Friday, July 3, 2009

কবিতার সঞ্চারণ-ধারা / তৃতীয় পর্ব

শিল্প কি? এরকম প্রশ্ন যদি কাউকে করা যায় তবে তিনি কোনো রকম জটিলতায় না গিয়ে সরাসরি উত্তর দিতে পারেন ‘সুন্দর’। পৃথিবীর সমগ্র সুন্দরকেই আমরা শিল্প বলতে পারি। তা সে কৃষিকাজই হোক, ব্যবসার কাজই হোক, অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠানই হোক, হাড়িপাতিল তৈরি করাই হোক, দা-বটি তৈরি করাই হোক বা অন্যান্য আরো যত আছে কুটির শিল্প তাই হোক, কাজ যখন সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই তাতে শিল্প ফুটে ওঠে যা ব্যক্তি মাত্রেরই ভালো লাগে। আর সেটা কবিতায় যদি হয় তবে তো তীক্ষ্ন বর্শার মতো গেঁথে ফেললো আপনাকে নিখুঁতভাবেই। অবশ্য আজ যা সুন্দর তা ভবিষ্যতে সুন্দর নাও থাকতে পারে কেননা সুন্দর কখন, কোথায়, কে, কিভাবে করবেন তা সময়ের মানুষেরাই ভালো বুঝেন। দ্বান্দিক বিস্ময়! এইরূপ আপেক্ষিক বিষয়ে আমার কিছু বলবার নেই সুন্দরের আখ্যান মানুষই রচনা করবেন মানুষই ভাঙবেন। এইসব ভাঙা-গড়ার মধ্যে সুন্দরকে কবিমাত্রই নিয়ে আসেন তাঁর কবিতায় ফলে যে কবিতায় সুন্দরের প্রকাশ তা যেকোন প্রকারের কবিতাই হোক না কেন উহাই পাঠকের কবিতা, পাঠযোগ্য কবিতা। পাঠকের কবিতাই শিল্পিত কবিতা, নন্দিত নন্দনের কবিতা, পঠিত হওয়া জরুরি। কেননা কবি যে সুন্দরকে কুড়িয়ে এনে জড়ো করেন কবিতায় তা পাঠকেরই জন্য, আর পাঠকরাও সেই সুন্দরকে কুড়িয়ে নেবেন তাঁর প্রিয় কবিতা থেকে।সুন্দর কাব্যিক সঞ্চারণে একজন কবির কতজন পাঠক থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করতে পারি। এখানে লেখা বাহুল্য যে, কবিকীর্তিটি স্পষ্ট করার জন্য একজন পাঠকেরও প্রয়োজন নেই, পাঠক প্রয়োজনীয়তার জায়গাটি মূলত কবিতার একটি বিতার্কিক অবস্থান তৈরি করে। অর্থাত সঞ্চারণ থেকে আপনার অবস্থান গিয়ে দাঁড়ালো মানুষের কবিতার প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে। কবিতা পঠন-শ্রবণের অধিকার শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পাঠক বা শ্রোতা আজ হয়ে উঠতে পারে কোনো যন্ত্র বা বস্তু বিশেষও। কথা হচ্ছে, কবিতাপাঠে আমাদের জানা মানবীয় গুনাগুন থাকছে কিনা। এঞ্জেলিক রিডস্ বা মানবীয় পাঠই কবিতাকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারে। তবে যেকোনো কবিকীর্তি মূর্তমান করার জন্য নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটিই যথেষ্ট। এই প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হয়তো নিজের ঢোল নিজেই বাজাতে শুরু করবেন- সেটা সংগত নয় কেননা একটি কবিতা যখন কবিআত্মা থেকে মুক্ত হয়ে যায় তখন বিপরীত দণ্ডায়মান পাঠককে যদি স্পর্শ করতে না পারে তবে তা কবিতাই কেন? পঠিত হবার শক্তি-সঞ্চারণেই তো কবিতার জন্ম হয়। সর্বাগ্রে রচয়িতা নিজেও একজন পাঠক আর কবিতাপ্রাণটিও