বাংলা কবিতার দীর্ঘ ধারাবাহিকতার পর ত্রিশের দশকে এসে কাব্য-ব্যবচ্ছেদে এক নতুন পথ তৈরি হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত হাঁটছেন অনেকেই। অবশ্য পঞ্চাশের দশকের পর গভীরতর বিস্তৃত পথ একটু শীথিল হয়ে যায়। তারপরও এর ভেতরেই কিছু কিছু কবি রয়েছেন যাঁরা একটু ব্যতিক্রম পথে হেঁটে চলেছেন। ষাঁট, সত্তুর দশকেও সেরকম দু,চারজন কবির সন্ধান পাওয়া যাবে। আশির দশক থেকে পুনরায় বাংলা কবিতা ভিন্নভাবে সজাগ হতে চলেছে। আর তারই বাঁক সম্ভাবনা কাঁধে নিয়ে নব্বইয়ের এবং বর্তমান শূন্য দশকের কবিদের পদচারণা শুরু হয়েছে। ধারণা করা যায় একবিংশের কবিদের হাতে কবিতার আর এক বাঁক বা ভাষার গূঢ়পট পরিবর্তনের উত্থান হবে এবং তার কাজ ভেতরে ভেতরে চালিয়ে যাচ্ছেন এই সময়ের কবিরা। কামরুল হাসান এই সম্মিলিত আশি-নব্বই এবং শূন্য দশকের ঊর্ধ্বতন অন্যতম প্রজ্ঞাকবি একজন। যিনি একাধারে কাব্যপুরুষ, পঠিত, প্রমাণিত এবং ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতায়ও যাঁর অমিত সম্ভাবনা থাকবে ধারণা করা যায়।
শফিক রেহমানের ‘রিপু কাহিনী’ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে মধ্যবিত্ত বাংলা ছোটগল্প সঞ্চারণের কাছে আমাদের ব্যাপক পাঠক পৌঁছাতে পারেনি। বরং তথাকথিত সাহিত্য সমালোচকের বদৌলতে পাঠককুল মৌলিকত্ব হারিয়েছে। অন্যদিকে নির্মলেন্দু গুণের ‘আপন দলের মানুষ’ পড়তে গিয়ে অভিভূত হয়েছি, কবির লেখা গল্প অসাধারণ সঞ্চারিত করেছে আমাকে। দুটি গল্প বইয়ের উদ্বৃতি দিলাম এই জন্যে যে, কবি কামরুল হাসানের কবিতায় এই গল্পময়তা গুণটিই অধিক সঞ্চারিত করেছে আমাকে। অগ্রে বলে রাখি ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণকারী এই কবির ‘পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে’সহ এযাবৎ মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ওপার বাংলার লিটল ম্যাগাজিনসহ একবিংশ, নিসর্গ এবং সমকালিন বাংলা ছোটকাগজ ‘হাওড়’-এর অন্যতম প্রধান কবি-লেখক তিনি। কামরুল হাসান স্মিতবাক, অনুচ্চকণ্ঠ, দূরবর্তী চেতনার কবি। জীবনস্পৃষ্ঠ দর্শন-চিন্তা কবিতার অন্তরীক্ষে কুয়াশার পাতলা আবরণের মতো কখনো স্বচ্চ, কখনো ম্রিয়মাণ। তবে দর্শনের গুরুভার তাঁর কবিতার মুখ্য উপাদান নয়। নয় বনেদী বাংলা কবিতার প্রথাছন্দ প্রয়োগের কবি। তাঁর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি আপনা থেকেই তাঁর কবিতার ছন্দ দোলায়িত করে পাঠক-কে। ফলে তাঁর কাব্যিক অবস্থান গিয়ে পৌঁছায় শাশ্বতকালের বাংলা শব্দতাঁতির অন্য এক গৌড়চন্দ্রিকায়। কেউ কেউ মনে করেন ছন্দ ছাড়া টিকে না কবিতা আবার কেউ কেউ মনে করেন কবিতা তার আপন ছন্দেই উপস্থাপিত হয়। তাঁর কবিতার ছন্দের উদারতার সূত্র ধরে লিখতে চাই যারা অনুবাদ কবিতার পাঠক তারা লক্ষ করবেন যখন অন্যভাষার