জীবদ্দশাতেই কবিতার শহীদ বলে খ্যাত কবি বিনয় মজুমদার। কাহ্নুপা থেকে বিহারীলাল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ এবং তৎপরবর্তী জীবনানন্দ, শক্তি, সৈয়দ হক, কাদরী, উৎপল পেরিয়ে বাংলা কবিতার আরো একজন উজ্জ্বলতম কবিতাকুহক। বিনয়ের কাব্য পাঠান্তে যেকোনো পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন যে, তাঁর কাব্যভাষাটি মূলত সারল্যের ভাষা, অরবৃত্ত গদ্য-ছন্দের গাঁথুনিতে কখনো টলে পড়ে না। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও যে ঘটেনি তা নয়। এর কারণ, বিনয়ের খোঁজ-খবর যারা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে থাকেন তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, বিনয় তাঁর চিন্তা-চেতনায় অধিক সময় অবচেতনে বিচরণ করেছেন। এই ‘অবচেতনে’ শব্দটি কেবল বিনয়ের ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। কেননা আমরা যে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়-কে মানসিক অসুস্থতার বিবেচনা করে থাকি মূলত সেটিই বিনয়ের কাব্যভাষা। লক্ষ করার বিষয়, বিনয়কে আমাদের এই অপ্রকৃতিস্থ বোধ-বিবেচনার কবি হিসেবে জানবার ফলে বিনয়ের কোনো কোনো কবিতায় ব্যঙ্গ-রসাত্মক উপমাটি আমাদের কাছে অন্য মানে তৈরি করে। জৈবনিক দীক্ষায় তিনি কী অন্যমনে শেষমেষ কবিতাকেই ধীকৃত করেছিলেন সমর্পণের দায়ে? বিনয়ের এইরূপ ভাষা-প্রক্রিয়ায় খেলা করার বিষয়টি বাংলা কবিতার সমঝদার পাঠকশ্রেণিকে নিশ্চয়ই আন্দোলিত করে। বিষয়-বৈচিত্রতায় বিনয়ের কাব্যভাষায় যথেচ্ছ চমক আছে, বিনয় সেই অবতাপ্রাপ্ত হয়েই জন্মেছিলেন। কিন্তু সমকালের বিক্রিত বিবেচনাই তাঁর সে অবস্থান ক্ষুণ্ন করেছে। বৈচিত্রের বদলে হয়ে ওঠেছেন মরুবৃক্ষের ন্যায় বিপণ্ন, বৈভবহীন ছিন্ন মনীষা। ভুল আলোচনার শিকার হয়ে পীড়িত হয়েছেন তিনি। কবিতা আর গণিতের সূত্রবদ্ধ সংজ্ঞায় নির্বাচিত যে বিনয়-কে দিব্যজগতে আমরা পেয়েছি সে বিনয় আজ আর নেই। বাংলা কবিতার এক সরলরৈখিক প্রবণতার সমাপ্তিরেখা অঙ্কন করে ১১ ডিসেম্বর ২০০৬ তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন মহিমান্বিত অনন্ত কবিতার প্রজ্ঞায়। তাঁর কাব্যভাষা মহাকালের খণ্ডিত কম্পনরূপে স্বারিত হয়ে থাকলো আমাদের কাছে। এই ফাঁকে, স্বতো-অবসরে তাঁর কবিতার দুটি মহার্ঘ পঙক্তি পাঠ করে নিই।
কিলবার্ণ কোম্পানির অফিস দেখেই আমি লাফ মেরে উঠি,
তাড়াতাড়ি চলে আসি এই গ্রামে শিমুলপুরেই।
কিলবার্ণ কোম্পানির / আমাকেও মনে রেখো, পৃষ্ঠা-৪৪
সময়ের নাগরিক ব্যস্ততা-জটিলতাকে প্রত্যভাবে পাশ কাটিয়ে বিনয়ের কাব্যসহবাস নির্ঝঞ্ঝাট, ঝুঁকিহীন, সরস-স্বাভাবিক প্রকৃতির। শুধুমাত্র প্রান্তিক জনজীবন থেকে শিল্পভাবের স্বচ্ছ উদ্ভাবনী স্বাত্তিক স্বত্তা দিয়ে নয়, নির্জলা কাব্যিকদ্যোতনাই একদিন তাঁকে শিমুলপুরে সন্ন্যাসযাপনে আন্দোলিত করেছে। যেমন আন্দোলিত করেছিল নিবিড় আরাধ্য আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, জয়নাল আবেদীন-কে। ভাবকে ভাষায় ফুটিয়ে তোলার বহু কৌশল আছে, প্রকৃত কথাটিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অন্যভাষায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বিনয় মজুমদার-কে আমার মনে হয় সেখানেই সিদ্ধহস্ত তিনি, শিশুর সারল্যবোধই তাঁকে সে স্থানে উন্নীত করেছে। ‘অকপটে সবকথা বলতে পারাই শিশুর সারল্যের নিদর্শন’ বিনয়ের যা স্বভাবজাত। গাণিতিক সূক্ষাতিসূক্ষ অন্তর্লোকই যাঁর স্বভাবকে নির্দেশ করেছে শিশুর সারল্যে। কাব্যিক ভেদাভেদে শিমুলপুরের বিনয় মজুমদার আর কলকাতার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দুজনেই শক্তিমান নিঃসন্দেহে। মুশকিল হলো, শক্তি সঞ্চারণের পরে বিনয় অবতা’র উল্টো হয়ে গৃহপ্রবেশের দৃষ্টিনন্দিত উপস্থাপনাটি সহজে কারো চোখে পড়ে না। ফলে দূরশ্রুত এক শব্দশিল্পীর মনো-সঞ্চারণ আবিস্কারের এই ট্রাজিক মাত্রাটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হওয়ার চেয়ে বরং চৈতনিক বিনয়ের অন্তর্বৃত্তেই ঘূর্ণমান নিজস্ব আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।
বস্ত্র পরিহিত এই পর্জন্যসমূহ কথা বলে / শাশ্বত গম্ভীর মন্ত্রে, তাদের বাণীনিঃসৃত আলো / উদ্ভাসিত করে তোলে জীবনের কিয়দংশ, ফলে / অন্তরে আনন্দ আসে, তমিশ্রায় পথ দেখা যায়।
বস্ত্র পরিহিত এই / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৯২ (দে’জ)‘
মুগ্ধতার কোনো বিশ্লেষণ হয় না। অন্তত আমি সে অসম্ভব ব্যাখ্যায় অম। বিনয় মজুমদার-কে আমি দেখেছি, তার সংগে কথা বলেছি, তিনি সস্নেহে আমার মতো অনধিকারীর সামনেও কবিতা ও গণিতের রামধনু সেতুটির ইশারা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন- এ সবই পূণ্যার্জন বলে আমি মনে করি। শুধু, আমি একা নই, আমরা শ্বাস নিচ্ছি সেই পৃথিবীতে, যখন একই মাতৃভাষায় শ্বাস নিচ্ছেন বিনয় মজুমদার, এ আমি সব সময়ের বাঙালির গর্ব মনে করি। সে গর্ব ঘুমন্ত ও সঙ্গোপন। এবং ভবিষ্যৎগামী। আমি এমনও আশা করি, আজ থেকে বহুবছর পরে কবিতা-গণিত সূত্রের নানা উন্মোচনে, আমাদের কারো কারো এই পূণ্যার্জন, অন্তত পারিবারিকভাবেও শুভ ও মঙ্গলের কারণ হয়ে উঠবে।’নাস্তিকের পূণ্যার্জন / মৃদুল দাশগুপ্ত, লোক * বিনয় মজুমদার সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৭৭