নিশ্চয়ই পাঠব্যতীত স্বস্তিতে থাকে না। ফলে একজন কবির পাঠকের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে যার একমাত্র কাজ হচ্ছে কবিতা পড়া- লিখা নয়। ওই নির্দিষ্ট পাঠকটি অবশ্য তার স্বীয় কবিটির গুরুত্ব বুঝতে এবং তার কবিকে যাতে কোনোভাবেই সময়ের অনুরণন থেকে অবহেলা বা কোনো অবিচার করতে না হয় তার জন্য তাকে হতে হবে সামগ্রিক কবিতার উন্নত পাঠক। অর্থাত সঞ্চারিত কবিতাই বারবার পাঠে নিজেকে ব্যাপৃত করা। উন্নত পাঠকের পক্ষেই সম্ভব তার নিজস্ব কবি ও কবিতাকে টোটাল কাব্যিকতা থেকে আলাদা করতে পারা। এই নির্দিষ্ট পাঠকব্যক্তিটি একজন কবিও হতে পারেন। একজন কবির মধ্যেও থাকা জরুরি উন্নত পাঠকসত্তা। যে পাঠকের পক্ষে সম্ভব সঞ্চারণ থেকে সঞ্চালন বা কবিতার উদ্ভাবনীতে স্পর্শ করা। পাঠকসংবেদ। শেষপর্যন্ত তার কবি হবে ওই স্বত্তাটি যার কবিতা দমন, শাসন, পরিচালিত করবে তার অন্তরাত্মা। সত্যকে উপলব্ধি করতে পারার যে সম্যকজ্ঞান, সেই পাঠকই অর্জিত হওয়া থিতু কবির কাজ। আপনি হয়ত পাহাড়ের সামনে দাঁড়ালেন এবং পাহাড়ের উচ্চতা বিদ্যুচ্চমকের মতো ক্ষীণকায় করে দিলো আপনার উচ্চজ্ঞান। আপনি থমকে গেলেন! সত্যিই তো, পাহাড় মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতার অধিকারী। খুব সহজ স্বাভাবিক সাত্ত্বিকপনায় যে পাঠকের বাস তার পক্ষেই সম্ভব কবিকীর্তিকে সঠিক স্বীকৃতি দেয়া। তারপর... এরকম পাঠকের সংখ্যা যদি ক্রমাগত বেড়ে যায় তবে তা বলা যেতে পারে কবির বিশেষ অর্জন। ভাবের শিল্পিত দর্শনের বহিঃপ্রকাশই কবিতা। ভাবের সকল সঞ্চারণ অব্যাখ্যাত, অবিক্রিত। ভাব কোথায় ফুটে ওঠবে তা অবশ্য কারুরই জানা নেই। মানুষের প্রতিটি কর্মের মধ্যেই ভাব নিহিত রয়েছে। যেমন, তার কথা বলায়, চলাফেরায়, গান গাওয়ায় ইত্যাদিতে কিন্তু সকল কিছুতেই শিল্পিত নন্দন খুঁজে পাওয়া যায় না আর যেখানে শিল্প নেই, নন্দন নেই সেখানে কবিতাও থাকে না। কথা হচ্ছে, তাহলে, কবিতার কি কোনো সংজ্ঞা রয়েছে? নির্দিষ্ট কোনো আকার দিয়ে কবিতাকে চিহ্নিত করবো? বহুল চর্চিত কবিতার এ ধারণা আমরা পরিহার করতে পারিনি। সময়ের ভাষা রাস্ট্র, জাতিভেদে বহু খণ্ডিত ভগ্নাংশে বিবক্ত হয়েছে। তিতিক্ষিত, নিরীক্ষিত হয়েছে। আসলে কবিতার মৌলিক কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ বা আকার দিয়ে চিন্তা না করাই ভালো বরং তাকে তার পথে যেতে দেওয়াই উচিত। প্রজন্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হবে মানুষের জীবনবোধ, কথা বলা, চলা-ফেরা, বসবাস করা। ফলে সে সময় যা দৃষ্টিতে সুন্দর, বোধে নন্দন, লেখায় শিল্পিত বিবেচিত হবে উহাই সে সময়ের কবিতা। কবিতা বুঝতে হলে একজন পাঠককে অবশ্যই শিল্পরুচিসম্পন্ন হতে হবে কেননা যে পাঠকের শিল্পরুচি নেই সে পাঠকের পক্ষে পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে কবিতাকে চিনে নেয়া কখনোই সম্ভব নয়। অবশ্য শিল্পকে তিনি কোথায় খুঁজবেন, সুন্দরকে কোথায় দেখবেন, নন্দনের বোধ কোথায় জাগ্রত হবে তা তার একান্তই নিজের ব্যাপার বিষয়। কারো সংগীত ভালো লাগে, কারো কবিতা ভালো লাগে, কারো কারো নাটক-উপন্যাস, কারো বা মোবাইলে কথা বলা, কারো ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কারোবা বিজ্ঞানচর্চা ফলে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে একমাত্র পাঠককেই দূরদর্শী হতে হয়। পাঠক যদি শুধুমাত্র পাঠকই হয় বা যে পাঠক বোধ বা সকল্পের বিশ্লেষণ করতে না জানে তাহলে তাকে পাঠকই-বা বলা কেন? সাহিত্য পাঠের জন্য দরকার অত্যন্ত সিরিয়াস পাঠক যার দৃষ্টি তীক্ষ্ন, বোধ শানিত, কথা বলায় বিশেষ সন্দর্শনের ফলাফল যিনি প্রকাশ করতে পারেন, সেরকম পাঠকের পক্ষেই সম্ভব কাব্যসাহিত্যকে বিস্তার করে দেয়া।কবিতা বুঝতে পারা যতটা সহজ ব্যাপার না বোঝা তারচেয়েও বহুগুন কঠিন বিষয়। যদি কোনো পাঠক কবিতা পড়ে বুঝে ওঠতে পারেন নির্দিষ্ট কবিতাটির ভাষা, ভাব, বিষয় বক্তব্য তবে কোনো কথাই থাকছে না এর প্রেক্ষিতে কিন্তু যখন একজন পাঠক বলেন যে কবিতা বুঝি না তখনই তার পেছনে একগুচ্ছ প্রশ্ন বিশালভাবে দাঁড়িয়ে যায়। যেমন কবিতাটি তিনি ক’বার পড়েছেন, ক’বার তন্ময় হয়েছেন, কবিতাটিতে মূলভাব কি নিহিত ছিলো? বলবার ভঙ্গিটি কি কিংবা কবিতাটির ছন্দ কি? ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ সনাতন উদ্রেকী যত প্রশ্ন আসে তা আবিস্কার করে ফেলা এবং নিজেকে এর উত্তীর্ণ অবস্থানে উন্নীত করাই একজন পাঠকের হিতব্রত হওয়া উচিত। আমাদের দেশে কবিতা বুঝতে পারা পাঠকের চেয়ে না বুঝতে পারা পাঠকের সংখ্যাই বেশি। এতে কি ধরে নেবো যে, আমাদের কবিতা বেশি বেশি পাঠ হচ্ছে! বিবৃত হচ্ছে! আসলে বিষয়টি তা নয়, অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে আমাদের পাঠক’রা চিরকালই উল্টোকথা বলে এসেছেন। তারা কবিতার যথার্থ পাঠ না নিয়েই সাধারণ বলে থাকেন কবিতা বুঝি না, কবিতা দুর্বোধ্য, কবিতার প্রয়োজন নেই। চিরকাল মিথ্যে বলেছেন তারা, সকল দহনের পর শ্মশ্রূ-শ্রান্ত কাব্যিকগীতলতায় তরঙ্গিত, নিদ্রিত হয়েছেন নির্দ্বিধ। রাজনৈতিক অভিজ্ঞান পাঠককে এরকম পরিস্থিতিতে কাবু করছে অনেক বেশি। দার্শনিক সক্রেটিসের ধারণায় কবিতার ছড়াছড়ি ছিলো। তাঁর হেমলক-পানে মৃতুকালীন শিষ্যকে তিনি যে উপদেশ বাণী দিয়েছিলেন তাতেও কাব্যিকতার ইঙ্গিত ছিলো। আবার তাঁরই ঘনিষ্ট শিষ্য প্লাতোর রাস্ট্রচিন্তায় কোনো কবিতা ও কবির অভিজ্ঞান ছিলো না। আরো ব্যাপৃত ফলশ্রুতি দেখুন প্লাতোর ভাবশিষ্য এরিস্টটলই লিখেছেন কাব্যতত্ত্ব। রাস্ট্র এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞানে কবি ও কবিতার অবস্থান এরকমই দাঁড়ায়। কবিতার পূর্ণাঙ্গ পাঠ না নিয়েই এর বাহির