কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত লেখক খালেকদাদ চৌধুরী। তাঁর একটি গল্প পাঠের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ২০০২ সালে। গল্পটির নাম ‘আবর্ত্ত’। সম্পাদকীয় লেখা থেকে জানা যায় এটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ রচনা। গল্পটি একজন প্রৌড়ার জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত। জনৈকা প্রৌড়ার পারিবারিক অস্তিত্ব, দাপট, ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে বিরোধিপক্ষের আঘাতে একে একে সাতটি সন্তানের মৃত্যু হয়। অথবা বলা যায় একমাত্র মাতৃপ্রীতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে সাতটি ছেলের আত্মাহুতির ঘটনা। গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা, আমার এ মতের কারণ নিশ্চয়ই জানবেন যে, গল্পটিতে পরিষ্কার কোনো বিষয়বস্তু (থিম) পাঠকের দরবারে তুলে দেওয়া হয়নি। বাস্তব কিংবা কল্পিত আখ্যান এটি; এরকম বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। যাহোক, গল্পটি আমার মধ্যে কৌতূহলী পাঠকসত্ত্বার উন্মোচন ব্যাতীত বিশেষ রেখাপাত করেনি তখন। তবু জন্মগতভাবে নেত্রকোণার একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম নিশ্চয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা লেখা বাহুল্য মনে করি, তাঁর ‘আবর্ত্ত’ গল্পটি না পড়লে জানতাম না যে, তিনি নেত্রকোণায় জন্মেছিলেন। সম্ভবত ভুল তথ্যেই আমি জানতাম খালেদা এদিব চৌধুরী নামে একজন নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণকারী লেখক। এই ‘আবর্ত্ত’ গল্পটি থেকেই মূলত খালেকদাদ চৌধুরীর সমগ্র সাহিত্যকীর্তিতে আমার অনুপ্রবেশের সূত্রমুখ ও সৃষ্ট অন্বেষী অভিপ্রায়। কালের বিচারে খালেকদাদ চৌধুরী ছিলেন বিগত শতকের ত্রিশের দশকের কথাসাহিত্যিক। এখানে উলেøখ রাখা ভালো যে, তাঁর ক্ষেত্রে এই ত্রিশের দশকের লেখক বিবেচনা কখনো কখনো সাহিত্যিক বিতর্কের কারণ হয়ে ওঠতে পারে। ছাত্রজীবনে ১৯২৩ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বিকাশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ এবং পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক কবি বন্দে আলী মিয়া তাৎক্ষণিক আরো লেখা চেয়ে চিঠি লিখলে যথারীতি ছোটগল্পসহ বেশ কয়েকটি লেখা প্রেরণ ও মুদ্রণের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রাথমিক সাহিত্যের অবতাড়না হলেও তিনি প্রকৃত সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ১৯৩০ সালের পরে, কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতাকালীন প্রধান শিক্ষক কবি আবদুল কাদিরের অন্যতম সাহচর্যে। ফলে তাঁকে লেখককাল বিবেচনায় চল্লিশের লেখক বলে যদি কেউ প্রজ্ঞা করেন তাতেও খুব বেশি ভ্রম হবাব অবকাশ নাই। আমি তাঁকে জন্মকাল ধরেই সাহিত্যিক বিবেচনায় এনেছি। কাজেই এ বিষয়ে অন্তত দ্বিমতপোষণ বা সংঘশক্তি প্রয়োগে চূড়ান্ত দশক নির্ধারণ প্রবৃত্তির প্রয়োজন পড়বে না।
তাঁর সমকালে তিনি খুব জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন আজকের বিশ্লেষণী সাহিত্য বিবেচনায় সেটি হলপ করে বলা মুশকিল। বরং তাঁর সময়ে উচ্চ সাহিত্যমার্গ বিবেচনায় তিনি কিছুটা পিছিয়েই ছিলেন, বোধ করি প্রতিবেশ এবং পেশাগত সাহিত্যিক, সামাজিক অবস্থানই এর প্রধান কারণ। কথাবস্তুতে খালেকদাদ যে বিষয় এবং ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা ছিলো বৃহত্তর ময়মনসিংহের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক কোনো কোনো প্রেক্ষাপট। বলা যায় চিরায়ত বাংলার সুবর্ণ-সবুজ অধ্যায় তথা লোকমানসই তাঁর সাহিত্যের মূলভিত্তি। কবিতায় পল্লিকবি জসীম উদ্দীন, কথাসাহিত্যে এ সময়ের শওকত আলী (প্রদোষে প্রাকৃতজন-এ) যে বিষয়ভিত্তিক অবস্থানে সফল ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই মূলত খালেকদাদ চৌধুরীর মূল কথাভাষ্যটি নির্মিত হয়। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ তিনি যে কোথাও কোথাও জনপ্রিয় ছিলেন সেই দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের পত্রতাগিদে।
ব্যক্তি জীবনের অবদমন প্রথা কখনো কখনো লেখকের সাহিত্যকীর্তিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শুধু লেখক বলে নয়, সামাজিক এই দুর্ধর্ষ অবদম অনাকাক্ঙ্ক্ষিতভাবে যে কারোরই মধ্যে জারিত হতে পারে। বোধ করি খালেকদাদ তাঁর সাহিতত্যিক জীবনে এই অবদমনের শিকার। ফলে সাহিত্যিক অবস্থানসহ তাঁর পশ্চাদপদতা ব্যাতীত কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারভূঁঞা আমলের অন্যতম বংশাতিবংশ তাঁরা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমলে কোম্পানি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁদের পূর্ব-পুরুষ ঢাকার গাজীপুর অঞ্চলে আশ্রয় নেন। পরবর্তিতে তাদেরই অধস্তন পুরুষ গাজী লস্কর ও গাজী আসকর নামে দুই ভাই আলপসিং পরগনায় চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। ছোটভাই গাজী আসকর নেত্রকোণা অঞ্চলের আটপাড়া থানায় সোনাজোড় গ্রামে স্থায়িভাবে বসতি গড়ে তোলেন। খালেকদাদ চৌধুরী এই গাজী আসকরেরই অধঃস্থন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন। ধারণা করা যায়, তাঁর পরিবার ঐতিহাসিক এতবড় একটি পরাজয়ের যে গ্লানি বহন করে চলেছিল এর বৃহত্তর প্রভাবও খালেকদাদের সাহিত্যিক প্রবণতাকে কোথাও কোথাও অবদমিত করে রেখেছিল অবচেতনে। মহাত্মা আহমদ ছফার যুক্তি (থিয়োরি) এখানে যোগ করতে চাই। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ লিখতে গিয়ে তিনি এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলেন যে, সামাজিক জীবনে আমরা চলায়, ফেরায়, বলায় তথা কর্মে এরকম একটি উপাসক প্রতিমূর্তি (আইডল) নির্মাণ করি, যেটি আমাদেরই ঈশ্বরের প্রতিরূপ পূজনিয়। নির্মাণের কারিগর ব্যাক্তি (আমাদের) কথা বাদ দিলে অন্তত উক্ত উপাসক বা প্রোফেট চরিত্রটির নিজস্ব ভাবাবেগ, স্বকিয়তা বা পার্সোনালিটি থাকে না। মোতাহার হোসেন চৌধুরীর যুক্তি অবশ্য এর বিপরীতে। ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে তিনি এই ঈশ্বরের প্রতিরূপ ব্যক্তিস্বত্তাটি নিজের মধ্যেই স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আমার আজকের অবস্থান সেখানে নয়। খালেকদাদ তাঁর সাহিত্যকীর্তিতে এইরূপ অনাকাক্ঙ্ক্ষিত প্রভাব, প্রবণতা দ্বারা কোথাও তাড়িত হননি সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হওয়া যায় না। এতদস্বত্ত্বেও উপন্যাসে তাঁরই সৃষ্টি সেইরূপ কোনো কোনো চরিত্র যেন আমাদের (পাঠকের) দরবারে আর্তি জানিয়েছে বারবার। ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে দিয়ারিশ, ‘চাঁদবেগেড় গড়’এ ডাকাত চাঁদবেগ, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ গায়বী বাবা তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