এ যাবৎ বিনয়ের এবং বিনয় সম্পর্কিত গোটাদশেক গ্রন্থ / ছোটকাগজ আমি পাঠ করেছি তাতে লক্ষ করেছি বিনয় তাঁর কাব্যে অবস্থান করেন উত্তমপুরুষে। এই উত্তমপুরুষটি এককেন্দ্রিক, অন্যঅর্থে বহুধাবিভক্তও বটে। কবিতার অন্তর্গত সেই উত্তমপ্রকৃতিটিরই প্রকাশনা ঘটিয়েছেন নির্দ্বিধ, কোথাও ফাঁকি দেননি তিনি। অথচ অশ্লিলতার ভাষ্য বলে কোথাও কোথাও অবহেলার শিকার হয়েছেন। এটি তাঁর একটি সেনসেশনাল ফের। অবশ্য আমার মনে হয় তাতে বিনয়ের কোনো খেদ নেই। কেননা বিনয় সে দিকে ফিরেও তাকায় না বা তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। তাঁর ‘বাল্মিকীর কবিতা’ যাকে বলা হচ্ছে, যৌনতার ভাষ্য নির্মাণ সেই কবিতাগুলোকেই আমার বহুল অর্থে লিখিত বলে মনে হয়। অন্তত আমি তা পাঠক-কে পড়ে দেখতে বলি। প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, কবিতাগুলো পাঠের শুরুতেই পাঠক যৌন বিষয়ক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন বেশি। এক্ষেত্রে যৌনতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতায় উপমা প্রয়োগ ও বিবৃতির গাণিতিক ব্যাখ্যাটিকেই তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন হয়ত। কিন্তু এর ভিতরেই কবিতার অন্য উপমিতি ছিল না তা নয়। কবিতাগুলো মূল্যায়ণ বিষয়ে অধিকাংশের নিম্নরুচির উপমাবিচার বাদ দিলে কবিতাগুলো সর্বাধিক কাব্যশৃঙ্গারে উত্তীর্ণ কবিতা। ভারতীয় উপমহাদেশে কাম-শৃঙ্গারের বিশ্লেষিত উপস্থাপনার যেরূপ চিত্র সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত ‘চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়– চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, মধ্যযুগের বাংলাগীতি কবিতা, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ কিংবা কামশাস্ত্র অধ্যয়নে আরো যেসব উদ্ধৃতি রয়েছে, কবিতাগুলো মোটেও তার থেকে পিছিয়ে থাকে না।আমার ভুট্টায় তেল মাখতে মাখতে চাঁদ বলল ‘তোমার / ভুট্টাটি ভীষণ মোটা’ আমি তার জবাব না দিয়ে / অন্য কথা বললাম- ‘ভুট্টার মাথায় একটু তেল মাখ’ তবে / চাঁদ কিন্তু ভুট্টাটিকে ফুটিয়েও ভুট্টার মাথায় / তেল মাখল না শুধু চারপাশে গায়ে মাখে, তেল মাখা হলে / চাঁদ মেঝে থেকে হেঁটে বিছানায় এসে শোয়, বিছানা মেঝেই পাতা থাকে।আমার ভুট্টায় তেল / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৮০, (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় আরো কিছু কবিতায় রূপকার্থে ব্যবহৃত এমন সব শব্দ পাওয়া যায়, যাকে, বহুপাঠক / প্রাবন্ধিক / আলোচক এ যাবৎ কবিতাগুলোকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে অপব্যাখ্যা দিয়ে কবিতার মূল টার্ম ভেঙে বিনয়-কে কাণ্ডজ্ঞানহীন দোষী সাব্বস্ত করেছেন। যা একজন উচ্চমার্গিয় কবি-লেখকের ক্ষেত্রে কোনোকালেই প্রাপ্য ছিল না। কবিতাগুলো পাঠশেষে, সর্বাগ্রে আমি এটাই মনে করি বিনয় মজুমদার এ কাব্যগুলোতেই ভাষার গূঢ়তাত্ত্বিক কারিগরি করেছেন। এইসব শব্দের স্থলে পাঠক তার পছন্দমতো আবিস্কৃত একটি প্রয়োজনীয় শব্দ বসিয়েও এখান থেকে নাব্যিক ভব্যতার শিল্পরস বের করে নিতে পারেন। তাছাড়া, বিনয় একটি ভুট্টার গায়ে তেল মেখে আগুনের আঁচে সেদ্ধ করে ভুট্টা খাওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি নিয়ে তাঁর কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে মিলিত হতেই পারেন। সেটা খুবই স্বতোঃসিদ্ধ, মজার বিষয় হলো উপমিত ‘মোটা ভুট্টা’ শব্দটি প্রয়োগে অনুমিত হওয়া যায় ভূগোলের একা একজন মানুষ কীরূপ শিশুবোধে কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে ক্রিড়ামগ্ন থেকেছেন। পাঠক সজাগ হলে লক্ষ করবেন যে বিনয় আরো লিখেছেন ‘লম্বা ডালাদের তক্তা বড় থাকে’। বাক্যটির মূলশব্দ ‘ডালা’র জীবন্ত চরিত্র নির্মাণ করে এর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিবৃতি দিচ্ছেন বিনয় মজুমদার। এবং পাঠকও সেদিকে ঝুঁকে পড়েছেন বেশি। বাক্যটিতে ডালা বিষয়ে অর্থাৎ একটি জড়বস্তুর ক্রিয়ার অর্থগত কোনো মানে তৈরি হয় না। নিষিদ্ধ ব্যঞ্জনেও কেউ কেউ জিভে জলসহযোগে রসনার তৃপ্তি পেতে পারেন কখনো, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আসলে অর্থহীন শব্দের দ্যোতনা এটি, এতদ্বসত্ত্বেও পাঠক উপমিত ডালার যৌনক্রীড়ায় আন্দোলিত হয়েছেন মুহুর্মুহু। কখনো কখনো এটাই বিনয়ের সরল বৈষয়িক কাব্যরীতি, বিনয়ের সঞ্চারণ মাত্রাই যেন পাঠক কে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। যারা তাঁর ছোটগল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী বা অন্যান্য পার্শ্ব রচনা পাঠ করেছেন তারা হয়ত অবগত আছেন যে তিনি সেখানেও একই গাণিতিক অন্তর্জাল ব্যাপ্ত করেছেন। আর ছন্দবীক্ষায় তো যেসব বর্ণের মাত্রা নেই সেসব বর্ণকে মাত্রার মর্যাদাই দেননি। আমি বলতে চাই এই হলো কবি বিনয় মজুমদার, আপাদমস্তক গাণিতিক-কাব্যিক অবিকারগ্রস্থ বিশ্বায়নের এক অন্যমানব।
বিপন্ন মড়াল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে, / যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে / রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ; / স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে; / সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু / এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি... তুমি...
