মানুষের মধ্যে সাহিত্যধারণা কিছুটা সচল থাকলেও সাহিত্যের কবিতা বিষয়ে, ধারণা অতটা স্বচ্ছ নয়। যে কারণে বিষয়টি ভালো পঠিত-চর্চিত হওয়ার চেয়ে বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। কাজেই এর ভবিষ্যত বিষয়ে কিছু বলতে গিয়ে সর্বাগ্রেই নানাবিধ বিরূপ দুরূহতায় আটকে থাকতে হয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত একাডেমিক একটি ধারণা আমাদের তৈরি হয়েছে। এটি আসলে সমস্যা জর্জরিত সাময়িক শিক্ষাব্রতী মানসিকতায় পরিচালিত ক্ষণভঙ্গুর একটি ধারণা। শ্রেণিশিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মানসিকতা ছাড়া ওখানে আসলে পাঠমনস্কতা তৈরি হয় না। বিষয়টি ক্রমান্বয়ে কবিতার ভবিষ্যত গন্তব্য নির্ধারণের চেয়ে রাস্ট্রিয় পলিসি মেকিং-এ গাণিতিক ব্যাখ্যাটিই নিশ্চিত করে কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হয় না। কবিতা যখন রাস্ট্র থেকে উত্তীর্ণ মানসিকতায় অবস্থান করে তখনই শিকার হয় ধর্মীয় মূল্যবোধের। ফলে ভবিষ্যত কবিতার একদিকে গন্তব্য নিশ্চিত হলেও অন্য আরেকটি সাহিত্য মানসিকতা অবহেলায় অবদমিত হয় পাঠকের অন্তরেই। এখানে রুটস্ এবং সাহিত্য মানসিকতা এ দুয়ের সমন্বিত একটি রূপই কবিতার ভবিষ্যতরূপ হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করতে পারি। যে বিষয়টি আসলে ক্রম চলমান সুদূর সীমানায় অবস্থিত মূল লক্ষবিন্দু নির্দেশ করে।
সাহিত্যের সৃষ্টি কখন হয়েছিলো যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে এর কোনো সুষ্পষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবে ধারণা করা হয় মানুষ যখন নিজেকে মানুষ বলে জানতে শিখলো তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে সাহিত্যের ধারণার সৃষ্টি হতে শুরু করে এবং তা কালে কালে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। মানুষ একসময় সাহিত্য করতো মুখে মুখে বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে (যখন ভাষা বা শব্দ ছিল না, ইতিহাস খুঁড়ে-ছেনে তুলে আনবার প্রয়োজনে যার কিছু কিছু রূপ এখনো আমাদের সংস্কৃতিতে উপস্থাপিত হয়)। আমরা জানি নৃত্য সৃষ্টির প্রথম কলা, কথাটি সম্পূর্ণ নয় এই জন্য যে, প্রাগৈতিহাসিক শব্দটি নিশ্চয়ই কোন পাঠক সাহিত্যের আভিধানিক ব্যাখ্যা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না, এর কোন ইতিহাসও আমরা কেউ জানি না। মানুষ ক্রমান্বয়ে রেখাচিত্র বা অঙ্কনের মাধ্যমেও সাহিত্যে অনুপ্রবেশ করে। যখন উপস্থাপন শৈলী বা নিবেদন মানসিকতার প্রশ্নের উদ্রেক হলো, সে সময়টাকেই আমরা সাহিত্যের শুরুর কাল হিসেবে ধরতে পারি। আবহমান সাহিত্যের সেই টোটালিটি থেকে তারই এক উত্তরসংস্কৃতি কবিতা। প্রথমদিকে কবিতা মুখে মুখেই করা হতো। মুখের ভাষার সেই তিনি, উৎকৃষ্ট কবি তার আবেগ, অনুভূতি, জ্ঞান, দর্শন সবমিলিয়েই যখন একটি কবিতা রচনা করতেন তখন তার রচনার মাধ্যম ছিল তারই ব্যাপৃত মন। ধারণা করা যায়, উৎকৃষ্ট মনের সেই ব্যক্তিটি এভাবেই মুখে মুখে বলে বেড়াতেন তার কবিতা জগতময়, যাকে আমরা একযুগ আগেও জানতাম এরকম ব্যক্তিটি আসলে সন্ন্যাসী। কিন্তু সন্ন্যাসের ভাষাই কী প্রকৃত কবিতার অনুবাদ? নাকি ভাষার প্রকৃত অনুবাদই হচ্ছে কবিতা; তা কে বলবে? পাঠক নাকি ভাষার অনুবাদক। কালে কালে লোকধর্ম বা সন্ন্যাসব্রতীদের ভাষার অবমূল্যায়ন হয়েছে আমাদের মাঝে। বিষয়টি চর্চিত হওয়া জরুরি।
সময়ের ব্যবধানে কোনো ব্যাখ্যাই স্থিত থাকছে না। ক্রমবৈচিত্রে পাল্টে যাচ্ছে ব্যাপৃত মানবসংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক মাধ্যম। ফলে বিচ্ছিন্ন না হয়েই সাহিত্য থেকে পাল্টে যাচ্ছে করিতার নিবেদন ভঙ্গিমাও। আমাদের মুদ্রণ যন্ত্রের ইতিহাস খুব বেশি দীর্ঘ নয়। ধরা যায় মুদ্রণ যন্ত্র আসার পর থেকেই সমগ্র সাহিত্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে থাকে। আর এই সময়ের সাহিত্যপ্রকাশও হয়ে ওঠছে ডিজিটাল এবং অদূর ভবিষ্যতের সন্নিকট চিত্রটিও প্রায় এরকম যে আগেকার কোনো প্রিন্টধরনেরও প্রয়োজন পড়বে না। তো মুখে মুখে যখন সাহিত্যচর্চা করা হতো সে সময়ের কোন কবিতার কথা আমরা কি জানি? তার উত্তর হলো অবশ্যই জানি কারণ আমরা শুধু লেখার প্রমাণ হিসেবে দলিল-দস্তাবেজকেই বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি মুখের কথাকেও এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ মনের ভাষাও স্বীকার করি। পাঠক-শ্রোতার আস্থা তো ধারণার বাইরে, কখনো কখনো দুটোতেই বিশ্বাস