি দুজনই কবিঅর্থে প্রায় নিষ্ক্রিয় বলা চলে।
তাহলে সোজা কথাটা দাঁড়াচ্ছে এরকম যে, সামগ্রিক অর্থে কাউকে কবি বা অকবি বলবার মতা আমাদের নেই বরং আমরা আমাদের পছন্দের কবি চিহ্নিত করতে পারি শুধু।
আমাকে দাওনি তুমি কম্পাসের খল নির্ভরতা
ছিলে না পরার্থপর মৃত্তিকার দিগন্ত নির্দেশে / বস্তু হতে অবাস্তব ভূতের আশ্লেষে
ক্রমশ লুপ্ত হয়ে অতগুলি অলৌকিক যন্ত্রের কথা
মনে কি পড়ে না কারো? আকাশে উড্ডীন
শকুনতাড়িত সূর্য হেলে পড়ে কম্পাসকাঁটায়-
বৈশাখ দুপুরে দূর বিমানের ধাতু আলেয়ায়
বিপুল এয়ারড্রোম পড়ে আছে বৈমানিকহীন।
(বিশাল বাস্তবিক নত্রপদ্ধতি: উৎপল কুমার বসু)
ভোরের উৎফুল্ল ঠোঁট দরোজায় জানালায় চুমু খায় আয়।
এই ছোট্ট ডাক দিয়ে একজন পাশ ফেরে যুগল শয্যায়,
ঘুমের ভেতরে হাসে, সবুজ বৃরে মতো আঙুল বাড়ায়।
আমাকে নির্বোধ যদি মনে করে থাকো- ভুল হবে;
যদি মনে করো আমি স্বভাবত ভুলে যাই সব- ভুল হবে;
যদি মনে করো এখনো জানি না আমি কি ফেলে এসেছি-
ভুল মনে করা হবে।
(গাছ পড়ে যায়: সৈয়দ শামসুল হক)
সময়ের মধ্য থেকে কিছুটা সময় বের করে নিতে হয়
যেমন সবার মধ্য থেকে প্রিয়তম বন্ধু এসে ডাক দেয়;
তার সরল কথা শোনার পরে পৃথিবীটা চির আধুনিক
জ্ঞানী কিংবা মূর্খ প্রত্যেকেই চেয়েছিলো এই ডাক দিক;
সময় পেয়েছে যারা, সময়ের থেকে চলে গেছে বহুদূর
সময়ের হাত ধরে লাইনে দাঁড়ালো- ওই যে সুদূর;
(সময়ের মধ্য থেকে: আলফ্রেড খোকন)
ভাবনার, আবেগের, বোধের সন্তরণই কবিতা। কবিকে তাই মগ্ন থাকতে হয় তাঁর চিন্তায়, কবি তাই মগ্নই থাকেন আর এভাবে মগ্ন থেকে থেকে ক্রমান্বয়ে তিনি হারাতে থাকেন পরিবার, সমাজ, দেশ। কবির ভাবনায় সমস্ত ভূখণ্ডই হয়ে যায় তাঁর চলার পথ। কেউ কেউ বলেন কবি আসলে সমাজের বিচ্ছিন্ন একটি প্রাণির নাম, এ কারণে যে একজন কবির মধ্যে সামাজিক কোনো দায়বোধ থাকে না বা সেঅর্থে জন্মও নেয় না। শুধুমাত্র একজন কবির ক্ষেত্রেই নয় যেকোন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিমাত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। এ কথাটা যতটা সত্যি তারচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে কবির কল্পনার বিস্তার সমস্ত মহাশূন্যকে ঘিরে। সুতরাং পরিবার সমাজ, দেশ, জাতি, ধর্ম, এসব কবির কাছে ক্ষুদ্র হয়ে যায়। সঙ্ঘশক্তি বা সমাজভাবনা যেখানে একজন সাধারণের আরাধ্য বিষয় হয়ে থাকে সেখানে একজন কবির ক্ষেত্রে বিপরীত হিতেরও কারণ হয়। ফলে ত্রেবিশেষ শুধু একজন কবি নয় সিরিয়াস পাঠকও এরকম সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। একটি কথা হলো, যার ঘর রা হয় তার বাহির রা হয় না আর যার বাহির রা হয় তার ঘর রা হয় না, মূলত এ দুটোর মাঝখানেই কবির অবস্থান। যার দুকূলই রা হয় বা এ’দুয়ের লিটারেসি মিডিয়ায় অধ্যরে ভূমিকা পালন করেন তিনি একজন পাঠক। একমাত্র পাঠকের দ্বারাই সম্ভব দুটো বিষয়কে সমন্বয় করা। আমাদের পাঠকরাই সমৃদ্ধ নয় এ দোষ বা গুণ কার উপর গিয়ে বর্তাবে তা ভেবে পাই না। সর্বোপরি আমাদের কবিরাও পাঠঋদ্ধ হওয়ার আগেই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন- যা সাধারণ পাঠকের প্রাপ্য নয়। বস্তুজগতের সকল মানুষই কবি এবং সবকিছুই কবিতা। এর মধ্যেও একজন কবি যখন লিখতে শুরু করলেন ধরা যাক সে সময় থেকেই কেবল তাঁর ইন্দ্রিয়টি খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রকাশবিচারে একজন কবির জ্ঞানের জগত যথার্থ প্রগাঢ় হওয়া চাই। এই বিষয়টির যথেষ্ট অভাবস্বত্বেও যখন একজন কবির মধ্যে অহেতুক উতলা হওয়ার অভিনয় দেখি তখন কষ্ট পাওয়াব্যাতীত কোনো গত্যন্তর থাকে না।
বাংলাসাহিত্যে পড়ান এমন এক রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপকের সাথে কথা হয়েছিলো একদিন। তাঁর বক্তব্য ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠের পর অধুনা সাহিত্য পাঠের কি প্রয়োজনিয়তা থাকতে পারে একজন পাঠকের? কি করবো হাসিতে ট্রাজেডিক লুকোচুরি খেলেছিলাম সেদিন। প্রশ্নটির মধ্যে পাঠকের গভীরতা নির্ণয়ের একটি বিষয় ছিলো কিন্তু আমার হাসিটা ছিলো অন্য কারণে। সমকালিন সৃষ্টিশীলতার কি তবে কোন প্রয়োজনিয়তাই থাকছে না? কবিতা তো তাই একবেলা খাবারের পর দ্বিতীয়বার ক্ষুধা পায় যেমন। আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবী স্থবির নয় তারই উদাহরণ কবিতা, এও সত্য যে পুরনো কে ভাঙাই কবিতার কাজ বা পুরানের ভেতর থেকেই নতুনের সৃষ্টি। একজন জীবনানন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং তাঁর কবিতা শতাব্দীর কবিতা হিসেবে যথার্থ গুরুত্বের দাবিতে ভরপুর; জীবনানন্দ দাশ ভেঙেছেন তাঁর পুরনো ধ্যান-ধারণা এবং উৎকৃষ্ট বোধে মূল্যায়িত করেছেন সময়ের সম্ভাষণাকে। তাই বলে যাঁরা এমন সাহিত্য বলয় তৈরি করেছেন তার ভেতরেই বা একজন পাঠক আবদ্ধ থাকবেন কেন? যাকে বলি মায়াজাল, একজন পাঠকের এরকম আবদ্ধতা আসলে কাটিয়ে উঠা উচিত। তাহলেই কেবল প্রকৃত চেতনার স্ফূরণটি তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
একজন পাঠকই আসলে প্রকৃত কবি। যখন তিনি নিমগ্ন হয়ে উপলব্ধি করেন কবিতাকে তখনই জন্ম নেয় তাঁর যথার্থ কবিতাগুলো। ফলে সময়মতো তাঁর কবিতাগুলো তিনিও লুফে নেন তাঁর কবির ভেতর থেকে। একজন যথার্থ পাঠকই হলেন প্রকৃত কবিতার জন্মদাতা।
ধূলিপথে প্রণয় হলে প্রলয় প্রত্যাসন্ন হয়,
অতঃপর পুনরায় ফিরে দেখা দ্বারপ্রান্তের দৃশ্যরেণু;
নগর কাহার নাগর ও ধূলিভাই
শিল্পবন্ধু, অনুনাদহীন নগরের বিস্তার-
আজ ঘরে ঘরে শূন্যতা বর্ণনা করি!
(নগরপর্ব: আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিন
ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুন
মসৃণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীলচিঠি
লন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপসন, শাদা বাক্স ওষুধের
সৌখিন শার্টের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতার
ভবিতব্যহীন নানাস্মৃতি আর রঙবেরঙের দিনগুলি
(বৃষ্টি, বৃষ্টি: শহীদ কাদরী)
জন্মভূমি- কথাটার মধ্যে এক আশ্চর্য মাদুর বিছানো আছে,
তাতেও শুয়ে দেখতে পারো।
জ্বালা যন্ত্রণার কথা মুখ ফুটে না বললেও টের পাই-
মানুষ যেমন ফুল, মানুষ তেমনই কাঁটা!
ঘরের ভেতরকার আসবাবে হোঁচট খেলেও তো তাকে রাখো!
(ফুলঝুরি, তোমার নাম: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কবি দেখেন, পড়েন, ভাবেন, লিখেন অতঃপর তিনি একটা ভূ-মণ্ডল রচনা করেন যা তাঁর একান্ত নিজস্ব একটা বলয়। সেখানে তিনি একা, বলা যায় এটা তাঁর গভীর পাঠ প্রস্তুতির কারণে। একাই দেখেন, ভাবেন, বুঝেন, লিখেন... এখানে তাঁর ভাবনার ব্যতিক্রম তো রয়েছেই, এখানে তিনি সমাজের আর দশজন মানুষের মতো ভাবনা বিস্তারী নন। তাঁর ভাবনা অতলস্পর্শী যা শেকড় ছুঁয়ে যায়, যতটা তিনি দিগন্তপ্লাবী ততটাই তিনি গভীর পাঠক। তিনি যখন একজন পাঠক এবং আরেকজন পাঠককে বিশ্লেষণ করতে যান তখনই ফুটে ওঠে তাঁর ব্যতিক্রম সত্তা ফলে পাঠককে ছুঁতে গিয়ে তাঁকে হয়ে উঠতে হয় অত্যন্ত গভীর বোধ আর মেধার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। কবিতার ভেতরকার টেক্সটই তাঁকে সেরকম ভারী করে তোলে। এইগূঢ় সত্যের বাহিরে যিনি অবস্থান করেন তিনি এক সাধারণ মানুষ, অতি প্রাকৃত, অতি সামাজিক, অতি কোমলপ্রাণ একজন। এরকম মুহূর্তে কবির যাকে দরকার তিনি একজন ঋদ্ধপাঠক, একমাত্র তিনিই ভাঙতে পারেন কবির নিজস্ব বলয়ের আবহটাকে এবং বের করে নিয়ে আসতে পারেন তাঁর নির্বাচিত কবিটাকে। শেষপর্যন্ত কোন পাঠকই যদি তা উদ্ধার করতে সম না হন তবে কবির তাতে বয়েই যায় বরং তাঁর কাব্যসত্ত্বা অপেক্ষা করে পরবর্তী মহাকালের অপেক্ষায়। একটা সত্যি বিষয় হলো, কবির বলয় থেকে তাঁর সত্ত্বাটাকে বুঝবার মতো কোন যোগ্য পাঠকের সৌভাগ্য হয়নি বাঙলা কবিতার। যেটুকু হয়েছে তা অতিসস্তা, নিম্নমানের, সাময়িক মুগদ্ধমানের পাঠক আর তাতেই বাঙলা কবিতা রাজকপালে। আজ যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর... জীবনানন্দ দাশ... জসীম উদ্দীন... সৈয়দ শামসুল হক... ফরিদ কবির... বলে হাই তোলে ঘুম ছাড়ছি কবিতা কবিতা বলে তারাও শেষমেষ পাঠকের দলে নই কারণ এঁদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হতে গিয়ে তারাই বসে আছেন রবীন্দ্র সাহিত্য বলয়ে, সেখান থেকে তাঁদের বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এ থেকে জীবনানন্দের পাঠক অবশ্য ব্যতিক্রম, তাঁরা ক্ষাণিকটা বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছেন আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হয়ে। কিন্তু এতেই বাঙলা কবিতার ব্যাপক প্রসার নিশ্চিত হয়ে পড়েনি, বলা যায় সবেমাত্র পাঠককুলের নাকের আঁওয়া ভাঙতে শুরু করেছে। এদিক থেকে আমরা আশাবাদী যে, বাঙলা কবিতার আরও ব্যাপক প্রসার অবশ্যস্থাবী। টেক্সটের ধারণা এখানে এসে সমস্ত যৌক্তিকতা ভেঙে দেয়। টেক্সটই যদি আপনাকে কবিতার দিকে প্রবাহিত করলো তবে সেখানে পাঠকের দুর্বলতা কিংবা টেক্সটের শক্তিময়তার কথা ভাবার কোন সুযোগ নেই। স্বয়ংনির্ভর টেক্সট কোন সঠিক জায়গায় আবেদিত হয়ে সমাপিত হলো সেটিই প্রধান বিষয়।
এই শীতে গান। এই শীতে গান নেই যদি না বানাই আমি
কেননা শালিক, কাক, চড়ুইয়ের ডাক / গান নয়- যদিও আমার কানে গান-
পাখিরে দেয়নি গান, পাখিরে দিয়েছে শুধু ডাক
আমারে দিয়েছে গান, আমি তাই গানেরেই ডাকি,
ডাকি শীতে, শীতের শত্রুতা সহ্য করে, পাংশু, দিনে, / রক্তশোষা অসহ্য সন্ধ্যায়।
(মৃত্যুর পরে-জন্মের আগে: বুদ্ধদেব বসু)
কবরের পাশে জন্মানো পিপ্পল গাছ,
সারারাত বাতাস আর ঘুঙুরের শব্দ শোনো,
কোথাও বিষাদ আড়াল করে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে রুষ্ঠ প্রেতাত্মারা,
দেখছে কবর প্রাচীর ভেঙে রাত থাকতে চলে গেছে গোরখোদকেরা,
কে তোমার পাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে হৃদয়?