একটি কবিতার অনুবাদ আমরা পাঠ করি তখন কিন্তু কবিতাটিতে আর মূলছন্দ থাকে না। একই অবস্থা হয় যখন বাংলাভাষার একটি কবিতা ইংরেজি কিংবা অন্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। কখনো কখনো এমন হয় যে মূল কবিতাটির ভাবান্তরও ঘটে যায়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে এই কাব্যিক গল্পময়তা এবং প্রথাছন্দহীন একটি ছন্দ কবিতার উদ্বৃতি দিচ্ছি।
নদীর উপরে জানি জানি, উত্তাল ঢেউ চড়েছিল, হেঁটে যাচ্ছিলাম
হাঁটতে হাঁটতে সেই সাধু হয়ে গেলাম যে মাঝনদীতে ডুবে গিয়েছিল
ঐ নদীর তলদেশে বহু রক্তাক্ত লাশ আর বিধ্বস্তরাজ্য স্তুপ হয়ে ছিল
রক্তাক্তরাজ্য আর বিধ্বস্তলাশের আগে
কিসের রাজ্য কিসের ত্রিতাল
রিপুর কাছেই জগত মাতাল
ভেঙে পড়ছে সময়ের ত্রাশ
সকল রাজা হলেন তো লাশ
দ্রাবিড়যাত্রা ও খড়ম প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৯
কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক যেন সেই গ্রামীণ লোকপুরাণের চিত্রটি ঠিক চোখের সামনে দেখতে পান। নদীর উপর দিয়ে কোনো সাধু-সন্ন্যাসী জায়নামাজ বিছিয়ে কিংবা খড়ম পায়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছেন। শুধু লোকশ্রুতির এই খড়ম-সন্ন্যাসীর কথাই নয় গ্রন্থভুক্ত তাঁর আরেকটি অসাধারণ কবিতা ‘সুনামগঞ্জ’। কবিতাটিতে আমাদের আঞ্চলিক লোকাচারের বিশেষ ছাপ, অন্তর্দাহের প্রজ্ঞাপিত আবেগময় স্মৃতিচারণা আছে। বরাবরই কবিতার ক্ষেত্রে একটি বাক্য খুব জোড়ালো হয়ে ওঠে উপেতি, অবহেলিত, দুর্বোধ্য। এই পাঠক দারিদ্র্যতার কথাটি আমরা নিজেই ভাবি না। আশ্চর্য! ল্য করুন, কবির সজ্ঞায় কিভাবে আমাদের লোক-সংস্কৃতির পরিবর্তন উঠে এসেছে। অবচেতনেই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে কপটতা, ভাণ-ভণ্ডামির। শুধুমাত্র কাব্যিক প্রতিবেশেই নয় চিরকাল যা আমরা বর্জন করতে চেয়েছি মানবিক মূল্যবোধের তাগিদেই।
খুব সকালে যাচ্ছিলাম আর্ট স্কুলের দিকটায়,
দেখি বন্ধ জানালার পাশে এক সুলনা দাঁড়িয়ে,
‘এই যে শুনুন’
ভাবলাম ভাগ্য প্রসন্ন, দেবী ডাকছেন,
বল্লেন, ‘ঘুমন্ত গৌতমকে একটু ডেকে দিন তো
হাত ধরে পালাবো’।
যেদিকে পালাতে চান সেদিকে স্থানুর মূর্তি ধরে আছে রামকিংকর বেইজ।
শান্তিনিকেতন, পৃষ্ঠা-১১
বোধের, আবেগের, ভাবের শিল্পিত বহিঃপ্রকাশই কবিতা। ধীরলয়। অনেকটা জীবনানন্দের ধীরলয়ের কাব্য-ঘরাণার চমৎকার একটা ফর্ম বেছে নিয়েছেন কামরুল হাসান, তাঁর কবিতায়। ধীরলয়ের এই মহিমাগুণেই তিনি পাঠককে প্রভাবিত করেন দূরশ্র“ত শব্দ-দ্যোতনায়। ফলে তিনি যে কোথাও কোথাও বাংলা কবিতার প্রভাব-প্রপাগাণ্ডার মধ্যে পড়েননি তা নয়। তাঁর কোনো কোনো কবিতাতে উৎপল কুমার বসু থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর অনুজ কবি ব্রাত্য রাইসুর কবিতার প্রভাবও লক্ষ করা যায়। গ্রন্থভুক্ত ‘কবরকাব্য’ কবিতাটি পাঠ করলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পজিটিভ অর্থেই লিখছি, বাংলাভাষার সবচেয়ে সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবিদের তালিকা করলে দেখা যাবে জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, উৎপল কুমার বসু, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর প্রমুখ কবিকুলই সর্বাধিক সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবি। অনায়াসে কামরুল হাসান নিজেও এই গোত্রের একজন।
আমরা জানি, কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়। আর সঞ্চারণ থেকেই যেহেতু প্রভাব-প্রবণতা তৈরি হয় কাজেই কবিতায় যদি কারো প্রভাব থাকে সেটি দোষের নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন আছে ‘প্রভাব কবিতা বর্জন করা’। এতে একটা মুশকিল হয়, মুহুর্মহু কবিতার নিউ টেক্সট কবিতার বৈচিত্রের বদলে কবিতার ভারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারেন পাঠক। আমার মতে, এই ‘প্রভাব কবিতা বর্জন’ ধারণাটির এখনি পরিবর্তন হওয়া জরুরি। ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট থেকে কবিতা বিষয়ক কবির নিজস্ব ভাবনাও এখানে উপস্থাপন করছি। ‘অতিদুর্বোধ্য, মাথামুণ্ডুহীন লেখারও বিপক্ষে আমি। আমাদের কবিতায় একদিকে অতিতরল কবিতার বল্গাহীন দৌড়, অন্যদিকে অতিদুর্বোধ্য লেখার অর্থহীন ভীড়। আমার কবিতা এ দু’ধরনের অকাব্যিক প্রবণতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে এবং মাঝামাঝি কোথাও নিজের পথটি খুঁজে পায়। কবিতায় ছন্দ থাকা প্রয়োজন তবে সে ছন্দ নিক্তি মেপে বসানো প্রাণহীন মাত্রা আর পর্বের হিসাব নয়, বরং কবির কানের কাছে শ্রুতিমধুর পদাবলী’।
কামরুল হাসান স্বভাব কবি। তাঁর কাব্যস্বভাবের একটি বৃহৎ অংশে বিস্তৃত রয়েছে রোমান্টিকতা। বাঙালির প্রধান স্বভাব-বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রেম, গূঢ়অর্থেই তিনি আমাদের জীবনাচারের সঠিক জায়গাটিতেই ক্লিক করেছেন। একটা সময় ছিল যখন ব্যাপকহারে কবিরা প্রেমের কবিতা লিখতেন। বাজারে অডিও মিডিয়ার কল্যাণে ট্রেডমার্কধারী কিছু প্রেমের কবিতা লিখিয়েও ছিলেন, যাঁরা শুধু প্রেমের কবিতাই লিখতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষপ্রান্তে এসে অডিও মিডিয়ায় আবৃত্তি শিল্পের ভাটা পড়ার সাথে সাথে এই রোমান্টিকতার বিলুপ্তি হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ এবং যুক্তিসঙ্গত প্রেমের কবিতার কথাই লিখছি। পাঠক লক্ষ করবেন, বিষয়টি কামরুল হাসানের কবিতায় কত গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
কী কাতরতায় মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে মানুষ একাকী
মাইল মাইল কুয়াশা পাড়ি দেয়, অন্ধকারে হাঁটে?