অবিচল থাকতে হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে সেরকম অজস্র কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীময় যা আমরা বিশ্বাস করি। লালন শাহ, হাসন রাজা এর উলেøখযোগ্য সাধক। এই দুই সাধকের কবিতা যা আমরা ধারণ করতে পেরেছি লেখায় তার চেয়ে বহুগুন রয়েছে লেখার বাহিরে। একসময় মানুষ উলঙ্গ ছিল কারণ তখন বস্ত্র ছিল না বা মানুষ বস্ত্রের কথা ভাবেনি। তখন ওটাকেই সভ্য বলে ধরে নেয়া হতো। এখনকার সময়ে বস্ত্র পরাটাকেই সভ্য বলে গণ্য করা হয়। এই সাময়িক রকমফের মানুষের সাহিত্যচর্চার ভিন্ন চেহারা মাত্র। এটা আমার আলোচ্য বিষয় নয় আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কবিতার ভবিষ্যত। তার আগে একটু কবিতা ব্যবচ্ছেদ জরুরি মনে করি। ভাষার উন্নত প্রকাশই হচ্ছে কবিতা। পাঠক যা তার অধ্যয়ন মানিসকতায় নিজের মধ্যে ক্রমাগত বিষয়টি রিনিউ করে। সেটা কোনো আকার নির্দিষ্ট করে নয়। সময়ের শূন্যতার ধ্বনিচিত্রও হতে পারে। ফলে কবিতার জন্য ভাষা যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ভাষার পাঠকও। পাঠকই কবিতার ভবিষ্যত। ভাষা এবং পাঠক কবিতার ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই সমান্তরাল প্রবাহমান। ভবিষ্যত পাঠকের পঠিত কবিতাই ভবিষ্যতের কবিতা। যদিও বিষয়টির স্পেসিফিক চরিত্র আবিস্কার করা কঠিন। রাস্ট্র অবহেলিত হলে ভাষা বিকৃত হয়ে যায়, ভাষার বিকৃতিতে ধর্মীয় অবক্ষয়; ধর্মের অবক্ষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কবিতার সম্ভাবনা, কবিতার ভবিষ্যত। কিন্তু কথা হচ্ছে নির্দিষ্ট কবিতার ভবিষ্যত বলতে তাহলে আমরা কী বুঝবো! বর্তমানের কোনো কবিতা যুগ যুগ জিয়ে ভবিষ্যতেও পঠিত হলে ওই পাঠমনস্কতাই কবিতার ভবিষ্যত এবং পঠিত কবিতাটিই ভবিষ্যতের কবিতা? নাকি শুধুমাত্র উচ্চারণনির্ভর নিরাকার, মানুষের চর্চিত ভাষাটির ভবিষ্যতই কবিতা? ভাষা তো অমর, ভবিষ্যতের ঊর্ধ্বে।
কবিতা নামক শব্দটিকে আমরা জেনেছি অনিবার্য ভাবেই তার সর্বময় উপস্থিতির কারণে। যিনি এ প্রশ্নটি করবেন যে, কবিতার ভবিষ্যত কী? তিনি আসলে সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ হবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি আমাদের সমগ্র সংস্কৃতির অনিবার্য সঞ্চারণশীল একটি ভাবাবেগ হলো কবিতা। যার মৌলিক কোনো ব্যাখা নেই আবার বিষয়টি আমূল ব্যাখ্যাত নয়। আবেগতাড়িত মানুষমাত্রই তার ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যামটিই বেছে নেয়। সেটি আঙ্গিক বিবেচনা করে কবিতা না বলে সবিতা বললেও অর্থের রকমফের প্রায় একই থাকে। চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। তবে শব্দ, আবেগ আর সময় সম্পর্কিত আরো যত আছে এইসব শব্দাবলি এর ব্যাখ্যায় কিছুটা যোগমাত্রা তৈরি করতে পারে। যোগমাত্রা তৈরি করবে একে ভেঙে ফেলার পর বেরিয়ে আসা কোটি কোটি অনুশব্দও; যার কানাকড়িও আমার জানা নেই। হয়তবা প্রতিটি পাঠকের ভেতর থেকে একটি একটি করে এর ভিন্ন শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকের মতে বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকে চিহ্নিত করা হয়। সে অর্থে চর্যাপদের সাহিত্য মর্যাদা বনেদী মেহমানখানার বনেদী অতিথির মতো। তার আরো পরে হিসেব করে দেখলে কবিতার দেহ, ভাষা, শব্দ আর আঙ্গিক গঠন ভাঙাগড়ার বিবেচনায় কবিতার বর্তমান হাল। কিন্তু এরও উৎস কোথায় ছিল? এবার গ্রাফচিত্রের ব্যাখ্যায় দেখি, একথা সত্য যে চর্যাপদে আমরা যে লোকাচারের জীবনচিত্র লক্ষ করেছি আজও তা সেই যুগ যুগ চিত্রধরনের অনুরণন মাত্র। বলা হয় চর্যাপদ দুর্বোধ্য কঠিন। অন্তত এখনকার সময়ে ভাষার তরজমা করলে আমরা তাই দেখবো। সেক্ষেত্রে পাঠক-শ্রোতাকে এর চিত্রধরনের সঞ্চারণে আস্থা রাখতে হয়। এখানে পাঠকের আস্থাই যদি না থাকে তাহলে কবিতা তো পঠনে-শ্রুতিতে আসবার কথা নয়। আর পঠন-শ্রুতিতে না থাকা মানেই কবিতা ভবিষ্যতহীন। কালিদাসের মেঘদূত, লালন শাহ, হাসন রাজার সাহিত্য জীবন, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গুরুসন্ধানী কাব্য গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, ময়মনসিংহ গীতিকা, সাম্প্রতিক জসীমউদ্দীনের ট্র্যাজিক আখ্যান-কাব্য নকশিকাঁথার মাঠ অন্যদিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করেছে মহাকাব্যিক যেসব গ্রন্থাবলি এগুলোও তার উদ্ধৃতিই হতে পারে মাত্র কিন্তু কবিতা নামে স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো বিষয় নয় কিংবা পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতি এগুলো ভবিষ্যত কাব্যেরও কোনো নিদর্শন নয়।