একটি উজ্জ্বল মাছ / কালের খেয়া, সংখ্যা-৭৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬
কবিতার রয়েছে কোনো শিল্পিত লক্ষ কিংবা নেই। অতটা খুঁজিনি, বিনয়কে পেয়েছি, জেনেছি, কবিতা কবিতাই, ভব্যতার নিগূঢ় কোনো এক সূক্ষতাত্ত্বিক এলিমেন্ট। বিনয়ের কবিতা বিনয়ের মতোই সহজ-স্বাভাবিক, জটিলতাবিহীন অবিকারগ্রস্থ ভাষা। যারা তাঁর কাব্যভাষা-কে কখনো কখনো বিকারগ্রস্থ ভেবেছেন-দেখেছেন তারাই নিজেদের ফাঁকি দিয়েছেন। তারা বিনয় মজুমদারের কাব্যলোকে প্রবেশের সূত্রমুখও আবিষ্কার করতে পারেননি। আবার কখনো কখনো তাঁর কবিতা বিষয়ে অহেতুক তর্ক-বিতর্কের ফাঁদ তৈরি করে কবিতা সঞ্চারণের মাত্রাকে অন্য আরেক অর্থে জাগিয়ে তোলার সুপ্তবীজও লুকায়িত ছিল বিদগ্ধশ্রেণিতে, এমন ধারণা করলে অস্বাভাবিক হবে না। আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলেও এরকম উন্নাসিকতার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যাবে। সোজাঅর্থে এটি কবিতার গরল। গায়ত্রী চক্রবর্তী’র সাথে বিনয়ের প্রণয় সম্পর্কটি যারা জানেন তারা ‘ফিরে এসো চাকা’ গ্রন্থটি পাঠ করলে বুঝতে পারবেন বিনয়ের সংবেদনশীলতার গভীরতা। কাব্যিক মহাকালের ক্রান্তিকাল এখন, বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে তর্কে-বিতর্কে জড়ানোর চেয়ে তাঁর কাব্য ব্যবচ্ছেদ সঙ্গত কারণেই অধিক জরুরি। পরিশেষে, এ সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধার্হ কবি শামসুর রাহমানের বিনয়াভিব্যক্তিটি তুলে ধরতে চাই পাঠকের দরবারে...
“আমরা একটি বিবৃতি পড়ছি। কিন্তু কোনো কোনো বিবৃতিও কবিতা হতে পারে, যেমন বিনয়ের এই পঙক্তিমালায় কবিতার স্বাদ রয়ে গেছে। ‘আমিই গণিতের শূন্য’ পুস্তকে কবি কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বিবৃতি বলে রচনাগুলিকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। সম্ভবত এই বইয়ের কবিতাবলিকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কিংবা ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র সমপর্যায়ে রাখা যাবে না, কিন্তু উড়িয়ে দেয়াও অসমীচীন।”
লোক, পৃষ্ঠা-১৬৬, বিনয় মজুমদার সংখ্যা, সম্পাদক: অনিকেত শামীম।
ভুট্টা সিরিজের কবিতাধারার আরো কিছু কবিতা লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে একই বিষয় রূপকার্থে ব্যবহৃত শব্দগুলো পাল্টিয়ে বরং নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগে তিনি পরবর্তী কবিতাগুলোর সমৃদ্ধ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এটি জনশ্রুতি না ভেবে যারা অভিযোগ করেন যে, বিনয় মূল নির্ণয় বাক্যে অবস্থান না করে শব্দের প্রকারান্তরে নিজেকে ব্যাপ্ত করেছেন বেশি তাদের বলতে পারি এ কাজটি কেবল ভাষা-বোধ-উপমা সচেতন কবির পক্ষেই সম্ভব। বিনয়ও তাই করেছেন, সেইসব সমালোচক-বিশ্লেষকদের বোকা বানিয়ে তিনি চলে গেছেন তাঁর অভিপ্সীত লক্ষে, যা থেকে তিনি শিতি করেছেন পাশবিক বিবেচনাকারীর। যেকোন বিষয়মাত্রই টেক্সট এরকম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির কবিতা থেকে দূরে থাকাই ভালো। মূলত এই শ্রেণির অজ্ঞতা থেকেই শিল্পের অবমূল্যায়ণটা তৈরি হয়ে আসতে থাকে। জানা দরকার কবিতা কোনো ফেলনা যৌগিক বিষয় নয়, পাষণ্ডদের হাতেই কেবল কবিতার বিষয়বস্তু বিচারে মৌলিকত্ব ছিল না চিরকাল। তারা একটি গড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন ‘উই আর অলওয়েজ মেইক থিঙ্কিং রাইট উইথ রিয়েলিটি’। বাট থিঙ্কিং জাস্ট এন ডেভিল সোসাইটি’ এ বিষয়টি সহজে তাদের মাথায় ঢুকেনি। এই হলো বৈষয়িক সোর্স আমাদের! অথচ বিনয় মজুমদার মনে করতেন যে কবিতার জন্য চাই ভালো কোনো বিষয়বস্তু সেই সাথে দার্শনিক প্রজ্ঞা যা পাঠকের ভাবাবেগ-কে আন্দোলিত করতে পারে। আমার কাছে মনে হয় ভুট্টা সিরিজ কিংবা ‘বাল্মিকীর কবিতা’গুলো তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
প্রৌঢ় বয়সেও আমি প্রায়শ দাঁড়াই দৃঢ় হয়েতার কিছুণ পরে আবার নেতিয়ে পড়ি আমি। বৃষ্টির দেবতা আমি এ জীবনে যত বৃষ্টিপাতকরেছি সে সব কথা মনে পড়ে, ফলে বেঁচে আছি। বৃষ্টি পতনের কথা কোনোদিন মনে থাকে না।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৪ (দে’জ)
সম্মত জলের কাছে বসে বসে তারপর চলে গেল একটি কবিতা। সেইহেতু লতা বাড়ে পুষ্পে পল্লবে স্নিগ্ধ, কবিতার পদাঙ্ক আকারলতাটির পাতাগুলি; বলি তাও ফেটে যায় আরো ছোট বালিকণা হয়েসাগর সৈকতে, আহা, জলের নিকটে থেকে। ফলে অসদ্ভাব হয় জলে ও বালুতে।