থেকে যিনি বলে থাকেন কবিতা দুর্বোধ্য, আমি বলি; তিনি তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন। সৌরজগতের সকল ঘটনা, বোধ বা প্রজ্ঞার দায় কোন মানুষ কিংবা প্রাণীমাত্রই বহন করতে পারে না। কিন্তু এরকম ডাহা একটি মিথ্যে কথার দায় কবিতা এবং কবির উপর শুধু শুধুই বা বর্তাবেন কেন? শুধু শুধুই-বা চাপাবেন কেন চিন্তার বিরূপ এই শ্রেণিবিদ্বেষ। এরকম ডাহা একটি মিথ্যে ধারণার সাথে সাথে অনাবিষ্কৃত থেকে যায় নবমাত্রিক কাব্যের উদ্ভাবনী সাহিত্য বিবেচনাও... কবিতা কবির সহায়। কবিতা নতুন দিগন্তের সূচনা করে। ফলে ধরে নিতে হচ্ছে কবিতার উদ্ভাবনী শক্তি যথার্থই আছে। কাব্যপাঠ একজন পাঠককে ক্রমান্বয়ে ইতিহাস অন্বেষী করে তুলে। বর্তমান কবিতা থেকে অতীতের কবিতার পূর্ণ আস্বাদনব্যতীত এর উদ্ভাবন মাত্রাও আবিষ্কার প্রায় দুরূহ। নবমাত্রিক কাব্যটি পঠিত হলেই এর উদ্ভাবনীটি টের পাওয়া যায় তার পূর্ববর্তী সাহিত্যের প্রভাব-প্রোপাগাণ্ডা। প্রকৃত পাঠকের পক্ষেই সম্ভব এই গূঢ় সত্যটি আবিষ্কার করা।টি, এস এলিয়টের মতে, প্রকৃত কবিতা বোধগম্য হবার পূর্বেই সঞ্চারিত হয় পাঠকের মনে অর্থাত কোন একটি কবিতা পাঠের পর তা পাঠকই প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারেন যথার্থ একটি কবিতা, কোন চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ ছাড়াই। কি ভালো লাগলো, কেন ভালো লাগলো, কিভাবে ভালো লাগলো তা পাঠকই বলতে পারেন কেবল, সঞ্চারণের পর কবিতাটি বারবার পাঠ করে। কিছু কিছু কবিতা রয়েছে যা লিখিত হবার পর স্বয়ং অধিশ্বর কবি নিজেও সঞ্চারিত হচ্ছেন না আবার বিশ্লেষণ-বিবৃতিরও কোন ভূমিকায় যেতে পারেন না। লেখকের মতে, ওই বোধ তাঁকে সঞ্চারিত করেছিলো বলেই কেবল ভাবাবেগটির কাব্যিক একটি রূপ দিয়েছিলেন। কখনো কখনো দেখা যায় যে, পাঠকের অন্দরে কবিতাটি সঞ্চারিত হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বোধের দরজা খুলেই। ফলে মূল কাব্যিক ব্যঞ্জনার উদ্ভাসে পাঠকেরই উচিত এরকম সঞ্চারণের সোর্স বিবৃত করে ফেলা।একজন কবির প্রকৃত কামনার বিষয়ই হচ্ছে কাব্যবস্তুতে থিতু হওয়া। কাজটি দুরূহ। কিন্তু কবিকে অর্জন করতে হয়। পেশা এবং তাত্ত্বিকতা বাদ দিলেও এর সার্বিক ফলশ্রুতিটা দাঁড়ায় মানবকল্যাণেই। মানবমন সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকা জরুরি। কবিতার ফলশ্রুতিটা সেখানেই অর্জিত হয়। মুক্ত, ঝরঝরে মানুষটির পক্ষেই সম্ভব তার স্বধর্মে পরিচালিত হওয়া। একমাত্র কবিতাতেই মানুষের সকল পঙ্কিলতা ম্লান হয়ে যায় আর তাকে দেয় ঝঞ্ঝাহীন পৃথিবীতে বিচরণের মুক্তআত্মা। পৃথিবীর সকল শুভকামী মানুষের একমাত্র কাম্যবস্তুই হচ্ছে কবিতা।