কবিতার কোনো বয়স নেই, কবিতা প্রৌড়ও নয়, কবিতা চির যৌবন। যতদূর তার যৌবনের হাওয়া গিয়ে শিহরণ জাগিয়ে আসতে পেরেছে সেখানেও কবিতার জন্ম হয়েছে। বাংলা কবিতার দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র কবিতাতে ফিরে আসি তবে তার অস্তিত্ব বের করা সম্ভব নয়। ওই যে লিখলাম পৃথিবীতে যখন শব্দ-ভাষার উদ্ভব হলো তারই আবেগের সঞ্চারণ কবিতা। তখনকার সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, সুখ, দুঃখ, জীবনবোধের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতাকে যিনি প্রথম প্রাণের গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন তার ধ্যানমগ্নতা, সন্ন্যাস পৃথিবীর সর্বময় পাঠিয়েছেন; নিশ্চয় সঞ্চারণ-মোহই শুধু নয় তাতে সংবেদনমাত্রাও যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার সে নিঃশ্বাস-বিশ্বাস ক্রমশ প্রসারিত হয়ে আসছে। আজ সে শুধুমাত্র একটি গ্রহ নয় একাধিক গ্রহে প্রসারিত হতে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে প্রথম সংগীত পরিবেশন করতে যাচ্ছেন সংগীততারকা ম্যাডোনা। একদিন কবিতাও পঠিত-যন্ত্রিত হতে পারে! এভাবে শুধুমাত্র স্যাটেলাইট গ্রহ-উপগ্রহই নয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রহ-উপগ্রহেও প্রাণের অস্তিত্বমাত্রই সেখানে ভাবাবেগ বিস্তারিত হতে পারে। আর ভাবাবেগের সরব উপস্থিতি মানেই ধরে নিচ্ছি প্রকৃত কবিতার সঞ্চারণ হলো এবং হতে থাকলো।
এভাবেই কি পাঠক-শ্রোতাকে কবিতা / কবিতার ভবিষ্যত বোঝাতে চাওয়ার পাণ্ডিত্য অর্জন সম্ভব! কবিতা কথার ঝুড়ি, শব্দের নবাগত পেলভতার আতিথ্যবরণই শুধু নয়। কবিতার জন্য দরকার হৃদয়ের উপলব্ধি। যেকথা আমি বোঝাতে চাই সেকথা হয়ত কবিতা হৃদয়ের কোনো অংশই স্পর্শ করলো না। সেজন্য একজন পাঠকের প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা আর প্রকৃত কবিতা উদ্ঘাটন। পাঠকের এই উদ্ঘাটন-উদ্ভাবনের মধ্যেই কবিতার ভবিষ্যত পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু মুশকিল আছে, কবিতার ভবিষ্যত নির্ধারণ করা তার পক্ষেও সম্ভব হবে না এই জন্যে যে, আজ যে কবিতা লিখিত হয়নি সে কবিতা ভবিষ্যতের কোনো কবি লিখে ফেলতে পারে। তখন কবিতার ভবিষ্যত নামের কাক্ঙ্ক্ষিত সাফল্যটি অর্জিত হয়ে যেতে পারে। অন্যঅর্থে ‘ভবিষ্যত’ ব্যাপারটি তাহলে কী দাঁড়ায়? সেটা কী সভ্যতার পর সভ্যতাধরে কবিতাকাল অতিক্রান্ত হওয়ার সময় হবে? নাকি যেকোন ব্যাপার-বিষয়ের নির্ভরতার মতোই কোনো ঘটনা! তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কবিতার ভবিষ্যত আছে। আজ থেকে পাঁচহাজার বছর পূর্বের কবি ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র কথা ভাবা যেতে পারে। মেয়েদের হাত ধরে পুরুষদের সাংস্কৃতিকচর্চার ভব্যতা থেকে যার সমস্ত সৃষ্টিকর্মই প্রায় বিলীন ছিলো, দীর্ঘবছর অপঠিত এবং অনাবিস্কৃত থাকার পর এই সময় তার কবিতা আবিষ্কৃত হওয়ার কথা নয়। স্বল্পদীর্ঘ সময়ের যেসব সভ্যতা আমাদের থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সেখানেও কী কোনো কবি ছিল না? প্রায় ১০ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মিসরীয় ফাঁরাও সভ্যতা কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো কোনো স্যভতাতেও। বিষয়টি তাও নয়। এযাবত লিখিত সব কবির কবিতা থেকে যদি কোনো কবির কবিতা যদি কাঙ্ক্ষিত সেই সময় অতিক্রম করে তাহলে এই কবিতাকে ভবিষ্যতের কবিতা বলার ব্যক্তিটিই বা কে হবেন? নিশ্চয়ই আজকের কোনো প্রশ্নকর্তার সে ভবিষ্যত দেখা সম্ভব নয়। ব্যক্তিমাত্রই ইতিহাস থেকে অতীত-ভবিষ্যত যতটুকু জানতে পারে সেটি কোনো সভ্যতাকে অতিক্রম করে না। আবার জাতি অর্থেও এই সময় রেড ইন্ডিয়ানদের আমরা আর পাবো না। কিন্তু এখানেও তো ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হয়ত রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই ভবিষ্যতের সেই নির্বাচিত কবি ও তার কবিতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাপানের হিরোশিমার কথাও ভাবি আমরা, ভবিষ্যতের কবিতা কি ওখানেই ছিলো? যদি তাই হয় তাহলে ভবিষ্যতের কবিতা নিশ্চয়ই ওখানে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য, যা আমরা আর ফিরে পাবো না।