ধুয়ে দিই / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৭ (দে’জ)
এ বছর মাঘ মাসে আমের মুকুল দেখা দিয়েছে বাগানে।
সারাটা জীবন আমি বৃদেবতার ডালে মুকুল দেখেছি।
অনুজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডালের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ধীরে
এ ফর্সা মুকুল আসে বের হয়ে, বসন্তের বাতাসে সে দোলে।
এ বছর মাঘ মাসে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১১ (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় লেখার যে মূলভাব, বিষয়বস্তু, ঈঙ্গিতময়তা- তা মূলত জৈবিক-প্রাকৃতিক খেলার নামান্তর মাত্র। লক্ষ করেছি, চিরকাল মানুষ যা আড়াল রাখতে চেয়েছে মনোবৈকল্যে বা অপরাধবোধে তাড়িত হয়ে, তিনি সেই দুর্লভ বস্তুটিকে উন্মোচিত করেছেন। জীবনাচারে আমরা যার নাম দিয়েছি যৌনতা। মহাকালের বিকৃত চর্বিতচর্বণে মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ আজ অবয় হতে হতে মৌলিকত্ব হারিয়েছে। যেখানে কামের ক্ল্যাসিকাল রূপটি বিবেচিত স্বর্গীয় এষণায় সেখানে কামকে টেনে-হিঁচড়ে রূপ নিয়েছে উলঙ্গ যৌনতায়। বিনয় মজুমদার প্রতীকি উপমায় সেই মহাকালিক গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই জানাচ্ছেন সৃষ্টিতত্ত্বের সূত্রপাত। প্রকৃতির সকল উপাদানের মধ্যেই অপারবিষ্ময়ে তিনি খুঁজেছেন সে রহস্যময় খেলা। পেয়েছেন। শুধু বিশ্বজগতেই নয় সমগ্র সৌরমণ্ডলেও কবির দৃষ্টিন্দ্রিয় দেখেছে এই দুর্লভ খেলা। আর এ খেলাটি সমগ্র প্রাণিজগতের সম্মুখে ঘটে থাকে। তবে সকলেই দেখে না বিনয়ের মতো কেউ কেউ দেখে। ফলে অদেখা জগতে অসদ্ভাব তৈরি হওয়াটাও স্বাভাবিক কিন্তু কাব্যমাত্রিক বিনয় মজুমদার-কে অসদ্ভাবে ঠাউরে যদি কেউ অবিবেচনা করেন তবে তা কবিতার পরিপন্থিই হবে।
সূর্য গ্রহণের কালে কিছু লেখা ভালো- এই ভেবে
আমি লিখি। আজ হলো তেসরা ফাল্গুন শনিবার
তেরোশ ছিয়াশি সাল। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে চাঁদের ছায়া। এই
লিখে ফের উঠলাম, গ্রহণ আবার দেখে আসি।
গ্রহণ দেখতে গিয়ে দেখলাম মেঘের আড়ালে
সূর্য চলে গেছে, আমি দুইখানি আলোকচিত্রের
ফিল্ম একসঙ্গে নিয়ে তার মাঝ দিয়েই দেখেছি
সূর্যের গ্রহণ প্রায় দশবার, তবে বর্তমানে
সূর্যকে ঢেকেছে মেঘে। যাই ফের দেখে আসি মেঘ
সরে যায় কিনা। ফিরে এসে আবার লিখছি বর্তমানে
আমার ঘড়িতে বাজে তিনটে আটচল্লিশ; মেঘে
সূর্য পুরোপুরি ঢাকা। ফের আমি উঠে গিয়ে দেখে
এলাম আকাশ, মেঘে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা তবে আকাশে
রযে অংশ মেঘে না ঢাকা সে আকাশ মনোযোগ দিয়ে
দেখেছি কোথাও কোনো তারকা উঠেনি আজ গ্রহণের কালে।
ঘড়িতে চারটে দশ বাজে, ফের আমি দেখে এলাম আকাশ
পুরোটাই মেঘে ঢাকা বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে।
চারটে বত্রিশ বাজে, বৃষ্টি অবিরাম পড়ে, তবে
রোদ্দুর উঠেছে ফলে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢাকা চাঁদের ছায়ায়, পুনরায়
দেখে আসি, রোদ আছে। পুনরায় দেখেছি সূর্যের
উপরের সিঁকিভাগে চাঁদের ছায়ায় ঢাকা আছে
চারটে উনচলিøশ মিনিটে। গ্রহণ শুরু হয়েছে যখন
সূর্যের নিচের দিক দেখেছে তখন, আর এই
গ্রহণের শেষ দিকে সূর্যের উপরের দিক ঢাকা,
অর্থাৎ চাঁদের ছায়া নিচ দিক থেকে ক্রমে উপরের দিকে
গিয়েছে বিকেলবেলা, পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন রয়েছে।
বৃষ্টি থেকে গেছে আমি ফের দেখে এসেছি সূর্যকে
চারটে উনপঞ্চাশ মিনিটে, সূর্যের উপরের
দিক ঢাকা মোটামুটি এক পঞ্চমাংশ, দেখলাম।
আবার বাইরে গিয়ে দেখলাম সূর্য মেঘে ঢাকা
চারটে পঞ্চান্ন বাজে সে সময়ে আমার ঘড়িতে
এই আমি করলাম আজ সূর্য গ্রহণের কালে
আমার শিমুলপুর গ্রামে বসে বিকেলবেলায়।
সূর্য গ্রহণের কালে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১৬