(উপকথার কবর ও একটি গাছ: রায়হান রাইন)
কেমন জাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতোপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিলো, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাওলার ঝোপে / লুকিয়ে বেঁচেছি এতকাল
(ডানা: সাজ্জাদ শরিফ)
কবিতা যেহেতু সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা, কাজেই সুযোগসন্ধ্যানী পাঠক সেদিকেই ধাবিত হবেন। কিন্তু আমাদের সমাজে সৌন্দর্যবীক্ষার এই ধারণারও একটা অবমূল্যায়ন আছে। আদ্যন্ত কবিতাকে জেনে নিয়েই একজন কবির উচিত তাঁর সকল নিবেদনকে প্রজ্ঞাপিত করা। গাল্পিক-সুলেখক রাজীব নূর, রেজা ঘটকের সংগে বিশেষ একটি আড্ডা হয়েছিলো একদিন আমাদের ‘পাঠসূত্র’ অফিসেই। তিনি প্রশ্ন রাখলেন কবিতা লেখা কেন জরুরি? একজন লেখক কেন তাঁর লেখাটি প্রকাশ মাধ্যমে দিতে পারেন? মহাকালের সৌন্দর্যচেতনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ইউনিট হচ্ছে কবিতা। আগেই উল্লেখ করেছি ‘সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা’ কবিতা তাই একজন কবির সৌন্দর্যচেতনা থেকেই লেখা জরুরি। যেখানে পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠতে পারে শৈল্পিক নিবেদন, অহং। ‘সঙ্ঘশক্তি’ ঠিক যে অর্থে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রিয়ার সৃষ্টি করে এর বিপরীত একটি অর্থেই একজন লেখকের প্রকাশিত লেখনি সমধিক ব্যাঞ্জণায় সঞ্চারণ সৃষ্টি করতে সম। ফলে একজন লেখকসত্ত্বার পূর্ণ নিবেদনে অবশ্যই ব্যাপক প্রকাশনা জরুরি। একটা বিষয় আমি স্পষ্ট লত করেছি যে, আমাদের কবিরা নিজেদের কবি হিসেবে ভাবতে সাহসী নয় কেননা তাঁরা এতই মুখচোরা যে, এখন আর কবি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন না। বিষয়টা প্রস্তাবনার ফলে কেউ কেউ হয়ত উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ দাশকে টেনে আনতে ভুল করবেন না কিন্তু আমার চিন্তা খুবই সাধারণ। আজও আমরা কবিতা লিখে গর্ববোধ বা শৈল্পিক অহং-এ তাড়িত হতে পারি না, যেন কবিতা লিখছি এটা একটা গর্হিত অপরাধির কাজ। তবে কিসে আর গর্ববোধ করবো? এমন অনেক পটূ কবিও রয়েছেন যাঁরা কবিতা লিখলেও মূলত তাঁর অহং-এর জায়গাটি হয়ে থাকে অন্য কোনো বৃহৎ পরিচয়ের। যা হয়ে থাকে বড় কোনো কর্মকর্তা, একজন বিদেশ ফেরত অকেজো বা কথার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে ধন্যবোধ করেন (হিজরা ইংরেজ) অথচ সকলেই জানি ওইসব স্থূল পরিচয়ের চেয়েও কবিতা নিশ্চয়ই আরো মহত্তম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের। এসবই প্রমাণ করে আমাদের কবি ও কবিতার অবস্থান এখন কেমন। যাঁরা এ অবস্থানটা তৈরি করেছেন ওইসব হিজরেরা কি জানেন পরবর্তী কবিদের মাথায় এর কতটা বোঝা তুলে দেয়া হলো। কথা আরো থেকে যাচ্ছে, সুন্দর প্রতিবেশ কবিতার একটি প্রধান শর্ত! মুক্তচর্চায় এরকম প্রতিবেশই কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য জরুরি হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহৎ কোনো ব্যক্তিক আইডেন্টিটিসহই কাব্যিক আইডলটি এত বেশি উজ্জ্বল থাকেন যে, আপনার সমস্ত ধারণা আমূল পাল্টে দিয়ে শৈল্পিক অহংটি পরাজিত হয়ে যেতে পারে। যে কারণে শুধু কবিতা নয় সমগ্র সাহিত্যই নখদর্পণে থাকা জরুরি। সাহিত্যে বাঙালির প্রথম নোবেল উইনার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। এরপর বাঙালির আর কোন সাহিত্যে নোবেল নেই। প্রায় একশো বছর পরে আমাদের এ দীনতা ঘুচাতে আজকের তরুণদের আরো বেশি সজাগ হওয়া জরুরি। এখনো আমাদের বাস্তবতা এরকম যে এই বাংলাদেশে শান্তিতে নোবেল পেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস আর আমাদের তরুণরা উদ্বেলিত হয়ে চায়ের আসর, ক্যাফে-ক্যান্টিন টেবিল চাপড়ে গরম করে ফেললো খবরটি শোনার পর। অথচ এরূপ হওয়াই সঙ্গত ছিলো যে, রবীন্দ্রনাথের পর আমাদের দেশে সাহিত্যে নোবেল পেতে যাচ্ছেন ফরিদ কবির। এই খবরটা আগেই জেনে ফেলা, তাহলে সেটি অধিক ফলপ্রসূ হতো। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ কিন্তু আমার ভাবনাটা এর বিপরীতে। আমার কাছে কেউ কেউ কবি নয় সকলেই কবি। কবিতা নামক শব্দটি যিনি জানেন, কবিতা নামক শব্দটি যিনি বুঝেন তিনিই কবি। যদি এমন কোনো পাঠককে খাতা-কলম হাতে বসিয়ে দিই কোথাও তবে তার পক্ষেও লিখে ফেলা সম্ভব কোনো কবিতা। সমস্যাটা এখানেই, কবিতা লিখলেই যে সেখানে কাব্যিক সঞ্চারণ থাকবে বা শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে যাবে বা যিনি লিখিয়ে তিনি যথার্থ অর্থে কবি হয়ে উঠবেন এমনটি নয়। মূলত তাকে চেনার জন্য পাঠকের একটি চোখ খোলা রাখলেই চলবে। যাঁর চলায়, ফেরায়, বলায়, চিন্তায়, মেধায়, মননে, দৃষ্টিতে, চেতনে, অবচেতনে, স্বপ্নে সর্বণ কাব্যচিন্তনের বিস্তার তিনিই কবি। সমাজের, দেশের, বিশ্বের তথা ভৌগলিক সমস্ত সুন্দর যিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর ভাবনায়; যাঁর চিন্তা সুন্দর, যিনি সত্য ভাবেন, সত্য লিখেন, যিনি সর্বণ দগ্ধ হচ্ছেন কবিতায়, তিনিই আমার কবি। ধন্য তাঁকে, নমস্য তাঁর পঙক্তি, আমার সকল নিবেদন, আমি তাঁর পূজা করি।
রক্ত দ্রাঘিমা থেকে পাঠিয়েছ বোবার কাহিনী
তাকে ক্যাসেটে চড়ালে শুধু শব্দহীন / ব্যর্থ ঘুরে মরে
আর যতো রাতের প্রদীপ এসে / হানা দ্যায় নিঃশ্বাসের ঝড়
ফলত সে নিভে যায়! / তথাপি শিখরে তার শিখা জ্বলমান
দৃষ্টি তো নিরেট তাই লোকেরা দ্যাখে না
শীতল ফলের মর্মে আজ রাতে তারকার নত।
(বোবার কাহিনী: জুয়েল মাজহার)
টের পাই / বীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে ফসলের গাছ
টের পাই / জেগে ওঠছে কবিতার নতুন অঙ্কুর
টের পাই / কাগজের শাদা পৃষ্ঠা নিয়ে খেলা করছে অবিরাম ঢেউ
টের পাই / ভোরবেলা জেগে ওঠবে কবিতার চারা
(কবিতার চারা: আবিদ আজাদ)
তোমার হতাশ চোখে
সন্ধ্যায় আগুনছবি নিভে আসে, মেঘ আরো নিচু / এবার হাডুডু মাঠে স্বগতোক্তি মুছে নিয়ে সংলাপের জন্ম হয়, ঝিঁঝিঁ ডাক / জোনাকি আলোয় তৃতীয় পঙতির মতো একটি গরীব মেয়ে হেঁটে যায়, ছেঁড়া ফ্রক / লোকচুক্ষুভীতা ভয়ে তুমি দ্যাখো, / এই অন্ধকার গ্রামে, কুপি জ্বেলে, পাঠকই কবিতা।
(হাডুডু খেলার মাঠ: রণজিৎ দাশ)
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই প্রশ্ন তোলবেন যে, কবিতা কি এবং কেন? কবিতার ভবিষ্যত কি? তারপে কবিতার ‘ক’ আর বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাঁকে অযথাই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতা কি ও কেন এবং কবিতার ভবিষ্যত কি? একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন, তাঁর কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুণ বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জন্মদাতা। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকে আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার-আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবনবোধ, এসব অসংখ্য কাজ এক নয়, কবিতাও তাই। অজস্র বছর চলতে চলতে এর ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি, হয়তোবা ভবিষ্যতেও আমরা এর আরও অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পে অসম্ভব যতণ না তিনি গভীরভাবে কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত সেইসব অধ্যাপক সমালোচকদেরই, যাঁরা কবিতা মাথায় নিয়ে পাঠক / শিক্ষার্থীদের কবিতার ভেদজ্ঞান বোঝাতে নিজেদের অধ্যাপক সাজিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেয়া।’ অর্থাৎ কাব্যিক আইডলটিরই সুনির্মাণ করা। কিন্তু ভাববার বিষয় হচ্ছে যে সেদিক থেকে আমাদের বর্তমান শিা প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠককে কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে, কতটুকু পাঠমনস্ক, কতটুকু পাঠক করে তোলে তার অধ্যাপক সমালোচকের মাধ্যমে। এটা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না আমাদের, যখন দেখি আমাদের পাঠকদের কাচুমাচু অবস্থা। আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে তার পাঠপর্ব শেষ, এই হীনভাবনার দায় নিশ্চয়ই ওই দুর্বল প্রতিষ্ঠান আর অধ্যাপকদের। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠপর্ব শেষ করে সে আর তার মতো করে পাঠের প্লানিং ফর্মটিই তৈরি করতে পারছে না বা সেই দায়বোধও তার মধ্যে জাগছে না। এই প্রশ্নটি করার আগে এইসব অধ্যাপকদের কানে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিস্কার করে কবিতার সঞ্চারণ সৃষ্টি করা জরুরি। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তবে কবিতার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে কেননা তা না হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এমন অনেক প্রশ্নকর্তা বেরিয়ে আসবে সে পরিপূর্ণ জ্ঞানপিপাষু হবার আগেই।
মাটি খুঁড়ি। তামার স্তর ভেদে, ভেঙে এত স্বর্ণ স্তূপ।
ছড়িয়েছি তাতে শরীর ও বিবমিষা, আমার দীর্ঘচুলের জটিল জালে
কালো মাটি আর আগুন ও চুম্বনে অগ্নি-ভষ্ম-বীজে;
অন্ধেরা পায় চূর্ণসূর্য, রঙের সারাতসার; উদগমনের ভারে
বীজের ভিতর ধারণ করেছি তাকে, সর্বগ্রাসে গর্ভধারণ করে
বেঁচে থাকা তাই ধানভানা এক আনন্দময়ী গান! তবু
চাল ও চুলায় চন্দনখড়ি জ্বেলে পাতাল গল্প বলি:
(শিকড়গুচ্ছ: শাহেদ শাফায়েত)
স্বাদগন্ধ নিরুদ্দেশ। আমি তাই স্ত্রীলোকের আমন্ত্রণে গিয়ে
দেখেছি জলের পাত্রে দুধ আর দধির কলস ভরা জল।
আসলে দেখিনি, শুধু নিরাপদ বাক্যালাপে অনুমান করে
বুঝেছি নারীর সংগে প্রকাশ্যেও পুণ্যলাভ হয়।
(কর্মফল: মৃদুল দাশগুপ্ত)
এই সামান্যই, দেখেছি ভেজা চোখে পাহাড়ে আগুন জ্বালে ছেলেরা
আর মেয়েদের থানে থানে তখনো জেগে আছে বাল্বের আলো
ছেলেরা কলার গাছ কেটে আনে। পরদিন ভাসাবে বাউলের ভেলা
শিশিরের ছেলেরা খাবে বলে বসে আছে চায়ের ফোয়ারা
আমাদের গ্রামে ক্যান্টিনও ছিলো। তখনো বেঁচে ছিলো এক টাকা।
নন-সাইবেরিয়ান ঠাণ্ডা পালায় কাপের-পর-কাপে ঘা খেয়ে
(শীতকাল: পলাশ দত্ত)
শিল্প কি? এরকম প্রশ্ন যদি কাউকে করা যায় তবে তিনি কোন জটিলতায় না গিয়ে সরাসরি উত্তর দিতে পারেন ‘সুন্দর’ পৃথিবীর সমগ্র সুন্দরকেই আমরা শিল্প বলতে পারি, তা সে কৃষি কাজই হোক, ব্যবসার কাজই হোক, অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠানই হোক, হাড়ি-পাতিল তৈরি করাই হোক বা অন্যান্য আরও যা কিছু আছে তাই হোক, কাজ যখন সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই তাতে শিল্প ফুটে ওঠে যা আমাদের প্রত্যেকেরই সূক্ষ অনুভূতির জন্ম দেয়। অবশ্য, আজ যা সুন্দর ভবিষ্যতে তা সুন্দর নাও থাকতে পারে কেননা সুন্দরকে কে, কখন, কোথায়, কিভাবে করে তোলবেন তা তার সময়ের মানুষেরাই ভালো বুঝবেন। এই আপেকি বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই, সুন্দরের আখ্যান মানুষেরাই রচনা করবেন মানুষেরাই ভাঙবেন। এইসব ভাঙাগড়ার মধ্যেই কবি সুন্দরকে নিয়ে আসেন তাঁর কবিতায়। ফলে যে কবিতায় সুন্দরের প্রকাশ তা যে কোনো প্রকারের কবিতাই হোক না কেন উহা পাঠকের কবিতা, কেননা কবি যে সুন্দরকে কুড়িয়ে এনে জড়ো করেন কবিতায় তা কোন না কোনভাবে পাঠকেরই জন্যে সমাপিত হয়।
একজন কবির কতজন পাঠক থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করতে পারি? এখানে লেখা বাহুল্য যে, কবিকীর্তিটি স্পষ্ট করার জন্য ওই নির্দিষ্ট কবি ব্যতীত আর একজন পাঠকেরও দরকার নেই আসলে। এই প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হয়ত নিজের ঢোল নিজেই বাজাতে শুরু করবেন- যা একজন কবির কখনোই সংগত নয়। একটি কবিতা যখন কবিআত্মা থেকে মুক্তি পাবে তখন আরেকজন পাঠককে যদি স্পর্শ না করতে পারে তবে তা যথার্থ কবিতা কেন? অবশ্য পৃথিবীতে যত কবিতা লেখা হয়ে থাকে প্রতিটি কবিতাই- পাঠ নিশ্চয়তা নিয়ে আসে- কোন না কোনভাবে তা পঠিত হয়।
কবির নিজস্ব একজন পাঠকের প্রয়োজন আছে কি? না, তারও প্রয়োজন নেই কিন্তু কেউ যদি সাগ্রহে এসে কবির পাঠক হয়ে ওঠেন তবে এটা তাঁর কাব্যিক মহিমাগুণেই। ওই নির্দিষ্ট পাঠকটি অবশ্য তার কবির গুরুত্ব বুঝতে এবং কবিকে যাতে কোনভাবে অবহেলা বা অবিচার করতে না হয় সেজন্যেই তাকেও হয়ে ওঠতে হয় সামগ্রিক কবিতার একজন স্বচ্ছ পাঠক আর সমগ্র কবিতা বোঝার পরই কেবল পাঠক তার নিজস্ব কবিটিকে আলাদা করতে পারেন টোটাল কাব্যিক প্রতিবেশ থেকে। এরকম অভিজ্ঞ পাঠকই জরুরি অধুনান্তিক বাংলা কবিতায় যাঁর কথা ইতোমধ্যে আলোচনা করে এসেছি। শেষপর্যন্ত তার কবি হবে সেই সত্ত্বাটি যার কবিতা সাত্তি¡ক অবস্থান থেকেই শাসন করবে তার অন্তরাত্মা। সেই পাঠকটিই অর্জিত হওয়া কবিকীর্তির স্বার আর সেরকম নিবেদিত পাঠকেই মূলত কবিতার পাঠক বলা যায়। এও সত্য যে একজন কবি তাঁর যথার্থ সঞ্চারণটি পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে উপভোগ করতে চান প্রকৃত সেই উদ্ভাবনা শব্দের, যা তাঁর মধ্যে নিবেদনের ক্রিয়াটি জন্ম দিয়েছিলো, যে বিদগ্ধতায় তিনি অস্থির হয়েছিলেন। ফলে একজন কবির পাঠক তো জরুরিই সেক্ষেত্রে শিক্ষিত পাঠকটিই তাঁর বেশি প্রয়োজন যেখানে তাঁর নিগূঢ় নিবেদন বস্তুটি স্বযত্নে মূল্যায়িত হয়। বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, গীতা যেখানে এই নিবেদন বস্তুটির কথাই উল্লেখিত হয়েছে অজস্রবার। আমাদের জীবনাচারের কাব্যময়তা থেকে যার বিরূপ ক্রিয়াও আমরা উপলব্ধি করেছি এবং সেই প্রার্থিত সুন্দর মহাসময়ের অপেক্ষাও আমরা করছি যার অবমূল্যায়ন থেকে মূল্যায়নই জরুরি হয়ে পড়েছে।
কথা যে স্বয়ম্ভরসভাবে হাসায়, শব্দদের প্রতিভা সে জানে
মহাপ্রকৃতি যে নিয়মে স্নায়ুকে জাগায়, উদ্দীপ্ত করে রাখে
অন্বিষ্ট ব্যাখ্যান থেকে পরাজিত মানুষের বেদনা তুলে নিয়ে
সেও তো মৌলিক হলো, ঐ গান শঙ্খসমুদ্রে যেভাবে বেজেছে
মানবীর তন্তুতারে তার সুর বুঝি পড়োকান্না কালরাতে
যৌগিক সমুদ্রে খুব ঝড় হলো, প্রভাতে তার চিহ্ন মাত্র নেই।
(মানুষ মকর নয়, অন্যপ্রত্নজীব: কামরুল হাসান)
ধান ছড়ানোর বেলা শেষে
উঠানে করো কি বউ? ভাবের বিন্যাস।
ধানের গন্ধের নেশা বাতাস আক্রান্ত করে / অতঃপর চুলে
বেঁধে নিয়ে খোঁপার কৌশলে
একটি ফুলের গাথা কেমন মৌসুমভর / আসর জমায়।
(শস্য নয়, ভাবের পার্বণ: শুভাশিস সিনহা)
ওরে ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া
আসমানে উড়াল দিয়া তোমরা আসেন
মরুভুমিতে যায়া লড়িব আমরা / কার সনে তাহা বাবাই জানেন
ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া / ইসলাম জীন্দা হোতা হায়,
(ভাওয়াইয়া: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
একটা মুশকিল হলো, যতই আমরা সাহিত্য সাহিত্য বলে চরাই-উৎরাই করে ফেলি না কেন আমাদের এই বিচিত্র বঙ্গদেশ মূলত সাহিত্য মূল্যায়নের কোনো স্থান নয়। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে অসংখ্য অরজ্ঞানসম্পন্ন মূর্খের ভিড় আশেপাশে, বিচিত্র জাতের মানুষের হাতে আমাদের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলি জিম্মি হয়ে আছে। এদেশে লেখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া অত্যন্ত মুশকিল। এর চেয়ে বরং ওপার বাংলার সাহিত্য এখন জমজমাট, এদের হাতে রয়েছে প্রচুর পাঠক আর নিজস্ব ঐতিহ্যসম্পন্ন বিশাল বিশাল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যদিও সেগুলোতে কাঁঠালপাতা চিবানোর সংখ্যাই বেশি তারপরও এই প্রকৃতির লোক যত রয়েছে তারচেয়েও বেশি আছে কাঁঠালগাছ। ফলে শিল্প-সাহিত্যে তারাই অনেক এগিয়ে। সাহিত্যের মান খুব একটা আহামরি নয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই তো ঝড়ের গতিতে ছেয়ে যাচ্ছে বিশ্বময় অথচ আমাদের দেশে শিল্পঋদ্ধ প্রকাশনা সম্পন্ন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তাদের নিজেদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজস্ব গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। টোটাল সাহিত্যে খুব বেশি অবদান নেই অথচ আমাদের দেশেই ইসলামিক ফাউন্ডেশান গড়ে তোলছে তার শাখা-প্রশাখা থানায় থানায় আর আমাদের বাংলা একাডেমি বসে বসে আঙুল চুষছেন আর ভাবছেন সেই খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প, বেশ! আশ্চর্যই বটে, এহেন মনীষায় তারা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড!