এ যাবৎ আমার খালেকদাদ রচিত উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’, ‘চাঁদবেগেড় গড়’, আত্মজীবনী ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’, অনুবাদ-ভ্রমণ ‘মরু সাহারায়’, ইতিহাস গ্রন্থ ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ছোটগল্প পাঠব্যাতীত আর কোনো গ্রন্থপাঠের সৌভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি কেননা তাঁর সকল গ্রন্থই এখন অনেকাংশে পাওয়া দুর্লভ। খালেকদাদ চৌধুরী রচিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব মিলিয়ে ১৫টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে উল্লেখিত গ্রন্থগুলো ব্যাতীত উপন্যাস ‘এ মাটি রক্তে রাঙা’, ‘অভিশপ্ত মসনদ’, ‘শেষ রণাঙ্গন’, ‘বেদুঈনের মেয়ে’, ‘আলবকর দ্বীপ’ দুটি অনুবাদ গ্রন্থসহ বেশকটি অনুবাদ গ্রন্থও তাঁর রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এইসব গ্রন্থসমুচয়ের প্রকাশকগণ গ্রন্থগুলোর প্রকাশনা, পুনমুদ্রণ বিষয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ আজো নিচ্ছেন না। খালেকদাদ চৌধুরীর ভাতিজা, নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের অন্যতম সংগঠক, সম্পাদক কামরুজ্জামান চৌধুরীর বরাতে জানা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ ইতিহাস অনুবাদ গ্রন্থটি চারখণ্ড একত্রে সম্প্রতি দিব্য প্রকাশের সত্ত্বাধিকারি মঈনুল আহসান সাবের প্রকাশ করেছেন। ০২ ফেব্রæয়ারি ২০০৭ তাঁর জন্মের ১০০ বছর এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ২৪ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি বাংলাদেশে, বাংলাভাষার বাঘা এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি খালেকদাদ চৌধুরী রচনাবলি প্রকাশের কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রকাশনা সংক্রান্ত কোনো খোঁজ-খবরও নেয়নি। উল্লেখ্য তাঁর সময়ে মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, দিলরুবা, যুগবাণী, সচিত্র সন্ধানী, পাকিস্থান খবর, প্রতিধ্বনি এইসব বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকায় বিভিন্ন সময়-সংখ্যায় লেখা ছোটগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রবন্ধ, (প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়ে) লেখাগুলোর সন্ধান, সংরক্ষণ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ কথাটি সর্বাগ্রে সত্য না হলেও কখনো কখনো তা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে সমাজের সঠিক দর্পণই বলা যেতে পারে। আর উপন্যাস, গল্পের ক্ষেত্রে যেখানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কাহিনী, নাটকীয়তা, চরিত্র তথা আখ্যান বিবৃডিতটিই হয়ে ওঠে সমাজের দর্পণ সেখানে কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর রচনায় এই গুণাগুণ অনেকাংশেই বিস্তৃত। তাছাড়া এই বৈশিষ্টটিতাঁর স্বভাবজাত, যাপিত জীবনের মধ্যেই ছিল। কখনো উপমাগুণে, কখনো রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে কল্পনায় আবার কখনো তিনি ঐতিহাসিক সত্যেই নির্মিত করেছিলেন গ্রমীণ জীবনের বিশুদ্ধ আখ্যান বা তাঁর দুর্লভ কথাভাণ্ডার। এমনই একটি বিশুদ্ধ আর্তিতে ওঠে আসে তাঁর উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’। প্রধান চরিত্র দিয়ারিশ। আমরা দেখি, তৎকালিন পাষণ্ড সমাজ ব্যবস্থায় কূটচক্রের শিকারে কী করে নির্দোষ দিয়ারিশের জীবন বিপণ্ন হতে হতে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। প্রথমে গ্রামবাসির কূটচক্রের শিকার। সুন্দরী স্ত্রীসহ রাতে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র এক জমিদারের আশ্রিত। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে বিশ্বস্ততা অর্জন। সেখানেও স্বস্তিতে থাকে না দিয়ারিশ। জমিদার-বধূ কর্তৃক পুনরায় কূটচক্রের শিকারে দীর্ঘ জেলযাপন। অবশ্য এ স্থানে এসে ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে ঔপন্যাসিক খালেকদাদের প্রবল নাটকীয়তা উপলব্ধি করা যায়। দিয়ারিশের সুন্দরী কন্যার প্রেমেমুগ্ধ জমিদারের দুইপুত্র। একে-অপরের দ্বন্দ এবং এক ভাইয়ের হাতে অন্য ভাই খুন হওয়ার ঘটনাটিই মূলত ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’ উপন্যাসকে এবং ঔপন্যাসিক খালেকদাদ চৌধুরীকে যথার্থ ঔপন্যাসিক মর্যাদায় উন্নীত করে। আর করুণ আর্তির দিয়ারিশ চরিত্রটি হয়ে ওঠে তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক নায়ক।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ খালেকদাদ চৌধুরীর কথাসাহিত্যিক প্রবণতা আরো ঝরঝরে, উজ্জ্বল। গল্পচরিত্র গায়বী বাবার মধ্য দিয়েই তিনি বিবৃত করেছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফকির বিদ্রোহের কাহিনী। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ সত্যিকার নায়েবে নাজেম মজনু শাহ (নবাব নূর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জঙ্গ বাহাদুর) এর কাহিনী। কিছুটা কল্পনাশ্রয় ব্যাতীত উপন্যাসটি ঐতিহাসিক সত্যেই রচিত। গায়বী বাবা চরিত্রটি যে খালেকদাদের স্বয়ং সে বিষয়ে ঘাগু পাঠকমাত্রই সহজে অনুমেয়। উপন্যাসটি তাঁর পূর্বপুরুষাশ্রয়ী, সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, কোম্পানি যুদ্ধ, মীর জাফর, মীর কাসিম, রাজা রাজবল্লব, জগৎ শেঠ, ফকির নেতা মজনু শাহ, টিপু পাগলা, জেনারেল কীড, এইমলি এইসব চরিত্র তথা ঘটনা বর্ণনাই তা প্রমাণ করে। উপন্যাসটি রচনায় খালেকদাদ কেন যে সম্পূর্ণ ইতিহাসাশ্রয়ী হননি সেটি অবশ্য প্রশ্নই থেকে যায়। এ বিষয়ে তার নিজের ভাষ্য...