এ প্রসঙ্গে কবি-শ্রদ্ধার্হ উৎপল কুমার বসু’র একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘আমরা বিষ্ময়ের সংগে লক্ষ করি আলোচ্য কবি অবলীলায় নির্ণয়বাক্য থেকে আরেক প্রকারে চলে যায়। কখনও ফিরে আসেন মূল সূত্রে। কখনও স্থির হন এক মাঝামাঝি অবস্থায়। আমি সেদিন বসে বসে একটি তালিকা তৈরি করছিলুম কী-জাতিয় নির্ণয়বাক্য বিনয় মজুমদারের প্রিয় প্রকরণ। এই তালিকা দিচ্ছি:স্বয়ংনির্ভর (পধঃবমড়ৎরপধষ) যদি-তাহলে (যুঢ়ড়ঃযবঃরপধষ) বিকল্পাত্মক (ফরংলঁহপঃরাব) অস্তিত্ববাচক (ধঃযবৎসধঃর) নিষেধাত্মক (হবমধঃরাব) সাকুল্যব্যাপক (ঁহরাবৎংধষ) পুননিশ্চয় (হবপবংংধৎু) সম্ভাবনাবাচক (ঢ়ৎড়নষবসধঃরব) এবংবস্তুবিষয়ক (ৎবধষ) আমি শুধু প্রস্তাবাকারে হদিশ দিলুম। তালিকাটিও সম্পূর্ণ নয়। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ বৈশিষ্ট্যের জন্য বিনয় মজুমদারের কবিতা তার অনেক অলংকার বর্জন করেছে। ছন্দোগুণ, উপমা, ধ্বনিসৌকর্য, অন্তমিল এবং আরো বহুবিধ চরিত্র লক্ষণ অর্থাৎ শাঁখা-সিঁদুর থেকে পান-আলতা- যা দিয়ে আমরা কবিতাকে চিনে থাকি- তা সবই প্রায় কবিতায় অনুপস্থিত। তাঁর কবিতার এই নিরাভরণ রূপটি বড় মনোলোভা। কমলকুমার মজুমদারের প্রভাবে বলা যায় বিনয়ের কাছে ‘রূপের কখনো রূপান্তর হয় না’।’
কিলবার্ণ কোম্পানির অফিস দেখেই আমি লাফ মেরে উঠি,
তাড়াতাড়ি চলে আসি এই গ্রামে শিমুলপুরেই।
কিলবার্ণ কোম্পানির / আমাকেও মনে রেখো, পৃষ্ঠা-৪৪
সময়ের নাগরিক ব্যস্ততা-জটিলতাকে প্রত্যভাবে পাশ কাটিয়ে বিনয়ের কাব্যসহবাস নির্ঝঞ্ঝাট, ঝুঁকিহীন, সরস-স্বাভাবিক প্রকৃতির। শুধুমাত্র প্রান্তিক জনজীবন থেকে শিল্পভাবের স্বচ্ছ উদ্ভাবনী স্বাত্তিক স্বত্তা দিয়ে নয়, নির্জলা কাব্যিকদ্যোতনাই একদিন তাঁকে শিমুলপুরে সন্ন্যাসযাপনে আন্দোলিত করেছে। যেমন আন্দোলিত করেছিল নিবিড় আরাধ্য আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, জয়নাল আবেদীন-কে। ভাবকে ভাষায় ফুটিয়ে তোলার বহু কৌশল আছে, প্রকৃত কথাটিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অন্যভাষায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বিনয় মজুমদার-কে আমার মনে হয় সেখানেই সিদ্ধহস্ত তিনি, শিশুর সারল্যবোধই তাঁকে সে স্থানে উন্নীত করেছে। ‘অকপটে সবকথা বলতে পারাই শিশুর সারল্যের নিদর্শন’ বিনয়ের যা স্বভাবজাত। গাণিতিক সূক্ষাতিসূক্ষ অন্তর্লোকই যাঁর স্বভাবকে নির্দেশ করেছে শিশুর সারল্যে। কাব্যিক ভেদাভেদে শিমুলপুরের বিনয় মজুমদার আর কলকাতার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দুজনেই শক্তিমান নিঃসন্দেহে। মুশকিল হলো, শক্তি সঞ্চারণের পরে বিনয় অবতা’র উল্টো হয়ে গৃহপ্রবেশের দৃষ্টিনন্দিত উপস্থাপনাটি সহজে কারো চোখে পড়ে না। ফলে দূরশ্রুত এক শব্দশিল্পীর মনো-সঞ্চারণ আবিস্কারের এই ট্রাজিক মাত্রাটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হওয়ার চেয়ে বরং চৈতনিক বিনয়ের অন্তর্বৃত্তেই ঘূর্ণমান নিজস্ব আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।
বস্ত্র পরিহিত এই পর্জন্যসমূহ কথা বলে / শাশ্বত গম্ভীর মন্ত্রে, তাদের বাণীনিঃসৃত আলো / উদ্ভাসিত করে তোলে জীবনের কিয়দংশ, ফলে / অন্তরে আনন্দ আসে, তমিশ্রায় পথ দেখা যায়।
বস্ত্র পরিহিত এই / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৯২ (দে’জ)‘
মুগ্ধতার কোনো বিশ্লেষণ হয় না। অন্তত আমি সে অসম্ভব ব্যাখ্যায় অম। বিনয় মজুমদার-কে আমি দেখেছি, তার সংগে কথা বলেছি, তিনি সস্নেহে আমার মতো অনধিকারীর সামনেও কবিতা ও গণিতের রামধনু সেতুটির ইশারা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন- এ সবই পূণ্যার্জন বলে আমি মনে করি। শুধু, আমি একা নই, আমরা শ্বাস নিচ্ছি সেই পৃথিবীতে, যখন একই মাতৃভাষায় শ্বাস নিচ্ছেন বিনয় মজুমদার, এ আমি সব সময়ের বাঙালির গর্ব মনে করি। সে গর্ব ঘুমন্ত ও সঙ্গোপন। এবং ভবিষ্যৎগামী। আমি এমনও আশা করি, আজ থেকে বহুবছর পরে কবিতা-গণিত সূত্রের নানা উন্মোচনে, আমাদের কারো কারো এই পূণ্যার্জন, অন্তত পারিবারিকভাবেও শুভ ও মঙ্গলের কারণ হয়ে উঠবে।’নাস্তিকের পূণ্যার্জন / মৃদুল দাশগুপ্ত, লোক * বিনয় মজুমদার সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৭৭
এ যাবৎ বিনয়ের এবং বিনয় সম্পর্কিত গোটাদশেক গ্রন্থ / ছোটকাগজ আমি পাঠ করেছি তাতে লক্ষ করেছি বিনয় তাঁর কাব্যে অবস্থান করেন উত্তমপুরুষে। এই উত্তমপুরুষটি এককেন্দ্রিক, অন্যঅর্থে বহুধাবিভক্তও বটে। কবিতার অন্তর্গত সেই উত্তমপ্রকৃতিটিরই প্রকাশনা ঘটিয়েছেন নির্দ্বিধ, কোথাও ফাঁকি দেননি তিনি। অথচ অশ্লিলতার ভাষ্য বলে কোথাও কোথাও অবহেলার শিকার হয়েছেন। এটি তাঁর একটি সেনসেশনাল ফের। অবশ্য আমার মনে হয় তাতে বিনয়ের কোনো খেদ নেই। কেননা বিনয় সে দিকে ফিরেও তাকায় না বা তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। তাঁর ‘বাল্মিকীর কবিতা’ যাকে বলা হচ্ছে, যৌনতার ভাষ্য নির্মাণ সেই কবিতাগুলোকেই আমার বহুল অর্থে লিখিত বলে মনে হয়। অন্তত আমি তা পাঠক-কে পড়ে দেখতে বলি। প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, কবিতাগুলো