সাহিত্যকর্মী নয় এমন কিছু বন্ধু আমার ছিল যারা আমার কাছে প্রায়ই আসতো। আমার সাথে ওদের পরিচয় আছে সেটা গর্ববোধে পরিচিতজনদের বলতো। বিষয়টি আমার মধ্যে যথেষ্ট কৌত‚হল উদ্রেক করেছে। একদিন ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কবিকে এতো শ্রদ্ধা করে কেন, কবির লেখা পড়ে তার ভালো লাগে কিনা? উত্তরে সে বলেছিলো, কবিতা আসলে ভালো লাগে না, বুঝি না বলে। আরো জিজ্ঞেস করেছিলাম তাহলে কী তার ভালো লাগে? সে বলেছিলো গল্প বা উপন্যাসই ভালো লাগে। তার মতে গল্প বা উপন্যাসই হচ্ছে সাহিত্যের একমাত্র স্বচ্ছ মাধ্যম (মিডিয়া) মানুষের ভাবাবেগ (ইমোশন) প্রকাশের আর কবিতা হচ্ছে একটু বেশি বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্রাক্ট) যা ওদের সাধারণকে সহজেই স্পর্শ করবার নয়। বিষয়টি আগামাথা সাহিত্যিক ধারণায় তার কাছে কোনো অর্থ তৈরি করেনি।হ্যাঁ, এর বেশি তার কাছ থেকে আশা করিনি, ওটুকুই যে বুঝতে পেরেছে তাতেই তো সে কবিতার মূল একটি বিষয় ধরে টান দিয়েছে হৃদগভীরে। কবিতা ঘোরের প্রকাশ, নিমজ্জনের তন্ময়তার প্রকাশ; প্রতিটি মানুষ কতটা ব্যাপৃত তার নিজের মধ্যেই বা তার আত্মার শুচিশুদ্ধতা, কাব্যিক প্রণোদনা না থাকলে তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। কবিতা তো তাই যা মানুষের ভেতরে জমে থাকা নোংরা আবর্জনা, গুমোটতা বের করে দেয়।সকল ক্ষেত্রে এইরূপ ব্যাখ্যা-বিবৃতি কিংবা ভাবের সঞ্চারণের আসলে কোনো ব্যাখ্যা হয় না। বাংলা কবিতার দীর্ঘ ধারাবাহিকতার পর তিরিশের দশকে এসে এর ভাঙাগড়ায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয় আমাদের কাব্যিক সঞ্চারণের মধ্যে এবং তারই ধারাবাহিকতায় অমোঘ গন্তব্যের সন্ধানে সূচিবদ্ধ হয়েছেন অনেকেই। পঞ্চাশের দশকের পর সেই গভীরতর ব্যাপৃত সঞ্চারণ একটু শীথিল হয়েছে। প্রচল ধারণার বাইরে ব্যতিক্রম বাদে ষাট-সত্তুর দশকেও দু-একজন কবি-লেখক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। আশির দশকে এসে পুনরায় বাংলা কবিতা একটু সজাগ হতে চলেছে আর তারই সূত্রাতিসূত্রে নব্বইয়ের পদচারণা। ধারণা করা হচ্ছে একবিংশের কবি-লেখকদের মধ্যেই শতকের কবিতার আরেক নতুন পর্বের উত্থান হবে এবং তার কাজ ভেতরে ভেতরে চালিয়ে যাচ্ছেন এই সময়ের কবি-লেখকরা। কিন্তু যে পর্বের উত্থান বা উদ্ধৃতি প্রত্যাশা করছি আমরা সেটি শুধুমাত্র কাব্যিকব্যাপ্তীর বিচারে উত্তীর্ণ হবে না। সময়ের সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তিই কেবল সেখানে দণ্ডায়মান হবে। এরমধ্যে প্রকৃত অর্থে কবিতাই সম্ভব প্রধান মাধ্যম যার ভাবাবেগ উত্তীর্ণ পর্ব থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন হবার নয়।