‘দিলিøর মোঘল সম্রাট আকবর, ঈশা খাঁ-কে যে বাইশটি পরগণা দান করেছিলেন, শেরপুর দক্ষবাড়িয়া তার অন্যতম। ঈশা খাঁ-র শেষ জীবনে তার দৌর্বল্যের সুযোগে তাঁর সেনাপতি আফগান গাজীরা শেরপুর দক্ষবাড়িয়া, ভাওয়াল পরগণা এবং মজলিশরা, খালিয়াজুড়ি ও নাসিরুজিয়াল পরগণা কেড়ে নিয়ে নিজেদের সেখানকার স্বাধীন ভূ-স্বামী শের আলী গাজীর নামানুসারে সে পরগণার নাম হয় শেরপুর। শের আলী গাজীকে এক হীনষড়যন্ত্রজালে জড়িত করে শেরপুর জায়গীরদারী থেকে বঞ্চিত করা হয়। কথিত আছে যে, দর্শার কানুন গো সেরেস্তাদার কর্মচারী বৈদ্যরাজবল্লব মজুমদারের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর প্রতি শের আলী গাজী আকৃষ্ট হন। তিনি নাকি তাকে লাভ করার জন্য গোপনে রামবল্লবকে হত্যা করান। রামবল্লবের স্ত্রী পালিয়ে তার পিত্রালয় মুর্শিদাবাদে চলে যায় এবং নওয়াব দরবারে শের আলীর বিরুদ্ধে নালিশ করে। শের আলী গাজীকে পদচ্যুত করে তার জায়গীরদারী রামবল্লবের বিধবাকে দান করেন।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’-এর পটভূমিকা এ পর্যন্তই। বাকিটুকু নিছক উপন্যাস এবং কল্পনাপ্রসূত। উপন্যাসের সার্থকতা পাঠকের বিচারের উপর নির্ভরশীল, সে ভার সহৃদয় পাঠকের / পাঠকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
স্বাধিনতা দিবস ১৯৬৬, নেত্রকোণা খালেকদাদ চৌধুরী
আমাদের অতীত মানে সুবর্ণঅতীত। আমরা অনেক কিছুই স্মৃতিতে রাখি না। এটা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যজনক! এ স্থানে এসে আবিস্কৃত হয় যে খালেকদাদ চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ উপন্যাসের মূল ভিত ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলের ফকির অভিযান থেকে শুরু করে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত শেরপুর নছরত শাহী পরগণা, টিপু পাগলের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধিন হওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আজকের সময় পর্যন্ত এসে যদি গড় বিবেচনায় স্থিত হই যে এই উপন্যাস খুঁড়ে-ছেনে বাঙালি জাতির অন্তত ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের সূত্রমুখ তথা সত্যাসত্য ঘটনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে। তাতেও পাঠকের অত্যুক্তি হওয়ার অবকাশ থাকবে না। স্থানিক, ভাষিক উপস্থাপন-এষণা এবং সে বিষয়ে যৌক্তিক অবতাড়না আজ আর নয়। তাঁর সময়ের অনেক লেখককেই তো আরো বিস্তৃত ব্যাপক প্রকাশনায় পেয়েছি, জেনেছি। এমনকি পাঠ্যসূচিতেও। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রসংগ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। খালেকদাদ চৌধুরীর সাংবাদিক জীবনে যিনি ছিলেন দৈনিক নবযুগ প্রধান সম্পাদক এবং সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব বা সাংবাদিকতা সংসর্গই নয় কবি নজরুলের সাহিত্যিক সংসর্গেও যে খালেকদাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন সে সম্পর্কে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দিন খালেকদাদ লোকান্তরিত হওয়ার পর এক নিবন্ধে লিখেন...
সেকালের তরুণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য তারকা জ্বলছিল, যার যতটুকু ক্ষমতা সেইমতো আলো বিকিরণ করছিল। একে একে সবাই বিদায় নিচ্ছেন। খালেকদাদ চৌধুরীর পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ তারকাটি খসে পড়লো।’
কবি নজরুলের কিংবদন্তি সাহিত্যের তুলনা না করলেও খালেকদাদ চৌধুরীর সমকালিন সাহিত্যিক কবি জসিম উদ্দিন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবু জাফর শামসুদ্দিন, শওকত ওসমান প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরীসহ অনেকের লেখা আমরা ব্যাপক প্রকাশিত ও পাঠ্য হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু খালেকদাদ অপঠিত থেকে গেছেন। এটা সত্য এবং লজ্জাকর।
কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, তিনি বিবৃতিপ্রধান লেখক ছিলেন। উপন্যাস, গল্পের প্রধান চরিত্রটির মধ্য দিয়ে গল্প তৈরির অভিনব কৌশুলীয় ছিলেন বটে। এই কৌশলের মাধ্যমেই তিনি তাঁর উপন্যাস, গল্পের মূল বিষয়টির ইংগিত প্রদান করতেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই গল্পময়তা বিষয়টি কথাসাহিত্যের আদিতেই ছিল। স্থান, কাল, পাত্র এবং ব্যাপ্তীগুণেই কথাসাহিত্যের পাঠক / শ্রোতাগণ উপন্যাসের সঠিক অবস্থানটি শনাক্তকরণ বা অভিযোজনের কাজটি সমাপ্ত করতে পারতেন। ‘চাঁদবেগের গড়’এ এসে প্রবলভাবে উপলব্ধি হয় যে, তাঁর এ উপন্যাসটি শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের দুঃখ, দুর্দশা তথা দৈন্যপীড়িত মানুষের প্রপীড়ণের চিত্রই নয় বরং এর ভিতরেই লুকিয়ে ছিল জাতিগত প্রপীড়ণমালার অন্য এক ইতিহাস। অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া, নীলকর, বৃটিশদের অত্যাচারের বিপরীতে ডাকাত চাঁদবেগের ভূমিকাটি যে প্রতিবাদী সত্ত্বাই ছিল সে বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ উন্মোচন করেন নাই। সে সময় কথাসাহিত্যের মননের চর্চায় তার প্রয়োজন হতো না নিশ্চয়ই। ডাকাত চাঁদবেগের সেই অপ্রকাশিত মহিমা বস্তুটিই ছিল পাঠকশিক্ষার জায়গা।