পাঠের শুরুতেই পাঠক যৌন বিষয়ক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন বেশি। এক্ষেত্রে যৌনতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতায় উপমা প্রয়োগ ও বিবৃতির গাণিতিক ব্যাখ্যাটিকেই তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন হয়ত। কিন্তু এর ভিতরেই কবিতার অন্য উপমিতি ছিল না তা নয়। কবিতাগুলো মূল্যায়ণ বিষয়ে অধিকাংশের নিম্নরুচির উপমাবিচার বাদ দিলে কবিতাগুলো সর্বাধিক কাব্যশৃঙ্গারে উত্তীর্ণ কবিতা। ভারতীয় উপমহাদেশে কাম-শৃঙ্গারের বিশ্লেষিত উপস্থাপনার যেরূপ চিত্র সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত ‘চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়– চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, মধ্যযুগের বাংলাগীতি কবিতা, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ কিংবা কামশাস্ত্র অধ্যয়নে আরো যেসব উদ্ধৃতি রয়েছে, কবিতাগুলো মোটেও তার থেকে পিছিয়ে থাকে না।আমার ভুট্টায় তেল মাখতে মাখতে চাঁদ বলল ‘তোমার / ভুট্টাটি ভীষণ মোটা’ আমি তার জবাব না দিয়ে / অন্য কথা বললাম- ‘ভুট্টার মাথায় একটু তেল মাখ’ তবে / চাঁদ কিন্তু ভুট্টাটিকে ফুটিয়েও ভুট্টার মাথায় / তেল মাখল না শুধু চারপাশে গায়ে মাখে, তেল মাখা হলে / চাঁদ মেঝে থেকে হেঁটে বিছানায় এসে শোয়, বিছানা মেঝেই পাতা থাকে।আমার ভুট্টায় তেল / বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৮০, (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় আরো কিছু কবিতায় রূপকার্থে ব্যবহৃত এমন সব শব্দ পাওয়া যায়, যাকে, বহুপাঠক / প্রাবন্ধিক / আলোচক এ যাবৎ কবিতাগুলোকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে অপব্যাখ্যা দিয়ে কবিতার মূল টার্ম ভেঙে বিনয়-কে কাণ্ডজ্ঞানহীন দোষী সাব্বস্ত করেছেন। যা একজন উচ্চমার্গিয় কবি-লেখকের ক্ষেত্রে কোনোকালেই প্রাপ্য ছিল না। কবিতাগুলো পাঠশেষে, সর্বাগ্রে আমি এটাই মনে করি বিনয় মজুমদার এ কাব্যগুলোতেই ভাষার গূঢ়তাত্ত্বিক কারিগরি করেছেন। এইসব শব্দের স্থলে পাঠক তার পছন্দমতো আবিস্কৃত একটি প্রয়োজনীয় শব্দ বসিয়েও এখান থেকে নাব্যিক ভব্যতার শিল্পরস বের করে নিতে পারেন। তাছাড়া, বিনয় একটি ভুট্টার গায়ে তেল মেখে আগুনের আঁচে সেদ্ধ করে ভুট্টা খাওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি নিয়ে তাঁর কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে মিলিত হতেই পারেন। সেটা খুবই স্বতোঃসিদ্ধ, মজার বিষয় হলো উপমিত ‘মোটা ভুট্টা’ শব্দটি প্রয়োগে অনুমিত হওয়া যায় ভূগোলের একা একজন মানুষ কীরূপ শিশুবোধে কল্পদেবীর সংগে কথোপকথনে ক্রিড়ামগ্ন থেকেছেন। পাঠক সজাগ হলে লক্ষ করবেন যে বিনয় আরো লিখেছেন ‘লম্বা ডালাদের তক্তা বড় থাকে’। বাক্যটির মূলশব্দ ‘ডালা’র জীবন্ত চরিত্র নির্মাণ করে এর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিবৃতি দিচ্ছেন বিনয় মজুমদার। এবং পাঠকও সেদিকে ঝুঁকে পড়েছেন বেশি। বাক্যটিতে ডালা বিষয়ে অর্থাৎ একটি জড়বস্তুর ক্রিয়ার অর্থগত কোনো মানে তৈরি হয় না। নিষিদ্ধ ব্যঞ্জনেও কেউ কেউ জিভে জলসহযোগে রসনার তৃপ্তি পেতে পারেন কখনো, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আসলে অর্থহীন শব্দের দ্যোতনা এটি, এতদ্বসত্ত্বেও পাঠক উপমিত ডালার যৌনক্রীড়ায় আন্দোলিত হয়েছেন মুহুর্মুহু। কখনো কখনো এটাই বিনয়ের সরল বৈষয়িক কাব্যরীতি, বিনয়ের সঞ্চারণ মাত্রাই যেন পাঠক কে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। যারা তাঁর ছোটগল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী বা অন্যান্য পার্শ্ব রচনা পাঠ করেছেন তারা হয়ত অবগত আছেন যে তিনি সেখানেও একই গাণিতিক অন্তর্জাল ব্যাপ্ত করেছেন। আর ছন্দবীক্ষায় তো যেসব বর্ণের মাত্রা নেই সেসব বর্ণকে মাত্রার মর্যাদাই দেননি। আমি বলতে চাই এই হলো কবি বিনয় মজুমদার, আপাদমস্তক গাণিতিক-কাব্যিক অবিকারগ্রস্থ বিশ্বায়নের এক অন্যমানব।
বিপন্ন মড়াল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে, / যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে / রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ; / স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে; / সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু / এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি... তুমি...