শিল্পমাত্রেরই বিদগ্ধ পাঠক/দর্শক (যিনি সমগ্র শিল্পের ফ্লেবার নিয়ে থাকেন গোগ্রাসে) কাব্যপাঠান্তে কিছু কিছু উদ্ধার-উদ্ধৃতিও দিয়ে থাকেন। যদিও আপাতত প্রশ্নউদ্রেকী বাক্যগুলোর নির্দেশিকা থাকছে না এখানে। শিল্পের বিমূর্ততা (অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্ম) দুটো ধারায় বিদ্যমান। কাব্য ও চিত্র, দুটোতেই রচয়িতা প্রাধান্য পায়। এ দুটো বাদ দিয়েও কি শিল্প ভাবা যায় না? বিষয়টি নিয়ে বহুবার চিন্তা করেছি আমি। হয়ত সহজ ভাবা! একটি জটিল বিষয় এখানে উদ্ধৃতি করি। ইদানিং ছন্দ ছাড়া কবিতা বলে একটা বিষয় চেপেছে কবি-লেখক-পাঠকের মধ্যে। দুর্বল, এমন সব ক্ষেত্রে এরকমও শুনতে হয় এখনকার কবিতাতে ছন্দ নেই অন্তমিলটাও থাকছে না পর্যন্ত (মহাভারত, রামায়ণ, মধ্যযুগীয় কাব্য, ময়মনসিংহ গীতিকা যে আঙ্গিকে রচনা করা হয়েছিল। অধুনান্তিক জসীমউদ্দীনের চারটি আখ্যান কাব্য। ভিন্ন একটি উদ্বৃতির প্রয়োজনে গদ্য আঙ্গিকে লেখা বিষাদসিন্ধু কাব্যটির কথাও বলবো)। এখানে বলতে হয়, শুধুমাত্র ছন্দের বিচারে এগুলোকে আমরা কাব্য বলে বিচার করতে পারি না, ধর্মীয় প্রেক্ষাপট, আখ্যান তো বটেই এগুলো লিখিত হবার ফলে কিছু কিছু চরিত্রও সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোতে শুধুমাত্র কাব্য বা ছন্দগুণই প্রধান ছিল না। যাহোক, বিবৃতি থেকে পুনরায় কাব্যে আসি। অধুনাকাব্যের যে আঙ্গিক, ভাষা, নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ চলছে তাতে আদৌ কী উল্লেখিত কাব্যগুলির মতো আবেদন রাখবে? মানুষের ভাবাবেগ থেকে মধুর-কোমল ছোট ছোট ইউনিটগুলোই তো ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছে। খুব সহজ স্বাভাবিক উত্তরটি এরকম নির্দেশিত থাকে যে, এর যথার্থতা কালই নির্ধারিত করবে। কালে হয়ত আলাদা আলাদা কোন নামে কাব্য নয় বরং থাকবে কাব্যের স্বধর্ম, অর্থাত কাব্যকে কাব্য বলে জানা, পদ্যকে পদ্য। সেটিই হয়ে উঠতে পারে মূখ্য যে বিষয়টি সচেতনভাবে জেনে ফেলা জরুরি। দর্শনইন্দ্রিয় অন্তত পাঠককে সেদিকেই শানিত করে।আমাদের মধ্য থেকে পঠন-পাঠন কমেছে। জনাধিক্যের সাথে সাথে পাঠকসংখ্যা বাড়লেও গড় বিবেচনায় পাঠক বাড়েনি। পাঠকহীনতাই মূলত প্রকৃত কাব্যসাহিত্য অনাবিস্কৃত থেকে যাওয়া। কবিতার মানবীয় পাঠ থেকে এবার আমরা বৈজ্ঞানিক পাঠে মনযোগ দিতে পারি। বস্তুবিশ্বে যন্ত্রেও ভাবাবেগ যুক্ত করে বিষযটি ভাবা যেতে পারে। অর্থাত বস্তুবিশ্বে কবিতার বৈচিত্রে পেশাগত অবস্থান সুদৃঢ় করা। কবিতার একজন পাঠক হিসেবে প্রথমেই আমার কাছে যে বিষয়টি সার্বজনীন ধারণার বলে মনে হয়, একজন কবির একেকটি কবিতা মূলত তাঁরই অন্তর্জগতের বহিঃপ্রকাশ সেখানে কবির অস্তিত্ব, ইতিহাস ভাবনা, কেন তাঁর লেখনীর অভিপ্রায়, কিভাবে সে উপলব্ধিত হলো সমকালীন সমাজব্যবস্থার রীতিনীতি, আচার-উপাচারে; থাকছে ইত্যাদির নানাবিধ বিচারবিধি আর তার সম্যকবিবৃতি। এই অন্বেষা কেবল কবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বিস্তার প্রতিটি মানুষের অন্তরেও। কিন্তু মানুষের চিন্তাভেদে অবস্থানটা দাঁড়াচ্ছে ভিন্ন আসনে। একই বিষয়বস্তু মানুষের কাছে