লেখক-পাঠকের উন্নত মনোসংযোগের যে শিল্পিত প্রকাশ সেই সাহিত্যই উদ্ভাবনী সাহিত্য। যে কারণে উদ্ভাবনী সাহিত্যের প্রসংগ আসে। একঘেয়ে সাহিত্য বিমুখ করে দেয় রিডারশ্রেণিকে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় হচ্ছে উদ্ভাবনী সাহিত্যে মনোযোগী হওয়া লেখক-কবিদের। উদ্ভাবনী সাহিত্য আসলে কী? এটি সাহিত্যের একটি চলমান প্রক্রিয়া, একটা সময়ের ভাষা থেকে আরেকটা সময়ের ভাষার যোগাযোগ। লেখক-কবিদের রচনার প্রভাব থেকে যা পাঠকের অন্তরে উৎসারণের জন্ম দেয়। অর্থাত পাঠক রচনায় মনোযোগী হলে তার মধ্যেও যে চিন্তার ধারা প্রভাবিত হয় এবং পাঠকের চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতিতে যে চমক সাহিত্যের জন্ম হচ্ছে সেটাই মূলত উদ্ভাবনী সাহিত্যে রূপ নেয় লেখক-কবিদের হাতেই। এই উদ্ভাবনী একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে চলতেই রূপ নিচ্ছে অন্য আরেকটি উদ্ভাবনীতে, জীবনাচারে। সঞ্চারিত হবার পরই রূপারোপ বোঝা যায় রূপের রূপান্তর, কিন্তু রূপান্তরের এই উদ্ভাবনী সাহিত্য সজ্ঞান গতিময়তার সাথে পঠিত হয়? প্রশ্নের উদ্রেক করে। নিথর, নিস্তেজ সাহিত্য উদ্ভাবনের গতিময়তাকে শ্লথ করে দেয়। সময়ের উদ্ভাবনীতে যতো সাহিত্য আমাদের মননের মধ্যে এসেছে তার সমগ্র সাহিত্যই কিছু না কিছু পঠিত হয়েছে রাস্ট্রভেদে, ভাষার বৈচিত্রে; অজস্র পাঠকের মধ্যে। এই পঠনের মধ্যে, পাঠক ক্লান্ত হয়েই কেবল অনুভব করেন নতুন সাহিত্যিক প্রজ্ঞা ও তার প্রয়োজনীয়তা। ক্রমবৈচিত্রে উদ্ভাসিত করতে চান নিজের আলোকিত ভুবন।
জ্ঞানের অসীম সম্ভাবনা। পঠনপাঠন জরুরি। সাহিত্যের বিশুদ্ধ পাঠক আছে একথা হলপ করে বলা দুরূহ ব্যাপার, বিশুদ্ধ পাঠক হয়ও না সাধারণত। ভাসা ভাসা পাঠে মনযোগী থাকেন অধিকাংশ পাঠক। আর গল্প, উপন্যাস, নাটকমতো রচনার তরল পাঠক তো সাহিত্যের ধারে-কাছেই আসে না, আসতে পারে না দুর্বল সাহিত্য মানসিকতার কারণেই। হালকা রোমান্সের আবেগে মগ্ন থাকতে দেখি অধিকাংশ রিডারকে। পাঠেরও যে প্রতিবেশ রাস্ট্রায়তনিক জনঘনত্বের সাথে সাথে বহুকাল পূর্বেই তা বিলুপের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। লেখকের পাঠের পরিবেশ, যাপনপ্রণালী বিঘ্নিত হয়েছে। এখানে পাঠকের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসংগও আসে। সাহিত্য এবং সাহিত্যের ভিতরে সংবাদবস্তুর প্রভাবে মিশ্র একটি ভাষার আবির্ভাব আমরা লক্ষ করেছি। উন্নত জাতিতাত্ত্বিক প্রণোদনায় বিষয়টি যেমন রচনার মধ্যেই আরোপিত হতে পারে তেমনই পাঠককেও সচেতন থাকতে হয় এর ফলাফল আবিস্কার ও পরিণতিতে সচেষ্ট হতে। বাংলা গদ্যের প্রসার এই বঙ্গে হয়নি। সকল গল্প, উপন্যাস, নাটকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি বা ভৌগলিকদর্শন আসছে না। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ নিরীক্ষণমাত্রায় আসার কথা নয়। আবার শুধুমাত্র বিনোদননির্ভর রচনাকেই আমরা সিরিয়াস সাহিত্য বলে আমলে নিচ্ছি না। বিস্তৃত সাহিত্যের উপযোগিতা থেকে এমন বিবৃতিও বের করা সম্ভব যে, মূল রচনার পঙতি ধরে ধরেও অর্থদ্যোতনার যোগসূত্রতা লেখকের চিন্তায় পাওয়া যায় না। যে কারণে সমালোচনা সাহিত্যের পরিপূর্ণতা পায়নি। পাঠক প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। নানা মত-বিতর্কেরও জন্ম হয়েছে, বিশেষ ফল হলে তারও শ্রুতিমাধুর্য এরমধ্যেই আমাদের উদ্ভাবনসীমায় উদ্ভাসিত থেকে যেত স্বনিয়মেই। উদ্ভাবনী সাহিত্যের একটা ধন্দ আছে। লেখকের উদ্ভাবনীতে এর দুটি রূপ পায়। একটি স্বয়ং লেখকের বলবার ভাষায় বর্তমান অন্যটি হচ্ছে তার লেখনির ভাষায় ভবিষ্যত সৃজনশীলতা। কখনো কখনো খুব তাত্ত্বিক মেধাবি লেখকের পক্ষেও তার বলবার ভাষা থেকে লেখার ভাষায় খেই হারানোর ঘটনাটি বুঝতে পারা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বুঝতে পারার সময় উবে যায়। তারই সৃষ্ট সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অবচেতনে তাকেও প্রতারিত করে। স্বয়ংনির্ভর অধিশ্বর। এরকম অবচেতনের জায়গা থেকেই লেখকের স্বাধিনতা ক্ষুণ্ন হয়। চিন্তাশক্তির অবক্ষয় হয়! এই পরিস্থিতিতে তার শ্রমসাধ্য লেখনিটিও পাঠকের শ্রুতিতে সার্বজনিন হয়ে আসে না। একটা বেতাল গতিতে পতিত হয় সমাজ মনস্কতায়। যে কারণে ধরে নিতে হচ্ছে নতুন চিন্তাস্রোত বা বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যে পাঠকের উদাসীনতা রয়েছে। পাঠকভেদে, জাতিভেদে সাহিত্যের উদ্ভাবনটা হয় অবচেতনেই। এর ফলশ্রুতিটি পেশাগত লেখক-কবিদের হাত দিয়েই রচিত হলো নাকি পাঠকই শেষমেশ লেখকসত্তায় উন্নীত হলেন সেটি বড় কথা নয়। যে অবস্থান থেকে উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত কিংবা লিখিত হলো সেখান থেকেই সৃজনশীল সাহিত্য এবং তার সাথে নতুন সাহিত্য কীর্তিমানের সূচনা আমরা ধরে নিতে পারি। ধরে নিতে পারি, সূচিত ওই কীর্তিমানের বিবৃতি থেকেই সভ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে উদ্ভাবনের উন্নীতমাত্রায় উদ্ভাসিত হবার রূপ।