কাহ্নপাদানাম, কৃত্তিবাস, জ্ঞান দাস, কালিদাস, দৌলত উজীর বাহারাম খান, আলাওল, দ্বিজ কানাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর, নাহিদ হাসান এরকম অনেক কবি-লেখক রয়েছেন যারা লেখকের দৃষ্টিগোচরে রয়েছেন। বাংলা কবিতার এইসব কবিদের মধ্যে কোনো কোনো কবির নাম ওঠে আসে শতাব্দি শতাব্দি কাল ধরে, যদিও এরমধ্যে কারো কারো কবিতা রচনাকাল দশকমাত্রই অতিক্রম হয়নি। এঁদেরও কেউ কেউ শতবর্ষ অতিক্রম করে সহস্রাব্দ, লক্ষাধিক বছর পঠিত-চর্চিত থাকতে পারেন কিন্তু মহাকালের বিবেচনায় সেটি হয় ভগ্নাংশকাল। এই ভগ্নাংশকালই অতিক্রম করার যে লক্ষবিন্দু ধরে নিই সেটিই আসলে কবিতার ভবিষ্যত। ভাবাবেগ থাকলেও সেই ভবিষ্যত কী মানুষের আকার থেকেই প্রকাশিত হবে, কেউ হয়তো জানবে না।
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই এই প্রশ্ন তোলবেন যে কবিতার ভবিষ্যত কী? তার পক্ষে কবিতার বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাকে অযথাই এই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতার ভবিষ্যত। একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন তার কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুন বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জনক। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকেই আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার, আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবন বোধ এইসব অসংখ্য কাজ এক নয়। কবিতাও তাই অজস্র বছর চলতে চলতে ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি। হয়তবা ভবিষ্যতে আমরা এর আরো আরো অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পক্ষে অসম্ভব যতক্ষণ না তিনি কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত অধ্যাপক, সমালোচকদের। একাডেমিক ধারণার ক্ষেত্রে আমি বলবো অধ্যাপকগণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হলেও সমালোচকমাত্রই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হন না তবু আমরা এ দুয়ের উপর ভরসা করতে পারি। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেওয়া’। সেদিক থেকে মূলত রিডার্স অর্থে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শুরুতেই ছাত্রদের কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে তা উপলব্ধি করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না যখন দেখি আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে পাঠপর্ব শেষ। এই হীন অবস্থার দায় নিশ্চয়ই ওই অধ্যাপক / সমালোচকদের। কবিতার ভবিষ্যত প্রশ্নটি করার আগে ওইসব অধ্যাপক / সমালোচকদের কানে কাঠি ঠেলে কবিতাপাঠ ধারণাটি প্রবেশ করানো জরুরি। কেননা এই কবিতাপাঠ ধারাবাহিকতাই একসময় কবিতার ভবিষ্যত গন্তব্যে কবিতাকে নিয়ে যেতে পারে। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তাহলে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। তবে মর্মে উপলব্ধি করার ব্যাপরটি বাদ দিতে পারি কারণ জ্ঞান মহাশয়ও যে জ্ঞান চুরির ঘটনায় দোষি সাব্যস্ত হবেন না ভবিষ্যতে, তাইবা হলপ করে কে বলতে পারে?
লিখছি কবিতার ভবিষ্যত অর্থাৎ কবিতার চলমান সময় পেরিয়ে ভবিতব্য আগামীর কথা প্রসঙ্গত কয়েকটি কথা এসে হাজির হলো। যেকোন প্রাণী জন্মমাত্র তার মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে আসে। আসন্ন মৃত্যুকে সামনে রেখেও সে আরো বাঁচতে চায়। যতটা জীবন পেরুয় ভাবে কিছুটা ভুল রয়ে গেল আর ভাবে আগামীতে সে ভুল শুদ্ধ করে নেবে। এমন আশায় আশায় সে আরো আরো বেশি সময় বাঁচতে চায়। এ ভাবনা তার মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বহাল থাকে। কবিতাও তেমন, সব কবিতা পাঠকের নয় কোনো কোনো কবিতা পাঠকের। কাজেই যে কবিতা পাঠকের নয় সে কবিতার জন্মমাত্রই মৃত্যু হলো। এরকম সব কবিতাই যদি পাঠকের হাতে মৃত্যুর মুখে পড়ে তাহলে তো নির্দিষ্ট কবিতার জন্য অন্তত ভবিষ্যত বলেও কিছু থাকছে না।
একথা সত্য যে পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্ব, প্রাণের ভাষা, প্রাণের ভাবাবেগ যতদিন থাকবে ততদিন কবিতাও পরম্পরায় বেঁচে থাকবে। একটি দিন পেরিয়ে মানুষ যেমন তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরবর্তী দিন তা আবার শুধরে নিয়ে সচল পথে হাঁটে। ঠিক তেমনই কবিতাও তার ভুলগুলি অতীত করে শুদ্ধতার দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। কেননা তিনিই স্বচ্ছ কবি যিনি তার ভুলগুলি লিখেছেন, শুদ্ধগুলিও লিখেছেন এবং ভবিষ্যতেও লিখবেন। সেদিক বিবেচনা করলে পৃথিবী যত সমাধানের দিকে এগুচ্ছে আমরা মনে করি কবিতাও সে পথেই এগুচ্ছে ক্রমশ, একটি সুনির্দিষ্ট সমাধানের জন্য। কবিতা বারবার পাঠে যা মনে হয়, আমাদের শব্দভাণ্ডার কম নয়। আবহমানকালে যা আমরা পাঠ হিসেবে পেয়েছি তা এর বিন্দুমাত্র। ফলে আগামীতে কবিতার পথ আরো আরো অনেক প্রসারিত হবার সম্ভাবনায়... যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তিভাবনা, নানা টেকনিক, ফিকশন-ডিকশন, কবিতা হয়ে ওঠছে আরো সাবধানি... জীবন ঘনিষ্ট... তত্ত¡বহুল... আরো যুক্তি নির্ভর... এ আমরা বিশ্বাস করি।