কথাসাহিত্যে খালেকদাদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি রোমান্টিকতা বর্জিত লেখক ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালুতে যেমন রোমান্টিকতার প্রয়োজন ছিল না। ঠিক তথাকথিত অর্থেও নয় তাঁর লেখক বৈশিষ্ট্যটেও বোধহয় বিষয়টি ছিল না। অনেকানেক যুক্তি হলো, ইতিহাস বিবৃতিই এর প্রধান কারণ ছিল। তাই বলে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’কে যদি কেউ রোমান্টিকতা বর্জিত আধুনিক উপন্যাস ভাবেন সেটা ভুল হবে। বরং বিষয় বিবেচনায় এ দুটি উপন্যাস অধিক সঞ্চারিত করে আমাকে। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর সময়ে অপঠিত ছিলেন বিষয়টি সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্যজনক কিংবা লজ্জাকর না ভেবে এরকম বিষয় ভাবা যেতে পারে। সমস্যা এখানেও আছে, কোনো রোমান্টিকতার ছাঁচে ফেলে তাঁর প্রবণতাকে খারিজ করা অসম্ভব। সিরিয়াস কথাসাহিত্য পাঠকের কাছে অন্তত এই যুক্তি অবান্তর ঠেকতে পারে। কথাসরিৎসাগরের টোটালিটি ধারণ করে যদি কোনো পাঠক বিষয়টি রোমান্টিক বলে আমলে আনেন তবে সেখানে যুক্তি প্রযোগের চেষ্টাও বৃথা যেতে পারে। পাঠক ক্যাটাগরিই মুখ্য। আজকের বিবেচনায় খালেকদাদ অবশ্য অন্য এক অনন্য সাহিত্যমাত্রিক সামগ্রিক।
খালেকদাদ চৌধুরী নামটি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিক পরিচয়েই নয় প্রত্যক্ষ একজন সমাজ সংগঠকের ভূমিকাও যথার্থ উজ্জ্বল। ষাট-সত্তুর-আশির দশকে খালেকদাদ চৌধুরী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ এবং ‘সৃজনী’ নামক ছোটকাগজটি ঘিরে নিভৃতপ্রায় একটি মফস্বল শহরের তথা সারাদেশের অগ্রজ-অনুজ লেখকদের মধ্যে যে চঞ্চলতার ধারা প্রবাহিত হয়েছিল, সেই কৃতিত্বও খালেকদাদ চৌধুরীর নিজের মহিমাগুণে। এই ‘উত্তর আকাশ’ থেকেই আমরা পেয়েছি নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘নূতন কাণ্ডারী’ (যিনি আজকের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ)। এছাড়াও রওশন ইজদানী, জালাল উদ্দিন খাঁ, রফিক আজাদ, নূরুল হক, আসাদ চৌধুরী, হুমায়ূন আজাদ, আশরাফ সিদ্দিকী, বশির আল হেলাল, আহমদ রফিক, শামসুল ইসলাম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, হেলাল হাফিজ, শামসুল আরেফিন, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ লেখকদের বিভিন্ন রচনা আমরা পাঠ করেছি ‘উত্তর আকাশ’ ও ‘সৃজনী’ থেকেই। নির্মলেন্দু গুণের নিজের লেখা থেকে এ কথার সত্যতা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে...
‘আমি এক কথায় বলতে পারি, তিনি, খালেকদাদ চৌধুরী আমাদের নেত্রকোণার দর্পণ। তাঁর উদার নেত্রের কোণায় ছায়া ফেলেছিল এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ। তিনি সেইসব মানুষের সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন সাফল্যের সঙ্গে তাঁর উপন্যাসে, গল্পে। সেকথা আমরা তাঁর রচনা থেকে জানি। কিন্তু নেত্রকোণার মতো আর্য-অগম্য একটি মফস্বল গ্রামে জন্মগ্রহণ করে, তিনি কিভাবে বিভাগপূর্ব কলকাতার রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক কল্লোলে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, সেখানে তাঁর ভূমিকা কী ছিল তা আমাদের সকলের জানা ছিল না। আমাদের জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি এঁকেছেন ওই সময়ের রেখাচিত্র। ফলে, নবজাগরণ প্রত্যাশী মুসলমান সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা, কবি নজরুল, মাওলানা আকরাম খাঁ, ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, কবি আবদুল কাদির, বন্দে আলী মিয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি মহীউদ্দীন-এঁরা সবাই খালেকদাদ চৌধুরীর নেত্রকোণায় কিছুটা ভিন্নভাবে ধরা পড়েছেন।’
নেত্রকোণা জেলার প্রথম গ্রাজুয়েট ও নেত্রকোণা পৌরসভার প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান, আঞ্জুমান হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আইনজীবী মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান নেত্রকোণার আপামর মানুষকে নির্দেশনা দিতে যে সুন্দর শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, বলা যায়, খালেকদাদ চৌধুরী তারই বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে। নেত্রকোণা সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতার সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না। গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রবীণ কর্মকর্তা মোর্শেদ আলী খানের দেয়া তথ্যমতে, প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলী ওসমান সিদ্দিকী। খালেকদাদ চৌধুরী দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকাকালিন গ্রন্থাগারটি বকুলতলায় একটি বড় পরিসরে স্থানান্তর এবং দ্বিতল ভবন নির্মাণে তাঁর বিশেষ অবদানই প্রধান ভূমিকা ছিল। নেত্রকোণার আজকের গণমানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্যে অগ্রণী ভূমিকায় নিয়ে আসতে মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান ও কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর ভূমিকা অমলিন, অনসীকার্য। সৈয়দ শামসুল হকের একটি উদ্বৃতি দিয়ে প্রবন্ধের প্রাথমিক অবতাড়না সমাপ্ত রাখছি...