লাখো গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বসাহিত্য আমাদের অপঠিত থাকে। ফলে জ্ঞানের উন্নীত স্পর্ধায় উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত হয় না আমাদের কাছে। বাঙালির চিরায়ত সুফি-সন্ন্যাস বাউলদর্শনের মধ্যে ব্যাপক উদ্ভাবন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সমাধান আছে। মানবিক দীক্ষা কিংবা বিশ্ববীক্ষা ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অভিজ্ঞান পাওয়া যায়। রিলিজিয়ন ফ্রম রিয়েলিটি। স্বভাববৈশিষ্ট্যে বাস্তবভিত্তিক যে জ্ঞানের সমাহার, যুগান্তরের মানবিক দীক্ষা, ওরকম পরিস্থিতি থেকেই সম্ভব। কিন্তু জাতিগত আইডোলিটি থেকে এরাই আবার পতিত হয়েছে। পতিত হবার শিক্ষা অর্জন করেছে। এই যে জীবনাচারের স্ফূরিত সঞ্চালকশক্তি, এটিই আবার উদ্দিপিত করেছে আধুনিক অক্ষরজ্ঞানে শিক্ষিতশ্রেণীকে। গৌতম বুদ্ধ পিতার সিংহাসন ছেড়ে অরণ্যে সন্ন্যাসসাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করলেন আত্মকৃত ভাবাদর্শে। রাস্ট্রবেস্টন তাকে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। কার্ল মার্কসের পুঁজিতন্ত্রের আধিপত্যে বিশ্ববাসী সাম্রাজ্যবাদে দীক্ষিত হলেন। বাঙালির জীবনাচারের ভাষাতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের ভুল ব্যাখ্যা এবং জাতিগত প্রলুব্ধির ক্ষেত্রটিতেও এমনই অবস্থা হয়েছে যে, এদের কথা বলবার ভাষাটিই পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টের ভাষা, বিজ্ঞাপনের ভাষায়। আপনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেনো আপনি পুঁজির সম্পদ। পুঁজি পুঁজির স্থানেই রয়ে গেছে। একক ব্যক্তির পুঁজি এবং সাম্রাজ্য প্রবৃত্তির বিষয়টি এদের সংজ্ঞা থেকে উঠে গেছে।
দশক, শতক পরিবর্তনের সাথে সাথে মৌলিক সাহিত্যব্যতীত অবচেতন উদ্ভাবনী আমাদের সংজ্ঞায় আসে একটা সময়ে। তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক পাঠকশ্রেণির কাছেই কেবল বিষয়টি ধরা পড়ে। আবার মানুষমাত্রই রাস্ট্রবেস্টনের একঘেয়ে জীবনাচারের মধ্যে থেকে নতুন চিন্তার সংগে নিজেকে যুক্ত করেন। রাজনৈতিক চিন্তাস্রোতের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন। এই চিন্তাস্রোতেরই যে ফলশ্রুতি আমরা লেখক-কবিদের মধ্য থেকে পাই তাই আসলে উদ্ভাবনী সাহিত্য। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি পড়ে যদি কোনো পাঠক এরকম মনে করেন যে, ‘যেন মহিমামণ্ডিত হয় এই উঁকি দেয়া, রোদের আগেই / যেই আভা এসে লাগে ধানগাছে, খঞ্জনা পাখির কণ্ঠে / উঠে যেন আসে ওই গান, মানুষের ঠোঁটে’ আবার ফরিদ কবিরের কবিতাপঙতি ‘অঙ্কুরের স্বপ্ন ফল ফলের স্বপ্ন কী? একথা জানি না, এটা জানে আমাদের গৌতম চৌধুরী’। লালে লাল। এরকম পঙতি পড়ে যদি কোনো সংগীত রচয়িতার মধ্যে কোনো প্রভাব পড়ে এবং তিনি যদি একটি সংগীতের, ‘জল ছুঁয়ে যায় জলের বাড়ি মন ছুঁয়ে যায় মনে’ এরকম কোনো পঙতি লিখে ফেলেন তাহলেই কেবল বোঝা সম্ভব উদ্ভাবনীটি আসলে কী ঘটিয়ে দিলো পাঠকের অন্তরে। আসলে বিষয় স্বাভাবিক। যাই হোক, সাহিত্যের উদ্ভাবনীটি তৈরি হয় ভাষার যোগসূত্রে। আদিতে মানুষের যে ভাষা তার সাথে বর্তমানের সমন্বয়ে যে ভাষার জন্ম এবং ভাষাজন্মের যে সাহিত্য। বিজ্ঞাননির্ভর তত্ত্ব দিয়ে আমরা ভাবতে পারি, তাতে সাহিত্য থাকে না। বিজ্ঞানচেতনা সাহিত্যে থাকতে পারে কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুকৃতি পাল্টে দেয় সাহিত্যের ধরন, প্রতিবেশ। ভৌগলিক পরিসর বাঙালিকে কাব্যিক মননশীলতায় ব্যাপ্তি দিয়েছে আর ভারতবর্ষে পড়েছে সাংস্কৃতিক প্রসারণ। তুরস্ক, ইরান, মিসর, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার জীবনাচার আমাদের মাঝে রূপকথারই জন্ম দিয়েছে কিন্তু ভারতবর্ষ সাংস্কৃতিক প্রণোদনার জায়গায় উন্নীত মাত্রাকেও অতিক্রম করেছে। নিসন্দেহে শুধুমাত্র জাতি এবং ভাষাই নয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও পড়েছে ব্যাপকভাবে। জাতিগত