মূল্যায়িত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে, কেউ কেউ কবিতার চিত্ররূপময়তা দেখিয়ে তাঁর পাঠকের সঞ্চারণ তৈরি করে নিচ্ছেন, কেউ কেউ কাব্যিক গীতলতায় ছান্দিক প্রকরণে। যখন আমি এই কথাটাকে প্রায়োরিটি দিতে যাই তখনই একটা সমস্যা তৈরি হয়, ছান্দিক প্রকরণ ব্যতীত কোন কবিতা লিখিত হওয়া এর প্রকৃতিকে যথেচ্ছ দুর্বল করে তোলে। বেসিক (মূল) কোন আইডোলজি ধরে একে মূল্যায়ন করতে গেলেই কবিতাটির অন্যান্য আনুষঙ্গিক সফলতার দরজাগুলি বন্ধ হয়ে যায় ফলে বিতর্কের মধ্যে কবিতাটির নির্দিষ্ট পাঠকের হাতে মৃত্যু হয়। এখানে পাঠক-নির্ভরতার প্রসঙ্গ আনতে চাই আমি। পাঠক যদি কবিতার ভাষা, বক্তব্যের নির্ভরতা ভেঙে কবিতাটি আবিস্কার করতে পারেন তবেই বোঝা যায় মূল কাব্যিক সফলতাটি আসলে কী? ফলশ্রুতিটাও দাঁড়ায় এরকম যে কবির চিন্তার গতিময়তাও ক্রমান্বয়ে বৈচিত্রেধাবিত হতে পারে পাঠকের শানিত উদ্ভাবনী থেকেই। এতদ্বব্যতীত কবিতাকে যদি গাণিতিক কোন সূত্র ধরে নতুন কাঠামো, টেক্সট বিবৃত করা যায় তাতেও দেখি যে কবিতাটির মুক্তি ঘটছে না বরং পূর্ববর্তী হিসাবেই ভিন্নায়ন হয়। কবি তাঁর অন্তর্জগতের উপলব্ধিত ব্যাখ্যাটি কোন ভাষায়, কোন ভঙ্গিতে, কোন উপমায় প্রকাশ ঘটাবেন তার আনুপূর্বিক ছান্দিক প্রকরণটি কী হতে পারে তা তিনিই নির্ধারণ করতে পারেন পাঠকের আস্থা থেকেই। যেভাবে প্রচল কবিতার আইডোলজি থেকে ছন্দের ধারণা প্রথমেই ভেঙে যায়। মূল কবিতা বা টেক্সট যেখানে পাঠককে সরাসরি কাব্যিকজ্ঞানেই বিদ্ধ করে। এবং এরসাথে টেক্সট-ই আসলে কবিতার প্রধান হিসেবে উপস্থাপিত হয়। প্রচল ছন্দের নির্ভরতার প্রয়োজনও থাকছে না পাঠকের। সময় বদলাচ্ছে। একজন প্রকৃত থিতু কবির একমাত্র ধর্মই দাঁড়াচ্ছে কবিতায়।কথা প্রসঙ্গে একদিন কবিবন্ধু রাজীব আর্জুনি-কে বলেছিলাম, আমার কাছে ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বছরের গোটা বাংলা কবিতা একই রকম মনে হয়। কথাটি বোধ হয় সে মেনে নিতে পারেনি, তার বলবার বিষয় ছিলো, প্রতিটি দশকেই রয়েছে কবিতার বাঁক বা ভাষার পরিবর্তন। ফলশ্রুতির বিষয়টি সে ভাবেনি। বাংলা কবিতায় ত্রিশের দশকের পর সেরকম আর কোন বাঁক সাধারণত আসেনি। ষাটের দশকে সেরকম একটা সম্ভাবনা ছিলোও বটে, ষাটের কবিদের পক্ষে তা সম্ভবও ছিলো কেননা হঠাত করেই বাংলা কবিতায় এতো বেশিসংখ্যক কবির আবির্ভাব কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। যেহেতু কবিতার আয়তন ছিলো ব্যাপক ফলে ব্যাপক পরিধি নিতে পারতো কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলা কবিতার উপর একটি বিশেষ প্রভাব ফেলেছে যেখানে উক্ত যুদ্ধোত্তর চেতনাকে নির্ভর করে বাংলাদেশের সত্তরের দশকটি রচিত হয় অবশ্য কবিরা সেভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না। তখনকার সমাজ, পরিবেশ, জৈবনিক ব্যবস্থাই