এদেশে লেখার মূল্যায়ন আজও তৈরি হয়নি, আমাদেরই দীনতা প্রচুর কারণ নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যের লেখাটি আজও মূল্যায়ন করতে শিখেনি আমাদের লেখককুল, যেন সর্বদাই তাঁর ভেতরে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। আর এমন অনেক লেখক বন্ধুও রয়েছে যে, বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থটির পাশাপাশি আরও অনেক ঋদ্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর হাজার কপি গ্রন্থ কেনার জন্য টেলিফোন ব্যতীত পার্শ্ববর্তী গ্রন্থটির প্রশংসাও করতে জানেন না। শিক্ষামন্ত্রণালয়ও কম যান না, তাদের চোখে প্রকৃত মসিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতিগণ। যেখানে একটি পাখির কণ্ঠ বিশ্লেষণ করতে লেখক-কবি আপাদমস্তক নেমে পড়লেন পুটলাপুটলি নিয়ে তাঁর তো রাস্তায় বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা ওইসব প্রকাশক, কর্মকর্তারাই তো উঠে পড়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রীর বই হাজার হাজার কপি কেনার জন্য। এতগুলা দীনতা যে দেশে সে দেশে লেখক থাকার কি প্রয়োজন তা আমার জানা নেই।
শহর কলকাতার শহর যেন পাখিহীন হয়ে থাকে;
পাখিদের আমি সবচেয়ে ক্যাপিটাল মনে করি।
(এইসব পাখি: জীবনানন্দ দাশ)
কখন যে চাঁদ ওঠে আড়াআড়ি পাহাড়ের ফাঁকে:
যেন কার পাথুরে স্তনের কাছে ঝুলে আছে শাদা
চাঁদির লকেট। দূরে, অতিকায় পাহাড়চূড়োয়
অপার্থিব আলো জ্বলে শিবের মন্দিরে। আর ভাবি
আমার মতন বুঝি জেগে আছে সেখানেও কেউ
অসংসারী, শঙ্কাহীন, মিথ্যে কোনো মায়াবী আশায়।
(অরণ্যে কান্তির দিন: আল মাহমুদ)
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
সে চারিদিকে তাকায় না। শূন্য শস্যতে।
কৃষকটির আড়ালে একটি কণ্ঠস্বরের মর্মরতা।
একে একে ছায়াগুলো ভেঙে শিথিল হয়ে যায়
আর বসন্তের আকাশ-গহ্বরে ঢুকে পড়ে।
(ভ্রমণের সূত্র: টোমাস ট্রান্সটোমার)
বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ‘পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বলে কিছু নেই, যা আছে তা সাময়িক উত্তেজনামাত্র।’ কথাটি যথাযথ হৃদয়গ্রাহী মনে করি আর তাঁকে মেনে নিয়েই... কোন কবিতাকেই আসলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে লেখা হয়ে ওঠে না, হওয়া উচিতও নয়। একক স্বকীয়সত্ত্বায় মনেপ্রাণে শেষ্ঠত্ব ধারণ করে আমরা স্থিতধিত বিচরিত। নতুন শ্রেষ্ঠটিও যেকোন ফেলনামূল্যে আমাদের কাছে অবিবেচিত হচ্ছে। এতটাই গভীরতার ভুল আলেখ্য আমাদের গ্রাস করেছে, যেখানে কার্পণ্যতা বসবাস করছে ব্যাখ্যাহীন সীমাহীন! কবিতার ক্ষেত্রেও বরাবরই তাই হয়ে আসছে। অনেকটা হযবরল হয়ে ওঠেছে আমাদের নিত্যদিনের বৈষয়িক যাপিতজীবন। কেননা কালে কালে নতুন কবিতা লেখা হতে পারে, হতে পারে সময়ের শ্রেষ্ঠ এমন সঠিক সন্ধানীও হতে পারিনি আমরা তাছাড়া আমাদের পাঠকের অধ্যয়নের পৃথিবীটা দিনদিন যেন আরও ছোট হয়ে আসছে। ছোট হয়ে আসছে টেক্সটও, কর্পোরেট লাইফ আমাদের সেই অবস্থানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, জাপানের হাইকু যারা পাঠ করেছেন তারা হয়ত দেখেছেন স্পিড অব ন্যাশনালিটি সেখানে কবিতার আঙ্গিক কাঠামো কত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এবং এটাকেই তারা সূতর জাতীয় মৌলিক কবিতাবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করতে সম হয়েছেন। হাইকুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হাজার বছর পূর্বের সকল কবিতাই কি ধারণ করতে পেরেছি আমরা? এককালে তা কখনোই সম্ভব নয়, হাজারও কবিতা হয়তোবা সময়ের চাপে কবেই তার নিজস্ব ভূমিতে হারিয়ে গেছে। যা হয়তোবা আমরা পুনরায় খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনছি, দ্যোতিত করে তুলছি সাময়িক বোধ বিবেচনায়, আলোকবর্ষের সুনৃতে। সমকালিন কবিতা বলে আসলে কোন কিছুকেই দাবি করা যায় না। কারণ ওই কবিতার জন্ম বা প্রসব উত্তর যন্ত্রণা বেশ অনেক পূর্বেই শুরু হয় বা যার আবহটাই গোলকায়িত যন্ত্রণায় কবিকে অস্থির করে তোলে। একজন কবি তার যে কবিতা একটু আগেই প্রসব করলেন সেই আবহ বা চিন্তা হয়তোবা দীর্ঘসময় ধরে দোলা খেতে খেতে বাতাসের সাথে ঝুলছিল। হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে টুপ করে জলে পড়লো কেবল! আর হঠাৎ করেই কেবল আপনি আবিস্কার করলেন, অরের জালে মৎস্যসন্তরণের ন্যায় বৃত্ত থেকে ব্যাপৃত হচ্ছে আপনার সুলেখাসমগ্র, ঠিক যেমনটি আপনি চেয়েছিলেন। যে পাঠক কবিতায় ঢুকতে চাচ্ছেন না আমি তাকে জোর করে কবিতায় ঢুকাতে পারবো না, সেটা আমার কাজও নয়। কারণ এইশ্রেণিটা বরাবরই ধূসর-বিমুখ তার আপন বিবরেই। আর যাই হোক তার কাছে চিরকালই দস্যি কবিতার প্রযোজনা অর্থাৎ বিষয়টি তার মধ্যে কখনোই সঞ্চারণ সৃষ্টিতে সম নয়। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার একবার তাঁর নিজের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘খোলা জানালা’য় কবিতা বিষয়ক এক গদ্যে কবিতা লেখার বিষয়ে বেশ কতগুলো কলা-কানুন দেখালেন এবং তিনি দাবি করলেন উক্ত নিয়ম বহির্ভূত কোন লেখা কবিতা হয়ে ওঠবে না। আমি ঠিক জানি না কাহ্নুপা, বিহারীলাল চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বিশাল মহীরুহের মতো এইসব কবিকুল তাঁর উক্ত নিয়ম মেনেই সেসময় কবিতা লিখতেন কিনা? আজকের তরুণ কবিই বা সে নিয়ম কতটুকু ভাবার অবকাশ পান তাঁর সুদূরপ্রসারী জীবন ভাবনার মাঝে? একজন কবি-লেখক যে সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হন তারও একটা সুবিশাল ভূমিকা থাকে। অবশ্য তিনি এরকম মনে করেন যে, একজন কবির যেখানে ব্যর্থতা রয়েছে মূল কাব্যিক কার্যসিদ্ধিতে অন্য আরেকজন কবি বা পাঠকের উচিৎ সেখান থেকেই শুরু করা। তাহলেই কেবল এর সমাধান সম্ভব।
উজানে ভেসেছি গংগা গা ভরতি মাদুলি কবজ কড়ি হাত-পা জড়িয়ে আছে শরীর জড়িয়ে আছে শীতল শরীর আহা মন আমার উথালপাথাল কত খালবিল নদীনদ পেরিয়ে এলাম তোকে বোঝাবো কেমনে গংগা কী যে সুখে ভেসে যাই ডানে বাঁয়ে হা-পিত্যেস ছড়ানো সংসারে কত ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন দেয় উলুধ্বনি না'য়ে না'য়ে আবাল্য সখীরা ডাকে না যাও রে ভরা গাঙে ডিঙা ডুবে ডিঙা ভাসে দেবর ননদ জা সতীন শাশুড়ি চলে পাশে ভেসে জলটানে চলেছি
(মনসা: ব্রাত্য রাইসু)
ইতিহাস খুলে পড়ছো তোমার পূর্ব পুরুষদের
প্রথম উড়াল আর শেয়ালতত্ত্বের কথা।
একদিন পৃথিবী ছিল যাদের মগজের দাস
সিংহ আর মাংসের সমন্বয়কারী
সেইসব প্রজাতি লুপ্ত আজ।
(শেয়াল বিলুপ্তির পর: মিজান মল্লিক)
পৃথিবীর ঘাস, মাটি, মানুষ, পশু ও পাখি সবার জীবনী লেখা হলে
আমার একার আর আলাদা জীবনী লেখা না হলেও চলে যেত বেশ।
আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেত।
তার মানে মানুষের, বস্তুদের, প্রাণিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক
অসংখ্য জীবন নয়, সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন মোটে; ফলে
আমি যে আলেখ্য আঁকি তা বিশ্বের সকলের যৌথ দৃষ্টি এইসব ছবি।
(এ জীবন: বিনয় মজুমদার)
কবিতা পড়া জরুরি বা জরুরি নয় কিনা তারচেয়েও জরুরি, কবিতা পাঠকমাত্রই শিক্ষিত, ঋদ্ধ, মার্জিত পাঠক সর্বাগ্রে এ ধারণাটিও যে ঠিক নয় এটি অন্তত পরিস্কার জেনে ফেলা। অনেকের কাছেই এর গভীরতা পরিস্কার নয়, পরিস্কার হয়েও ওঠে না। গুলিবিদ্ধ একজন মানুষের চেয়ে কবিতাবিদ্ধ একজন মানুষের যন্ত্রণা বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে যথার্থ কবিতাতেই বিদ্ধ হলো কিনা সেটি ভাববার বিষয়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিবৃতি সাজিয়ে সে পাঠককে কোনটা কবিতা কোনটা অকবিতা তা বুঝাতে গিয়ে তাঁকে খাটো করতে চাই না। বরং একজন শিতি পাঠক তাঁর কবিতা ঠিকই হাজার কবিতার ভেতর থেকে আবিষ্কার করে নেয় বলে জানি। এটা আসলে এক ধরনের কবিতার সংবেদও বলা যায়। কবিতায় উদ্ভাসিত এই সংবেদ মূলত আকুল করে তোলে কবিকে, যিনি পাঠক তার উপর সংবেদন জারিত হয়, প্রিয় কবিতাটি পড়ামাত্রই পাঠক সঞ্চারিত হচ্ছেন অনেকটা ঐশ্বরিক মহিমায়। একেবারে সন্নিকটে না হলেও যোজন দূরে কোথাও তার প্রভাব পড়ে থাকে। আর যতসব নিয়ম-নির্মিতি তা শুধু নিজের ভালো লাগা বা না লাগার ব্যাপারমাত্র। তাছাড়া যে পাঠক সাহিত্যের টোটালিটি থেকে একটিমাত্র কবিতাকেই বেছে নিলেন, সে পাঠকমাত্রই বোকা এ জ্ঞান সম্পূর্ণ শুদ্ধ শব্দচর্চার দাবি রাখে না, অন্তত আমি তা যথার্থ অর্থেই মনে করি। কেননা ওই একটি কবিতাই তো মহিমান্বিত করে তুলছে তার অমিয় ভুবন। কবিতা পড়ার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, অন্তর্লোকে প্রবেশের পূর্বে নির্দেশিকাটি দেখুন। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন পাঠেরও নির্দেশিকা আছে ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’। এর একটা সফল কার্যকরিতা আছে, যথার্থ নিবেদনে মধুর আবেগে পাঠে মনযোগি হওয়ার গুরুত্ব তৈরি হয়। ফলে স্বয়ং পাঠকই নয় সঞ্চারিত হতে থাকেন তার পরের শ্রোতাও। কবিতা আখ্যানের কোনো কোনো অধ্যায়ে এরকম পূণ্যার্থী ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। যদিও সামগ্রিক কবিতাক্ষেত্রে এরকম পূণ্যার্থীর কোনো ভূমিকা পাওয়া যাবে, সহজ অর্থে আমি তা প্রথমেই বিশ্বাস করি না। বরং আজকের এই কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগে একজন পাঠক তাঁর প্রিয় লেখাগুলো বেছে নেয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে হাতের কাছে পাচ্ছেন খুব সহজেই। সে পাঠককে কবিতা বোঝাতে যাওয়া তো আরও বোকামি। আমার সাত্ত্বিক অবস্থান হলো এই সত্ত্ত্বাটির মৌলিক ইন্দ্রিয়টি বাজিয়ে দেয়া, যে বৃত্ত থেকে বা কেন্দ্রবিন্দু থেকেই উদ্ভাসিত হয়ে তার আগমন হোক না কেন। মার্জিত একটি লক্ষেই তো প্রযোজিত হচ্ছেন তিনি কিংবা প্রযোজনার জন্য সঞ্চারিত হচ্ছেন। যেমন ধরুন, দিবস শুরুতে আপনার মন উতলা হয়েছে, ফরিদ কবিরের ‘সুরসন্ধানী’ কবিতাটি পাঠ করলেন যার কোনো কোনো পঙক্তি এরকম ‘সঙ্গীত এতটা পারে, শুষে নেয় গমের যন্ত্রণা / যে-কারণে ঘন হয় গাছের নিঃশ্বাস / রাতের পাতায় জমে ঘাম / সুরের সন্ধানে তবু লোকে করে / নদীর বন্দনা / আমি কিংবা মিতা হক উপলমাত্র’। সেইসাথে আপনার দিবসটিই সঙ্গীতময় হয়ে গেলো, আপনি যতই বিচরিত হলেন আপনার সমগ্র সত্ত্বায় সঙ্গীতই সেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এরকম সঙ্গীতময়তার কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন পড়ে না নিশ্চয়ই। আসলে ওইদিন আপনার সঞ্চারণ পৃথিবীর এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে কি!
বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু আর মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন / সদলবলে গাইবে দুর্ভিরে স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস
ফিরে তুমি যাবে বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও, / কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?
(মেঘদূত: সমর সেন)
আমাদের হাওয়া গিয়ে তোমাদের জামপাতা মৃদুভাবে নাড়ে,
ফলে কি জামের বন আত্মীয়প্রবণ হয়ে ওঠে!
আমরা কোকিল ছাড়ি তোমাদের কাকের গৃহে ডিম পেড়ে আসে,
তোমাদের পীছানাগুলি এপাড়ের ডালে বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করে।
সীমান্তরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পিঁপিলিকা শ্রেণী / খাদ্য বহন করে নিয়ে আসে এপাড়ের থানায় থানায়
একই জলে স্নান করে দুই ভূগোলের দুটি লোক,
বিদেশ এতটা নিকটে থাকে। এতখানি শিলাময়!
(সীমান্ত: কামরুজ্জামান কামু)
সে বাড়ি ফেরে। কথা বলে না কোন।
নিশ্চিত খারাপ কিছু ঘটেছে। / সে জামাজুতো নিয়েই শুয়ে পড়ে।
মাথা গুঁজে দেয় কম্বলের নিচে।
পা’দুটো কুঁকড়ে নেয়। / বয়স তার চল্লিশ, যদিও এ মুহূর্তে নয়।
এখন তার অবস্থান মাতৃজরায়ুর
সপ্তম আবরণের এলাকার সুরতি অন্ধকারে।
কাল সে মহাকাশ নিয়ে বক্তৃতা দেবে।
(প্রত্যাবর্তন: ভিস্লাভা শিম্বোর্স্কা)
কবিতার পথ বহুদূর নয় বটে তবে এতটা পথ যে, আর পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি আপনার মৌলিক অবস্থান থেকে অনেক দূর চলে এসেছেন কবিতার দিকে। লক্ষ করে দেখুন, কবিতা যতদূর এগিয়েছে ততটুকুতেই সে সংস্কৃতি দাবি করে বা আমরা যতটুকুই সংস্কৃতির আসনে বসিয়েছি। অথবা ধরতে পারেন কবিতা একটি আলাদা সংস্কৃতি বলেই তাকে আপনি সবিতা বলে জানেননি। কোথাও কোথাও জেগে ওঠছে ধর্মীয় মূল্যবোধও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হতো, কাজী নজরুল ইসলামের হামদ্-নাথ্ এখনো মুসলিম ইজমের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় পবিত্রতা বা শুভ ভাবনায় পাঠ হয়ে থাকে, বলা হয়ে থাকে বাইবেলে অজস্র কবিতার উপাদান ছড়ানো-ছিটানো কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এসবই জাগিয়ে তুলেছে শৃংখলিত এক সূতর ধর্মীয় মূল্যবোধ। আর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ তো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক মহাকাব্যিক ইস্যু। গ্রামাঞ্চলে বাউলদের পালাগানও অনেকটা এরকমই সেখানে ভেদজ্ঞান, তাত্ত্বিকতা তো থাকেই যা হাজার দর্শক দলবেধে গভীর মনযোগে অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকে। এ সবই আসলে একটি সত্ত্বার উপর মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, কবিতা মাধ্যমেও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। একসময় হয়ত সে একত্ববাদ থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেক কবিতাই তাঁর নিজস্ব ভূ-মণ্ডলে এক ভিন্ন ভিন্ন ইমেজের জন্ম দেবে। সেটা খুবই স্বাভাবিক, তাছাড়া মানব সভ্যতার ভাবের জায়গাটি অন্তর্লোকেই আর সেখান থেকেই তো কবিতা বেজে ওঠছে খুব শক্তিশালী হয়ে। হাজার বছরের কবিতার ভাঙা-গড়ায় আমাদের যে চৈতন্য ঘটে তা তিরিশের জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে। আমি বলবো এঁরা ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছেন বাংলা কবিতায়, একেবারে কবিতা মাধ্যমটিকে উজ্জ্বল করেই। অন্তত ১০০ বছরের বাংলা কবিতার কথাই ধরুন, আধুনিক কবিতার সাথে বাঙালি জাতির পরিচয়টা যেভাবে হয়েছে। কবিতায় এসেছে সমকালিনতা, রাজনীতি, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের ধারণা, ঔপনিবেশিক সমন্বয়। উবঢ়ঃয ঙভ খরঃবৎধঃঁৎব মননবৃত্তেই আপনি দুমড়ে-মুচড়ে নতুন করে নির্মিত হয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন প্রায় এক শতাব্দীর কাব্যিক ফের। তার পরবর্তী আজকেরও যে কবিতা, তাতো ভিন্ন প্যাটার্নের অবশ্যই। একেবারে সন্নিকট চিত্রটিও প্রত্য করে দেখুন, মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যেই আমরা তার ফলাফল গ্রহণ করতে যাচ্ছি; এক দশক সময় শুধুমাত্র আপনার নির্ণায়ক বিচার বিশ্লেষণের সময়। কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়, একবার পাঠ করে রেখে দিলেই চোখের সামনে স্পষ্টভাবে কবিতার উজ্জ্বল চিত্রটি প্রত্য করা সম্ভব নয়। বারবার পাঠে কবিতা স্বচ্ছ থেকে আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। চর্চার এ জায়গাটিতে আমরা বরাবরই অলস, আপন বিবরের উপস্থাপনা থেকে এর উত্তরণ অধিক জরুরি আর তখনই কবিতার ফলাফল একজন পাঠকের নেয়া সম্ভব। কেননা আজকের কোন কোন কবিতার বিষয় তার শব্দ প্রয়োগ বিন্যাস অবশ্যই দীর্ঘদিনের উপকথার ফসল। সৃষ্টি শুরুর পর থেকে যখন মানব সভ্যতার প্রসার হলো বোধ করি কবিতা নামক সঞ্চারণটি সেই তখন থেকেই আপন বিবরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে ভাগ হয়ে সমর্পিত হয়ে আসছিলো। মাটি, পাহাড়, বাতাস, আলো, রোদ্দুর, নদী, দূরের নত্র, সভ্যতার যত যত এলিমেন্ট, অচেনা জগত এগুলো যত চর্বিতচর্বণ হয়েই থাকুক না কেন আজকে তা আকাক্সার, আজকে তা পাঠকের... এই গূঢ় সত্য বিষয়টি যতণ না কোন পাঠক গভীর মহিমায় উপলব্ধি করতে পারছেন ততদিন আমাদের অপো করতে হবে খেয়াঘাটের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া মাথায় নিয়েই।
দাঁড়াও রুপালি নদী, রজত জ্যোৎস্নার শিহরণ
আমি সংগে যাবো!