কে কবে বুঝেছে কাকে, তবু কেউ একজন চলে যায় / অযুত যোজন দূরে-
এইপাড় হতে কে একজন ক্ষীণস্বরে তাকে ডেকে আনে / অবোধরে...
কে অবোধ? কার কষ্ট ভারী হলো মাঠের হৃদয়ে?
প্রান্তরের কান্নাসজল মানুষেরা, পৃষ্ঠা-৪৪
‘সময় সবুজ ডাইনী’ রণজিৎ দাশের এই কাব্যমনীষার যথার্থ যৌক্তিকতা আছে। সমকাল কবি-লেখকদের কাছ থেকে উবে যায়। কামরুল হাসানের ক্ষেত্রেও এর বাত্যয় ঘটেনি। তাঁর কাব্যপ্রবণতা দিনে দিনে কতটা গভীর হয়েছে তা আমাদের ব্যাপক পাঠকের সংজ্ঞায় আসেনি। অথচ প্রেমের কবিতা লেখার ট্রেডমার্ক পোয়েট মহাদেব সাহা কী করে বালখিল্যতা করে একটি প্রেমের চিঠিকে ছন্দের প্রয়োজনে ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেন ‘করুণা করেও হলে চিঠি দিও’। অদ্যাবধি কবিতাটি মহাদেব সাহার একটি শীর্ষ প্রেমের কবিতা হিসেবে স্বীকৃত! প্রণম্য পাঠক, খুবই আশ্চর্যের বিষয় তাই না!
বাংলাভাষায় নরেশ গুহ নামে একজন কবি ছিলেন। যিনি মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থের অধিকর্তা ছিলেন। কবি বিনয় মজুমদার, তাঁর একটি প্রবন্ধে পাঠকের উদ্দেশ্যে আর্জি রেখেছিলেন তাঁকে যথার্থ কবি হিসেবে বিবেচনা করার। বাংলা ভাষাভাষিদের একজন বড়মাপের কবি কামরুল হাসানের কাব্যপ্রতিভাকে খাটো করা অর্থে নয় বরং ব্যাপক দৃষ্টিনন্দন উদ্দেশ্যেই লিখছি, কাব্যস্বভাবে কামরুল হাসান অনেক বিস্তৃত এবং পাড়ি দিয়েছেন যোজন অভিজ্ঞতায়। ফলে পাঠকের দরবারে তিনি যতটা প্রজ্ঞাসহ এগিয়ে এসেছেন, পাঠকের উচিত হবে ততোধিক সাদরেই তাঁকে গ্রহণ করা, বাংলা কবিতায়।
পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে \ কামরুল হাসান, প্রকাশক \ নিসর্গ, ফেব্রুয়ারি-২০০৭, প্রচ্ছদ \ অশেষ সাহা, পৃষ্ঠা-৬৪, মূল্য-৫০ টাকা।
শফিক রেহমানের ‘রিপু কাহিনী’ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে মধ্যবিত্ত বাংলা ছোটগল্প সঞ্চারণের কাছে আমাদের ব্যাপক পাঠক পৌঁছাতে পারেনি। বরং তথাকথিত সাহিত্য সমালোচকের বদৌলতে পাঠককুল মৌলিকত্ব হারিয়েছে। অন্যদিকে নির্মলেন্দু গুণের ‘আপন দলের মানুষ’ পড়তে গিয়ে অভিভূত হয়েছি, কবির লেখা গল্প অসাধারণ সঞ্চারিত করেছে আমাকে। দুটি গল্প বইয়ের উদ্বৃতি দিলাম এই জন্যে যে, কবি কামরুল হাসানের কবিতায় এই গল্পময়তা গুণটিই অধিক সঞ্চারিত করেছে আমাকে। অগ্রে বলে রাখি ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণকারী এই কবির ‘পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে’সহ এযাবৎ মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ওপার বাংলার লিটল ম্যাগাজিনসহ একবিংশ, নিসর্গ এবং সমকালিন বাংলা ছোটকাগজ ‘হাওড়’-এর অন্যতম প্রধান কবি-লেখক তিনি। কামরুল হাসান স্মিতবাক, অনুচ্চকণ্ঠ, দূরবর্তী চেতনার কবি। জীবনস্পৃষ্ঠ দর্শন-চিন্তা কবিতার অন্তরীক্ষে কুয়াশার পাতলা আবরণের মতো কখনো স্বচ্চ, কখনো ম্রিয়মাণ। তবে দর্শনের গুরুভার তাঁর কবিতার মুখ্য উপাদান নয়। নয় বনেদী বাংলা কবিতার প্রথাছন্দ প্রয়োগের কবি। তাঁর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি আপনা থেকেই তাঁর কবিতার ছন্দ দোলায়িত করে পাঠক-কে। ফলে তাঁর কাব্যিক অবস্থান গিয়ে পৌঁছায় শাশ্বতকালের বাংলা শব্দতাঁতির অন্য এক গৌড়চন্দ্রিকায়। কেউ কেউ মনে করেন ছন্দ ছাড়া টিকে না কবিতা আবার কেউ কেউ মনে করেন কবিতা তার আপন ছন্দেই উপস্থাপিত হয়। তাঁর কবিতার ছন্দের উদারতার সূত্র ধরে লিখতে চাই যারা অনুবাদ কবিতার পাঠক তারা লক্ষ করবেন যখন অন্যভাষার একটি কবিতার অনুবাদ আমরা পাঠ করি তখন কিন্তু কবিতাটিতে আর মূলছন্দ থাকে না। একই অবস্থা হয় যখন বাংলাভাষার একটি কবিতা ইংরেজি কিংবা অন্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। কখনো কখনো এমন হয় যে মূল কবিতাটির ভাবান্তরও ঘটে যায়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে এই কাব্যিক গল্পময়তা এবং প্রথাছন্দহীন একটি ছন্দ কবিতার উদ্বৃতি দিচ্ছি।
নদীর উপরে জানি জানি, উত্তাল ঢেউ চড়েছিল, হেঁটে যাচ্ছিলাম
হাঁটতে হাঁটতে সেই সাধু হয়ে গেলাম যে মাঝনদীতে ডুবে গিয়েছিল
ঐ নদীর তলদেশে বহু রক্তাক্ত লাশ আর বিধ্বস্তরাজ্য স্তুপ হয়ে ছিল
রক্তাক্তরাজ্য আর বিধ্বস্তলাশের আগে
কিসের রাজ্য কিসের ত্রিতাল
রিপুর কাছেই জগত মাতাল
ভেঙে পড়ছে সময়ের ত্রাশ
সকল রাজা হলেন তো লাশ
দ্রাবিড়যাত্রা ও খড়ম প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৯
কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক যেন সেই গ্রামীণ লোকপুরাণের চিত্রটি ঠিক চোখের সামনে দেখতে পান। নদীর উপর দিয়ে কোনো সাধু-সন্ন্যাসী জায়নামাজ বিছিয়ে কিংবা খড়ম পায়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছেন। শুধু লোকশ্রুতির এই খড়ম-সন্ন্যাসীর কথাই নয় গ্রন্থভুক্ত তাঁর আরেকটি অসাধারণ কবিতা ‘সুনামগঞ্জ’। কবিতাটিতে আমাদের আঞ্চলিক লোকাচারের বিশেষ ছাপ, অন্তর্দাহের প্রজ্ঞাপিত আবেগময় স্মৃতিচারণা আছে। বরাবরই কবিতার ক্ষেত্রে একটি বাক্য খুব জোড়ালো হয়ে ওঠে উপেতি, অবহেলিত, দুর্বোধ্য। এই পাঠক দারিদ্র্যতার কথাটি আমরা নিজেই ভাবি না। আশ্চর্য! ল্য করুন, কবির সজ্ঞায় কিভাবে আমাদের লোক-সংস্কৃতির পরিবর্তন উঠে এসেছে। অবচেতনেই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে কপটতা, ভাণ-ভণ্ডামির। শুধুমাত্র কাব্যিক প্রতিবেশেই নয় চিরকাল যা আমরা বর্জন করতে চেয়েছি মানবিক মূল্যবোধের তাগিদেই।
খুব সকালে যাচ্ছিলাম আর্ট স্কুলের দিকটায়,
দেখি বন্ধ জানালার পাশে এক সুলনা দাঁড়িয়ে,
‘এই যে শুনুন’
ভাবলাম ভাগ্য প্রসন্ন, দেবী ডাকছেন,
বল্লেন, ‘ঘুমন্ত গৌতমকে একটু ডেকে দিন তো
হাত ধরে পালাবো’।
যেদিকে পালাতে চান সেদিকে স্থানুর মূর্তি ধরে আছে রামকিংকর বেইজ।
শান্তিনিকেতন, পৃষ্ঠা-১১