কবিদের বাধ্য করেছিলো বিপর্যস্ত দেশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কল্লোলের গতি প্রকৃতি বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিতে। বিপর্যয় বলবো এই জন্যে যে ৪৭-এর দেশভাগ, ৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রভাব আমাদেরকে জাতিগত রাজনৈতিক ভাবেই শুধু নয় পিছিয়ে দিয়েছে ভাষার দৌরাত্মেও। কাব্যিক বিবেচনায় কোনো ঔপনিবেশিকতার প্রয়োজন না থাকলেও বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ঔপনিবেশিক অবস্থানের কথা ভাবতে হবে। জাতিগত দুর্বলতা, এ বিষয় উতরিয়ে আশির দশকের কবি-লেখকরা ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যবিবেচনায় বিশেষ তত্পর। স্বাধিন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেসময় সাংস্কৃতিক-সাংগঠনিক দিকটির সফলতা এসেছে কিন্তু অধিকাংশই মূলত সাহিত্যপ্রজ্ঞার জায়গাটিতে স্থিত হয়েছেন ১০০ বছরের পেরিয়ে আসা বাঙালির সাহিত্যের চিত্রসরূপে। কতিপয়ের উপলক্ষিত সফলতা ব্যতীত সার্বিকভাবে সেখানেও বিশেষ কোন সফলতা বা বিশাল কোন পরিবর্তন আসেনি। কারও কারও মতে কবিতায় সেই বিশাল পরিবর্তন এখন একবিংশের কবি-লেখকদের হাতে। অবশ্য কাঙ্ক্ষিত সেই সফলতা কখন অর্জিত হবে সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত হতে পারেন না। কেউ কেউ মনে করেন ২০২০ সালের মধ্যেই আবার কেউ কেউ মনে করেন ২০৫০ সালের মধ্যেই জাতিগত ভূ-বৈশিষ্ট্যে আচার-আচরণের পরিবর্তনের সাথেই অর্জিত হবে। এটি সংগত কারণেই মেনে নেয়া যায় যে, যেহেতু আমাদের মাঝে একটি শতাব্দির পরিবর্তন হলো ফলে তার সাথে মানুষের জীবনযাত্রায় এক বিরাট পরিবর্তন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে আরও আরও অনেক নতুন কিছুই। আর সবকিছুর সাথে তালমিলিয়ে আমাদের চিন্তাস্রোতেরও ব্যাপক পরিবর্তন সমাসন্ন। রাস্ট্র একটি ভৌগলিক সীমারেখায় বেষ্টিত বলে জীবনাচারের মধ্যেও আমরা এর আকারের পরিবর্তন দেখি না। কিন্তু প্রজন্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে সভ্যতার মানবিক আকার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় মানবিক আত্মার নিগূঢ়তম ব্যাপৃতায়ন। সেটি হয় মানুষের লৈঙ্গিক-বৈশ্বিক রাজনৈতিক সচেতনতা থেকেই। আমরা নিশ্চিত যে, খুব শিঘ্রই কবিতার সেই পালাবদল দেখবো। দেখবো যে সমকালীন কবিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেই উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে কোনো পোয়েট লরিয়েট রোবট, পোয়েট এলিয়েন। তার আবহ এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে- এও নিশ্চিত যে, কবিতার সঞ্চারণ! যার ইতিবাচক প্রভাব, সত্যিকার অর্থে এই সময়ের কবিতা থেকেই সে যাত্রা শুরু। শুভাশুভ মধুরেণ সমাপয়েত্

No comments:

Post a Comment