সামান্য হাতের কাজ বাকি আছে, সেরে নিয়ে দ্রুত
দরোজা দু’হাট খুলে মাঠে গিয়ে নিশ্চয় দাঁড়াবো
নিরুদ্দেশ পথের বাতাসে...
রাত্রিভর হেঁটে যাবো বালুচরে। শ্মশানে নিঃশব্দ কাশবন,
ঘুমন্ত গ্রামের ছায়া রেখে যাবো পাশে...
(যাবো: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
নদীর জলে ওড়ে ভষ্ম, ওড়ে মৎস্য, কোথায় যাবি তুই
বাইসনেরা ধুলোয় লুটায় / পক্ষিরা সব পক্ষ গুটায়
দিসনে ঠোকর, পুড়বে কেবল পুড়বে রে চঞ্চুই।
(সার্কারামা: মাসুদ খান)
তাকালেই ভোর হয়, তাকালেই সন্ধ্যা
যেনবা আঙুলব্যাপী সন্তরণশীল ভোর, সন্ধ্যা
আমার ইঙ্গিতমতো পাল্টায় পোশাক
পোশাকেই সমস্ত রহস্য / ধর্মগ্রন্থে এসবের উল্লেখ ছিল না।
পাতায় পাতায় আমি এই কথা প্রচার করেছি
নগ্ন-নারী নয়, আনারসে আছে প্রকৃত রহস্য
খোসা ছাড়ালেই আনারসমাত্র খাদ্য হয়ে ওঠে
মেঘাচ্ছন্ন রমণীরা সেই খাদ্য পরিবেশন করে।
(রহস্য: ফরিদ কবির)
নদী যেরকম যায় সেরকম পাখি যেরকম যায় সেরকম
চলে যেতে সমূহ ইচ্ছুক আমি সে রকমই চলে যেতে চাই,
হাতের পালকগুলো খসে গেলে ক্ষতি নেই,
চোখ একটা অবাস্তব জলাশয় কিছু যায় বা আসে না,
এবং শরীর একটা অন্ধকার মৃত্যুর কবর হলে ক্ষতি নেই।
মানুষের কাছ থেকে মানুষের মতো আমি চলে যেতে চাই।
(প্রস্থান প্রসঙ্গ: আবুল হাসান)
কবিতায় আসছে নতুন টেক্সট, থীম, ধারণা, প্রচার, প্রয়াস। আসছেন নতুন কবি, বদলাচ্ছে কবিতার মানে, উপমিতি, অনুষঙ্গ আপনার সমস্ত ধারণা যা কিছু আছে, আমূল সব পাল্টে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠছে নব নব কবিতার প্রস্তরায়ণ। এই এক দশক পূর্বেও আমরা কবিতাকে যেভাবে বুঝতে শিখেছি আজ আর তা ভাববার সুযোগ নেই। তৈরি হয়েছে যোজন ব্যবধান, চিন্তার আর অর্থগত মানে কবিতার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যিনি শুধু একবেলা খাবারের কথা ভাবেন তার সাথে কবিতার কিছুটা তফাত তো রয়েছেই কেননা কবিতা খাবারের বা খেয়ে জীবনধারণের কথাই শুধু চিন্তা করে না করে আত্মসংযমেরও। ফলে কবিতার ঞড়ঃধষ টহরঃ-এর একটি হচ্ছে সংযম অর্থাৎ স্বীয় সত্ত্বাটিকে অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে অবদমিত করা। এক্ষেত্রে সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন আর একজন কবির স্বীয় অবদমন ক্রিয়াটির বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সমাজবদ্ধ মানুষের অবদমন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আইডল নির্মাণের বিষয় নিহিত থাকে আর কবির আত্ম-অবদমনের মধ্যে থাকে কবিতার সুন্দর নির্মিতি বা শুধুমাত্র কাব্যিক আইডল। ফলে সাধক কবির এই কাজটি যে খুব সহজ নয় এইটা খুব দ্রুত জেনে ফেলাই হলো একজন বুদ্ধিমান পাঠকের কাজ। কবি কল্পলোকে তাঁর জীবনকে উপো করেন চিন্তার প্রখরতায়। এখানে কবির সাধক সত্ত্বাটিও আপনার কাছে সুবিবেচ্চ না হলে আপনার সকল কৌতূহল বৃথা গেল। একটি কবিতাই যখন সকল মসৃণতা নিয়ে উপস্থিত হয় আপনার নিকট ইন্দ্রিয়ে বা সংসার ত্যাগী হয়েও যখন তাঁর আবেগ দিয়ে সংসার ভাবনা পাঠককে বুঝাতে চান এইরূপ তাঁর ভালোবাসা কিংবা সহজ অর্থে প্রণয়েরর হেতু। তখন তাকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পে সম্ভব নয়। কেননা তাঁর ভাবনা আমাকেও মোহগ্রস্থ করে গূঢ় এক ব্যাপৃত ইন্দ্রজালে। একটা সময়কে কেন্দ্র করেই একদল কবির সম্মিলিত ভাষাটি স্পষ্ট হয়। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এটা স্পষ্ট বুঝে ফেলা খুবই সহজ। এ সময়ের কবি-পাঠকরা সেটা খুব সহজেই আয়ত্ত করছেন। আমাদের পূর্বে যারা ছিলেন তাদেরকেও চিহ্নিত করা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। আমাদের দেশে আশির কবি-লেখকদের মধ্য থেকে সেটি খুব জোরালো হয়ে উঠেছে। একদল কবি বিশেষ করে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, মাতিয়ার রাফায়েল, জহির হাসান, সাখাওয়াত টিপু, বদরে মুনীর এঁরা চর্যাপদ থেকে শুরু করে কালিদাস, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, মাইকেল, বিহারীলালকেও আদ্যন্ত নখরে গেঁথেছেন। কারো কারো কবিতায় এসেছে ভিন্নমাত্রিক ভাষার দ্যোতনাও। এঁদের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষার উজ্জ্বল কবি ফরিদ কবির। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর অরবৃত্ত মুক্তকের দৃঢ় ছন্দোবদ্ধতায় অনেকটা চিহ্নিত করেছেন, বাংলা কবিতা যে-রকমটা পাঠকের কবিতা হয়ে উঠতে পারে। সঞ্চারণ থেকে পাঠক ফিরে যেতে পারেন অযাচিত কোনো কবিতায় এমনটি হবার নয়। অনেকটা পড়ে যাওয়া পাঠককে তুলে এনে কবিতার মূল স্থানাঙ্কবিন্দুতে স্থিত করা। শব্দের সমীক্ষা, আভিজাত্য, বিদগ্ধতা আর অর্থদ্যোতকের নির্দেশনায় পাঠকের শব্দজট খুলে যাচ্ছে মুহূর্তেই। প্রচল কবিতার ভাবাদর্শ বর্জন করে সেটা তিনি ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে সম হয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটি দাঁড়ায় অন্য জায়গায়, যিনি সুহৃদচিত্তেই কবিতার দিকে ধাবিত হলেন তাকে অব্যাখ্যাত বিবৃতির ছাঁচে ফেলে দ্বিধাদ্বৈতের চর্চা করা আমাদের জনাধিক্যের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা। একজনের সংস্কৃতি মনস্কতা অন্যজনের বঞ্চিত অধিকার। অথচ এরকম জীবনবিমুখ কর্মকাণ্ড চিরকালই শিল্পের বিপরীতে অবস্থান নেয়। শিল্পপ্রাণ ব্যক্তিমাত্রই এই বিষয়টির প্রতি সচেতন হওয়া জরুরি যার অধিক অভাব আমাদের সাহিত্য পাঠক শ্রেণির মধ্যে। ফলে কবিতা ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে অব্যাখ্যাত প্রমাণ বঞ্চনায় এরকম ট্রাজেডি থেকে আমাদের এখনি বেরিয়ে পড়া জরুরি।
আমার মায়ের নাম গ্রাম। / পিতা নাকি দূরের শহর!
নদী ও হাওড় দুটি বোন, / এই বিল জলা সহোদর।
আমি ভালোবাসি সমুদ্র দুহিতারে
দিগন্তের হাওয়া এসে শোনায় সুদূরতা, / মেঘের ঠিকানা, ঝড়ের বার্তাদি।
পিতা ভুলে গেছে আমাদের, / চুপিচুপি কাঁদে মা আমার।
আমি তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জেলে / ফেঁসে গেছি জলচক্রে, জালে।
ফেঁসে তো গেছি কংকালে, মাংস থেকে মাংসে।
(কংকালে মাংসে: মাহবুব কবির)
ঘরে প্রজাবর্গের মতো বাবা। উঠানে মটরশুঁটির মতো মা।
তৃণ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাঙের শরগুলো ভয়ঙ্কর ধারালো।
বাবা একটা হারেমের ভিতরে থাকে। আমার অনেকগুলো মা।
আমার মা ভিজে পাখির যন্ত্রণার মতো। আমার মা কলাপাতার মতো দুঃখি।
(আমার ডাকনাম: রিফাত চৌধুরী)
সামান্য কিশোরী তুমি! ঘুরে ঘুরে / দাদী’মা হয়েছ!
কি তবে গ্রহণীয় আজ / গৃহে গৃহে?
অসীমায় সীমাবদ্ধ যাহা... ম্যাজিক্যাল
ও ভাই স্পাইরাল / তবে কী না
আমার দাদী’মা কখনো কিশোরী ছিল না
যেন আমি কোনওদিন কোথাও যাইনি...
(সংশয়: টোকন ঠাকুর)
বসন্ত বেড়াতে যায়...
কি এক নিঃসঙ্গ কুয়াশায় ভরে যায় দেহ,
সূর্য আমি তাকাতে পারি না।
আমার ডানায় পিঁপড়েরা ঘুমিয়ে আছে,
চারপাশে জল, মালিরা ফিরেছে ঘরে
শুধু এক সর্বনাশা খেয়েছে ফসল।
(বাগান: সরোজ মোস্তফা)
কবিতার পথ বড় দহনের। দহনে দহনে কবিতা যেন আরও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। যিনি এ পথে আসেন, আসলে প্রথমে তিনি বুঝতে পারেন না এটা আসলেই একটা দহন প্রক্রিয়া। ব্যক্তি কবিটির কথা উহ্য রেখে দিলেও দহন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত কবিতাটিই যেন কারো কারো কাছে কোটরাগত প্রাণ, যা তিনি বের করে নিয়ে নেন। কবিঅর্থে চিহ্নিত সত্ত্বাটি আসলে মোটেও পশ্চাতপ্রবণ নয় বরং জ্বলতে জ্বলতে তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কে বা আপন বিবরে অবকাশ যাপনে গিয়ে খানিক জিরিয়ে নেন। ওইখানে কবি আসলে সমূহ উজ্জ্বল এক প্রাণ, আসলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কিভাবে তিনি জ্বালানোর প্রক্রিয়াটা শুরু করবেন। মূল কথাটা হচ্ছে কবি জ্বলতে আসেন, জ্বালাতে আসেন; দিনে দিনে জ্বালানোটাই যেন সংসার পেতে বসে কারও মনে। বোধকরি এইরূপ প্রণোদনাও সকল কাব্যিক নিবেদন নয়। তবে কি, কী কবিতা আর কী কবিতা নয় এরূপ বোধ বিবেচনায় আমরা কিছু উদাহরণকেও বেছে নিতে পারি নিজেকে শানিয়ে নেয়ার জন্যে। জানি সেদিনই তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ‘কবিরা শিশু। কবির মনটাই সরল; বুদ্ধিটা ঋষির। কবি তপস্যা করেন, সৃজন করেন, কৃষকের মতো কর্ষণ করেন; ভাষা দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন রূপের ফসল।’ তো ফসলের এই ফলেল শুভাচার আমরা কিভাবে বুঝবো? নিশ্চয়ই বুদ্ধির ব্যবহারটা এখানে সাবলীল হওয়া চাই। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব প্রয়োজন পড়েছিলো আর আমাদের দেশে শিল্পবিপ্লব অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে গেছে সেটা জাতির মননের ভেতর দিয়েই। শিল্প বিষয়টি আমাদের দেশের মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছেন। যেকোন কালচারাল ইভেন্টগুলির উপর নজর দিয়ে দেখতে পারেন। উন্নত জাতির প্রশ্নে, তারা এখন বুঝতে শিখেছেন শিল্পিত উপস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। যে জাতির উপস্থাপনা যত বেশি শিল্পিত সে জাতিই সারাবিশ্বে পুচ্চটি তার উচ্চে তুলে ধরেছে। বরাবরই কবিতা এখানে সেরা মাধ্যম, তীক্ষ্ন এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবিতার পাঠক খুব সহজেই এ বিষয়টি বুঝে ফেলতে পারেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একবাক্যে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন ‘কবিতা পাঠককে শিক্ষিত হতে হয়, কবি ভাষাটি জানতে হয়।’
কবিতাকে কোন সংজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। স্বয়ংসম্পন্ন শব্দের দ্যোতনায় আইডেন্টিফাইড কবিতা আত্মারই খোরাক অবশেষে। দিবসের সকল কান্তি-শ্রান্তির পর এলানো দোলানো আপনার মন খুব সুন্দর একটি দৃশ্য প্রযোজনায় রত। আপনিও কল্পনা করে দেখুন না জনাধিক্য নির্বাসন দিয়ে একটি শিশু সুদূর নির্জনে পাহাড়ের চূড়ায় বসে তপস্যারত। সুন্দরের এই উপাসক সত্ত্বাটিই আসলে অধিশ্বর, কবিতার। স্থানাঙ্কবিন্দু নির্দেশনায় ধরে নিতে পারেন সেখান থেকেই উদ্ভাসিত হচ্ছে কবিতাবিবর। শিশুর কান্নায় আপনি আন্দোলিত হচ্ছেন, উদ্বেলিত হচ্ছেন কিন্তু উপাসক শিশুর ভূমিকায় আপনি কি ভেঙে পড়েছেন? সে হয়ত আগেই উপলব্ধি করেছিলো বেথেলহেম ঠিকই একদিন ব্রোথেলে পরিণত হয়ে যাবে। কবিতাটি আসলে এখানেই, প্রতিটি মানুষ যা দেখে, যা শেখে, যা লেখে বা তাঁর অতীতের কয়েকটি দিনের ভাবনাও কবিতা। বলতে চাচ্ছি কবিতা প্রতিটি মানুষের দর্শন, বিশ্বাস। লিখতে গেলে পরিমাপের দিক থেকে যার ওজন হবে অজস্র ভাগের একবিন্দু মাত্র। ওই একবিন্দুতেই আমার স্বনির্ভর পক্ষপাত কেননা ওখানেই কবিতা রয়েছে আর যেখানে কবিতা রয়েছে সেখানে আমার বিচরণের সায় ব্যাক্ত করি।
এই যে কবিতার হাঁটাহাঁটি মানতে পারি কি সব শিল্পের বিপরীতে, আর ভাবি শিল্পটা কী, সে কি বলো জটিল গণিত কোনো, প্রাইভেট স্যার রেখে শিখে-টিখে নেবো, পথেদের কোন বাঁকে বহাবো তবে এই শব্দমিছিল, যেই দিকে মনোবল ভারী করে তোলে, জনতাই ঠিক যদি তবে আর কবিতার খোঁজে ফিরে লাভ নেই, এইমতো ভাবি আমি, এইমতো ভেবে ভেবে লিখে ফেলি যতোসব অপকবিতারে।
(বাতিঘর: মুজিব মেহদী)
প্রতিটি সূর্যাস্ত কেশবতী হলে ভালো লাগে।
প্রতিটি দুপুর শস্যমাতা হলে ভালো লাগে।
উঠোনের ধানে নূপুরের কল্লোল নেমে এলে,
কোজাগরী মুখে ছড়ায় গাঁয়ের ঝিলিক;
অরূপিত গানে অধিবাস কেটে গেলে
পৃথিবীর মাঠ যেন বহু শিলাময়, আরও রূপময়।
(আহ্নিক: রাজীব আর্জুনি)
পাটাতনে শুয়ে আছে কাঠ
কাঠ চেরাইয়ের শব্দ, তোমাদের বাগানবাড়ি।
আমার স্বপ্নের ভেতর লোহার করাত দাঁত / কাঠের শরীর ফালিফালি।
তুমি ঘরের ভেতর গোসল করো, পাশ ফিরে শোও
আমার ঘুমের ভেতর কাঠের গুঁড়া, স্বপ্নের বিষয়।
(কাঠ চেরাইয়ের শব্দ: শোয়াইব জিবরান)
আমি আমার পাঁচটি আঙুলে
পাঁচ রাজ্যের প্রভুত্ব / রেখেছিলাম
হায় ইশ্বর / এখন ছেঁড়া কামিজ মেরামত করতে
আমার সকাল / সন্ধ্যার দিকে পা বাড়ায়।
(দর্জি: অমর শঙ্কর দত্ত)