বোধের, আবেগের, ভাবের শিল্পিত বহিঃপ্রকাশই কবিতা। ধীরলয়। অনেকটা জীবনানন্দের ধীরলয়ের কাব্য-ঘরাণার চমৎকার একটা ফর্ম বেছে নিয়েছেন কামরুল হাসান, তাঁর কবিতায়। ধীরলয়ের এই মহিমাগুণেই তিনি পাঠককে প্রভাবিত করেন দূরশ্র“ত শব্দ-দ্যোতনায়। ফলে তিনি যে কোথাও কোথাও বাংলা কবিতার প্রভাব-প্রপাগাণ্ডার মধ্যে পড়েননি তা নয়। তাঁর কোনো কোনো কবিতাতে উৎপল কুমার বসু থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর অনুজ কবি ব্রাত্য রাইসুর কবিতার প্রভাবও লক্ষ করা যায়। গ্রন্থভুক্ত ‘কবরকাব্য’ কবিতাটি পাঠ করলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পজিটিভ অর্থেই লিখছি, বাংলাভাষার সবচেয়ে সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবিদের তালিকা করলে দেখা যাবে জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, উৎপল কুমার বসু, মোহাম্মদ রফিক, জয় গোস্বামী, ফরিদ কবির, টোকন ঠাকুর প্রমুখ কবিকুলই সর্বাধিক সঞ্চারণ-প্রভাব সৃষ্টিকারি কবি। অনায়াসে কামরুল হাসান নিজেও এই গোত্রের একজন।
আমরা জানি, কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়। আর সঞ্চারণ থেকেই যেহেতু প্রভাব-প্রবণতা তৈরি হয় কাজেই কবিতায় যদি কারো প্রভাব থাকে সেটি দোষের নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন আছে ‘প্রভাব কবিতা বর্জন করা’। এতে একটা মুশকিল হয়, মুহুর্মহু কবিতার নিউ টেক্সট কবিতার বৈচিত্রের বদলে কবিতার ভারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারেন পাঠক। আমার মতে, এই ‘প্রভাব কবিতা বর্জন’ ধারণাটির এখনি পরিবর্তন হওয়া জরুরি। ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট থেকে কবিতা বিষয়ক কবির নিজস্ব ভাবনাও এখানে উপস্থাপন করছি। ‘অতিদুর্বোধ্য, মাথামুণ্ডুহীন লেখারও বিপক্ষে আমি। আমাদের কবিতায় একদিকে অতিতরল কবিতার বল্গাহীন দৌড়, অন্যদিকে অতিদুর্বোধ্য লেখার অর্থহীন ভীড়। আমার কবিতা এ দু’ধরনের অকাব্যিক প্রবণতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে এবং মাঝামাঝি কোথাও নিজের পথটি খুঁজে পায়। কবিতায় ছন্দ থাকা প্রয়োজন তবে সে ছন্দ নিক্তি মেপে বসানো প্রাণহীন মাত্রা আর পর্বের হিসাব নয়, বরং কবির কানের কাছে শ্রুতিমধুর পদাবলী’।
কামরুল হাসান স্বভাব কবি। তাঁর কাব্যস্বভাবের একটি বৃহৎ অংশে বিস্তৃত রয়েছে রোমান্টিকতা। বাঙালির প্রধান স্বভাব-বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রেম, গূঢ়অর্থেই তিনি আমাদের জীবনাচারের সঠিক জায়গাটিতেই ক্লিক করেছেন। একটা সময় ছিল যখন ব্যাপকহারে কবিরা প্রেমের কবিতা লিখতেন। বাজারে অডিও মিডিয়ার কল্যাণে ট্রেডমার্কধারী কিছু প্রেমের কবিতা লিখিয়েও ছিলেন, যাঁরা শুধু প্রেমের কবিতাই লিখতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষপ্রান্তে এসে অডিও মিডিয়ায় আবৃত্তি শিল্পের ভাটা পড়ার সাথে সাথে এই রোমান্টিকতার বিলুপ্তি হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ এবং যুক্তিসঙ্গত প্রেমের কবিতার কথাই লিখছি। পাঠক লক্ষ করবেন, বিষয়টি কামরুল হাসানের কবিতায় কত গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
কী কাতরতায় মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে মানুষ একাকী
মাইল মাইল কুয়াশা পাড়ি দেয়, অন্ধকারে হাঁটে?