একটি উজ্জ্বল মাছ / কালের খেয়া, সংখ্যা-৭৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬
কবিতার রয়েছে কোনো শিল্পিত লক্ষ কিংবা নেই। অতটা খুঁজিনি, বিনয়কে পেয়েছি, জেনেছি, কবিতা কবিতাই, ভব্যতার নিগূঢ় কোনো এক সূক্ষতাত্ত্বিক এলিমেন্ট। বিনয়ের কবিতা বিনয়ের মতোই সহজ-স্বাভাবিক, জটিলতাবিহীন অবিকারগ্রস্থ ভাষা। যারা তাঁর কাব্যভাষা-কে কখনো কখনো বিকারগ্রস্থ ভেবেছেন-দেখেছেন তারাই নিজেদের ফাঁকি দিয়েছেন। তারা বিনয় মজুমদারের কাব্যলোকে প্রবেশের সূত্রমুখও আবিষ্কার করতে পারেননি। আবার কখনো কখনো তাঁর কবিতা বিষয়ে অহেতুক তর্ক-বিতর্কের ফাঁদ তৈরি করে কবিতা সঞ্চারণের মাত্রাকে অন্য আরেক অর্থে জাগিয়ে তোলার সুপ্তবীজও লুকায়িত ছিল বিদগ্ধশ্রেণিতে, এমন ধারণা করলে অস্বাভাবিক হবে না। আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলেও এরকম উন্নাসিকতার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যাবে। সোজাঅর্থে এটি কবিতার গরল। গায়ত্রী চক্রবর্তী’র সাথে বিনয়ের প্রণয় সম্পর্কটি যারা জানেন তারা ‘ফিরে এসো চাকা’ গ্রন্থটি পাঠ করলে বুঝতে পারবেন বিনয়ের সংবেদনশীলতার গভীরতা। কাব্যিক মহাকালের ক্রান্তিকাল এখন, বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে তর্কে-বিতর্কে জড়ানোর চেয়ে তাঁর কাব্য ব্যবচ্ছেদ সঙ্গত কারণেই অধিক জরুরি। পরিশেষে, এ সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধার্হ কবি শামসুর রাহমানের বিনয়াভিব্যক্তিটি তুলে ধরতে চাই পাঠকের দরবারে...
“আমরা একটি বিবৃতি পড়ছি। কিন্তু কোনো কোনো বিবৃতিও কবিতা হতে পারে, যেমন বিনয়ের এই পঙক্তিমালায় কবিতার স্বাদ রয়ে গেছে। ‘আমিই গণিতের শূন্য’ পুস্তকে কবি কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বিবৃতি বলে রচনাগুলিকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। সম্ভবত এই বইয়ের কবিতাবলিকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কিংবা ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র সমপর্যায়ে রাখা যাবে না, কিন্তু উড়িয়ে দেয়াও অসমীচীন।”
লোক, পৃষ্ঠা-১৬৬, বিনয় মজুমদার সংখ্যা, সম্পাদক: অনিকেত শামীম।
ভুট্টা সিরিজের কবিতাধারার আরো কিছু কবিতা লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে একই বিষয় রূপকার্থে ব্যবহৃত শব্দগুলো পাল্টিয়ে বরং নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগে তিনি পরবর্তী কবিতাগুলোর সমৃদ্ধ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এটি জনশ্রুতি না ভেবে যারা অভিযোগ করেন যে, বিনয় মূল নির্ণয় বাক্যে অবস্থান না করে শব্দের প্রকারান্তরে নিজেকে ব্যাপ্ত করেছেন বেশি তাদের বলতে পারি এ কাজটি কেবল ভাষা-বোধ-উপমা সচেতন কবির পক্ষেই সম্ভব। বিনয়ও তাই করেছেন, সেইসব সমালোচক-বিশ্লেষকদের বোকা বানিয়ে তিনি চলে গেছেন তাঁর অভিপ্সীত লক্ষে, যা থেকে তিনি শিতি করেছেন পাশবিক বিবেচনাকারীর। যেকোন বিষয়মাত্রই টেক্সট এরকম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির কবিতা থেকে দূরে থাকাই ভালো। মূলত এই শ্রেণির অজ্ঞতা থেকেই শিল্পের অবমূল্যায়ণটা তৈরি হয়ে আসতে থাকে। জানা দরকার কবিতা কোনো ফেলনা যৌগিক বিষয় নয়, পাষণ্ডদের হাতেই কেবল কবিতার বিষয়বস্তু বিচারে মৌলিকত্ব ছিল না চিরকাল। তারা একটি গড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন ‘উই আর অলওয়েজ মেইক থিঙ্কিং রাইট উইথ রিয়েলিটি’। বাট থিঙ্কিং জাস্ট এন ডেভিল সোসাইটি’ এ বিষয়টি সহজে তাদের মাথায় ঢুকেনি। এই হলো বৈষয়িক সোর্স আমাদের! অথচ বিনয় মজুমদার মনে করতেন যে কবিতার জন্য চাই ভালো কোনো বিষয়বস্তু সেই সাথে দার্শনিক প্রজ্ঞা যা পাঠকের ভাবাবেগ-কে আন্দোলিত করতে পারে। আমার কাছে মনে হয় ভুট্টা সিরিজ কিংবা ‘বাল্মিকীর কবিতা’গুলো তারই প্রকৃষ্ট উপমা।
প্রৌঢ় বয়সেও আমি প্রায়শ দাঁড়াই দৃঢ় হয়েতার কিছুণ পরে আবার নেতিয়ে পড়ি আমি। বৃষ্টির দেবতা আমি এ জীবনে যত বৃষ্টিপাতকরেছি সে সব কথা মনে পড়ে, ফলে বেঁচে আছি। বৃষ্টি পতনের কথা কোনোদিন মনে থাকে না।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৪ (দে’জ)
সম্মত জলের কাছে বসে বসে তারপর চলে গেল একটি কবিতা। সেইহেতু লতা বাড়ে পুষ্পে পল্লবে স্নিগ্ধ, কবিতার পদাঙ্ক আকারলতাটির পাতাগুলি; বলি তাও ফেটে যায় আরো ছোট বালিকণা হয়েসাগর সৈকতে, আহা, জলের নিকটে থেকে। ফলে অসদ্ভাব হয় জলে ও বালুতে।
ধুয়ে দিই / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১০৭ (দে’জ)
এ বছর মাঘ মাসে আমের মুকুল দেখা দিয়েছে বাগানে।
সারাটা জীবন আমি বৃদেবতার ডালে মুকুল দেখেছি।
অনুজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ডালের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ধীরে