‘এই শহর (নেত্রকোণা) ও অঞ্চল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পেলাম এখান থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র সৃজনীতে। শুধু ইতিহাস নয়। এখানকার লেখকদের সৃষ্টিশীল লেখারও ভালো সাক্ষাতও পাওয়া গেল এর পাতায়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করি যে, ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত বলেই পত্রিকাটি সাহিত্য সংস্কৃতির মূলধারা থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন নয়। খুবই উন্নতমানের এই সাহিত্য পত্রিকাটি আমি যে আগে কখনো দেখিনি, একটু লজ্জিত বোধ করলাম; সর্বাধুনিক সংখ্যাটি দেখতে চাইলাম। জানতে পারলাম এর সম্পাদক খালেকদাদ চৌধুরী লোকান্তরিত হবার পর এখন পর্যন্ত এমন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সম্পাদনার দায়িত্ব বহন করতে পারেন। কাজেই পত্রিকাটি বের হয় না। এটিও আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো।’
তথ্যসূত্র:
১. ছোটগল্পের কথা: রথীন্দ্রনাথ রায়, সুপ্রকাশ প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-১৯৫৯
২. বাঙালি মুসলমানের মন: আহমদ ছফা, বাংলা একাডেমি-১৯৮১
৩. শতাব্দীর দুই দিগন্ত: খালেকদাদ চৌধুরী, সুনেত্র-১৯৯৫
৪. জীবনী গ্রন্থমালা, খালেকদাদ চৌধুরী: ইমামুর রশীদ, বাংলা একাডেমি-১৯৯৭
৫. উত্তর আকাশ (পাক্ষিক)
৬. সৃজনী (সাহিত্য পত্রিকা): ১৩তম সংখ্যা, বৈশাখ-১৩৯১, এপ্রিল-১৯৮৪
৭. স্টাইলের দড়ি-খুঁটি, একটি বাস্তবের সামিয়ানা: সাধন চট্টোপাধ্যায়, নিসর্গ: সম্পাদক-সরকার আশরাফ
৮. সওগাত: বৈশাখ-১৩৪০ সংখ্যা
৯. মাহে নও: মার্চ ১৯৫৬, চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যা
১০. মাসিক মোহাম্মদী: ১০ম বর্ষ, ৭তম-৮ম-৯বম সংখ্যা
তাঁর সমকালে তিনি খুব জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন আজকের বিশ্লেষণী সাহিত্য বিবেচনায় সেটি হলপ করে বলা মুশকিল। বরং তাঁর সময়ে উচ্চ সাহিত্যমার্গ বিবেচনায় তিনি কিছুটা পিছিয়েই ছিলেন, বোধ করি প্রতিবেশ এবং পেশাগত সাহিত্যিক, সামাজিক অবস্থানই এর প্রধান কারণ। কথাবস্তুতে খালেকদাদ যে বিষয় এবং ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা ছিলো বৃহত্তর ময়মনসিংহের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক কোনো কোনো প্রেক্ষাপট। বলা যায় চিরায়ত বাংলার সুবর্ণ-সবুজ অধ্যায় তথা লোকমানসই তাঁর সাহিত্যের মূলভিত্তি। কবিতায় পল্লিকবি জসীম উদ্দীন, কথাসাহিত্যে এ সময়ের শওকত আলী (প্রদোষে প্রাকৃতজন-এ) যে বিষয়ভিত্তিক অবস্থানে সফল ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই মূলত খালেকদাদ চৌধুরীর মূল কথাভাষ্যটি নির্মিত হয়। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ তিনি যে কোথাও কোথাও জনপ্রিয় ছিলেন সেই দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের পত্রতাগিদে।
ব্যক্তি জীবনের অবদমন প্রথা কখনো কখনো লেখকের সাহিত্যকীর্তিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শুধু লেখক বলে নয়, সামাজিক এই দুর্ধর্ষ অবদম অনাকাক্ঙ্ক্ষিতভাবে যে কারোরই মধ্যে জারিত হতে পারে। বোধ করি খালেকদাদ তাঁর সাহিতত্যিক জীবনে এই অবদমনের শিকার। ফলে সাহিত্যিক অবস্থানসহ তাঁর পশ্চাদপদতা ব্যাতীত কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারভূঁঞা আমলের অন্যতম বংশাতিবংশ তাঁরা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমলে কোম্পানি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁদের পূর্ব-পুরুষ ঢাকার গাজীপুর অঞ্চলে আশ্রয় নেন। পরবর্তিতে তাদেরই অধস্তন পুরুষ গাজী লস্কর ও গাজী আসকর নামে দুই ভাই আলপসিং পরগনায় চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। ছোটভাই গাজী আসকর নেত্রকোণা অঞ্চলের আটপাড়া থানায় সোনাজোড় গ্রামে স্থায়িভাবে বসতি গড়ে তোলেন। খালেকদাদ চৌধুরী এই গাজী আসকরেরই অধঃস্থন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন। ধারণা করা যায়, তাঁর পরিবার ঐতিহাসিক এতবড় একটি পরাজয়ের যে গ্লানি বহন করে চলেছিল এর বৃহত্তর প্রভাবও খালেকদাদের সাহিত্যিক প্রবণতাকে কোথাও কোথাও অবদমিত করে রেখেছিল অবচেতনে। মহাত্মা আহমদ ছফার যুক্তি (থিয়োরি) এখানে যোগ করতে চাই। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ লিখতে গিয়ে তিনি এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলেন যে, সামাজিক জীবনে আমরা চলায়, ফেরায়, বলায় তথা কর্মে এরকম একটি উপাসক প্রতিমূর্তি (আইডল) নির্মাণ করি, যেটি আমাদেরই ঈশ্বরের প্রতিরূপ পূজনিয়। নির্মাণের কারিগর ব্যাক্তি (আমাদের) কথা বাদ দিলে অন্তত উক্ত উপাসক বা প্রোফেট চরিত্রটির নিজস্ব ভাবাবেগ, স্বকিয়তা বা পার্সোনালিটি থাকে না। মোতাহার হোসেন চৌধুরীর যুক্তি অবশ্য এর বিপরীতে। ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে তিনি এই ঈশ্বরের প্রতিরূপ ব্যক্তিস্বত্তাটি নিজের মধ্যেই স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আমার আজকের অবস্থান সেখানে নয়। খালেকদাদ তাঁর সাহিত্যকীর্তিতে এইরূপ অনাকাক্ঙ্ক্ষিত প্রভাব, প্রবণতা দ্বারা কোথাও তাড়িত হননি সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হওয়া যায় না। এতদস্বত্ত্বেও উপন্যাসে তাঁরই সৃষ্টি সেইরূপ কোনো কোনো চরিত্র যেন আমাদের (পাঠকের) দরবারে আর্তি জানিয়েছে বারবার। ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে দিয়ারিশ, ‘চাঁদবেগেড় গড়’এ ডাকাত চাঁদবেগ, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ গায়বী বাবা তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