সাহিত্যের সৃষ্টি কখন হয়েছিলো যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে এর কোনো সুষ্পষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবে ধারণা করা হয় মানুষ যখন নিজেকে মানুষ বলে জানতে শিখলো তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে সাহিত্যের ধারণার সৃষ্টি হতে শুরু করে এবং তা কালে কালে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। মানুষ একসময় সাহিত্য করতো মুখে মুখে বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে (যখন ভাষা বা শব্দ ছিল না, ইতিহাস খুঁড়ে-ছেনে তুলে আনবার প্রয়োজনে যার কিছু কিছু রূপ এখনো আমাদের সংস্কৃতিতে উপস্থাপিত হয়)। আমরা জানি নৃত্য সৃষ্টির প্রথম কলা, কথাটি সম্পূর্ণ নয় এই জন্য যে, প্রাগৈতিহাসিক শব্দটি নিশ্চয়ই কোন পাঠক সাহিত্যের আভিধানিক ব্যাখ্যা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না, এর কোন ইতিহাসও আমরা কেউ জানি না। মানুষ ক্রমান্বয়ে রেখাচিত্র বা অঙ্কনের মাধ্যমেও সাহিত্যে অনুপ্রবেশ করে। যখন উপস্থাপন শৈলী বা নিবেদন মানসিকতার প্রশ্নের উদ্রেক হলো, সে সময়টাকেই আমরা সাহিত্যের শুরুর কাল হিসেবে ধরতে পারি। আবহমান সাহিত্যের সেই টোটালিটি থেকে তারই এক উত্তরসংস্কৃতি কবিতা। প্রথমদিকে কবিতা মুখে মুখেই করা হতো। মুখের ভাষার সেই তিনি, উৎকৃষ্ট কবি তার আবেগ, অনুভূতি, জ্ঞান, দর্শন সবমিলিয়েই যখন একটি কবিতা রচনা করতেন তখন তার রচনার মাধ্যম ছিল তারই ব্যাপৃত মন। ধারণা করা যায়, উৎকৃষ্ট মনের সেই ব্যক্তিটি এভাবেই মুখে মুখে বলে বেড়াতেন তার কবিতা জগতময়, যাকে আমরা একযুগ আগেও জানতাম এরকম ব্যক্তিটি আসলে সন্ন্যাসী। কিন্তু সন্ন্যাসের ভাষাই কী প্রকৃত কবিতার অনুবাদ? নাকি ভাষার প্রকৃত অনুবাদই হচ্ছে কবিতা; তা কে বলবে? পাঠক নাকি ভাষার অনুবাদক। কালে কালে লোকধর্ম বা সন্ন্যাসব্রতীদের ভাষার অবমূল্যায়ন হয়েছে আমাদের মাঝে। বিষয়টি চর্চিত হওয়া জরুরি।
সময়ের ব্যবধানে কোনো ব্যাখ্যাই স্থিত থাকছে না। ক্রমবৈচিত্রে পাল্টে যাচ্ছে ব্যাপৃত মানবসংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক মাধ্যম। ফলে বিচ্ছিন্ন না হয়েই সাহিত্য থেকে পাল্টে যাচ্ছে করিতার নিবেদন ভঙ্গিমাও। আমাদের মুদ্রণ যন্ত্রের ইতিহাস খুব বেশি দীর্ঘ নয়। ধরা যায় মুদ্রণ যন্ত্র আসার পর থেকেই সমগ্র সাহিত্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে থাকে। আর এই সময়ের সাহিত্যপ্রকাশও হয়ে ওঠছে ডিজিটাল এবং অদূর ভবিষ্যতের সন্নিকট চিত্রটিও প্রায় এরকম যে আগেকার কোনো প্রিন্টধরনেরও প্রয়োজন পড়বে না। তো মুখে মুখে যখন সাহিত্যচর্চা করা হতো সে সময়ের কোন কবিতার কথা আমরা কি জানি? তার উত্তর হলো অবশ্যই জানি কারণ আমরা শুধু লেখার প্রমাণ হিসেবে দলিল-দস্তাবেজকেই বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি মুখের কথাকেও এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ মনের ভাষাও স্বীকার করি। পাঠক-শ্রোতার আস্থা তো ধারণার বাইরে, কখনো কখনো দুটোতেই বিশ্বাস অবিচল থাকতে হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে সেরকম অজস্র কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীময় যা আমরা বিশ্বাস করি। লালন শাহ, হাসন রাজা এর উলেøখযোগ্য সাধক। এই দুই সাধকের কবিতা যা আমরা ধারণ করতে পেরেছি লেখায় তার চেয়ে বহুগুন রয়েছে লেখার বাহিরে। একসময় মানুষ উলঙ্গ ছিল কারণ তখন বস্ত্র ছিল না বা মানুষ বস্ত্রের কথা ভাবেনি। তখন ওটাকেই সভ্য বলে ধরে নেয়া হতো। এখনকার সময়ে বস্ত্র পরাটাকেই সভ্য বলে গণ্য করা হয়। এই সাময়িক রকমফের মানুষের সাহিত্যচর্চার ভিন্ন চেহারা মাত্র। এটা আমার আলোচ্য বিষয় নয় আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কবিতার ভবিষ্যত। তার আগে একটু কবিতা ব্যবচ্ছেদ জরুরি মনে করি। ভাষার উন্নত প্রকাশই হচ্ছে কবিতা। পাঠক যা তার অধ্যয়ন মানিসকতায় নিজের