কবি ভাবছেন কবিতা তাঁর অন্তর্গত ঘোরের বয়ার। ভাবনাটি ঠিক। জৈবনিক এই মহৎ সন্তরণ ক্রিয়াটি সমন্বিত এক বেষ্টনির ভেতরে থেকে তাঁকে লিখতেই হচ্ছে। যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে নিরেট তাঁর দাহিকাবিবর। যিনি কবিতা লিখেন তিনি শব্দ কুড়াতে কুড়াতে এক সময় কাব্যবন্ধনীর ভেতরে শরীরটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর জগত রচনা করেন। মৃত্যু ও ক্ষীণ বিষক্রিয়ার সেই পোকাটির মতো যে তার সমাধিমহল নিজেই তৈরি করে অনন্তযাত্রাকে স্বীকার করে নেয়। সবুজ কোনো মাঠে ঘাসেদের মাড়িয়ে যখন যেতে থাকেন দিগন্তের দিকে তখনও তিনি সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই, যখন তিনি কোনো জনবহুল রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে রাস্তা পার হন বা যখন তিনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন কিংবা কোনো নির্জন বাগানে একটি প্রজাপতির ডানার শব্দ শুনতে মগ্ন থাকেন তখনও তিনি তাঁর সেই কাব্যবন্ধনীর মধ্যেই অবস্থান করেন অর্থাৎ যিনি কবিতা লিখেন তাঁর মনে সব সময় দোল খেতে থাকে ‘কবি’ নামক শুদ্ধ, সৎ, অতি নির্ভীক শব্দটি যার শুধুমাত্র ভাবনা হলো কবিতা বা তাঁর এই ঘোরের বয়ার, যার ভাবনা হলো সদ্য গর্ভজাত কবিতাটি কোন্ শব্দের পরিচর্যায় তিনি তাঁর গর্ভে লালন করে আলোর মুখ দেখাবেন। এহেন ভাবনায় জর্জরিত হতে হতে তিনি সুন্দর করেন তাঁর সন্তানকে। তাঁর চোখে দেখা পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরকে তিনি তুলে আনেন কবিতায়। কবিতা তাই বহুগুণের অধিকারী- তার প্রথম গুণই হলো স্বয়ং কাব্যিক অধিশ্বর কবি এবং ক্রমান্বয়ে তারপরের গুণই হলো কবিতা কবিতা। প্রকৃতপে কবি ও কবিতাই হলো পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থনার বিষয় যেখানে কোনো বৈষয়িক ভাবনা নেই। আছে শুধু নিজস্ব ভূ-মণ্ডলকে দেখার বাসনা, জানার বাসনা, জানাবার প্রচণ্ড তাগিদ। এতসব জানার পরও সিরিয়াস পাঠকের কাছে কবিতা পুনরায় দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। আমরা জেনেছি কবিতার প্রথম পঙক্তি স্বর্গ থেকেই কবির উপর সঞ্চারিত হয় বাদবাকি কবির ঘোরেরই অন্তর্বয়ান। কিন্তু আলফ্রেড খোকন তাঁর এক কবিতায় জানাচ্ছেন কোনো এক বিশেষ কারণে তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরকম পঙক্তি উৎসারণের ফলে পাঠক একটু দ্বন্দেই পড়তে পারেন। প্রথমত তিনি কবিতা লিখে সেই লেখার সূত্রাসূত্র নির্দেশনায় আস্থা রাখেননি, দ্বিতীয়ত অধ্মাত্য একটি ইন্দ্রজালে পাঠককে এখানে অযথাই জটিল করে তোলেন তিনি। সমস্ত ঘোরের বয়ার ভেঙে দিয়ে পাঠক এখানে স্থূল কোনো আইডিয়ায় আটকে যেতে পারেন। কবিতা কি তবে স্বয়ং কবির ক্রিয়েটিভিটি ছাড়াই রচিত হবার মতো কোনো বিষয়? তাহলে তাঁর এই দীর্ঘ দীর্ঘ কাব্যিক উপাসনার ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে? স্বয়ং অতীশ দীপঙ্কর কী সহস্র বর্ষের থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে তাঁর জমানো শব্দগুলো কবির ভেতর থেকে বের করে সাজিয়ে, নিবেদনের জন্য নিয়ে গেলেন? মোটেও তা নয়, সেক্রিফাইস যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ওখান থেকেই তো লিখিত হতে পারতো! পাঠকের আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনাটি কিন্তু এখানে ঘটে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আইডিয়া আবিষ্করণে পাঠকের বিশেষ ব্যবচ্ছেদ-জ্ঞান জরুরি। সাধক পাঠকের অধিক নিমগ্নতার কোনো বিকল্প থাকছে না এখানে। সমকালিন প্রেক্ষাপটে বলতে পারি এরকম পাঠমনস্কতার অভাব দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। এরূপ পরিস্থিতি পরবর্তী সময়কে ব্যাপক দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেভাবেই হোক এই অবস্থাটি আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
তুমি কালো নদী থেকে উঠে এসে জাপটে ধরো আমাকে
সূর্য বেরিয়ে পড়ে মেঘ থেকে, কতোকাল সে আমার / বন্ধু ছিল না
ধুলোর ভেতর দিয়ে জুতোহীন হেঁটে গেছি পাতার-বাকলে / গুপ্তাঙ্গ ঢেকে
দুপুর, সকাল থেকে; সন্ধ্যা, বিকেল থেকে; / রাত্রি বসেছে বেঁকে ভোরে
আমি আলো ঢেলেছিলাম, আলো।
(ভারতবর্ষ: চঞ্চল আশরাফ)
কোন না কোন সমুদ্রের জন্য
আমাদের নারীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে / ভূতপূর্ব দস্যুর সত্তায়।
হাওয়ার ধারালো হ্রেষার চেয়ে তীক্ষ্ন
লবণাক্ত ফেনার প্রসার এসে যার
রক্তকে ফেনিয়ে তোলে, ঢেকে দেয়
প্রজ্ঞাপ্রণালীর হিমায়িত সিন্ধুর কিনারা। / তবুও সমুদ্র দেখিনি আমরা।
(জলদস্যু: শান্তনু চৌধুরী)
কায় ভাসিলো পথের ধুলোয়
আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন
কে গো ভাসালে বলো / উড়ো মন্তরের ছায়া ঘোরের বয়ার
রহস্য বিভঙ্গ আরও পরে থাকে মেঘের কাপড়
আমি গৃহ বাঁধি তার বাড়ি / ধুলোর জলে অনেক রকম কেলি
(ধুলোপাঠ: মোস্তাক আহমাদ দীন)
ছন্দময়তা কবির কর্ণইন্দ্রিয়টিকে সজাগ করে দেয় ফলে একজন লেখক-কবির মধ্যে সহজ মন্তব্যে কর্ণযোগ করার একটি প্রবণতা আপনা থেকেই তৈরি হয়। রচয়িতার স্বাভাবিক সঞ্চারণও কখনো কখনো মুছড়ে পড়ে সেখানে। কবিতার কথা শোনেই যে পাঠক নাক সিটকোবেন যে, কবিতা-টবিতার ওসব বুঝি না কিছু, কি যে লিখে ছাই! এখানে নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটিই আসলে নিগৃহিত হলো দুর্বল পাঠকের মন্তব্যে কিন্তু কবিতার জন্য আসলে এটি কোনো মন্তব্যই নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি আসলে সাহিত্যের কোন শাখায় বোঝেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কবিতা বুঝতে পারা যতটা কঠিন তার চেয়ে সহজ হবে না বোঝা এমন ভাবনা থেকেই হয়ত সহজেই কেউ ওরকম মন্তব্য করে বসতে পারেন। এটাই তার জন্যে সঙ্গত সহজকথা। তাছাড়া তার এই বোধভাবনাটি যে ব্যাপৃত কবিতার চেয়ে কবির মৌলিকসত্ত্বায় গিয়ে পড়েছে তা আমার বুঝতে বাকি থাকে না। এরকম মন্তব্যে যেকোন লেখক-কবিরই মৌলিক ভাবনা ব্যাহত হবার কারণ থাকে। জাতিয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে এই মনোভাবটি বর্জিত হওয়া জরুরি বলেই মনে করি আমি। যে কারণে আমাদের শিতি পাঠকশ্রেণি থাকা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি যদি তিনবেলা পেটপুরে খাবার খেতে পছন্দ করেন, খানিকটা হাঁটতে, গান গাইতে, কোন নারীর যৌন উত্তেজনা পেতে বা মাটিচাষ করে ফসল ফলাতে ভালোবাসেন তবে তিনি যে কবিতায়ই ঘুরেফিরে আসছেন তা তাকে বুঝতে হবে। একটি পাখির হৃদস্পন্দন ও পিঁপড়ের নিরব হাঁটাহাঁটিও আমার কাছে একটি প্রকৃত কবিতার গর্ভপঙতি। পৃথিবীর এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে কবিতার কোষ নেই। কবিতা অসীম শূন্যতার মতোই সর্বময় বিভাজিত আর তা থেকে কবিতা ব্যাপৃতই হচ্ছে কেবল। আসলে তাঁর ভেতরটা কবি বাহিরটা শ্যাঁওলায় তেলতেলে, পা রাখলেই পিছলে যায়। আবার অন্যঅর্থে এরও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, খুব কমসংখ্যক কাব্য রচয়িতার ক্ষেত্রেই এরকমটি হতে পারে। অনেক ভালো সৃজন প্রয়াসও তাঁর কাছে ব্যর্থ হতে পারে অধিক শৈল্পিক প্রকরণগত ভাবনার কারণে। কবি-ছড়াকার রইস মনরম লেখালেখির প্রসঙ্গ ধরে খুব সূক্ষ একটি প্রশ্ন রাখলেন আমার কাছে। যেকোন লেখকমাত্রই কি তাঁর লেখনি হতেই হবে ভেবে লিখতে হবে? মুশকিল হলো, তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন লেখকের কাছে বিষয়টি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাঁর লিখনপ্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয় তখনই যখন সে বুঝে ফেলে তাঁর লেখা হতেই হচ্ছে না। এরকম বোধ, প্রজ্ঞার কারণে তাঁর কাছ থেকে সবকিছু ফসকে যেতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন চূড়াস্পর্শী তাঁর লেখনিটি হয়তো আর ভূচরণে সমাপিত হবার নয়। ফলে এই হতেই না হওয়া লেখাটি নিয়ে ক্রমশ হতাশায় পড়ে তিনি কবিতা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে যেতে থাকেন। আর এভাবে লেখকটির কাছ থেকে ইনফরমেশনও এমনভাবে কমতে থাকে যে, একসময় লেখকটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়েন। এবং তাঁর শব্দ-সম্ভারের ক্রিয়েটিভ সার্কেলটি হয়ে পড়ে প্রায় মনোবাঞ্ছাহীন এক ব্যর্থ মনীষা। এরকম পরিস্থিতিতে আটকে থাকা কোন সৃজনশীল লেখকের জন্যই কাম্য নয়। এটা একটা জাতির জন্য দুষ্প্রাপ্য মৌলিক কোনো প্রাপ্তির আরাধ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। সমকালিন প্রোপট যাই হোক না কেন বরং সামগ্রিক কবিতাকল্যাণে এর থেকে কাব্যিক সত্ত্বাটির উত্তরণই জরুরি।
পাতার আড়ালে গিয়ে চুপচাপ থাকবো ঘুমিয়ে
একটি মৃত্যুর পরে জমে হিম করুণ বরফ
অসীম অমর তুমি শূন্যতায় সারাটি দুপুর
পৃথিবীতে কেঁদে কেঁদে জলে জলে জাগাবে জীবন
নদী কি ঝরনার মতো গলে গলে
পর্বতের স্তন বেয়ে চিরে-চিরে জন্মের নাভিতে / আমি।
(পুনর্জন্ম: শোয়েব শাদাব)
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে পোড়ে পথ, গ্রাম / ছেঁউরিয়া জপে শুধু রাধা রাধা নাম
আকাশে প্রবল মেঘ গ্রামবাসী ঘুমে অচেতন
এখনই নামবে ঝড় কলঘরে জলের পতন
কালঘুমে পার হয় জন্মের স্বাদ / বৃষ্টির জল আনে নতুন আবাদ
কর্ষণে বীজ পেলে একে একে দিন চলে যায়
রাধাও শাশুড়ি হয় কোনো এক ঘন বরিষায়।
(নতুন আবাদ: অলকা নন্দিতা)
মানুষকে তার দুঃখ কি পুড়ে? / মানুষ পোড়ে সুখে।
রহস্যময়ী সুখ মানুষকে কেবলই এক
নিকষ অন্ধকারে উবু করে রাখে।
আর সুখের এই হেন অনুধ্যানে / মানুষ তার দিনরাত্রি খুয়ে
নিঃস্ব হতে ঢাকে বিবর্ণ মুখ / এভাবেই সুখ
মানুষ পুড়ে পুড়ে খণ্ডন করে / একদিন পৃথিবীর সমিল করে তোলে।
মানুষকে তার দুঃখ তো পুড়ে না / মানুষ পোড়ে সুখে।
(মানুষ পোড়ে সুখে: সৈয়দ নাজমুল করিম)
কবিতা আপনার কেন ভালো লাগবে আর কেন ভালো লাগবে না তা আমার জানা নেই। কী করলে ভালো লাগবে তাও জানা নেই। তবে আমার কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে বারবার পড়তে, যতবার পড়ি ততবার সে আমার কাছে চির নতুন, প্রথম সঙ্গমের মতো আরামদায়ক। অক্সিজেনহীন কোনো ঘরে একজন মানুষ বাতাস পেলে যেমন প্রাণ ফিরে পায় আমার কাছে কবিতা সেরকম স্বস্তিদায়ক। শৈশবে আমি ঘোড়ায় চড়তাম, গর্ভবতী ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াতাম, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বহুদূরের গ্রাম দেখতাম, সবুজ মাঠ; পিঁপড়ের মতো মানুষজন দেখতাম, মনে হতো যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। আজ সেই স্বপ্নগুলো আমার অতীত, আকাশে ভেসে বেড়ানো হয় না ঘুমের মধ্যে ছাড়া। ঘুড়ির লেজের মতো ছিঁড়ে গেছে উড়াল পাখির দিন। পেছনের লেজটাও হারিয়েছি কবে। অরণ্য থেকে বেরিয়ে মুছে ফেলেছি পিতামহের নাম, মসৃণ সুতোয় ঢেকে ফেলেছি সুন্দর সৌন্দর্যটুকু। মনে নাই আমার নামও ছিলো ক্যালকানা ফলুয়াকি চ্যাঙ। মন্দ কি! কবিতা হলেই যদি সে স্বপ্নটাকে পুনরায় উপভোগ করি তার শব্দের গূঢ়তায় তবে তা যথার্থ যশাসই। শব্দের শক্তি ও আরও অনেক সম্ভাবনার কথা সকলেই জানি। শব্দের পর শব্দ সমন্বয় করেই একজন কবি আপনাকে দোলায়িত করছেন কবিতায়। কোমল ভাবনাটি জাগিয়ে তুলছেন, নরম করে তুলছেন আপনার সূক্ষ ইন্দ্রিয়কে যেন আপনি স্বাপ্নিক ঘুমে চিৎকৃত হচ্ছেন। শব্দের এই দোলায়িত হওয়ার বিষয়টিই আসে ছান্দিক কবির সুনির্দিষ্ট ছন্দের প্রয়োগ থেকেই। আমি প্রায়শই বলে থাকি, যে কবির কবিতায় ছন্দের সুন্দর বিন্যাস থাকে ওই কবির কবিতা দীর্ঘব্যঞ্জণায় পাঠকের মনে অনেক অনেক দিন সঞ্চারিত হতে থাকে। যেমন ধরুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিপখান তিনদাড় / তিনজন মাল্লা / চৌপর দিনভর / দেয় দূর পাল্লা’ আবার আমার ‘অসমাপ্ত রৌদ্রদিন’ কবিতার কয়েকটি চরণ এরকম ‘মেঘশরীরে শীতল ছিলো, শীতল ছিলো পানি / তোমার বাড়ি দেখিনি আরও চোখের রেখাখানি / চোখের কোণে সাঝের ছবি চোখেই সর্বনাশ / তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আমার গলায় ফাঁস’ স্বরবৃত্ত ছেড়ে অন্য আরেকটি ছন্দে সুমন রহমানের ‘মেঘশিশু’ কবিতাটি দেখুন ‘আকাশে তখন জোর প্রস্তুতি, তুমুল গমগম / সমতটে শ্রাবণ আজ শুরু, মেয়েটিকে প্রথম কদম / উপহার কে দেবে, বাঁশি একাই রাধা রাধা বলে / হায় চঞ্চল হাওয়া! ওকে ডাক, ও যে মেঘশিশু / ডেকে আন মাতৃমেঘে, কচুক্ষেতে করতে দিও না হিশু’। এখন পাঠক ভেবে দেখুন উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর সঞ্চারণ আর প্রথাছন্দহীন কোনো কবিতার সঞ্চারণ একইরকম কিনা? যে কারণে একজন কবির ছন্দ সচেতন হয়ে কবিতা লেখা জরুরি, পাশাপাশি পাঠকেরও ছন্দজ্ঞান ব্যতীত কবিতা আস্বাদন কবিতাকে কখনো কখনো অর্থহীনতায় ফেলে দেয়। আবার কবিতার নিজস্ব একটা ছন্দ আছে যা থেকে পাঠক দারুণ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। টি,এস এলিয়ট মনে করতেন যে ‘কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়’, অর্থাৎ সঞ্চারণ বস্তুটি এমনই সূতর যে বোধগম্য হওয়ার চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত পাঠককে পৌঁছাতে হচ্ছে না, এরও অনেক পূর্বে কবিতার পজিটিভ দিকটি তার মধ্যে লোডেড হয়ে যাচ্ছে। কোনো পঙক্তি উচ্চারণের সাথে সাথে মুহূর্তেই আপনি এর ভাবাবেগে আন্দোলিত হতে থাকলেন। এর বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলবো ওখানেই কবিতা নিহিত আছে। যিনি পড়বেন আপন ভুলে, ধ্যানে মগ্ন হয়ে। আর যিনি লিখবেন একপশলা রোদ এসে কীভাবে একটি সকাল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। টেক্সটের ভিন্নতা সত্বেও এখানে উভয়ের চেনাপথ, দর্শন, চলাফেরা, যন্ত্রণা একই। আসলে এঁরা দুজনেই কবি। একজন পড়েন অন্যজন লিখেন। কবিতার একই ঘরে সহোদর তারা মিলেমিশে পাঠক আর কবি। একজন আসেন সৃজন করতে অন্যজন গড়তে। এ দুয়ের ভূমিকাও সমান কাব্যিক ব্যঞ্জণায় উদ্ভাসিত।
কাকের কথা আমি আগেও বলেছি- তারা শান্তিপ্রিয়, এখনো আমার প্রতিবেশী হিসেবে তাদের পাই সকালের আয়োজনে রাতের অপস্রিয়মাণতায়। পৃথিবীর সমস্ত পতঙ্গ তাকে ভুল বুঝেছে ভুল চিনেছে- কাকের অনন্য সাধারণ কর্কশ কণ্ঠের বিরল সুস্পষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে কাক বিষয়ে আমাদের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
(পুনশ্চ, কাক বিষয়ে: জাফর আহমদ রাশেদ)
দ্রুততম চলে যাচ্ছে সময় তার অদ্ভুত-অদৃশ্য বাহনে চড়ে
আমাদের নেই একটুও ঠাঁই তার কামড়ায় একসঙ্গে উঠার;
কেনো মিছে ভাই হেঁয়ালি তবে আর / উজান-তরঙ্গে কিসের ভাটিয়ালি!