সাংস্কৃতিক প্রাণচাঞ্চল্যের বৈশিষ্ট্যে ভারত আজ আর পিছিয়ে নেই। কবিতা, গদ্যসাহিত্য, চলচিত্র, রাজনৈতিক অভিজ্ঞানেও ব্যাপক পরিসরের প্রসংগে পাঠকশ্রোতার বিমুখ হবার অবকাশ নাই। এখানে বাঙালির সুফিতত্ত্বের ধারণাটি একটি চমক সৃষ্টি করবে। অধ্যাত্ম মরমীচর্চায়, আদিভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় হয়ত অতীশ দীপঙ্করের ভাষাকেই কমুনিকেট করা যায়। তাতে কাব্যিক মননশীলতাও পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভৌগলিক বীক্ষায় সংস্কৃতিকচর্চা করতে গেলে বাস্তবতায় ফিরে আসতেই হয়। সজ্ঞানে, বাজারদরে কোনো পাঠকও এখানে প্রতারিত হবার সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হবেন না।
ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মান সাহিত্যের সংগে আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য। দুর্বলতার একটা ক্ষেত্রে অবস্থানে আমরা সংজ্ঞাত হয়েছি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানদের সাহিত্যই আধুনিক সাহিত্য। আরো বিভাজন করে দেখলে স্পেন, ফ্রান্স, কানাডা, সুইডেন, জাপান, জার্মান সাহিত্যই কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত। কিন্তু ভাষার অজ্ঞতা থেকেই যায়। জাতিগতভাবে আত্মনির্ভরতা হারালেই কেবল এইরূপ চিন্তন প্রক্রিয়ার অভ্যুদয় হয়। বিশ শতকের একেবারে শেষ দু-দশকে আমরা দেখেছি পেঙ্গুইন বুকস, রাশান প্রগতি, সংঘ প্রকাশনের বাংলা প্রকাশনার সমৃদ্ধি এমনকি ভারতিয় আনন্দবাজার, দেশ প্রকাশনার সহস্র প্রকাশনায় বৈদেশিক সাহিত্যের ছড়াছড়ি যেভাবে হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশি সাহিত্য কিংবা প্রকাশনার বিশেষ কোন ব্যাপ্তিই ওইসব প্রকাশনায় ছিল না। ফলে বাংলাভাষায় সাবলিল বুদ্ধিবৃত্তিক মনোনিবেশের বিকাশ ঘটার প্রতিবেশ পায়নি। উল্লেখিত কমুনিকেটিভ লিটারেচারেও আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তিতে প্রসারলাভ বিলম্বিত হয়েছে। অধুনান্তিক গ্লোবালাইজেশন প্রক্রিয়াটি দূরকল্পন। প্রতি পনের কিলোমিটার অন্তরেই মানুষের ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার লৈঙ্গিক রাজনীতিতেও ভাষা দুর্বলতার শিকার হয়। দুর্বল ভাষার প্রভাবে হীনসংস্কৃতির উদ্ভব। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই পেশাগত অবস্থানকে বিগড়ে দিচ্ছে। একদিকে করুণ আর্তির নগ্নতায় রচিত হয় হীনমন্যতা অন্যদিকেই বিনোদনের মাত্রাতিরিক্ত সভ্যতার ভোগবাদ। ফলে ভোগবাদের সাহিত্য হীনমন্য সামাজিকতাকেই উন্নীত করেছে বিশ্ব চরাচরে। এর ফলশ্রুতি ইউরোপ, আমেরিকায় পড়েনি। যা শ্রেষ্ঠ তা আসলে শ্রেষ্ঠই, শ্রেষ্ঠজ্ঞানে উদ্ধৃতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে ভাষায় আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য এবং দখলদারিত্ব নেই এরকম বিষয়ই নির্বাচিত করি আমরা উদ্ভাবন বিবেচনায়।
উদ্ভাবনী সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আছে। উদ্ভাবন থেকেই উদ্দিপিত হওয়া। মানুষের জীবনাচারে সাহিত্য না থাকলে সংস্কৃতির জন্ম হয় না, সংস্কৃতি না থাকলে রাস্ট্রের উপস্থাপনশৈলী বিশ্বের কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ রাস্ট্রের কাছে যেমন দায়বদ্ধ তেমনই মহাকালের সময়ে, সৌরজগতের ব্যাপৃতিতেও তার দায় যথাবহাল থাকে। মহাকালের চেতনায় আপনার রাস্ট্র ভেদ করে বিশ্বে এবং বিশ্ব থেকে সৌরশক্তিতে প্রবেশ করার (যুদ্ধপ্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আধিপত্যের চেয়ে সৌন্দর্যবীক্ষায় সাম্রাজ্যহরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যম) নব নব চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতিই সময়ের উদ্ভাবনী সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিচেতনার অবিসংবাদিত সেই মননশীল কীর্তিমান যার মননশীলতায় জাতিগতভাবেই উন্নীত হওয়া আজো সময়ের ব্যাপার। এই অবিসংবাদিত মহান কীর্তিমানের সাহিত্যিক পদমর্যাদা মর্মবস্তুতে উন্নীত না করেই দুই বাংলার সাহিত্যিক প্রতিবেশ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সাহিত্যিক প্রবণতা ও প্রতিবেশের মানবীয় গুণাগুণ। ভবিষ্যত সাহিত্যে আমরা হয়ত ভাষার দুর্বল সেই অবস্থানের দিকেই যাচ্ছি যেখানে অবিভক্ত বাংলাভাষার উৎসচর্চায় মূল কেন্দ্রবিন্দুটি আর শনাক্ত করা যাবে না। কিছুটা ভাষার উৎস আমরা পাবো পল্লিকবি জসীমউদ্দীনেই। পূর্ববঙ্গে তিনিই একমাত্র আধুনিক, যার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো শিক্ষিতশ্রেণির বোধকে জাগ্রত করে দেয়া চিরন্তন বাঙালির চর্চিত মূল্যবোধের ভাষায়, মানবিক জীবনবৈশিষ্ট্যে।