মধ্যে ক্রমাগত বিষয়টি রিনিউ করে। সেটা কোনো আকার নির্দিষ্ট করে নয়। সময়ের শূন্যতার ধ্বনিচিত্রও হতে পারে। ফলে কবিতার জন্য ভাষা যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ভাষার পাঠকও। পাঠকই কবিতার ভবিষ্যত। ভাষা এবং পাঠক কবিতার ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই সমান্তরাল প্রবাহমান। ভবিষ্যত পাঠকের পঠিত কবিতাই ভবিষ্যতের কবিতা। যদিও বিষয়টির স্পেসিফিক চরিত্র আবিস্কার করা কঠিন। রাস্ট্র অবহেলিত হলে ভাষা বিকৃত হয়ে যায়, ভাষার বিকৃতিতে ধর্মীয় অবক্ষয়; ধর্মের অবক্ষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কবিতার সম্ভাবনা, কবিতার ভবিষ্যত। কিন্তু কথা হচ্ছে নির্দিষ্ট কবিতার ভবিষ্যত বলতে তাহলে আমরা কী বুঝবো! বর্তমানের কোনো কবিতা যুগ যুগ জিয়ে ভবিষ্যতেও পঠিত হলে ওই পাঠমনস্কতাই কবিতার ভবিষ্যত এবং পঠিত কবিতাটিই ভবিষ্যতের কবিতা? নাকি শুধুমাত্র উচ্চারণনির্ভর নিরাকার, মানুষের চর্চিত ভাষাটির ভবিষ্যতই কবিতা? ভাষা তো অমর, ভবিষ্যতের ঊর্ধ্বে।
কবিতা নামক শব্দটিকে আমরা জেনেছি অনিবার্য ভাবেই তার সর্বময় উপস্থিতির কারণে। যিনি এ প্রশ্নটি করবেন যে, কবিতার ভবিষ্যত কী? তিনি আসলে সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ হবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি আমাদের সমগ্র সংস্কৃতির অনিবার্য সঞ্চারণশীল একটি ভাবাবেগ হলো কবিতা। যার মৌলিক কোনো ব্যাখা নেই আবার বিষয়টি আমূল ব্যাখ্যাত নয়। আবেগতাড়িত মানুষমাত্রই তার ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যামটিই বেছে নেয়। সেটি আঙ্গিক বিবেচনা করে কবিতা না বলে সবিতা বললেও অর্থের রকমফের প্রায় একই থাকে। চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। তবে শব্দ, আবেগ আর সময় সম্পর্কিত আরো যত আছে এইসব শব্দাবলি এর ব্যাখ্যায় কিছুটা যোগমাত্রা তৈরি করতে পারে। যোগমাত্রা তৈরি করবে একে ভেঙে ফেলার পর বেরিয়ে আসা কোটি কোটি অনুশব্দও; যার কানাকড়িও আমার জানা নেই। হয়তবা প্রতিটি পাঠকের ভেতর থেকে একটি একটি করে এর ভিন্ন শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকের মতে বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকে চিহ্নিত করা হয়। সে অর্থে চর্যাপদের সাহিত্য মর্যাদা বনেদী মেহমানখানার বনেদী অতিথির মতো। তার আরো পরে হিসেব করে দেখলে কবিতার দেহ, ভাষা, শব্দ আর আঙ্গিক গঠন ভাঙাগড়ার বিবেচনায় কবিতার বর্তমান হাল। কিন্তু এরও উৎস কোথায় ছিল? এবার গ্রাফচিত্রের ব্যাখ্যায় দেখি, একথা সত্য যে চর্যাপদে আমরা যে লোকাচারের জীবনচিত্র লক্ষ করেছি আজও তা সেই যুগ যুগ চিত্রধরনের অনুরণন মাত্র। বলা হয় চর্যাপদ দুর্বোধ্য কঠিন। অন্তত এখনকার সময়ে ভাষার তরজমা করলে আমরা তাই দেখবো। সেক্ষেত্রে পাঠক-শ্রোতাকে এর চিত্রধরনের সঞ্চারণে আস্থা রাখতে হয়। এখানে পাঠকের আস্থাই যদি না থাকে তাহলে কবিতা তো পঠনে-শ্রুতিতে আসবার কথা নয়। আর পঠন-শ্রুতিতে না থাকা মানেই কবিতা ভবিষ্যতহীন। কালিদাসের মেঘদূত, লালন শাহ, হাসন রাজার সাহিত্য জীবন, সপ্তদশ শতকে শুকুর মামুদের গুরুসন্ধানী কাব্য গোঁপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, ময়মনসিংহ গীতিকা, সাম্প্রতিক জসীমউদ্দীনের ট্র্যাজিক আখ্যান-কাব্য নকশিকাঁথার মাঠ অন্যদিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করেছে মহাকাব্যিক যেসব গ্রন্থাবলি এগুলোও তার উদ্ধৃতিই হতে পারে মাত্র কিন্তু কবিতা নামে স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো বিষয় নয় কিংবা পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাস্রোতের ফলশ্রুতি এগুলো ভবিষ্যত কাব্যেরও কোনো নিদর্শন নয়।
কবিতার কোনো বয়স নেই, কবিতা প্রৌড়ও নয়, কবিতা চির যৌবন। যতদূর তার যৌবনের হাওয়া গিয়ে শিহরণ জাগিয়ে আসতে পেরেছে সেখানেও কবিতার জন্ম হয়েছে। বাংলা কবিতার দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র কবিতাতে ফিরে আসি তবে তার অস্তিত্ব বের করা সম্ভব নয়। ওই যে লিখলাম পৃথিবীতে যখন শব্দ-ভাষার উদ্ভব হলো তারই আবেগের সঞ্চারণ কবিতা। তখনকার সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, সুখ, দুঃখ, জীবনবোধের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতাকে যিনি প্রথম প্রাণের গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন তার ধ্যানমগ্নতা, সন্ন্যাস পৃথিবীর সর্বময় পাঠিয়েছেন; নিশ্চয় সঞ্চারণ-মোহই শুধু নয় তাতে