কে কবে বুঝেছে কাকে, তবু কেউ একজন চলে যায় / অযুত যোজন দূরে-
এইপাড় হতে কে একজন ক্ষীণস্বরে তাকে ডেকে আনে / অবোধরে...
কে অবোধ? কার কষ্ট ভারী হলো মাঠের হৃদয়ে?
প্রান্তরের কান্নাসজল মানুষেরা, পৃষ্ঠা-৪৪
‘সময় সবুজ ডাইনী’ রণজিৎ দাশের এই কাব্যমনীষার যথার্থ যৌক্তিকতা আছে। সমকাল কবি-লেখকদের কাছ থেকে উবে যায়। কামরুল হাসানের ক্ষেত্রেও এর বাত্যয় ঘটেনি। তাঁর কাব্যপ্রবণতা দিনে দিনে কতটা গভীর হয়েছে তা আমাদের ব্যাপক পাঠকের সংজ্ঞায় আসেনি। অথচ প্রেমের কবিতা লেখার ট্রেডমার্ক পোয়েট মহাদেব সাহা কী করে বালখিল্যতা করে একটি প্রেমের চিঠিকে ছন্দের প্রয়োজনে ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেন ‘করুণা করেও হলে চিঠি দিও’। অদ্যাবধি কবিতাটি মহাদেব সাহার একটি শীর্ষ প্রেমের কবিতা হিসেবে স্বীকৃত! প্রণম্য পাঠক, খুবই আশ্চর্যের বিষয় তাই না!
বাংলাভাষায় নরেশ গুহ নামে একজন কবি ছিলেন। যিনি মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থের অধিকর্তা ছিলেন। কবি বিনয় মজুমদার, তাঁর একটি প্রবন্ধে পাঠকের উদ্দেশ্যে আর্জি রেখেছিলেন তাঁকে যথার্থ কবি হিসেবে বিবেচনা করার। বাংলা ভাষাভাষিদের একজন বড়মাপের কবি কামরুল হাসানের কাব্যপ্রতিভাকে খাটো করা অর্থে নয় বরং ব্যাপক দৃষ্টিনন্দন উদ্দেশ্যেই লিখছি, কাব্যস্বভাবে কামরুল হাসান অনেক বিস্তৃত এবং পাড়ি দিয়েছেন যোজন অভিজ্ঞতায়। ফলে পাঠকের দরবারে তিনি যতটা প্রজ্ঞাসহ এগিয়ে এসেছেন, পাঠকের উচিত হবে ততোধিক সাদরেই তাঁকে গ্রহণ করা, বাংলা কবিতায়।
পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে \ কামরুল হাসান, প্রকাশক \ নিসর্গ, ফেব্রুয়ারি-২০০৭, প্রচ্ছদ \ অশেষ সাহা, পৃষ্ঠা-৬৪, মূল্য-৫০ টাকা।
No comments:
Post a Comment