এ যাবৎ আমার খালেকদাদ রচিত উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’, ‘চাঁদবেগেড় গড়’, আত্মজীবনী ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’, অনুবাদ-ভ্রমণ ‘মরু সাহারায়’, ইতিহাস গ্রন্থ ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ছোটগল্প পাঠব্যাতীত আর কোনো গ্রন্থপাঠের সৌভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি কেননা তাঁর সকল গ্রন্থই এখন অনেকাংশে পাওয়া দুর্লভ। খালেকদাদ চৌধুরী রচিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব মিলিয়ে ১৫টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে উল্লেখিত গ্রন্থগুলো ব্যাতীত উপন্যাস ‘এ মাটি রক্তে রাঙা’, ‘অভিশপ্ত মসনদ’, ‘শেষ রণাঙ্গন’, ‘বেদুঈনের মেয়ে’, ‘আলবকর দ্বীপ’ দুটি অনুবাদ গ্রন্থসহ বেশকটি অনুবাদ গ্রন্থও তাঁর রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এইসব গ্রন্থসমুচয়ের প্রকাশকগণ গ্রন্থগুলোর প্রকাশনা, পুনমুদ্রণ বিষয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ আজো নিচ্ছেন না। খালেকদাদ চৌধুরীর ভাতিজা, নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের অন্যতম সংগঠক, সম্পাদক কামরুজ্জামান চৌধুরীর বরাতে জানা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ ইতিহাস অনুবাদ গ্রন্থটি চারখণ্ড একত্রে সম্প্রতি দিব্য প্রকাশের সত্ত্বাধিকারি মঈনুল আহসান সাবের প্রকাশ করেছেন। ০২ ফেব্রæয়ারি ২০০৭ তাঁর জন্মের ১০০ বছর এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ২৪ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি বাংলাদেশে, বাংলাভাষার বাঘা এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি খালেকদাদ চৌধুরী রচনাবলি প্রকাশের কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রকাশনা সংক্রান্ত কোনো খোঁজ-খবরও নেয়নি। উল্লেখ্য তাঁর সময়ে মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, দিলরুবা, যুগবাণী, সচিত্র সন্ধানী, পাকিস্থান খবর, প্রতিধ্বনি এইসব বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকায় বিভিন্ন সময়-সংখ্যায় লেখা ছোটগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রবন্ধ, (প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়ে) লেখাগুলোর সন্ধান, সংরক্ষণ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ কথাটি সর্বাগ্রে সত্য না হলেও কখনো কখনো তা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে সমাজের সঠিক দর্পণই বলা যেতে পারে। আর উপন্যাস, গল্পের ক্ষেত্রে যেখানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কাহিনী, নাটকীয়তা, চরিত্র তথা আখ্যান বিবৃডিতটিই হয়ে ওঠে সমাজের দর্পণ সেখানে কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর রচনায় এই গুণাগুণ অনেকাংশেই বিস্তৃত। তাছাড়া এই বৈশিষ্টটিতাঁর স্বভাবজাত, যাপিত জীবনের মধ্যেই ছিল। কখনো উপমাগুণে, কখনো রূপক, চিত্রকল্পের ব্যবহারে কল্পনায় আবার কখনো তিনি ঐতিহাসিক সত্যেই নির্মিত করেছিলেন গ্রমীণ জীবনের বিশুদ্ধ আখ্যান বা তাঁর দুর্লভ কথাভাণ্ডার। এমনই একটি বিশুদ্ধ আর্তিতে ওঠে আসে তাঁর উপন্যাস ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’। প্রধান চরিত্র দিয়ারিশ। আমরা দেখি, তৎকালিন পাষণ্ড সমাজ ব্যবস্থায় কূটচক্রের শিকারে কী করে নির্দোষ দিয়ারিশের জীবন বিপণ্ন হতে হতে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। প্রথমে গ্রামবাসির কূটচক্রের শিকার। সুন্দরী স্ত্রীসহ রাতে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র এক জমিদারের আশ্রিত। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে বিশ্বস্ততা অর্জন। সেখানেও স্বস্তিতে থাকে না দিয়ারিশ। জমিদার-বধূ কর্তৃক পুনরায় কূটচক্রের শিকারে দীর্ঘ জেলযাপন। অবশ্য এ স্থানে এসে ‘একটি আত্মার অপমৃত্যুতে ঔপন্যাসিক খালেকদাদের প্রবল নাটকীয়তা উপলব্ধি করা যায়। দিয়ারিশের সুন্দরী কন্যার প্রেমেমুগ্ধ জমিদারের দুইপুত্র। একে-অপরের দ্বন্দ এবং এক ভাইয়ের হাতে অন্য ভাই খুন হওয়ার ঘটনাটিই মূলত ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’ উপন্যাসকে এবং ঔপন্যাসিক খালেকদাদ চৌধুরীকে যথার্থ ঔপন্যাসিক মর্যাদায় উন্নীত করে। আর করুণ আর্তির দিয়ারিশ চরিত্রটি হয়ে ওঠে তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক নায়ক।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’এ খালেকদাদ চৌধুরীর কথাসাহিত্যিক প্রবণতা আরো ঝরঝরে, উজ্জ্বল। গল্পচরিত্র গায়বী বাবার মধ্য দিয়েই তিনি বিবৃত করেছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফকির বিদ্রোহের কাহিনী। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ সত্যিকার নায়েবে নাজেম মজনু শাহ (নবাব নূর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জঙ্গ বাহাদুর) এর কাহিনী। কিছুটা কল্পনাশ্রয় ব্যাতীত উপন্যাসটি ঐতিহাসিক সত্যেই রচিত। গায়বী বাবা চরিত্রটি যে খালেকদাদের স্বয়ং সে বিষয়ে ঘাগু পাঠকমাত্রই সহজে অনুমেয়। উপন্যাসটি তাঁর পূর্বপুরুষাশ্রয়ী, সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, কোম্পানি যুদ্ধ, মীর জাফর, মীর কাসিম, রাজা রাজবল্লব, জগৎ শেঠ, ফকির নেতা মজনু শাহ, টিপু পাগলা, জেনারেল কীড, এইমলি এইসব চরিত্র তথা ঘটনা বর্ণনাই তা প্রমাণ করে। উপন্যাসটি রচনায় খালেকদাদ কেন যে সম্পূর্ণ ইতিহাসাশ্রয়ী হননি সেটি অবশ্য প্রশ্নই থেকে যায়। এ বিষয়ে তার নিজের ভাষ্য...