সংবেদনমাত্রাও যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার সে নিঃশ্বাস-বিশ্বাস ক্রমশ প্রসারিত হয়ে আসছে। আজ সে শুধুমাত্র একটি গ্রহ নয় একাধিক গ্রহে প্রসারিত হতে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে প্রথম সংগীত পরিবেশন করতে যাচ্ছেন সংগীততারকা ম্যাডোনা। একদিন কবিতাও পঠিত-যন্ত্রিত হতে পারে! এভাবে শুধুমাত্র স্যাটেলাইট গ্রহ-উপগ্রহই নয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রহ-উপগ্রহেও প্রাণের অস্তিত্বমাত্রই সেখানে ভাবাবেগ বিস্তারিত হতে পারে। আর ভাবাবেগের সরব উপস্থিতি মানেই ধরে নিচ্ছি প্রকৃত কবিতার সঞ্চারণ হলো এবং হতে থাকলো।
এভাবেই কি পাঠক-শ্রোতাকে কবিতা / কবিতার ভবিষ্যত বোঝাতে চাওয়ার পাণ্ডিত্য অর্জন সম্ভব! কবিতা কথার ঝুড়ি, শব্দের নবাগত পেলভতার আতিথ্যবরণই শুধু নয়। কবিতার জন্য দরকার হৃদয়ের উপলব্ধি। যেকথা আমি বোঝাতে চাই সেকথা হয়ত কবিতা হৃদয়ের কোনো অংশই স্পর্শ করলো না। সেজন্য একজন পাঠকের প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা আর প্রকৃত কবিতা উদ্ঘাটন। পাঠকের এই উদ্ঘাটন-উদ্ভাবনের মধ্যেই কবিতার ভবিষ্যত পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু মুশকিল আছে, কবিতার ভবিষ্যত নির্ধারণ করা তার পক্ষেও সম্ভব হবে না এই জন্যে যে, আজ যে কবিতা লিখিত হয়নি সে কবিতা ভবিষ্যতের কোনো কবি লিখে ফেলতে পারে। তখন কবিতার ভবিষ্যত নামের কাক্ঙ্ক্ষিত সাফল্যটি অর্জিত হয়ে যেতে পারে। অন্যঅর্থে ‘ভবিষ্যত’ ব্যাপারটি তাহলে কী দাঁড়ায়? সেটা কী সভ্যতার পর সভ্যতাধরে কবিতাকাল অতিক্রান্ত হওয়ার সময় হবে? নাকি যেকোন ব্যাপার-বিষয়ের নির্ভরতার মতোই কোনো ঘটনা! তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কবিতার ভবিষ্যত আছে। আজ থেকে পাঁচহাজার বছর পূর্বের কবি ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র কথা ভাবা যেতে পারে। মেয়েদের হাত ধরে পুরুষদের সাংস্কৃতিকচর্চার ভব্যতা থেকে যার সমস্ত সৃষ্টিকর্মই প্রায় বিলীন ছিলো, দীর্ঘবছর অপঠিত এবং অনাবিস্কৃত থাকার পর এই সময় তার কবিতা আবিষ্কৃত হওয়ার কথা নয়। স্বল্পদীর্ঘ সময়ের যেসব সভ্যতা আমাদের থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সেখানেও কী কোনো কবি ছিল না? প্রায় ১০ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মিসরীয় ফাঁরাও সভ্যতা কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো কোনো স্যভতাতেও। বিষয়টি তাও নয়। এযাবত লিখিত সব কবির কবিতা থেকে যদি কোনো কবির কবিতা যদি কাঙ্ক্ষিত সেই সময় অতিক্রম করে তাহলে এই কবিতাকে ভবিষ্যতের কবিতা বলার ব্যক্তিটিই বা কে হবেন? নিশ্চয়ই আজকের কোনো প্রশ্নকর্তার সে ভবিষ্যত দেখা সম্ভব নয়। ব্যক্তিমাত্রই ইতিহাস থেকে অতীত-ভবিষ্যত যতটুকু জানতে পারে সেটি কোনো সভ্যতাকে অতিক্রম করে না। আবার জাতি অর্থেও এই সময় রেড ইন্ডিয়ানদের আমরা আর পাবো না। কিন্তু এখানেও তো ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’র ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হয়ত রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই ভবিষ্যতের সেই নির্বাচিত কবি ও তার কবিতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাপানের হিরোশিমার কথাও ভাবি আমরা, ভবিষ্যতের কবিতা কি ওখানেই ছিলো? যদি তাই হয় তাহলে ভবিষ্যতের কবিতা নিশ্চয়ই ওখানে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য, যা আমরা আর ফিরে পাবো না।
কাহ্নপাদানাম, কৃত্তিবাস, জ্ঞান দাস, কালিদাস, দৌলত উজীর বাহারাম খান, আলাওল, দ্বিজ কানাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর, নাহিদ হাসান এরকম অনেক কবি-লেখক রয়েছেন যারা লেখকের দৃষ্টিগোচরে রয়েছেন। বাংলা কবিতার এইসব কবিদের মধ্যে কোনো কোনো কবির নাম ওঠে আসে শতাব্দি শতাব্দি কাল ধরে, যদিও এরমধ্যে কারো কারো কবিতা রচনাকাল দশকমাত্রই অতিক্রম হয়নি। এঁদেরও কেউ কেউ শতবর্ষ অতিক্রম করে সহস্রাব্দ, লক্ষাধিক বছর পঠিত-চর্চিত থাকতে পারেন কিন্তু মহাকালের বিবেচনায় সেটি হয় ভগ্নাংশকাল। এই ভগ্নাংশকালই অতিক্রম করার যে লক্ষবিন্দু ধরে নিই সেটিই আসলে কবিতার ভবিষ্যত। ভাবাবেগ থাকলেও সেই ভবিষ্যত কী মানুষের আকার থেকেই প্রকাশিত হবে, কেউ হয়তো জানবে না।