আধুনিক গদ্যসাহিত্যের প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েনি। মননশীলতার প্রভাবই-বা সৃজিত হয় কোত্থেকে। অমিয় চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গদ্যছাড়া আধুনিক গদ্যসাহিত্য কিংবা সমালোচনা সাহিত্যের সমৃদ্ধি আসেনি। রাস্ট্রচিন্তায় সমালোচনা সাহিত্যের যেটুকু প্রবৃত্তি অর্জন হয়েছে এর বাইরে এই সময় একমাত্র সলিমুল্লাহ খানেরই বুদ্ধিবৃত্তিক রচনার সমৃদ্ধি এসেছে। ঔপনিবেশিক, উপমহাদেশিয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং গ্লোবালচিন্তন প্রক্রিয়ার প্রভাব উন্মুক্ত করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চা, সমাজ-রাজনীতি, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান আছে। ড. প্রথমা রায়মণ্ডল লিখেন, প্রবন্ধের বিকাশ যে অনুকূল পরিবেশকে আশ্রয় করেই সম্ভব হয় এবং অধোগতিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে প্রতিকূল পরিবেশের যন্ত্রণায়- বাঙলাদেশের রাজনীতিতে তথা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের সেই চেহারাটিই লক্ষ করা যায়।
সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূলতায় চিন্তাবিদদের চিন্তাশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তেমনি অনুকূল প্রতিবেশ পেলে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক ও শিল্পীর অধিকার তথা স্বাধিন সৃষ্টিশীল দিগন্ত হয় প্রসারিত। পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতির বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটেছে, তবে তা নিছকই কৌশলগত। মূল কাঠামো না বদলালে তার উপরি-কাঠামো বদলায় না।
(বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, প্রতীক বুকস, কলকাতা-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২৩)
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে রোমান্টিক রচনাধারায় ভিন্নমাত্রিক সংযোজন নাসরীন জাহানের ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’। জৈবনিক বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট এটি একটি প্রভাব আধিপত্যের উপন্যাস। ঔপনিবেশিকতা ছাড়া মানবীয় চরিত্রই যেখানে প্রধান উপজীব্য হয়েছে। যদিও উপন্যাসটিতে লৈঙ্গিক শ্রেণিবিন্যাসে শুধুমাত্র নারীবাদী রচনা বলে খারিজ করে দিতে পারেন যেকোন পাঠক। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গদ্যের দুর্বলতা, মৌলবাদী হীনমন্যতা বর্জন করা গেলে উপন্যাসটিতে বিবাহযোগ্যা একজন যুবতী কন্যার রাস্ট্রিক সামাজিক প্রপীড়ন, লজ্জা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ট্র্যাজিক চিত্রটিই নিবেদিত হয় পাঠকের দরবারে, যে ধরনের রচনার পক্ষে সম্ভব মুহূর্তেই পাঠককে উদ্দিপিত করে ফেলা সাহিত্যিক সঞ্চারণে।
মানুষের মধ্যেই যেহেতু সাহিত্যের বিস্তার কাজেই মানবজন্মের সংগে এর সম্পৃক্ততা নিবিড়, আরাধ্য। সৌরমণ্ডলে মানব অস্তিত্ব বিলুপ হবার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যের উৎসারণ আমরা পাবো এবং কালে কালে এর উদ্ভাবনও দেখবো এটা ঠিক। আবার প্রযুক্তিও ব্যাপক উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। সময়ে যা মানুষের কাছে পরিবর্তিত হলো, পরিবর্তনের প্রকাশ হলো সেটাই উদ্ভাবন আমাদের। উনিশ শতকের প্রযুক্তি এবং পরিবর্তনের পর আজকের বিশ শতকে লেখক-পাঠক যারা তারাই এই উদ্ভাবনের ধন্দে পড়লেন। হস্তলিখিত সাহিত্যের মুদ্রণভঙ্গিমা পাল্টে যুক্ত হলো প্রযুক্তি মাধ্যমের ওয়েব সংস্করণ / প্রকাশন। লেখক-কবিমাত্রই কাগজে-কলমে চিন্তাশক্তির ব্যাপক প্রয়োগে লিখন প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। প্রযুক্তির আধিপত্য। আপনার চিন্তার পরের ফলশ্রুতিটিও পেতে পারেন খুব সহজেই। রিডার নোটবুক পিসি, প্রযুক্তির একটি পাঠক ধরে নিয়েও সম্ভব উদ্ভাবনী সাহিত্য তথা সাহিত্যিক প্রসারণ ক্ষমতা আবিষ্কার করা। এই উদ্ভাবন বা ধন্দটাকেই আমি একটা চাটখিলা অবস্থা বলে চালিয়ে নিতে চাই। অর্থাত ক্রমউদ্ভাবনের মধ্যে থেকেও আপনার মনে হলো যে আপনি সাহিত্যের উদ্ভাবনীতে নেই। সাহিত্য পঠিত হলে যেমন উদ্ভাবন বহাল থাকে আবার অপঠিত থাকলে তারও উদ্ভাবন থাকে লেখক-কবি বা পাঠকের মননের মধ্যেই। যা উদ্ভাবন তা আসলে উদ্ভাবন-ই। এর কোনো বিকল্প নাই।