‘দিলিøর মোঘল সম্রাট আকবর, ঈশা খাঁ-কে যে বাইশটি পরগণা দান করেছিলেন, শেরপুর দক্ষবাড়িয়া তার অন্যতম। ঈশা খাঁ-র শেষ জীবনে তার দৌর্বল্যের সুযোগে তাঁর সেনাপতি আফগান গাজীরা শেরপুর দক্ষবাড়িয়া, ভাওয়াল পরগণা এবং মজলিশরা, খালিয়াজুড়ি ও নাসিরুজিয়াল পরগণা কেড়ে নিয়ে নিজেদের সেখানকার স্বাধীন ভূ-স্বামী শের আলী গাজীর নামানুসারে সে পরগণার নাম হয় শেরপুর। শের আলী গাজীকে এক হীনষড়যন্ত্রজালে জড়িত করে শেরপুর জায়গীরদারী থেকে বঞ্চিত করা হয়। কথিত আছে যে, দর্শার কানুন গো সেরেস্তাদার কর্মচারী বৈদ্যরাজবল্লব মজুমদারের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর প্রতি শের আলী গাজী আকৃষ্ট হন। তিনি নাকি তাকে লাভ করার জন্য গোপনে রামবল্লবকে হত্যা করান। রামবল্লবের স্ত্রী পালিয়ে তার পিত্রালয় মুর্শিদাবাদে চলে যায় এবং নওয়াব দরবারে শের আলীর বিরুদ্ধে নালিশ করে। শের আলী গাজীকে পদচ্যুত করে তার জায়গীরদারী রামবল্লবের বিধবাকে দান করেন।
‘রক্তাক্ত অধ্যায়’-এর পটভূমিকা এ পর্যন্তই। বাকিটুকু নিছক উপন্যাস এবং কল্পনাপ্রসূত। উপন্যাসের সার্থকতা পাঠকের বিচারের উপর নির্ভরশীল, সে ভার সহৃদয় পাঠকের / পাঠকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
স্বাধিনতা দিবস ১৯৬৬, নেত্রকোণা খালেকদাদ চৌধুরী
আমাদের অতীত মানে সুবর্ণঅতীত। আমরা অনেক কিছুই স্মৃতিতে রাখি না। এটা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যজনক! এ স্থানে এসে আবিস্কৃত হয় যে খালেকদাদ চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ উপন্যাসের মূল ভিত ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলের ফকির অভিযান থেকে শুরু করে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত শেরপুর নছরত শাহী পরগণা, টিপু পাগলের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধিন হওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আজকের সময় পর্যন্ত এসে যদি গড় বিবেচনায় স্থিত হই যে এই উপন্যাস খুঁড়ে-ছেনে বাঙালি জাতির অন্তত ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের সূত্রমুখ তথা সত্যাসত্য ঘটনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে। তাতেও পাঠকের অত্যুক্তি হওয়ার অবকাশ থাকবে না। স্থানিক, ভাষিক উপস্থাপন-এষণা এবং সে বিষয়ে যৌক্তিক অবতাড়না আজ আর নয়। তাঁর সময়ের অনেক লেখককেই তো আরো বিস্তৃত ব্যাপক প্রকাশনায় পেয়েছি, জেনেছি। এমনকি পাঠ্যসূচিতেও। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রসংগ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। খালেকদাদ চৌধুরীর সাংবাদিক জীবনে যিনি ছিলেন দৈনিক নবযুগ প্রধান সম্পাদক এবং সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব বা সাংবাদিকতা সংসর্গই নয় কবি নজরুলের সাহিত্যিক সংসর্গেও যে খালেকদাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন সে সম্পর্কে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দিন খালেকদাদ লোকান্তরিত হওয়ার পর এক নিবন্ধে লিখেন...
সেকালের তরুণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য তারকা জ্বলছিল, যার যতটুকু ক্ষমতা সেইমতো আলো বিকিরণ করছিল। একে একে সবাই বিদায় নিচ্ছেন। খালেকদাদ চৌধুরীর পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ তারকাটি খসে পড়লো।’
কবি নজরুলের কিংবদন্তি সাহিত্যের তুলনা না করলেও খালেকদাদ চৌধুরীর সমকালিন সাহিত্যিক কবি জসিম উদ্দিন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবু জাফর শামসুদ্দিন, শওকত ওসমান প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরীসহ অনেকের লেখা আমরা ব্যাপক প্রকাশিত ও পাঠ্য হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু খালেকদাদ অপঠিত থেকে গেছেন। এটা সত্য এবং লজ্জাকর।
কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, তিনি বিবৃতিপ্রধান লেখক ছিলেন। উপন্যাস, গল্পের প্রধান চরিত্রটির মধ্য দিয়ে গল্প তৈরির অভিনব কৌশুলীয় ছিলেন বটে। এই কৌশলের মাধ্যমেই তিনি তাঁর উপন্যাস, গল্পের মূল বিষয়টির ইংগিত প্রদান করতেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই গল্পময়তা বিষয়টি কথাসাহিত্যের আদিতেই ছিল। স্থান, কাল, পাত্র এবং ব্যাপ্তীগুণেই কথাসাহিত্যের পাঠক / শ্রোতাগণ উপন্যাসের সঠিক অবস্থানটি শনাক্তকরণ বা অভিযোজনের কাজটি সমাপ্ত করতে পারতেন। ‘চাঁদবেগের গড়’এ এসে প্রবলভাবে উপলব্ধি হয় যে, তাঁর এ উপন্যাসটি শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের দুঃখ, দুর্দশা তথা দৈন্যপীড়িত মানুষের প্রপীড়ণের চিত্রই নয় বরং এর ভিতরেই লুকিয়ে ছিল জাতিগত প্রপীড়ণমালার অন্য এক ইতিহাস। অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া, নীলকর, বৃটিশদের অত্যাচারের বিপরীতে ডাকাত চাঁদবেগের ভূমিকাটি যে প্রতিবাদী সত্ত্বাই ছিল সে বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ উন্মোচন করেন নাই। সে সময় কথাসাহিত্যের মননের চর্চায় তার প্রয়োজন হতো না নিশ্চয়ই। ডাকাত চাঁদবেগের সেই অপ্রকাশিত মহিমা বস্তুটিই ছিল পাঠকশিক্ষার জায়গা।
কথাসাহিত্যে খালেকদাদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি রোমান্টিকতা বর্জিত লেখক ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালুতে যেমন রোমান্টিকতার প্রয়োজন ছিল না। ঠিক তথাকথিত অর্থেও নয় তাঁর লেখক বৈশিষ্ট্যটেও বোধহয় বিষয়টি ছিল না। অনেকানেক যুক্তি হলো, ইতিহাস বিবৃতিই এর প্রধান কারণ ছিল। তাই বলে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’কে যদি কেউ রোমান্টিকতা বর্জিত আধুনিক উপন্যাস ভাবেন সেটা ভুল হবে। বরং বিষয় বিবেচনায় এ দুটি উপন্যাস অধিক সঞ্চারিত করে আমাকে। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর সময়ে অপঠিত ছিলেন বিষয়টি সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্যজনক কিংবা লজ্জাকর না ভেবে এরকম বিষয় ভাবা যেতে পারে। সমস্যা এখানেও আছে, কোনো রোমান্টিকতার ছাঁচে ফেলে তাঁর প্রবণতাকে খারিজ করা অসম্ভব। সিরিয়াস কথাসাহিত্য পাঠকের কাছে অন্তত এই যুক্তি অবান্তর ঠেকতে পারে। কথাসরিৎসাগরের টোটালিটি ধারণ করে যদি কোনো পাঠক বিষয়টি রোমান্টিক বলে আমলে আনেন তবে সেখানে যুক্তি প্রযোগের চেষ্টাও বৃথা যেতে পারে। পাঠক ক্যাটাগরিই মুখ্য। আজকের বিবেচনায় খালেকদাদ অবশ্য অন্য এক অনন্য সাহিত্যমাত্রিক সামগ্রিক।
খালেকদাদ চৌধুরী নামটি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিক পরিচয়েই নয় প্রত্যক্ষ একজন সমাজ সংগঠকের ভূমিকাও যথার্থ উজ্জ্বল। ষাট-সত্তুর-আশির দশকে খালেকদাদ চৌধুরী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ এবং ‘সৃজনী’ নামক ছোটকাগজটি ঘিরে নিভৃতপ্রায় একটি মফস্বল শহরের তথা সারাদেশের অগ্রজ-অনুজ লেখকদের মধ্যে যে চঞ্চলতার ধারা প্রবাহিত হয়েছিল, সেই কৃতিত্বও খালেকদাদ চৌধুরীর নিজের মহিমাগুণে। এই ‘উত্তর আকাশ’ থেকেই আমরা পেয়েছি নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘নূতন কাণ্ডারী’ (যিনি আজকের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ)। এছাড়াও রওশন ইজদানী, জালাল উদ্দিন খাঁ, রফিক আজাদ, নূরুল হক, আসাদ চৌধুরী, হুমায়ূন আজাদ, আশরাফ সিদ্দিকী, বশির আল হেলাল, আহমদ রফিক, শামসুল ইসলাম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, হেলাল হাফিজ, শামসুল আরেফিন, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ লেখকদের বিভিন্ন রচনা আমরা পাঠ করেছি ‘উত্তর আকাশ’ ও ‘সৃজনী’ থেকেই। নির্মলেন্দু গুণের নিজের লেখা থেকে এ কথার সত্যতা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে...