কতটুকু স্থিরতা সহকারে কবিতা ক্রমশ এগিয়ে আসছে সভ্যতাকে মাথায় নিয়ে তা স্পষ্ট জেনে না নিয়ে যিনি প্রথমেই এই প্রশ্ন তোলবেন যে কবিতার ভবিষ্যত কী? তার পক্ষে কবিতার বর্তমান জানাও সম্ভব নয়। আজকেই লিখতে বসেছেন যে কবি তাকে অযথাই এই প্রশ্ন করে বিব্রত করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কিনা তা ভেবে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কবিতার ভবিষ্যত। একটি কবিতা পাঠকের হাতে পৌঁছামাত্র যে পাঠক প্রাপ্তিস্বীকার করেই বাঁচতে চাইলেন তার কাছে কবিতার দায় আরো অজস্রগুন বেড়ে গেলো। একটি কবিতাই অজস্র কবিতার জনক। শুরুর কালের একটি কবিতা থেকেই আজকের কোটি কোটি কবিতা। মানুষের আচার, আচরণ, কথা বলা, গান গাওয়া, জীবন বোধ এইসব অসংখ্য কাজ এক নয়। কবিতাও তাই অজস্র বছর চলতে চলতে ভিন্ন ভিন্ন রিদম তৈরি হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক কাঠামোর বিবর্তন আমরা দেখেছি। হয়তবা ভবিষ্যতে আমরা এর আরো আরো অজস্র কাঠামো দেখতে পাবো। এই পাঠোদ্ধার একজন পাঠকের পক্ষে অসম্ভব যতক্ষণ না তিনি কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব সাধারণত অধ্যাপক, সমালোচকদের। একাডেমিক ধারণার ক্ষেত্রে আমি বলবো অধ্যাপকগণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হলেও সমালোচকমাত্রই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হন না তবু আমরা এ দুয়ের উপর ভরসা করতে পারি। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘কবির কাজ কবিতা রচনা করা আর একজন অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে তা মর্মে উপলব্ধি করা এবং তা পাঠকের হাতে তোলে দেওয়া’। সেদিক থেকে মূলত রিডার্স অর্থে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শুরুতেই ছাত্রদের কতটুকু অধ্যয়নমনস্ক করে তোলে তা উপলব্ধি করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না যখন দেখি আজকের একজন ছাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেই ভাবছে পাঠপর্ব শেষ। এই হীন অবস্থার দায় নিশ্চয়ই ওই অধ্যাপক / সমালোচকদের। কবিতার ভবিষ্যত প্রশ্নটি করার আগে ওইসব অধ্যাপক / সমালোচকদের কানে কাঠি ঠেলে কবিতাপাঠ ধারণাটি প্রবেশ করানো জরুরি। কেননা এই কবিতাপাঠ ধারাবাহিকতাই একসময় কবিতার ভবিষ্যত গন্তব্যে কবিতাকে নিয়ে যেতে পারে। তারপরও যদি সম্ভব না হয় তাহলে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। তবে মর্মে উপলব্ধি করার ব্যাপরটি বাদ দিতে পারি কারণ জ্ঞান মহাশয়ও যে জ্ঞান চুরির ঘটনায় দোষি সাব্যস্ত হবেন না ভবিষ্যতে, তাইবা হলপ করে কে বলতে পারে?
লিখছি কবিতার ভবিষ্যত অর্থাৎ কবিতার চলমান সময় পেরিয়ে ভবিতব্য আগামীর কথা প্রসঙ্গত কয়েকটি কথা এসে হাজির হলো। যেকোন প্রাণী জন্মমাত্র তার মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে আসে। আসন্ন মৃত্যুকে সামনে রেখেও সে আরো বাঁচতে চায়। যতটা জীবন পেরুয় ভাবে কিছুটা ভুল রয়ে গেল আর ভাবে আগামীতে সে ভুল শুদ্ধ করে নেবে। এমন আশায় আশায় সে আরো আরো বেশি সময় বাঁচতে চায়। এ ভাবনা তার মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বহাল থাকে। কবিতাও তেমন, সব কবিতা পাঠকের নয় কোনো কোনো কবিতা পাঠকের। কাজেই যে কবিতা পাঠকের নয় সে কবিতার জন্মমাত্রই মৃত্যু হলো। এরকম সব কবিতাই যদি পাঠকের হাতে মৃত্যুর মুখে পড়ে তাহলে তো নির্দিষ্ট কবিতার জন্য অন্তত ভবিষ্যত বলেও কিছু থাকছে না।
একথা সত্য যে পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্ব, প্রাণের ভাষা, প্রাণের ভাবাবেগ যতদিন থাকবে ততদিন কবিতাও পরম্পরায় বেঁচে থাকবে। একটি দিন পেরিয়ে মানুষ যেমন তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরবর্তী দিন তা আবার শুধরে নিয়ে সচল পথে হাঁটে। ঠিক তেমনই কবিতাও তার ভুলগুলি অতীত করে শুদ্ধতার দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। কেননা তিনিই স্বচ্ছ কবি যিনি তার ভুলগুলি লিখেছেন, শুদ্ধগুলিও লিখেছেন এবং ভবিষ্যতেও লিখবেন। সেদিক বিবেচনা করলে পৃথিবী যত সমাধানের দিকে এগুচ্ছে আমরা মনে করি কবিতাও সে পথেই এগুচ্ছে ক্রমশ, একটি সুনির্দিষ্ট সমাধানের জন্য। কবিতা বারবার পাঠে যা মনে হয়, আমাদের শব্দভাণ্ডার কম নয়। আবহমানকালে যা আমরা পাঠ হিসেবে পেয়েছি তা এর বিন্দুমাত্র। ফলে আগামীতে কবিতার পথ আরো আরো অনেক প্রসারিত হবার সম্ভাবনায়... যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তিভাবনা, নানা টেকনিক, ফিকশন-ডিকশন, কবিতা হয়ে ওঠছে আরো সাবধানি... জীবন ঘনিষ্ট... তত্ত¡বহুল... আরো যুক্তি নির্ভর... এ আমরা বিশ্বাস করি।
No comments:
Post a Comment