এ ফর্সা মুকুল আসে বের হয়ে, বসন্তের বাতাসে সে দোলে।
এ বছর মাঘ মাসে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১১ (দে’জ)
বিনয়ের এ জাতিয় লেখার যে মূলভাব, বিষয়বস্তু, ঈঙ্গিতময়তা- তা মূলত জৈবিক-প্রাকৃতিক খেলার নামান্তর মাত্র। লক্ষ করেছি, চিরকাল মানুষ যা আড়াল রাখতে চেয়েছে মনোবৈকল্যে বা অপরাধবোধে তাড়িত হয়ে, তিনি সেই দুর্লভ বস্তুটিকে উন্মোচিত করেছেন। জীবনাচারে আমরা যার নাম দিয়েছি যৌনতা। মহাকালের বিকৃত চর্বিতচর্বণে মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ আজ অবয় হতে হতে মৌলিকত্ব হারিয়েছে। যেখানে কামের ক্ল্যাসিকাল রূপটি বিবেচিত স্বর্গীয় এষণায় সেখানে কামকে টেনে-হিঁচড়ে রূপ নিয়েছে উলঙ্গ যৌনতায়। বিনয় মজুমদার প্রতীকি উপমায় সেই মহাকালিক গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই জানাচ্ছেন সৃষ্টিতত্ত্বের সূত্রপাত। প্রকৃতির সকল উপাদানের মধ্যেই অপারবিষ্ময়ে তিনি খুঁজেছেন সে রহস্যময় খেলা। পেয়েছেন। শুধু বিশ্বজগতেই নয় সমগ্র সৌরমণ্ডলেও কবির দৃষ্টিন্দ্রিয় দেখেছে এই দুর্লভ খেলা। আর এ খেলাটি সমগ্র প্রাণিজগতের সম্মুখে ঘটে থাকে। তবে সকলেই দেখে না বিনয়ের মতো কেউ কেউ দেখে। ফলে অদেখা জগতে অসদ্ভাব তৈরি হওয়াটাও স্বাভাবিক কিন্তু কাব্যমাত্রিক বিনয় মজুমদার-কে অসদ্ভাবে ঠাউরে যদি কেউ অবিবেচনা করেন তবে তা কবিতার পরিপন্থিই হবে।
সূর্য গ্রহণের কালে কিছু লেখা ভালো- এই ভেবে
আমি লিখি। আজ হলো তেসরা ফাল্গুন শনিবার
তেরোশ ছিয়াশি সাল। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে চাঁদের ছায়া। এই
লিখে ফের উঠলাম, গ্রহণ আবার দেখে আসি।
গ্রহণ দেখতে গিয়ে দেখলাম মেঘের আড়ালে
সূর্য চলে গেছে, আমি দুইখানি আলোকচিত্রের
ফিল্ম একসঙ্গে নিয়ে তার মাঝ দিয়েই দেখেছি
সূর্যের গ্রহণ প্রায় দশবার, তবে বর্তমানে
সূর্যকে ঢেকেছে মেঘে। যাই ফের দেখে আসি মেঘ
সরে যায় কিনা। ফিরে এসে আবার লিখছি বর্তমানে
আমার ঘড়িতে বাজে তিনটে আটচল্লিশ; মেঘে
সূর্য পুরোপুরি ঢাকা। ফের আমি উঠে গিয়ে দেখে
এলাম আকাশ, মেঘে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা তবে আকাশে
রযে অংশ মেঘে না ঢাকা সে আকাশ মনোযোগ দিয়ে
দেখেছি কোথাও কোনো তারকা উঠেনি আজ গ্রহণের কালে।
ঘড়িতে চারটে দশ বাজে, ফের আমি দেখে এলাম আকাশ
পুরোটাই মেঘে ঢাকা বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে।
চারটে বত্রিশ বাজে, বৃষ্টি অবিরাম পড়ে, তবে
রোদ্দুর উঠেছে ফলে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢাকা চাঁদের ছায়ায়, পুনরায়
দেখে আসি, রোদ আছে। পুনরায় দেখেছি সূর্যের
উপরের সিঁকিভাগে চাঁদের ছায়ায় ঢাকা আছে
চারটে উনচলিøশ মিনিটে। গ্রহণ শুরু হয়েছে যখন
সূর্যের নিচের দিক দেখেছে তখন, আর এই
গ্রহণের শেষ দিকে সূর্যের উপরের দিক ঢাকা,
অর্থাৎ চাঁদের ছায়া নিচ দিক থেকে ক্রমে উপরের দিকে
গিয়েছে বিকেলবেলা, পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন রয়েছে।
বৃষ্টি থেকে গেছে আমি ফের দেখে এসেছি সূর্যকে
চারটে উনপঞ্চাশ মিনিটে, সূর্যের উপরের
দিক ঢাকা মোটামুটি এক পঞ্চমাংশ, দেখলাম।
আবার বাইরে গিয়ে দেখলাম সূর্য মেঘে ঢাকা
চারটে পঞ্চান্ন বাজে সে সময়ে আমার ঘড়িতে
এই আমি করলাম আজ সূর্য গ্রহণের কালে
আমার শিমুলপুর গ্রামে বসে বিকেলবেলায়।
সূর্য গ্রহণের কালে / শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১১৬
এ প্রসঙ্গে কবি-শ্রদ্ধার্হ উৎপল কুমার বসু’র একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘আমরা বিষ্ময়ের সংগে লক্ষ করি আলোচ্য কবি অবলীলায় নির্ণয়বাক্য থেকে আরেক প্রকারে চলে যায়। কখনও ফিরে আসেন মূল সূত্রে। কখনও স্থির হন এক মাঝামাঝি অবস্থায়। আমি সেদিন বসে বসে একটি তালিকা তৈরি করছিলুম কী-জাতিয় নির্ণয়বাক্য বিনয় মজুমদারের প্রিয় প্রকরণ। এই তালিকা দিচ্ছি:স্বয়ংনির্ভর (পধঃবমড়ৎরপধষ) যদি-তাহলে (যুঢ়ড়ঃযবঃরপধষ) বিকল্পাত্মক (ফরংলঁহপঃরাব) অস্তিত্ববাচক (ধঃযবৎসধঃর) নিষেধাত্মক (হবমধঃরাব) সাকুল্যব্যাপক (ঁহরাবৎংধষ) পুননিশ্চয় (হবপবংংধৎু) সম্ভাবনাবাচক (ঢ়ৎড়নষবসধঃরব) এবংবস্তুবিষয়ক (ৎবধষ) আমি শুধু প্রস্তাবাকারে হদিশ দিলুম। তালিকাটিও সম্পূর্ণ নয়। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ বৈশিষ্ট্যের জন্য বিনয় মজুমদারের কবিতা তার অনেক অলংকার বর্জন করেছে। ছন্দোগুণ, উপমা, ধ্বনিসৌকর্য, অন্তমিল এবং আরো বহুবিধ চরিত্র লক্ষণ অর্থাৎ শাঁখা-সিঁদুর থেকে পান-আলতা- যা দিয়ে আমরা কবিতাকে চিনে থাকি- তা সবই প্রায় কবিতায় অনুপস্থিত। তাঁর কবিতার এই নিরাভরণ রূপটি বড় মনোলোভা। কমলকুমার মজুমদারের প্রভাবে বলা যায় বিনয়ের কাছে ‘রূপের কখনো রূপান্তর হয় না’।’
No comments:
Post a Comment