‘আমি এক কথায় বলতে পারি, তিনি, খালেকদাদ চৌধুরী আমাদের নেত্রকোণার দর্পণ। তাঁর উদার নেত্রের কোণায় ছায়া ফেলেছিল এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ। তিনি সেইসব মানুষের সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন সাফল্যের সঙ্গে তাঁর উপন্যাসে, গল্পে। সেকথা আমরা তাঁর রচনা থেকে জানি। কিন্তু নেত্রকোণার মতো আর্য-অগম্য একটি মফস্বল গ্রামে জন্মগ্রহণ করে, তিনি কিভাবে বিভাগপূর্ব কলকাতার রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক কল্লোলে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, সেখানে তাঁর ভূমিকা কী ছিল তা আমাদের সকলের জানা ছিল না। আমাদের জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি এঁকেছেন ওই সময়ের রেখাচিত্র। ফলে, নবজাগরণ প্রত্যাশী মুসলমান সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা, কবি নজরুল, মাওলানা আকরাম খাঁ, ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, কবি আবদুল কাদির, বন্দে আলী মিয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি মহীউদ্দীন-এঁরা সবাই খালেকদাদ চৌধুরীর নেত্রকোণায় কিছুটা ভিন্নভাবে ধরা পড়েছেন।’
নেত্রকোণা জেলার প্রথম গ্রাজুয়েট ও নেত্রকোণা পৌরসভার প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান, আঞ্জুমান হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আইনজীবী মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান নেত্রকোণার আপামর মানুষকে নির্দেশনা দিতে যে সুন্দর শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, বলা যায়, খালেকদাদ চৌধুরী তারই বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে। নেত্রকোণা সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতার সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না। গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রবীণ কর্মকর্তা মোর্শেদ আলী খানের দেয়া তথ্যমতে, প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলী ওসমান সিদ্দিকী। খালেকদাদ চৌধুরী দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকাকালিন গ্রন্থাগারটি বকুলতলায় একটি বড় পরিসরে স্থানান্তর এবং দ্বিতল ভবন নির্মাণে তাঁর বিশেষ অবদানই প্রধান ভূমিকা ছিল। নেত্রকোণার আজকের গণমানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্যে অগ্রণী ভূমিকায় নিয়ে আসতে মরহুম এলাহী নেওয়াজ খান ও কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর ভূমিকা অমলিন, অনসীকার্য। সৈয়দ শামসুল হকের একটি উদ্বৃতি দিয়ে প্রবন্ধের প্রাথমিক অবতাড়না সমাপ্ত রাখছি...
‘এই শহর (নেত্রকোণা) ও অঞ্চল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পেলাম এখান থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র সৃজনীতে। শুধু ইতিহাস নয়। এখানকার লেখকদের সৃষ্টিশীল লেখারও ভালো সাক্ষাতও পাওয়া গেল এর পাতায়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করি যে, ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত বলেই পত্রিকাটি সাহিত্য সংস্কৃতির মূলধারা থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন নয়। খুবই উন্নতমানের এই সাহিত্য পত্রিকাটি আমি যে আগে কখনো দেখিনি, একটু লজ্জিত বোধ করলাম; সর্বাধুনিক সংখ্যাটি দেখতে চাইলাম। জানতে পারলাম এর সম্পাদক খালেকদাদ চৌধুরী লোকান্তরিত হবার পর এখন পর্যন্ত এমন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সম্পাদনার দায়িত্ব বহন করতে পারেন। কাজেই পত্রিকাটি বের হয় না। এটিও আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো।’
তথ্যসূত্র:
১. ছোটগল্পের কথা: রথীন্দ্রনাথ রায়, সুপ্রকাশ প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-১৯৫৯
২. বাঙালি মুসলমানের মন: আহমদ ছফা, বাংলা একাডেমি-১৯৮১
৩. শতাব্দীর দুই দিগন্ত: খালেকদাদ চৌধুরী, সুনেত্র-১৯৯৫
৪. জীবনী গ্রন্থমালা, খালেকদাদ চৌধুরী: ইমামুর রশীদ, বাংলা একাডেমি-১৯৯৭
৫. উত্তর আকাশ (পাক্ষিক)
৬. সৃজনী (সাহিত্য পত্রিকা): ১৩তম সংখ্যা, বৈশাখ-১৩৯১, এপ্রিল-১৯৮৪
৭. স্টাইলের দড়ি-খুঁটি, একটি বাস্তবের সামিয়ানা: সাধন চট্টোপাধ্যায়, নিসর্গ: সম্পাদক-সরকার আশরাফ
৮. সওগাত: বৈশাখ-১৩৪০ সংখ্যা
৯. মাহে নও: মার্চ ১৯৫৬, চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যা
১০. মাসিক মোহাম্মদী: ১০ম বর্ষ, ৭তম-৮ম-৯বম সংখ্যা
No comments:
Post a Comment