চর্যাপদের ভাষা এবং জীবনাচার একরকম ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যধরন আরেকপ্রকার। বঙ্কিম-রবীন্দ্র বা বিশ শতকের সামগ্রিক সাহিত্যের মননশীলতায় একরূপ আর এই সময়ের সাহিত্যের সৃজনকাতরতার ভিন্ন আরেকটি রূপ। রাস্ট্রবেস্টনের মধ্যে, জীবনাচারে পিছিয়ে পড়া লেখক-কবিমাত্রই বলবার কিংবা প্রকাশ ভঙ্গিমায় সাহিত্যকে অস্বীকার করেন আবার নিজেই নিজের ভেতরে লালন করেন আত্মার অসীম মুক্তি, মুক্তির আকুলতা তারই সৃষ্ট রচনার গুণাগুণে। এই যে আমাদের চেনাজানা সাহিত্যের পরিবর্তন, লেখক-কবিরাই ভৌগলিক বীক্ষায় লেখনির জায়গাটিতে ক্রমান্বয়ে দাসে পরিণত হলেন। এর একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তরেই আমরা দেখেছি সাহিত্যের উদ্ভাবন সময়ের লেখক-কবিদের।
জ্ঞানের অসীম সম্ভাবনা। পঠনপাঠন জরুরি। সাহিত্যের বিশুদ্ধ পাঠক আছে একথা হলপ করে বলা দুরূহ ব্যাপার, বিশুদ্ধ পাঠক হয়ও না সাধারণত। ভাসা ভাসা পাঠে মনযোগী থাকেন অধিকাংশ পাঠক। আর গল্প, উপন্যাস, নাটকমতো রচনার তরল পাঠক তো সাহিত্যের ধারে-কাছেই আসে না, আসতে পারে না দুর্বল সাহিত্য মানসিকতার কারণেই। হালকা রোমান্সের আবেগে মগ্ন থাকতে দেখি অধিকাংশ রিডারকে। পাঠেরও যে প্রতিবেশ রাস্ট্রায়তনিক জনঘনত্বের সাথে সাথে বহুকাল পূর্বেই তা বিলুপের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। লেখকের পাঠের পরিবেশ, যাপনপ্রণালী বিঘ্নিত হয়েছে। এখানে পাঠকের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসংগও আসে। সাহিত্য এবং সাহিত্যের ভিতরে সংবাদবস্তুর প্রভাবে মিশ্র একটি ভাষার আবির্ভাব আমরা লক্ষ করেছি। উন্নত জাতিতাত্ত্বিক প্রণোদনায় বিষয়টি যেমন রচনার মধ্যেই আরোপিত হতে পারে তেমনই পাঠককেও সচেতন থাকতে হয় এর ফলাফল আবিস্কার ও পরিণতিতে সচেষ্ট হতে। বাংলা গদ্যের প্রসার এই বঙ্গে হয়নি। সকল গল্প, উপন্যাস, নাটকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি বা ভৌগলিকদর্শন আসছে না। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ নিরীক্ষণমাত্রায় আসার কথা নয়। আবার শুধুমাত্র বিনোদননির্ভর রচনাকেই আমরা সিরিয়াস সাহিত্য বলে আমলে নিচ্ছি না। বিস্তৃত সাহিত্যের উপযোগিতা থেকে এমন বিবৃতিও বের করা সম্ভব যে, মূল রচনার পঙতি ধরে ধরেও অর্থদ্যোতনার যোগসূত্রতা লেখকের চিন্তায় পাওয়া যায় না। যে কারণে সমালোচনা সাহিত্যের পরিপূর্ণতা পায়নি। পাঠক প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। নানা মত-বিতর্কেরও জন্ম হয়েছে, বিশেষ ফল হলে তারও শ্রুতিমাধুর্য এরমধ্যেই আমাদের উদ্ভাবনসীমায় উদ্ভাসিত থেকে যেত স্বনিয়মেই। উদ্ভাবনী সাহিত্যের একটা ধন্দ আছে। লেখকের উদ্ভাবনীতে এর দুটি রূপ পায়। একটি স্বয়ং লেখকের বলবার ভাষায় বর্তমান অন্যটি হচ্ছে তার লেখনির ভাষায় ভবিষ্যত সৃজনশীলতা। কখনো কখনো খুব তাত্ত্বিক মেধাবি লেখকের পক্ষেও তার বলবার ভাষা থেকে লেখার ভাষায় খেই হারানোর ঘটনাটি বুঝতে পারা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বুঝতে পারার সময় উবে যায়। তারই সৃষ্ট সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অবচেতনে তাকেও প্রতারিত করে। স্বয়ংনির্ভর অধিশ্বর। এরকম অবচেতনের জায়গা থেকেই লেখকের স্বাধিনতা ক্ষুণ্ন হয়। চিন্তাশক্তির অবক্ষয় হয়! এই পরিস্থিতিতে তার শ্রমসাধ্য লেখনিটিও পাঠকের শ্রুতিতে সার্বজনিন হয়ে আসে না। একটা বেতাল গতিতে পতিত হয় সমাজ মনস্কতায়। যে কারণে ধরে নিতে হচ্ছে নতুন চিন্তাস্রোত বা বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যে পাঠকের উদাসীনতা রয়েছে। পাঠকভেদে, জাতিভেদে সাহিত্যের উদ্ভাবনটা হয় অবচেতনেই। এর ফলশ্রুতিটি পেশাগত লেখক-কবিদের হাত দিয়েই রচিত হলো নাকি পাঠকই শেষমেশ লেখকসত্তায় উন্নীত হলেন সেটি বড় কথা নয়। যে অবস্থান থেকে উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত কিংবা লিখিত হলো সেখান থেকেই সৃজনশীল সাহিত্য এবং তার সাথে নতুন সাহিত্য কীর্তিমানের সূচনা আমরা ধরে নিতে পারি। ধরে নিতে পারি, সূচিত ওই কীর্তিমানের বিবৃতি থেকেই সভ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে উদ্ভাবনের উন্নীতমাত্রায় উদ্ভাসিত হবার রূপ।