যখন য়ে গিয়ে বিনষ্ট আমাদের না’-এর গলুই-তক্তা-মাথাকাঠ,
ফেরার আগেই সঙ্গীদের হারিয়েছি চিরপুরী বাতাসে-
আর কত ভাসান দেব, হৃদয়-আকাশেরও তো / কূল-কিনার নেই;
(সময়বোধ: আশরাফ রোকন)
সবসময় তোমাকে অবশ্যই মাতাল হতে হবে।
সময়ের বিভৎস বোঝা যাতে অনুভব করতে না হয়, যা-
তোমার কাঁধ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, নুইয়ে দিচ্ছে মাটির...
দিকে, তোমাকে মাতাল হতেই হবে, একটুও থামলে চলবে না।
কিসে মাতাল হবে, সূরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা-
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
(শিরোনামহীন: শার্ল বোদলেয়ার)
কবিতার এই আবহমান প্রক্রিয়ায় আমরা পার করে এসেছি বিগত শতাব্দী। অসংখ্য কবিতার বোঝা আমাদের মাথায়। গত শতাব্দীতে আমরা কবিতাকে কতটুকু ভালোবেসেছিলাম, কতটুকু লালন করেছিলাম, কতটুকু ব্যাপৃত প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা সঠিক জেনে নিয়েই আজকের নতুন কবিকে লিখে যেতে হবে তাঁর অভিপ্রায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজের সময়টা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। সমকাল তাকে এত বেশি মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, অন্ধমোহে জড়িয়ে থাকা ছাড়া তার কোন গত্যন্তর থাকে না। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে যে, সে তাঁর অতীতের দিনগুলোকে প্রত্য করেনি; প্রত্যক্ষ করেনি কোন কবিতার গূঢ়তায় তার আজকের লেখার তাগিদ আর দেখেনি সে নিকট কোনো ভবিষ্যত। যে নবীন কবি আজকের এই দীনতাকে মাথায় তোলে বয়ে বেড়াবেন তাঁর সময়কে, আগামীর শ্রদ্ধা তো তাঁরই। তাছাড়া এই বিষয়টি প্রত্য উপলব্ধি করার সুযোগ নবীনদের ক্ষেত্রেই বেশি থাকে। সেই আসন্ন নবীন কবি-পাঠকটিই জরুরি এখন বাংলা কবিতায়। বিগত শতাব্দিতে আমরা কবিতার কাছে যতটা দায় ফেলে এসেছি সে দায় থেকে মুক্তি পেতে যে অগ্রজ একজন নতুন কবিকে পর্দার আড়ালে টেনে নিয়ে ধোঁয়া সেধে অজ্ঞান করে রাখতে চাইছেন সে দায়টুকুও একজন নবীনকেই মাথায় নিয়ে তাকে শিল্পের পথ পরিস্কার করতে হবে। একজন কবির যদি তাঁর লেখার সময় থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত জানার প্রচণ্ড তাগিদ না থাকে আর কবিতাকে নাকসিটকোতে শিখেন তবে প্রকৃতই কবিতার আসন্ন মৃত্যু হবে বৈকি! (অবশ্য সে মৃত্যু ওই নির্দিষ্ট সময়ের পাঠকের কাছে, প্রকৃতই কবিতার মৃত্যু নেই। প্রায় চার / পাঁচ হাজার বছর পর আবিষ্কৃত সাফো’র দুর্লভ কবিতাগুলো আজ আমরা ঠিকই পড়তে পারছি)।
এ আমাদের দীনতাই বলতে হবে যে, বাংলা একাডেমির মতো এত বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের থাকা সত্বেও তরুণদের জন্য বৃহৎ কোনো উদ্যোগে তাদের চৈতন্য নেই। প্রতিবছরই এই প্রতিষ্ঠান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অজস্র প্রকাশনা করে থাকলেও কবিতার ক্ষেত্রে আহামরি কোনো অবদান রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। (করে থাকলেও আমার মতো অনেক পাঠকের যোগাযোগের বাইরে)। প্রায়শই দেখা যায় যে অগ্রজ-অনুজের মধ্যে চিন্তার একটা তফাত তৈরি হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও এরকমই ঘটে আসছে। অগ্রজ একজন কবি সাধারণত অনুজ কোন কবির লেখা পড়েন না কিছুই হচ্ছে না বা হয়ে ওঠবে না কিংবা হয়ে উঠলেও তাঁর কাক্সিত ল্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না এরকম একটা ধারণা নিয়ে। বিপরীত একটা মুশকিল এখানে থাকছে। অনুজ কবির সৃষ্টিশীলতা তাঁর অজ্ঞাতেই থেকে যাচ্ছে এবং তার ব্যর্থতার জায়গাটিও তিনি আবিষ্কার করতে পারলেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে চিন্তার যোজন ফারাক আর বৈষম্যতাও। অগ্রজ-অনুজ এই দুই বৈষম্যকে সমন্বয় করতে তারাই পারেন এ’দুয়ের ফলপ্রসূ প্রকাশনার মাধ্যমে। অথচ সেদিকটাতেও তাদের হুঁশ রয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে এতটা কার্পণ্য নেই বোধ হয়। সারাবিশ্বের যেকোন দেশের কোনো না কোনো কবিকে আমাদের দেশের পাঠক জেনে গেছেন মূলত সে দেশের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও যোগাযোগের কারণে। আমার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সেরকম ফলপ্রসূ কোন ভূমিকা আজও রাখতে পারেনি। কবিতার ভূমি আমার গর্বের দেশ অথচ কি বিচিত্র এই বঙ্গদেশ! দেশের মানুষজন! প্রতিষ্ঠান! সেলুকাস... আজও তারা কবিতাকে ধারণ করতে পারলো না প্রাণের গভীরে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করবো আমাদের বৃহৎ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেজন্যই ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র লিটলম্যাগের আবির্ভাব ঘটেছে এইটুকু একটা দেশে আর সেগুলোর হঠাৎই মৃত্যু হয়। কোন কোনটির ক্ষেত্রে আর্থিক অসংগতি, বিজ্ঞাপনের অভাব, লেখার অভাব, লেখায় শিল্পময়তার অভাব এখানেও ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠছে অগ্রজ-অনুজ বৈষম্য। এহেন কলুষিত অধ্যায় আমরা সাহিত্য থেকে মুছে ফেলতে না পারলে বা পাঠকের কানে সে সুর বাজার আগেই কবিতার পথ পরিস্কার না করলে ধ্বংসের কিনারে একা একা বসে থাকতে হবে আগামীর কবিদের। আমি মনে করি শুভস্য শীঘ্রম আপনার কাব্যিক প্রণোদনা।
বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যায় সমস্ত শরীর / ভায়ওলিনের সুর দোলে
দুলে ওঠে মানিপ্লান্টের লতা / একচালা ছোট ছোট ঘরগুলি
পুকুর ঘাটে নতুন বউ, কদম গাছে ছোটপাখি
ধানের ক্ষেতে শাপলা একপায়ে তালগাছ
পর্দা সরে যায় বড়কর্তার ঘরের জানালার
মেঘের শব্দে মিশে যায় নারীর আর্তনাদ
স্বর্ণচাপার তলায় সাপের খেলা / নেড়ি কুকুর অবিরাম ডেকে চলে, ডাকছে কাক
খিচুরির চাল ফুটছে চুলোয় / ঘরে প্রতিক্ষায় কেউ
(স্বীয় সঙ্গোপনে-১৩: মাহফুজা হিলালী)
ভালো ভাষা, তুমি কি বহন কর বিশ্বাসযোগ্যতা?
সৌন্দর্যবিচার থেকে কিছু শব্দ খসে গেছে, পড়ে আছে
নর্দমার ধারে, তাকে তুলে এনে কোথায় রেখেছো?
ঘষা কাঁচ, পুরনো পয়সার দুঃখ নিঃস্বের ঝুলিতে
প্রাত্যহিকতার সাথে মিশে তাও আজ কিশে।
(ভালো ভাষা, কোথায় চলেছ?: বিশ্বজিৎ চৌধুরী)
জল বোবা হলে / সাগর হয়ে ওঠে
দেশে দেশে পালকের বোবা কাহিনী / গেয়ে থাকে পাখিরা
বোবাদের চারপাশে বেড়ে ওঠে / গান, ফুল ও রোদ
আমার ঘর যেন / পালক ও কাশফুলের পৃথিবী
(বোবা কাহিনী: যুবা রহমান)
‘কাব্য সাহিত্যে নাটক হচ্ছে সর্বোত্তম’ উক্তিটি কার? এ মুহূর্তে মনে আসছে না। তবে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি এই জন্যে যে, তাঁর বোধের স্বচ্ছ জগত থেকে তিনি তাঁর বোধের ভাষাটা রেখেছিলেন কাব্য পাঠকের জন্য। নাটকের প্রধান সঞ্চারণের বিষয় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার মধ্যেই দর্শকশ্রেণি আন্দোলিত হচ্ছেন ঠিক অন্য একটি ঘটনায়, তাঁর কল্পলোকে। আর সেই কল্পনা থেকেই জেগে উঠছে আপনার প্রকৃত ইমোশান বা ভাবাবেগ যা শিল্পের জন্য প্রধান একটি বিষয়। জগতের সকল বিষয়েই আমরা যেরূপ নাটকিয়তা প্রত্যক্ষ করি আমাদের জৈবনিক সকল ক্রিয়ায় অনেকটা বন্ধনযাতনায়! ফলে প্রিয় থেকে প্রিয়তম এই বিষয়টির শিল্পময়তা বিষয়ে আমার দ্বিধাদ্বৈততা নেই। আর সাধারণ শ্রেণির আন্দোলিত হওয়ার পেছনেও আমার যথাযথ সায় ব্যাক্ত করি, পাশাপাশি সংগীতের আবেদনকেও এর সাথে যোগ করি আমি।
কিন্তু একজন কবি যথার্থ অর্থেই নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকার, প্রবন্ধকার যাই হোন না কেন তাঁর ভেতরে যখন কাব্য খেলা করে তখন তিনি কোথায় উত্তম, সর্বোত্তম, অধতম তা তাঁর নিজেরই জানা থাকে না। আপাত দৃষ্টিতে তাঁর কবিন্দ্রিয়টি খোলা রাখলে বা খোলা থাকে তবে তাঁর সৃষ্টি সর্বোত্তম, সে নাটকই হোক, কবিতাই হোক, প্রবন্ধই হোক আর ছোটগল্পই হোক। কবির জন্য এটি অত্যন্ত সুখের যে, তাঁর কবিন্দ্রিয়টি যদি খোলা থাকে বা যদি হয় সঞ্চারণম তবে একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদার্পণ করা কিন্তু একজন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, ভ্রমণ কাহিনী এইসব লিখিয়ে এমনই এক সূক্ষ বৃত্ত বা ব্যাসার্ধ থেকে পরিচালিত হন যে, তাঁর পে কখনোই সম্ভব নয় কাব্যিক অন্তরায় সঞ্চারিত হওয়া, ওই অবস্থান থেকে কখনোই সম্ভব নয় সাহিত্যের সকল শাখায় প্রভাব বিস্তার করা। এক্ষেত্রে কবি ও কবিতাই সিদ্ধ স্মরণেষু কেননা একজন কবি তাঁর কবিতায় ধারণ করেন সমস্ত কিছুর প্লট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সৈয়দ শামসুল হকের লেখা যাঁরা গভীরভাবে পাঠ করেছেন তাঁরা এর সত্যাসত্য আবিষ্কার করেছেন নিশ্চয়ই। একমাত্র কবিরই সকল বোধ খোলা থাকে কিন্তু যাঁরা সরাসরি ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার তাঁদের বেলায় এরকমটা হয় না সাধারণত। কবি অর্থে চিহ্নিত কারা? তা প্রমাণ করা কারো পে সম্ভব নয়, একমাত্র তিনিই এর যথার্থ উত্তর মেলাতে পারেন যিনি পড়েন আর পড়েন এবং পাঠশেষে নির্দ্বিধ বলে দিতে পারেন সর্বোচ্চ সঞ্চারিত কবির নাম। কিন্তু যুক্তিনিষ্ট সত্যভাষণ প্রদান করতে পারেন এরকম পাঠক আমাদের নেই। তারপরও স্বাভাবিক অর্থেই আমরা জেনে যাই কে কবি আর কে অকবি। পাঠকই তা নির্ধারণ করেন। অবশ্য এখানে একটা সমস্যা তৈরি হয়, পাঠকই আসলে প্রকৃত অর্থে কবি; তা না হলে কবি যে কবিই মূলত সে বিষয়টি কে আবিষ্কার করতো? জীবনানন্দ দাশ কবি চিহ্নিত করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ শেষপর্যন্ত তারও সিদ্ধান্ত ছিলো পাঠকের উপর কেননা সকলেই কবি না হলেও পরবর্তীতে আর কোনো কবি আসবে না একথা তিনিও বলে দিতে পারেননি আর তাছাড়া নিজেকে যদি কেউ সঠিকতা নির্ণায়ক হিসেবে দাবি করেন তবে তা ভুলই হবে। সময়ই বলে দিতে পারে কে কবি আর কে অকবি। একশো বছর পর যদি ওই সময়ের পাঠক জীবনানন্দ দাশের পরে কবি হিসেবে মহাদেব সাহা, রবীন্দ্র গোপ, আসলাম সানী-কে আবিষ্কার করেন এবং সে যুক্তি যদি যথার্থ অর্থে সাময়িক হয় তবে কারোরই কিছু করার থাকবে না। যেহেতু এ সময় আমরা এঁদের সেঅর্থে কবি হিসেবে মনে করি না। কিছুটা মহাদেব সাহা ব্যতীত বাকি দুজনই কবিঅর্থে প্রায় নিষ্ক্রিয় বলা চলে।