লাখো গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বসাহিত্য আমাদের অপঠিত থাকে। ফলে জ্ঞানের উন্নীত স্পর্ধায় উদ্ভাবনীটি আবিস্কৃত হয় না আমাদের কাছে। বাঙালির চিরায়ত সুফি-সন্ন্যাস বাউলদর্শনের মধ্যে ব্যাপক উদ্ভাবন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সমাধান আছে। মানবিক দীক্ষা কিংবা বিশ্ববীক্ষা ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অভিজ্ঞান পাওয়া যায়। রিলিজিয়ন ফ্রম রিয়েলিটি। স্বভাববৈশিষ্ট্যে বাস্তবভিত্তিক যে জ্ঞানের সমাহার, যুগান্তরের মানবিক দীক্ষা, ওরকম পরিস্থিতি থেকেই সম্ভব। কিন্তু জাতিগত আইডোলিটি থেকে এরাই আবার পতিত হয়েছে। পতিত হবার শিক্ষা অর্জন করেছে। এই যে জীবনাচারের স্ফূরিত সঞ্চালকশক্তি, এটিই আবার উদ্দিপিত করেছে আধুনিক অক্ষরজ্ঞানে শিক্ষিতশ্রেণীকে। গৌতম বুদ্ধ পিতার সিংহাসন ছেড়ে অরণ্যে সন্ন্যাসসাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করলেন আত্মকৃত ভাবাদর্শে। রাস্ট্রবেস্টন তাকে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। কার্ল মার্কসের পুঁজিতন্ত্রের আধিপত্যে বিশ্ববাসী সাম্রাজ্যবাদে দীক্ষিত হলেন। বাঙালির জীবনাচারের ভাষাতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের ভুল ব্যাখ্যা এবং জাতিগত প্রলুব্ধির ক্ষেত্রটিতেও এমনই অবস্থা হয়েছে যে, এদের কথা বলবার ভাষাটিই পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টের ভাষা, বিজ্ঞাপনের ভাষায়। আপনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেনো আপনি পুঁজির সম্পদ। পুঁজি পুঁজির স্থানেই রয়ে গেছে। একক ব্যক্তির পুঁজি এবং সাম্রাজ্য প্রবৃত্তির বিষয়টি এদের সংজ্ঞা থেকে উঠে গেছে।
দশক, শতক পরিবর্তনের সাথে সাথে মৌলিক সাহিত্যব্যতীত অবচেতন উদ্ভাবনী আমাদের সংজ্ঞায় আসে একটা সময়ে। তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক পাঠকশ্রেণির কাছেই কেবল বিষয়টি ধরা পড়ে। আবার মানুষমাত্রই রাস্ট্রবেস্টনের একঘেয়ে জীবনাচারের মধ্যে থেকে নতুন চিন্তার সংগে নিজেকে যুক্ত করেন। রাজনৈতিক চিন্তাস্রোতের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন। এই চিন্তাস্রোতেরই যে ফলশ্রুতি আমরা লেখক-কবিদের মধ্য থেকে পাই তাই আসলে উদ্ভাবনী সাহিত্য। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি পড়ে যদি কোনো পাঠক এরকম মনে করেন যে, ‘যেন মহিমামণ্ডিত হয় এই উঁকি দেয়া, রোদের আগেই / যেই আভা এসে লাগে ধানগাছে, খঞ্জনা পাখির কণ্ঠে / উঠে যেন আসে ওই গান, মানুষের ঠোঁটে’ আবার ফরিদ কবিরের কবিতাপঙতি ‘অঙ্কুরের স্বপ্ন ফল ফলের স্বপ্ন কী? একথা জানি না, এটা জানে আমাদের গৌতম চৌধুরী’। লালে লাল। এরকম পঙতি পড়ে যদি কোনো সংগীত রচয়িতার মধ্যে কোনো প্রভাব পড়ে এবং তিনি যদি একটি সংগীতের, ‘জল ছুঁয়ে যায় জলের বাড়ি মন ছুঁয়ে যায় মনে’ এরকম কোনো পঙতি লিখে ফেলেন তাহলেই কেবল বোঝা সম্ভব উদ্ভাবনীটি আসলে কী ঘটিয়ে দিলো পাঠকের অন্তরে। আসলে বিষয় স্বাভাবিক। যাই হোক, সাহিত্যের উদ্ভাবনীটি তৈরি হয় ভাষার যোগসূত্রে। আদিতে মানুষের যে ভাষা তার সাথে বর্তমানের সমন্বয়ে যে ভাষার জন্ম এবং ভাষাজন্মের যে সাহিত্য। বিজ্ঞাননির্ভর তত্ত্ব দিয়ে আমরা ভাবতে পারি, তাতে সাহিত্য থাকে না। বিজ্ঞানচেতনা সাহিত্যে থাকতে পারে কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুকৃতি পাল্টে দেয় সাহিত্যের ধরন, প্রতিবেশ। ভৌগলিক পরিসর বাঙালিকে কাব্যিক মননশীলতায় ব্যাপ্তি দিয়েছে আর ভারতবর্ষে পড়েছে সাংস্কৃতিক প্রসারণ। তুরস্ক, ইরান, মিসর, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার জীবনাচার আমাদের মাঝে রূপকথারই জন্ম দিয়েছে কিন্তু ভারতবর্ষ সাংস্কৃতিক প্রণোদনার জায়গায় উন্নীত মাত্রাকেও অতিক্রম করেছে। নিসন্দেহে শুধুমাত্র জাতি এবং ভাষাই নয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও পড়েছে ব্যাপকভাবে। জাতিগত সাংস্কৃতিক প্রাণচাঞ্চল্যের বৈশিষ্ট্যে ভারত আজ আর পিছিয়ে নেই। কবিতা, গদ্যসাহিত্য, চলচিত্র, রাজনৈতিক অভিজ্ঞানেও ব্যাপক পরিসরের প্রসংগে পাঠকশ্রোতার বিমুখ হবার অবকাশ নাই। এখানে বাঙালির সুফিতত্ত্বের ধারণাটি একটি চমক সৃষ্টি করবে। অধ্যাত্ম মরমীচর্চায়, আদিভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় হয়ত অতীশ দীপঙ্করের ভাষাকেই কমুনিকেট করা যায়। তাতে কাব্যিক মননশীলতাও পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভৌগলিক বীক্ষায় সংস্কৃতিকচর্চা করতে গেলে বাস্তবতায় ফিরে আসতেই হয়। সজ্ঞানে, বাজারদরে কোনো পাঠকও এখানে প্রতারিত হবার সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হবেন না।
ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মান সাহিত্যের সংগে আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য। দুর্বলতার একটা ক্ষেত্রে অবস্থানে আমরা সংজ্ঞাত হয়েছি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানদের সাহিত্যই আধুনিক সাহিত্য। আরো বিভাজন করে দেখলে স্পেন, ফ্রান্স, কানাডা, সুইডেন, জাপান, জার্মান সাহিত্যই কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত। কিন্তু ভাষার অজ্ঞতা থেকেই যায়। জাতিগতভাবে আত্মনির্ভরতা হারালেই কেবল এইরূপ চিন্তন প্রক্রিয়ার অভ্যুদয় হয়। বিশ শতকের একেবারে শেষ দু-দশকে আমরা দেখেছি পেঙ্গুইন বুকস, রাশান প্রগতি, সংঘ প্রকাশনের বাংলা প্রকাশনার সমৃদ্ধি এমনকি ভারতিয় আনন্দবাজার, দেশ প্রকাশনার সহস্র প্রকাশনায় বৈদেশিক সাহিত্যের ছড়াছড়ি যেভাবে হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশি সাহিত্য কিংবা প্রকাশনার বিশেষ কোন ব্যাপ্তিই ওইসব প্রকাশনায় ছিল না। ফলে বাংলাভাষায় সাবলিল বুদ্ধিবৃত্তিক মনোনিবেশের বিকাশ ঘটার প্রতিবেশ পায়নি। উল্লেখিত কমুনিকেটিভ লিটারেচারেও আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তিতে প্রসারলাভ বিলম্বিত হয়েছে। অধুনান্তিক গ্লোবালাইজেশন প্রক্রিয়াটি দূরকল্পন। প্রতি পনের কিলোমিটার অন্তরেই মানুষের ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার লৈঙ্গিক রাজনীতিতেও ভাষা দুর্বলতার শিকার হয়। দুর্বল ভাষার প্রভাবে হীনসংস্কৃতির উদ্ভব। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই পেশাগত অবস্থানকে বিগড়ে দিচ্ছে। একদিকে করুণ আর্তির নগ্নতায় রচিত হয় হীনমন্যতা অন্যদিকেই বিনোদনের মাত্রাতিরিক্ত সভ্যতার ভোগবাদ। ফলে ভোগবাদের সাহিত্য হীনমন্য সামাজিকতাকেই উন্নীত করেছে বিশ্ব চরাচরে। এর ফলশ্রুতি ইউরোপ, আমেরিকায় পড়েনি। যা শ্রেষ্ঠ তা আসলে শ্রেষ্ঠই, শ্রেষ্ঠজ্ঞানে উদ্ধৃতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে ভাষায় আমাদের পরিচিতি অতি নগণ্য এবং দখলদারিত্ব নেই এরকম বিষয়ই নির্বাচিত করি আমরা উদ্ভাবন বিবেচনায়।
উদ্ভাবনী সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আছে। উদ্ভাবন থেকেই উদ্দিপিত হওয়া। মানুষের জীবনাচারে সাহিত্য না থাকলে সংস্কৃতির জন্ম হয় না, সংস্কৃতি না থাকলে রাস্ট্রের উপস্থাপনশৈলী বিশ্বের কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ রাস্ট্রের কাছে যেমন দায়বদ্ধ তেমনই মহাকালের সময়ে, সৌরজগতের ব্যাপৃতিতেও তার দায় যথাবহাল থাকে। মহাকালের চেতনায় আপনার রাস্ট্র ভেদ করে বিশ্বে এবং বিশ্ব থেকে সৌরশক্তিতে প্রবেশ করার (যুদ্ধপ্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আধিপত্যের চেয়ে সৌন্দর্যবীক্ষায় সাম্রাজ্যহরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যম) নব নব চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতিই সময়ের উদ্ভাবনী সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিচেতনার অবিসংবাদিত সেই মননশীল কীর্তিমান যার মননশীলতায় জাতিগতভাবেই উন্নীত হওয়া আজো সময়ের ব্যাপার। এই অবিসংবাদিত মহান কীর্তিমানের সাহিত্যিক পদমর্যাদা মর্মবস্তুতে উন্নীত না করেই দুই বাংলার সাহিত্যিক প্রতিবেশ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সাহিত্যিক প্রবণতা ও প্রতিবেশের মানবীয় গুণাগুণ। ভবিষ্যত সাহিত্যে আমরা হয়ত ভাষার দুর্বল সেই অবস্থানের দিকেই যাচ্ছি যেখানে অবিভক্ত বাংলাভাষার উৎসচর্চায় মূল কেন্দ্রবিন্দুটি আর শনাক্ত করা যাবে না। কিছুটা ভাষার উৎস আমরা পাবো পল্লিকবি জসীমউদ্দীনেই। পূর্ববঙ্গে তিনিই একমাত্র আধুনিক, যার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো শিক্ষিতশ্রেণির বোধকে জাগ্রত করে দেয়া চিরন্তন বাঙালির চর্চিত মূল্যবোধের ভাষায়, মানবিক জীবনবৈশিষ্ট্যে।
আধুনিক গদ্যসাহিত্যের প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েনি। মননশীলতার প্রভাবই-বা সৃজিত হয় কোত্থেকে। অমিয় চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গদ্যছাড়া আধুনিক গদ্যসাহিত্য কিংবা সমালোচনা সাহিত্যের সমৃদ্ধি আসেনি। রাস্ট্রচিন্তায় সমালোচনা সাহিত্যের যেটুকু প্রবৃত্তি অর্জন হয়েছে এর বাইরে এই সময় একমাত্র সলিমুল্লাহ খানেরই বুদ্ধিবৃত্তিক রচনার সমৃদ্ধি এসেছে। ঔপনিবেশিক, উপমহাদেশিয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং গ্লোবালচিন্তন প্রক্রিয়ার প্রভাব উন্মুক্ত করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চা, সমাজ-রাজনীতি, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান আছে। ড. প্রথমা রায়মণ্ডল লিখেন, প্রবন্ধের বিকাশ যে অনুকূল পরিবেশকে আশ্রয় করেই সম্ভব হয় এবং অধোগতিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে প্রতিকূল পরিবেশের যন্ত্রণায়- বাঙলাদেশের রাজনীতিতে তথা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের সেই চেহারাটিই লক্ষ করা যায়।
সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূলতায় চিন্তাবিদদের চিন্তাশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তেমনি অনুকূল প্রতিবেশ পেলে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক ও শিল্পীর অধিকার তথা স্বাধিন সৃষ্টিশীল দিগন্ত হয় প্রসারিত। পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতির বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটেছে, তবে তা নিছকই কৌশলগত। মূল কাঠামো না বদলালে তার উপরি-কাঠামো বদলায় না।
(বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, প্রতীক বুকস, কলকাতা-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২৩)
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে রোমান্টিক রচনাধারায় ভিন্নমাত্রিক সংযোজন নাসরীন জাহানের ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’। জৈবনিক বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট এটি একটি প্রভাব আধিপত্যের উপন্যাস। ঔপনিবেশিকতা ছাড়া মানবীয় চরিত্রই যেখানে প্রধান উপজীব্য হয়েছে। যদিও উপন্যাসটিতে লৈঙ্গিক শ্রেণিবিন্যাসে শুধুমাত্র নারীবাদী রচনা বলে খারিজ করে দিতে পারেন যেকোন পাঠক। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গদ্যের দুর্বলতা, মৌলবাদী হীনমন্যতা বর্জন করা গেলে উপন্যাসটিতে বিবাহযোগ্যা একজন যুবতী কন্যার রাস্ট্রিক সামাজিক প্রপীড়ন, লজ্জা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ট্র্যাজিক চিত্রটিই নিবেদিত হয় পাঠকের দরবারে, যে ধরনের রচনার পক্ষে সম্ভব মুহূর্তেই পাঠককে উদ্দিপিত করে ফেলা সাহিত্যিক সঞ্চারণে।
মানুষের মধ্যেই যেহেতু সাহিত্যের বিস্তার কাজেই মানবজন্মের সংগে এর সম্পৃক্ততা নিবিড়, আরাধ্য। সৌরমণ্ডলে মানব অস্তিত্ব বিলুপ হবার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যের উৎসারণ আমরা পাবো এবং কালে কালে এর উদ্ভাবনও দেখবো এটা ঠিক। আবার প্রযুক্তিও ব্যাপক উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। সময়ে যা মানুষের কাছে পরিবর্তিত হলো, পরিবর্তনের প্রকাশ হলো সেটাই উদ্ভাবন আমাদের। উনিশ শতকের প্রযুক্তি এবং পরিবর্তনের পর আজকের বিশ শতকে লেখক-পাঠক যারা তারাই এই উদ্ভাবনের ধন্দে পড়লেন। হস্তলিখিত সাহিত্যের মুদ্রণভঙ্গিমা পাল্টে যুক্ত হলো প্রযুক্তি মাধ্যমের ওয়েব সংস্করণ / প্রকাশন। লেখক-কবিমাত্রই কাগজে-কলমে চিন্তাশক্তির ব্যাপক প্রয়োগে লিখন প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। প্রযুক্তির আধিপত্য। আপনার চিন্তার পরের ফলশ্রুতিটিও পেতে পারেন খুব সহজেই। রিডার নোটবুক পিসি, প্রযুক্তির একটি পাঠক ধরে নিয়েও সম্ভব উদ্ভাবনী সাহিত্য তথা সাহিত্যিক প্রসারণ ক্ষমতা আবিষ্কার করা। এই উদ্ভাবন বা ধন্দটাকেই আমি একটা চাটখিলা অবস্থা বলে চালিয়ে নিতে চাই। অর্থাত ক্রমউদ্ভাবনের মধ্যে থেকেও আপনার মনে হলো যে আপনি সাহিত্যের উদ্ভাবনীতে নেই। সাহিত্য পঠিত হলে যেমন উদ্ভাবন বহাল থাকে আবার অপঠিত থাকলে তারও উদ্ভাবন থাকে লেখক-কবি বা পাঠকের মননের মধ্যেই। যা উদ্ভাবন তা আসলে উদ্ভাবন-ই। এর কোনো বিকল্প নাই।
চর্যাপদের ভাষা এবং জীবনাচার একরকম ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যধরন আরেকপ্রকার। বঙ্কিম-রবীন্দ্র বা বিশ শতকের সামগ্রিক সাহিত্যের মননশীলতায় একরূপ আর এই সময়ের সাহিত্যের সৃজনকাতরতার ভিন্ন আরেকটি রূপ। রাস্ট্রবেস্টনের মধ্যে, জীবনাচারে পিছিয়ে পড়া লেখক-কবিমাত্রই বলবার কিংবা প্রকাশ ভঙ্গিমায় সাহিত্যকে অস্বীকার করেন আবার নিজেই নিজের ভেতরে লালন করেন আত্মার অসীম মুক্তি, মুক্তির আকুলতা তারই সৃষ্ট রচনার গুণাগুণে। এই যে আমাদের চেনাজানা সাহিত্যের পরিবর্তন, লেখক-কবিরাই ভৌগলিক বীক্ষায় লেখনির জায়গাটিতে ক্রমান্বয়ে দাসে পরিণত হলেন। এর একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তরেই আমরা দেখেছি সাহিত্যের উদ্ভাবন সময়ের লেখক-কবিদের।
No comments:
Post a Comment