তাহলে সোজা কথাটা দাঁড়াচ্ছে এরকম যে, সামগ্রিক অর্থে কাউকে কবি বা অকবি বলবার মতা আমাদের নেই বরং আমরা আমাদের পছন্দের কবি চিহ্নিত করতে পারি শুধু।
আমাকে দাওনি তুমি কম্পাসের খল নির্ভরতা
ছিলে না পরার্থপর মৃত্তিকার দিগন্ত নির্দেশে / বস্তু হতে অবাস্তব ভূতের আশ্লেষে
ক্রমশ লুপ্ত হয়ে অতগুলি অলৌকিক যন্ত্রের কথা
মনে কি পড়ে না কারো? আকাশে উড্ডীন
শকুনতাড়িত সূর্য হেলে পড়ে কম্পাসকাঁটায়-
বৈশাখ দুপুরে দূর বিমানের ধাতু আলেয়ায়
বিপুল এয়ারড্রোম পড়ে আছে বৈমানিকহীন।
(বিশাল বাস্তবিক নত্রপদ্ধতি: উৎপল কুমার বসু)
ভোরের উৎফুল্ল ঠোঁট দরোজায় জানালায় চুমু খায় আয়।
এই ছোট্ট ডাক দিয়ে একজন পাশ ফেরে যুগল শয্যায়,
ঘুমের ভেতরে হাসে, সবুজ বৃরে মতো আঙুল বাড়ায়।
আমাকে নির্বোধ যদি মনে করে থাকো- ভুল হবে;
যদি মনে করো আমি স্বভাবত ভুলে যাই সব- ভুল হবে;
যদি মনে করো এখনো জানি না আমি কি ফেলে এসেছি-
ভুল মনে করা হবে।
(গাছ পড়ে যায়: সৈয়দ শামসুল হক)
সময়ের মধ্য থেকে কিছুটা সময় বের করে নিতে হয়
যেমন সবার মধ্য থেকে প্রিয়তম বন্ধু এসে ডাক দেয়;
তার সরল কথা শোনার পরে পৃথিবীটা চির আধুনিক
জ্ঞানী কিংবা মূর্খ প্রত্যেকেই চেয়েছিলো এই ডাক দিক;
সময় পেয়েছে যারা, সময়ের থেকে চলে গেছে বহুদূর
সময়ের হাত ধরে লাইনে দাঁড়ালো- ওই যে সুদূর;
(সময়ের মধ্য থেকে: আলফ্রেড খোকন)
ভাবনার, আবেগের, বোধের সন্তরণই কবিতা। কবিকে তাই মগ্ন থাকতে হয় তাঁর চিন্তায়, কবি তাই মগ্নই থাকেন আর এভাবে মগ্ন থেকে থেকে ক্রমান্বয়ে তিনি হারাতে থাকেন পরিবার, সমাজ, দেশ। কবির ভাবনায় সমস্ত ভূখণ্ডই হয়ে যায় তাঁর চলার পথ। কেউ কেউ বলেন কবি আসলে সমাজের বিচ্ছিন্ন একটি প্রাণির নাম, এ কারণে যে একজন কবির মধ্যে সামাজিক কোনো দায়বোধ থাকে না বা সেঅর্থে জন্মও নেয় না। শুধুমাত্র একজন কবির ক্ষেত্রেই নয় যেকোন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিমাত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। এ কথাটা যতটা সত্যি তারচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে কবির কল্পনার বিস্তার সমস্ত মহাশূন্যকে ঘিরে। সুতরাং পরিবার সমাজ, দেশ, জাতি, ধর্ম, এসব কবির কাছে ক্ষুদ্র হয়ে যায়। সঙ্ঘশক্তি বা সমাজভাবনা যেখানে একজন সাধারণের আরাধ্য বিষয় হয়ে থাকে সেখানে একজন কবির ক্ষেত্রে বিপরীত হিতেরও কারণ হয়। ফলে ত্রেবিশেষ শুধু একজন কবি নয় সিরিয়াস পাঠকও এরকম সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। একটি কথা হলো, যার ঘর রা হয় তার বাহির রা হয় না আর যার বাহির রা হয় তার ঘর রা হয় না, মূলত এ দুটোর মাঝখানেই কবির অবস্থান। যার দুকূলই রা হয় বা এ’দুয়ের লিটারেসি মিডিয়ায় অধ্যরে ভূমিকা পালন করেন তিনি একজন পাঠক। একমাত্র পাঠকের দ্বারাই সম্ভব দুটো বিষয়কে সমন্বয় করা। আমাদের পাঠকরাই সমৃদ্ধ নয় এ দোষ বা গুণ কার উপর গিয়ে বর্তাবে তা ভেবে পাই না। সর্বোপরি আমাদের কবিরাও পাঠঋদ্ধ হওয়ার আগেই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন- যা সাধারণ পাঠকের প্রাপ্য নয়। বস্তুজগতের সকল মানুষই কবি এবং সবকিছুই কবিতা। এর মধ্যেও একজন কবি যখন লিখতে শুরু করলেন ধরা যাক সে সময় থেকেই কেবল তাঁর ইন্দ্রিয়টি খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রকাশবিচারে একজন কবির জ্ঞানের জগত যথার্থ প্রগাঢ় হওয়া চাই। এই বিষয়টির যথেষ্ট অভাবস্বত্বেও যখন একজন কবির মধ্যে অহেতুক উতলা হওয়ার অভিনয় দেখি তখন কষ্ট পাওয়াব্যাতীত কোনো গত্যন্তর থাকে না।
বাংলাসাহিত্যে পড়ান এমন এক রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপকের সাথে কথা হয়েছিলো একদিন। তাঁর বক্তব্য ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠের পর অধুনা সাহিত্য পাঠের কি প্রয়োজনিয়তা থাকতে পারে একজন পাঠকের? কি করবো হাসিতে ট্রাজেডিক লুকোচুরি খেলেছিলাম সেদিন। প্রশ্নটির মধ্যে পাঠকের গভীরতা নির্ণয়ের একটি বিষয় ছিলো কিন্তু আমার হাসিটা ছিলো অন্য কারণে। সমকালিন সৃষ্টিশীলতার কি তবে কোন প্রয়োজনিয়তাই থাকছে না? কবিতা তো তাই একবেলা খাবারের পর দ্বিতীয়বার ক্ষুধা পায় যেমন। আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবী স্থবির নয় তারই উদাহরণ কবিতা, এও সত্য যে পুরনো কে ভাঙাই কবিতার কাজ বা পুরানের ভেতর থেকেই নতুনের সৃষ্টি। একজন জীবনানন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং তাঁর কবিতা শতাব্দীর কবিতা হিসেবে যথার্থ গুরুত্বের দাবিতে ভরপুর; জীবনানন্দ দাশ ভেঙেছেন তাঁর পুরনো ধ্যান-ধারণা এবং উৎকৃষ্ট বোধে মূল্যায়িত করেছেন সময়ের সম্ভাষণাকে। তাই বলে যাঁরা এমন সাহিত্য বলয় তৈরি করেছেন তার ভেতরেই বা একজন পাঠক আবদ্ধ থাকবেন কেন? যাকে বলি মায়াজাল, একজন পাঠকের এরকম আবদ্ধতা আসলে কাটিয়ে উঠা উচিত। তাহলেই কেবল প্রকৃত চেতনার স্ফূরণটি তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
একজন পাঠকই আসলে প্রকৃত কবি। যখন তিনি নিমগ্ন হয়ে উপলব্ধি করেন কবিতাকে তখনই জন্ম নেয় তাঁর যথার্থ কবিতাগুলো। ফলে সময়মতো তাঁর কবিতাগুলো তিনিও লুফে নেন তাঁর কবির ভেতর থেকে। একজন যথার্থ পাঠকই হলেন প্রকৃত কবিতার জন্মদাতা।
ধূলিপথে প্রণয় হলে প্রলয় প্রত্যাসন্ন হয়,
অতঃপর পুনরায় ফিরে দেখা দ্বারপ্রান্তের দৃশ্যরেণু;
নগর কাহার নাগর ও ধূলিভাই
শিল্পবন্ধু, অনুনাদহীন নগরের বিস্তার-
আজ ঘরে ঘরে শূন্যতা বর্ণনা করি!
(নগরপর্ব: আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিন
ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুন
মসৃণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীলচিঠি
লন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপসন, শাদা বাক্স ওষুধের
সৌখিন শার্টের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতার
ভবিতব্যহীন নানাস্মৃতি আর রঙবেরঙের দিনগুলি
(বৃষ্টি, বৃষ্টি: শহীদ কাদরী)
জন্মভূমি- কথাটার মধ্যে এক আশ্চর্য মাদুর বিছানো আছে,
তাতেও শুয়ে দেখতে পারো।
জ্বালা যন্ত্রণার কথা মুখ ফুটে না বললেও টের পাই-
মানুষ যেমন ফুল, মানুষ তেমনই কাঁটা!
ঘরের ভেতরকার আসবাবে হোঁচট খেলেও তো তাকে রাখো!
(ফুলঝুরি, তোমার নাম: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কবি দেখেন, পড়েন, ভাবেন, লিখেন অতঃপর তিনি একটা ভূ-মণ্ডল রচনা করেন যা তাঁর একান্ত নিজস্ব একটা বলয়। সেখানে তিনি একা, বলা যায় এটা তাঁর গভীর পাঠ প্রস্তুতির কারণে। একাই দেখেন, ভাবেন, বুঝেন, লিখেন... এখানে তাঁর ভাবনার ব্যতিক্রম তো রয়েছেই, এখানে তিনি সমাজের আর দশজন মানুষের মতো ভাবনা বিস্তারী নন। তাঁর ভাবনা অতলস্পর্শী যা শেকড় ছুঁয়ে যায়, যতটা তিনি দিগন্তপ্লাবী ততটাই তিনি গভীর পাঠক। তিনি যখন একজন পাঠক এবং আরেকজন পাঠককে বিশ্লেষণ করতে যান তখনই ফুটে ওঠে তাঁর ব্যতিক্রম সত্তা ফলে পাঠককে ছুঁতে গিয়ে তাঁকে হয়ে উঠতে হয় অত্যন্ত গভীর বোধ আর মেধার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। কবিতার ভেতরকার টেক্সটই তাঁকে সেরকম ভারী করে তোলে। এইগূঢ় সত্যের বাহিরে যিনি অবস্থান করেন তিনি এক সাধারণ মানুষ, অতি প্রাকৃত, অতি সামাজিক, অতি কোমলপ্রাণ একজন। এরকম মুহূর্তে কবির যাকে দরকার তিনি একজন ঋদ্ধপাঠক, একমাত্র তিনিই ভাঙতে পারেন কবির নিজস্ব বলয়ের আবহটাকে এবং বের করে নিয়ে আসতে পারেন তাঁর নির্বাচিত কবিটাকে। শেষপর্যন্ত কোন পাঠকই যদি তা উদ্ধার করতে সম না হন তবে কবির তাতে বয়েই যায় বরং তাঁর কাব্যসত্ত্বা অপেক্ষা করে পরবর্তী মহাকালের অপেক্ষায়। একটা সত্যি বিষয় হলো, কবির বলয় থেকে তাঁর সত্ত্বাটাকে বুঝবার মতো কোন যোগ্য পাঠকের সৌভাগ্য হয়নি বাঙলা কবিতার। যেটুকু হয়েছে তা অতিসস্তা, নিম্নমানের, সাময়িক মুগদ্ধমানের পাঠক আর তাতেই বাঙলা কবিতা রাজকপালে। আজ যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর... জীবনানন্দ দাশ... জসীম উদ্দীন... সৈয়দ শামসুল হক... ফরিদ কবির... বলে হাই তোলে ঘুম ছাড়ছি কবিতা কবিতা বলে তারাও শেষমেষ পাঠকের দলে নই কারণ এঁদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হতে গিয়ে তারাই বসে আছেন রবীন্দ্র সাহিত্য বলয়ে, সেখান থেকে তাঁদের বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এ থেকে জীবনানন্দের পাঠক অবশ্য ব্যতিক্রম, তাঁরা ক্ষাণিকটা বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছেন আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হয়ে। কিন্তু এতেই বাঙলা কবিতার ব্যাপক প্রসার নিশ্চিত হয়ে পড়েনি, বলা যায় সবেমাত্র পাঠককুলের নাকের আঁওয়া ভাঙতে শুরু করেছে। এদিক থেকে আমরা আশাবাদী যে, বাঙলা কবিতার আরও ব্যাপক প্রসার অবশ্যস্থাবী। টেক্সটের ধারণা এখানে এসে সমস্ত যৌক্তিকতা ভেঙে দেয়। টেক্সটই যদি আপনাকে কবিতার দিকে প্রবাহিত করলো তবে সেখানে পাঠকের দুর্বলতা কিংবা টেক্সটের শক্তিময়তার কথা ভাবার কোন সুযোগ নেই। স্বয়ংনির্ভর টেক্সট কোন সঠিক জায়গায় আবেদিত হয়ে সমাপিত হলো সেটিই প্রধান বিষয়।
এই শীতে গান। এই শীতে গান নেই যদি না বানাই আমি
কেননা শালিক, কাক, চড়ুইয়ের ডাক / গান নয়- যদিও আমার কানে গান-
পাখিরে দেয়নি গান, পাখিরে দিয়েছে শুধু ডাক
আমারে দিয়েছে গান, আমি তাই গানেরেই ডাকি,
ডাকি শীতে, শীতের শত্রুতা সহ্য করে, পাংশু, দিনে, / রক্তশোষা অসহ্য সন্ধ্যায়।
(মৃত্যুর পরে-জন্মের আগে: বুদ্ধদেব বসু)
কবরের পাশে জন্মানো পিপ্পল গাছ,
সারারাত বাতাস আর ঘুঙুরের শব্দ শোনো,
কোথাও বিষাদ আড়াল করে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে রুষ্ঠ প্রেতাত্মারা,
দেখছে কবর প্রাচীর ভেঙে রাত থাকতে চলে গেছে গোরখোদকেরা,
কে তোমার পাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে হৃদয়?
(উপকথার কবর ও একটি গাছ: রায়হান রাইন)
কেমন জাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতোপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিলো, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাওলার ঝোপে / লুকিয়ে বেঁচেছি এতকাল
(ডানা: সাজ্জাদ শরিফ)
কবিতা যেহেতু সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা, কাজেই সুযোগসন্ধ্যানী পাঠক সেদিকেই ধাবিত হবেন। কিন্তু আমাদের সমাজে সৌন্দর্যবীক্ষার এই ধারণারও একটা অবমূল্যায়ন আছে। আদ্যন্ত কবিতাকে জেনে নিয়েই একজন কবির উচিত তাঁর সকল নিবেদনকে প্রজ্ঞাপিত করা। গাল্পিক-সুলেখক রাজীব নূর, রেজা ঘটকের সংগে বিশেষ একটি আড্ডা হয়েছিলো একদিন আমাদের ‘পাঠসূত্র’ অফিসেই। তিনি প্রশ্ন রাখলেন কবিতা লেখা কেন জরুরি? একজন লেখক কেন তাঁর লেখাটি প্রকাশ মাধ্যমে দিতে পারেন? মহাকালের সৌন্দর্যচেতনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ইউনিট হচ্ছে কবিতা। আগেই উল্লেখ করেছি ‘সৌন্দর্যবীক্ষার প্রধান অন্তরা’ কবিতা তাই একজন কবির সৌন্দর্যচেতনা থেকেই লেখা জরুরি। যেখানে পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠতে পারে শৈল্পিক নিবেদন, অহং। ‘সঙ্ঘশক্তি’ ঠিক যে অর্থে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রিয়ার সৃষ্টি করে এর বিপরীত একটি অর্থেই একজন লেখকের প্রকাশিত লেখনি সমধিক ব্যাঞ্জণায় সঞ্চারণ সৃষ্টি করতে সম। ফলে একজন লেখকসত্ত্বার পূর্ণ নিবেদনে অবশ্যই ব্যাপক প্রকাশনা জরুরি। একটা বিষয় আমি স্পষ্ট লত করেছি যে, আমাদের কবিরা নিজেদের কবি হিসেবে ভাবতে সাহসী নয় কেননা তাঁরা এতই মুখচোরা যে, এখন আর কবি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন না। বিষয়টা প্রস্তাবনার ফলে কেউ কেউ হয়ত উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ দাশকে টেনে আনতে ভুল করবেন না কিন্তু আমার চিন্তা খুবই সাধারণ। আজও আমরা কবিতা লিখে গর্ববোধ বা শৈল্পিক অহং-এ তাড়িত হতে পারি না, যেন কবিতা লিখছি এটা একটা গর্হিত অপরাধির কাজ। তবে কিসে আর গর্ববোধ করবো? এমন অনেক পটূ কবিও রয়েছেন যাঁরা কবিতা লিখলেও মূলত তাঁর অহং-এর জায়গাটি হয়ে থাকে অন্য কোনো বৃহৎ পরিচয়ের। যা হয়ে থাকে বড় কোনো কর্মকর্তা, একজন বিদেশ ফেরত অকেজো বা কথার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে ধন্যবোধ করেন (হিজরা ইংরেজ) অথচ সকলেই জানি ওইসব স্থূল পরিচয়ের চেয়েও কবিতা নিশ্চয়ই আরো মহত্তম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের। এসবই প্রমাণ করে আমাদের কবি ও কবিতার অবস্থান এখন কেমন। যাঁরা এ অবস্থানটা তৈরি করেছেন ওইসব হিজরেরা কি জানেন পরবর্তী কবিদের মাথায় এর কতটা বোঝা তুলে দেয়া হলো। কথা আরো থেকে যাচ্ছে, সুন্দর প্রতিবেশ কবিতার একটি প্রধান শর্ত! মুক্তচর্চায় এরকম প্রতিবেশই কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য জরুরি হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহৎ কোনো ব্যক্তিক আইডেন্টিটিসহই কাব্যিক আইডলটি এত বেশি উজ্জ্বল থাকেন যে, আপনার সমস্ত ধারণা আমূল পাল্টে দিয়ে শৈল্পিক অহংটি পরাজিত হয়ে যেতে পারে। যে কারণে শুধু কবিতা নয় সমগ্র সাহিত্যই নখদর্পণে থাকা জরুরি। সাহিত্যে বাঙালির প্রথম নোবেল উইনার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। এরপর বাঙালির আর কোন সাহিত্যে নোবেল নেই। প্রায় একশো বছর পরে আমাদের এ দীনতা ঘুচাতে আজকের তরুণদের আরো বেশি সজাগ হওয়া জরুরি। এখনো আমাদের বাস্তবতা এরকম যে এই বাংলাদেশে শান্তিতে নোবেল পেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস আর আমাদের তরুণরা উদ্বেলিত হয়ে চায়ের আসর, ক্যাফে-ক্যান্টিন টেবিল চাপড়ে গরম করে ফেললো খবরটি শোনার পর। অথচ এরূপ হওয়াই সঙ্গত ছিলো যে, রবীন্দ্রনাথের পর আমাদের দেশে সাহিত্যে নোবেল পেতে যাচ্ছেন ফরিদ কবির। এই খবরটা আগেই জেনে ফেলা, তাহলে সেটি অধিক ফলপ্রসূ হতো। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ কিন্তু আমার ভাবনাটা এর বিপরীতে। আমার কাছে কেউ কেউ কবি নয় সকলেই কবি। কবিতা নামক শব্দটি যিনি জানেন, কবিতা নামক শব্দটি যিনি বুঝেন তিনিই কবি। যদি এমন কোনো পাঠককে খাতা-কলম হাতে বসিয়ে দিই কোথাও তবে তার পক্ষেও লিখে ফেলা সম্ভব কোনো কবিতা। সমস্যাটা এখানেই, কবিতা লিখলেই যে সেখানে কাব্যিক সঞ্চারণ থাকবে বা শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে যাবে বা যিনি লিখিয়ে তিনি যথার্থ অর্থে কবি হয়ে উঠবেন এমনটি নয়। মূলত তাকে চেনার জন্য পাঠকের একটি চোখ খোলা রাখলেই চলবে। যাঁর চলায়, ফেরায়, বলায়, চিন্তায়, মেধায়, মননে, দৃষ্টিতে, চেতনে, অবচেতনে, স্বপ্নে সর্বণ কাব্যচিন্তনের বিস্তার তিনিই কবি। সমাজের, দেশের, বিশ্বের তথা ভৌগলিক সমস্ত সুন্দর যিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর ভাবনায়; যাঁর চিন্তা সুন্দর, যিনি সত্য ভাবেন, সত্য লিখেন, যিনি সর্বণ দগ্ধ হচ্ছেন কবিতায়, তিনিই আমার কবি। ধন্য তাঁকে, নমস্য তাঁর পঙক্তি, আমার সকল নিবেদন, আমি তাঁর পূজা করি।
রক্ত দ্রাঘিমা থেকে পাঠিয়েছ বোবার কাহিনী
তাকে ক্যাসেটে চড়ালে শুধু শব্দহীন / ব্যর্থ ঘুরে মরে
আর যতো রাতের প্রদীপ এসে / হানা দ্যায় নিঃশ্বাসের ঝড়
ফলত সে নিভে যায়! / তথাপি শিখরে তার শিখা জ্বলমান
দৃষ্টি তো নিরেট তাই লোকেরা দ্যাখে না
শীতল ফলের মর্মে আজ রাতে তারকার নত।
(বোবার কাহিনী: জুয়েল মাজহার)
টের পাই / বীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে ফসলের গাছ
টের পাই / জেগে ওঠছে কবিতার নতুন অঙ্কুর
টের পাই / কাগজের শাদা পৃষ্ঠা নিয়ে খেলা করছে অবিরাম ঢেউ
টের পাই / ভোরবেলা জেগে ওঠবে কবিতার চারা
(কবিতার চারা: আবিদ আজাদ)
তোমার হতাশ চোখে
সন্ধ্যায় আগুনছবি নিভে আসে, মেঘ আরো নিচু / এবার হাডুডু মাঠে স্বগতোক্তি মুছে নিয়ে সংলাপের জন্ম হয়, ঝিঁঝিঁ ডাক / জোনাকি আলোয় তৃতীয় পঙতির মতো একটি গরীব মেয়ে হেঁটে যায়, ছেঁড়া ফ্রক / লোকচুক্ষুভীতা ভয়ে তুমি দ্যাখো, / এই অন্ধকার গ্রামে, কুপি জ্বেলে, পাঠকই কবিতা।
(হাডুডু খেলার মাঠ: রণজিৎ দাশ)
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই প্রশ্ন তোলবেন যে, কবিতা কি এবং কেন? কবিতার ভবিষ্যত কি? তারপে কবিতার ‘ক’ আর বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাঁকে অযথাই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতা কি ও কেন এবং কবিতার ভবিষ্যত কি? একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন, তাঁর কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুণ বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জন্মদাতা। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকে আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার-আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবনবোধ, এসব অসংখ্য কাজ এক নয়, কবিতাও তাই। অজস্র বছর চলতে চলতে এর ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি, হয়তোবা ভবিষ্যতেও আমরা এর আরও অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পে অসম্ভব যতণ না তিনি গভীরভাবে কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত সেইসব অধ্যাপক সমালোচকদেরই, যাঁরা কবিতা মাথায় নিয়ে পাঠক / শিক্ষার্থীদের কবিতার ভেদজ্ঞান বোঝাতে নিজেদের অধ্যাপক সাজিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেয়া।’ অর্থাৎ কাব্যিক আইডলটিরই সুনির্মাণ করা। কিন্তু ভাববার বিষয় হচ্ছে যে সেদিক থেকে আমাদের বর্তমান শিা প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠককে কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে, কতটুকু পাঠমনস্ক, কতটুকু পাঠক করে তোলে তার অধ্যাপক সমালোচকের মাধ্যমে। এটা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না আমাদের, যখন দেখি আমাদের পাঠকদের কাচুমাচু অবস্থা। আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে তার পাঠপর্ব শেষ, এই হীনভাবনার দায় নিশ্চয়ই ওই দুর্বল প্রতিষ্ঠান আর অধ্যাপকদের। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠপর্ব শেষ করে সে আর তার মতো করে পাঠের প্লানিং ফর্মটিই তৈরি করতে পারছে না বা সেই দায়বোধও তার মধ্যে জাগছে না। এই প্রশ্নটি করার আগে এইসব অধ্যাপকদের কানে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিস্কার করে কবিতার সঞ্চারণ সৃষ্টি করা জরুরি। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তবে কবিতার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে কেননা তা না হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এমন অনেক প্রশ্নকর্তা বেরিয়ে আসবে সে পরিপূর্ণ জ্ঞানপিপাষু হবার আগেই।
মাটি খুঁড়ি। তামার স্তর ভেদে, ভেঙে এত স্বর্ণ স্তূপ।
ছড়িয়েছি তাতে শরীর ও বিবমিষা, আমার দীর্ঘচুলের জটিল জালে
কালো মাটি আর আগুন ও চুম্বনে অগ্নি-ভষ্ম-বীজে;
অন্ধেরা পায় চূর্ণসূর্য, রঙের সারাতসার; উদগমনের ভারে
বীজের ভিতর ধারণ করেছি তাকে, সর্বগ্রাসে গর্ভধারণ করে
বেঁচে থাকা তাই ধানভানা এক আনন্দময়ী গান! তবু
চাল ও চুলায় চন্দনখড়ি জ্বেলে পাতাল গল্প বলি:
(শিকড়গুচ্ছ: শাহেদ শাফায়েত)
স্বাদগন্ধ নিরুদ্দেশ। আমি তাই স্ত্রীলোকের আমন্ত্রণে গিয়ে
দেখেছি জলের পাত্রে দুধ আর দধির কলস ভরা জল।
আসলে দেখিনি, শুধু নিরাপদ বাক্যালাপে অনুমান করে
বুঝেছি নারীর সংগে প্রকাশ্যেও পুণ্যলাভ হয়।
(কর্মফল: মৃদুল দাশগুপ্ত)
এই সামান্যই, দেখেছি ভেজা চোখে পাহাড়ে আগুন জ্বালে ছেলেরা
আর মেয়েদের থানে থানে তখনো জেগে আছে বাল্বের আলো
ছেলেরা কলার গাছ কেটে আনে। পরদিন ভাসাবে বাউলের ভেলা
শিশিরের ছেলেরা খাবে বলে বসে আছে চায়ের ফোয়ারা
আমাদের গ্রামে ক্যান্টিনও ছিলো। তখনো বেঁচে ছিলো এক টাকা।
নন-সাইবেরিয়ান ঠাণ্ডা পালায় কাপের-পর-কাপে ঘা খেয়ে
(শীতকাল: পলাশ দত্ত)
শিল্প কি? এরকম প্রশ্ন যদি কাউকে করা যায় তবে তিনি কোন জটিলতায় না গিয়ে সরাসরি উত্তর দিতে পারেন ‘সুন্দর’ পৃথিবীর সমগ্র সুন্দরকেই আমরা শিল্প বলতে পারি, তা সে কৃষি কাজই হোক, ব্যবসার কাজই হোক, অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠানই হোক, হাড়ি-পাতিল তৈরি করাই হোক বা অন্যান্য আরও যা কিছু আছে তাই হোক, কাজ যখন সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই তাতে শিল্প ফুটে ওঠে যা আমাদের প্রত্যেকেরই সূক্ষ অনুভূতির জন্ম দেয়। অবশ্য, আজ যা সুন্দর ভবিষ্যতে তা সুন্দর নাও থাকতে পারে কেননা সুন্দরকে কে, কখন, কোথায়, কিভাবে করে তোলবেন তা তার সময়ের মানুষেরাই ভালো বুঝবেন। এই আপেকি বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই, সুন্দরের আখ্যান মানুষেরাই রচনা করবেন মানুষেরাই ভাঙবেন। এইসব ভাঙাগড়ার মধ্যেই কবি সুন্দরকে নিয়ে আসেন তাঁর কবিতায়। ফলে যে কবিতায় সুন্দরের প্রকাশ তা যে কোনো প্রকারের কবিতাই হোক না কেন উহা পাঠকের কবিতা, কেননা কবি যে সুন্দরকে কুড়িয়ে এনে জড়ো করেন কবিতায় তা কোন না কোনভাবে পাঠকেরই জন্যে সমাপিত হয়।
একজন কবির কতজন পাঠক থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করতে পারি? এখানে লেখা বাহুল্য যে, কবিকীর্তিটি স্পষ্ট করার জন্য ওই নির্দিষ্ট কবি ব্যতীত আর একজন পাঠকেরও দরকার নেই আসলে। এই প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হয়ত নিজের ঢোল নিজেই বাজাতে শুরু করবেন- যা একজন কবির কখনোই সংগত নয়। একটি কবিতা যখন কবিআত্মা থেকে মুক্তি পাবে তখন আরেকজন পাঠককে যদি স্পর্শ না করতে পারে তবে তা যথার্থ কবিতা কেন? অবশ্য পৃথিবীতে যত কবিতা লেখা হয়ে থাকে প্রতিটি কবিতাই- পাঠ নিশ্চয়তা নিয়ে আসে- কোন না কোনভাবে তা পঠিত হয়।
কবির নিজস্ব একজন পাঠকের প্রয়োজন আছে কি? না, তারও প্রয়োজন নেই কিন্তু কেউ যদি সাগ্রহে এসে কবির পাঠক হয়ে ওঠেন তবে এটা তাঁর কাব্যিক মহিমাগুণেই। ওই নির্দিষ্ট পাঠকটি অবশ্য তার কবির গুরুত্ব বুঝতে এবং কবিকে যাতে কোনভাবে অবহেলা বা অবিচার করতে না হয় সেজন্যেই তাকেও হয়ে ওঠতে হয় সামগ্রিক কবিতার একজন স্বচ্ছ পাঠক আর সমগ্র কবিতা বোঝার পরই কেবল পাঠক তার নিজস্ব কবিটিকে আলাদা করতে পারেন টোটাল কাব্যিক প্রতিবেশ থেকে। এরকম অভিজ্ঞ পাঠকই জরুরি অধুনান্তিক বাংলা কবিতায় যাঁর কথা ইতোমধ্যে আলোচনা করে এসেছি। শেষপর্যন্ত তার কবি হবে সেই সত্ত্বাটি যার কবিতা সাত্তি¡ক অবস্থান থেকেই শাসন করবে তার অন্তরাত্মা। সেই পাঠকটিই অর্জিত হওয়া কবিকীর্তির স্বার আর সেরকম নিবেদিত পাঠকেই মূলত কবিতার পাঠক বলা যায়। এও সত্য যে একজন কবি তাঁর যথার্থ সঞ্চারণটি পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে উপভোগ করতে চান প্রকৃত সেই উদ্ভাবনা শব্দের, যা তাঁর মধ্যে নিবেদনের ক্রিয়াটি জন্ম দিয়েছিলো, যে বিদগ্ধতায় তিনি অস্থির হয়েছিলেন। ফলে একজন কবির পাঠক তো জরুরিই সেক্ষেত্রে শিক্ষিত পাঠকটিই তাঁর বেশি প্রয়োজন যেখানে তাঁর নিগূঢ় নিবেদন বস্তুটি স্বযত্নে মূল্যায়িত হয়। বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, গীতা যেখানে এই নিবেদন বস্তুটির কথাই উল্লেখিত হয়েছে অজস্রবার। আমাদের জীবনাচারের কাব্যময়তা থেকে যার বিরূপ ক্রিয়াও আমরা উপলব্ধি করেছি এবং সেই প্রার্থিত সুন্দর মহাসময়ের অপেক্ষাও আমরা করছি যার অবমূল্যায়ন থেকে মূল্যায়নই জরুরি হয়ে পড়েছে।
কথা যে স্বয়ম্ভরসভাবে হাসায়, শব্দদের প্রতিভা সে জানে
মহাপ্রকৃতি যে নিয়মে স্নায়ুকে জাগায়, উদ্দীপ্ত করে রাখে
অন্বিষ্ট ব্যাখ্যান থেকে পরাজিত মানুষের বেদনা তুলে নিয়ে
সেও তো মৌলিক হলো, ঐ গান শঙ্খসমুদ্রে যেভাবে বেজেছে
মানবীর তন্তুতারে তার সুর বুঝি পড়োকান্না কালরাতে
যৌগিক সমুদ্রে খুব ঝড় হলো, প্রভাতে তার চিহ্ন মাত্র নেই।
(মানুষ মকর নয়, অন্যপ্রত্নজীব: কামরুল হাসান)
ধান ছড়ানোর বেলা শেষে
উঠানে করো কি বউ? ভাবের বিন্যাস।
ধানের গন্ধের নেশা বাতাস আক্রান্ত করে / অতঃপর চুলে
বেঁধে নিয়ে খোঁপার কৌশলে
একটি ফুলের গাথা কেমন মৌসুমভর / আসর জমায়।
(শস্য নয়, ভাবের পার্বণ: শুভাশিস সিনহা)
ওরে ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া
আসমানে উড়াল দিয়া তোমরা আসেন
মরুভুমিতে যায়া লড়িব আমরা / কার সনে তাহা বাবাই জানেন
ও বাবার দ্যাশের কড়ুয়া / ইসলাম জীন্দা হোতা হায়,
(ভাওয়াইয়া: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
একটা মুশকিল হলো, যতই আমরা সাহিত্য সাহিত্য বলে চরাই-উৎরাই করে ফেলি না কেন আমাদের এই বিচিত্র বঙ্গদেশ মূলত সাহিত্য মূল্যায়নের কোনো স্থান নয়। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে অসংখ্য অরজ্ঞানসম্পন্ন মূর্খের ভিড় আশেপাশে, বিচিত্র জাতের মানুষের হাতে আমাদের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলি জিম্মি হয়ে আছে। এদেশে লেখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া অত্যন্ত মুশকিল। এর চেয়ে বরং ওপার বাংলার সাহিত্য এখন জমজমাট, এদের হাতে রয়েছে প্রচুর পাঠক আর নিজস্ব ঐতিহ্যসম্পন্ন বিশাল বিশাল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যদিও সেগুলোতে কাঁঠালপাতা চিবানোর সংখ্যাই বেশি তারপরও এই প্রকৃতির লোক যত রয়েছে তারচেয়েও বেশি আছে কাঁঠালগাছ। ফলে শিল্প-সাহিত্যে তারাই অনেক এগিয়ে। সাহিত্যের মান খুব একটা আহামরি নয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই তো ঝড়ের গতিতে ছেয়ে যাচ্ছে বিশ্বময় অথচ আমাদের দেশে শিল্পঋদ্ধ প্রকাশনা সম্পন্ন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তাদের নিজেদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজস্ব গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। টোটাল সাহিত্যে খুব বেশি অবদান নেই অথচ আমাদের দেশেই ইসলামিক ফাউন্ডেশান গড়ে তোলছে তার শাখা-প্রশাখা থানায় থানায় আর আমাদের বাংলা একাডেমি বসে বসে আঙুল চুষছেন আর ভাবছেন সেই খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প, বেশ! আশ্চর্যই বটে, এহেন মনীষায় তারা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড!
এদেশে লেখার মূল্যায়ন আজও তৈরি হয়নি, আমাদেরই দীনতা প্রচুর কারণ নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যের লেখাটি আজও মূল্যায়ন করতে শিখেনি আমাদের লেখককুল, যেন সর্বদাই তাঁর ভেতরে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। আর এমন অনেক লেখক বন্ধুও রয়েছে যে, বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থটির পাশাপাশি আরও অনেক ঋদ্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর হাজার কপি গ্রন্থ কেনার জন্য টেলিফোন ব্যতীত পার্শ্ববর্তী গ্রন্থটির প্রশংসাও করতে জানেন না। শিক্ষামন্ত্রণালয়ও কম যান না, তাদের চোখে প্রকৃত মসিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতিগণ। যেখানে একটি পাখির কণ্ঠ বিশ্লেষণ করতে লেখক-কবি আপাদমস্তক নেমে পড়লেন পুটলাপুটলি নিয়ে তাঁর তো রাস্তায় বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা ওইসব প্রকাশক, কর্মকর্তারাই তো উঠে পড়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রীর বই হাজার হাজার কপি কেনার জন্য। এতগুলা দীনতা যে দেশে সে দেশে লেখক থাকার কি প্রয়োজন তা আমার জানা নেই।
No comments:
Post a Comment